তেহরানে তিন দেশের শীর্ষ নেতার বৈঠক হলো। সেখানেই উত্তর সিরিয়ায় সামরিক অভিযানে দুই দেশের সাহায্য চাইলেন এর্দোয়ান।
বিজ্ঞাপন
তিনি যে উত্তর সিরিয়ায় কুর্দিদের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযানের কথা ভাবছেন, শীর্ষ বৈঠকে সেই কথা জানালেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এর্দোয়ান। তিনি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুটিন এবংইরানের প্রেসিডেন্ট রাইসির কাছ থেকে এই বিষয়ে সাহায্য চেয়েছেন। একইসঙ্গে জানিয়ে দিয়েছেন, তুরস্ক একাই ওই সন্ত্রাসবাদীদের মোকাবিলা করার ক্ষমতা রাখে। এর্দোয়ান অবশ্য সম্প্রতি বেশ কয়েক বার এই অভিযানের কথা বলেছেন।
এই তিন নেতার বৈঠকে প্রধান আলোচ্য বিষয় ছিল সিরিয়া। গত কয়েক বছর ধরে তারা এই আলোচনা চালাচ্ছেন। এই প্রয়াসকে বলা হয় আস্তানা শান্তি প্রক্রিয়া।
গত কয়েক মাস ধরে এর্দোয়ান উত্তর সিরিয়ায় সামরিক অভিযানের কথা বলছেন। ইউফ্রেটাস নদীর তীরে তাল রিফাতের মতো কিছু শহর সশস্ত্র কুর্দি গোষ্ঠী পিপলস প্রোটেকশন ইউনিট(ওয়াইপিজি)-র নিয়ন্ত্রণে। এর্দোয়ান ওই শহরগুলি থেকে ওয়াইপিজি-কে সরাতে চান।
কুর্দি কারা, কোথায় থাকে?
কুর্দিশ ইন্সটিটিউট অফ প্যারিসের ২০১৭ সালের হিসেবে বিশ্বে কুর্দিদের আনুমানিক সর্বোচ্চ সংখ্যা সাড়ে চার কোটির বেশি৷ আর্মেনিয়া, ইরাক, ইরান, সিরিয়া ও তুরস্কে বেশিরভাগ কুর্দির বাস৷
ছবি: Reuters/A. Lashkari
কুর্দির সংখ্যা ও ধর্ম
কুর্দিশ ইন্সটিটিউট অফ প্যারিসের ২০১৭ সালের হিসেবে বিশ্বে কুর্দিদের আনুমানিক সর্বোচ্চ সংখ্যা সাড়ে চার কোটির বেশি৷ তাদের বেশিরভাগই সুন্নি মুসলমান৷ বাকিরা শিয়া, অ্যালেভিজম, ইয়াদিজম, ইয়ারসানিজমসহ অন্যান্য ধর্মের অনুসারী৷ কুর্দিদের ভাষা অনেকটা ফার্সির মতো৷
ছবি: AFP/D. Souleiman
স্বাধীনতার প্রায় কাছাকাছি
অটোমান সাম্রাজ্যের শেষ দিকে ১৮৯০ দশকে কুর্দি জাতীয়তাবাদ শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল৷ প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯২০ সালে স্বাক্ষরিত এক চুক্তিতে কুর্দিদের স্বাধীনতা দেয়ার অঙ্গীকার করা হয়েছিল৷ কিন্তু মাত্র তিন বছর পরই সেই চুক্তি ছিড়ে ফেলেন তুর্কি নেতা কামাল আতাতুর্ক৷ এরপর ১৯২৪ সালে অনুমোদন পাওয়া আরেক চুক্তির মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যে সৃষ্টি হওয়া দেশগুলোর মধ্যে কুর্দিদের আবাসস্থল ভাগ হয়ে যায়৷
ছবি: Getty Images/AFP/D. Souleiman
যেখানে থাকে
বর্তমানে বেশিরভাগ কুর্দির বাস আর্মেনিয়া, ইরাক, ইরান, সিরিয়া ও তুরস্কে৷ সেসব দেশে তারা মাঝেমধ্যে স্বশাসনের দাবি তুলে ধরে৷ এছাড়াও বিশ্বের অনেক দেশে কুর্দিরা বাস করেন৷
ছবি: Getty Images/C. Court
সিরিয়া
আরব বসন্ত শুরুর আগে সিরিয়ার জনসংখ্যার ৮-১০ শতাংশ ছিল কুর্দি৷ ইসলামিক স্টেটের বিরুদ্ধে লড়তে তাদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র৷ আর সিরিয়ার সরকার মূলত ব্যস্ত ছিল সুন্নি আরব বিদ্রোহীদের মোকাবিলা করতে৷ ফলে একসময় কুর্দিরা সিরিয়ার প্রায় এক-চতুর্থাংশ এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিতে সক্ষম হয়৷ তবে সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র সিরিয়ার কুর্দি এলাকা থেকে সৈন্য সরিয়ে নেয়ার ঘোষণা দিলে তুরস্ক সেখানে হামলা শুরু করেছে৷
ছবি: Getty Images/AFP/D. Souleiman
তুরস্ক
তুরস্কের মোট জনসংখ্যার ২০ শতাংশ কুর্দি৷ স্বশাসনের দাবিতে ১৯৮৪ সালে সরকারের বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে নেয় কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টি, পিকেকে৷ সেই থেকে সংঘাতে প্রায় ৪০ হাজার জন প্রাণ হারিয়েছেন৷ যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও তুরস্ক পিকেকে-কে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে বিবেচনা করে৷ তুর্কি প্রেসিডেন্ট এর্দোয়ান অবশ্য কুর্দি ভাষা ব্যবহারের উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়েছেন৷
ছবি: Getty Images/AFP/N. Al-Khatib
ইরাক
উত্তরাঞ্চলের তিন রাজ্যে কুর্দিদের বাস৷ মোট জনসংখ্যার প্রায় ১৫-২০ শতাংশ৷ ১৯৮০-র দশকে সাদ্দাম হোসেন কুর্দিদের বিরুদ্ধে রাসায়নিক গ্যাস ব্যবহার করেছিলেন৷ ২০১৪ সালে আইএস ইরাকের একটি অংশ দখল করলে কেন্দ্রীয় সরকার দুর্বল হয়ে পড়ে৷ সেই সুযোগ কির্কুকের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিয়েছিল কুর্দিরা৷ পরে ২০১৭ সালে স্বাধীনতার দাবিতে গণভোটের আয়োজন করে ব্যর্থ হয় তারা৷ উলটো বাগদাদের কাছ থেকে প্রতিশোধের শিকার হয় কুর্দিরা৷
ছবি: picture-alliance/AP/K. Mohammed
ইরান
ইরানের জনসংখ্যার প্রায় ১০ শতাংশ কুর্দি৷ তুরস্কের পিকেকে সংগঠনের অনুসারী ইরানের ‘পার্টি অফ ফ্রি লাইফ অফ কুর্দিস্তান’এর বিরুদ্ধে সামরিক শক্তি নিয়োগ করা হয়েছিল৷ সংগঠনটি ইরানের কুর্দিদের জন্য আরও বেশি সায়ত্ত্বশাসনের দাবি জানিয়েছিল৷ ইরানের কুর্দিরা বৈষম্যের শিকার ও তাদের নেতাদের বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড, এমনকি মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয় বলে মানবাধিকার সংস্থাগুলো অভিযোগ করে থাকে৷
ছবি: IRNA
7 ছবি1 | 7
এর্দোয়ানের দাবি, ওয়াইপিজি হলো সন্ত্রাসবাদী সংগঠন। তারা কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টি(পিকেকে)-র সঙ্গে যুক্ত। ১৯৮৪ সাল থেকে পিকেকে তুরস্কের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। তুরস্কের অভিযোগ, পিকেকে-র সঙ্গে হাত মিলিয়ে ওয়াইপিজি সিরিয়ায় তুরস্কের সেনার উপর হামলা করছে।
বৈঠকে এর্দোয়ান বলেছেন, তিনি তুরস্কের দক্ষিণে সিরিয়ার সীমান্তে ৩০ কিলোমিটার-জুড়ে সেফ জোন তৈরি করতে চান। এর্দোয়ান বলেছেন, ''আপনারা বলছেন, তুরস্কের চিন্তা বুঝতে পারছেন। কিন্তু শুধু এই কথা যথেষ্ট নয়।''
ইরানের প্রতিক্রিয়া
বৈঠকের পর রাইসি বলেছেন, ''আমরা চাই, সিরিয়ার সরকার গোটা দেশের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করুক। ইউফ্রেটাসের পূর্বদিকে অ্যামেরিকানদের উপস্থিত থাকার কোনো কারণই নেই। তাদের অবিলম্বে ওই এলাকা ছেড়ে চলে যেতে হবে।''
সিরিয়া- ভুলো না আমায়!
যুদ্ধ যেন ‘প্রকৃত’ সিরিয়াকে ভুলিয়েই দিচ্ছে৷ যে দেশে সব ধর্মের মানুষ মিলেমিশে থাকতো, যে দেশের সাংস্কৃতিক সমৃদ্ধির নিদর্শন মিলেছে মানবসভ্যতার সূচণালগ্নে- সেই সিরিয়াকে মনে করিয়ে দিতে জার্মানিতে চলছে অন্যরকম এক প্রদর্শনী৷
ছবি: Lutz Jaekel
‘সিরিয়া- বিস্মরণের বিরুদ্ধে’
সিরিয়া যুদ্ধ শুরু হয়েছিল ১১ বছর আগে৷ যুদ্ধের কারণে সিরিয়ার উদার ধর্মীয় এবং সাংস্কৃতিক অতীত আজ প্রায় বিলীন৷ এখন সিরিয়ার কথা বললেই চোখে ভাসে যুদ্ধবিধ্বস্ত এক দেশের ছবি৷ কিন্তু সিরিয়া মানে তো শুধু যুদ্ধ আর হানাহানি নয়৷ সিরিয়ার অতীত খুব উজ্জ্বল এবং আকর্ষণীয়৷ সেই অতীতকে মনে করিয়ে দিতেই জার্মানির কোলন শহরে শুরু হয়েছে দারুণ এক প্রদর্শনী৷ প্রদর্শনীর নাম দেয়া হয়েছে, ‘সিরিয়া- এগেইনস্ট ফরগেটিং’৷
ছবি: Dieter Cöllen
প্রদর্শনীর উদ্দেশ্য
কোলনের রাউটেনট্রাউশ-জোয়েস্ট জাদুঘরে চলমান এই প্রদর্শনীর মূল উদ্দেশ্য- সিরিয়া আসলে কেমন দেশ ছিল আর পশ্চিমা বিশ্ব সে বিষয়ে কত কম জানে তা স্পষ্টভাবে তুলে ধরা৷ প্রদর্শনীর কিউরেটর জব্বার আব্দুল্লাহ বলেন, ‘‘ প্রধান লক্ষ্য যুদ্ধ নিয়েই শুধু কথা না বলা৷ আমরা অন্য এক সিরিয়া দেখাতে চাই এবং জন্মভূমি সম্পর্কে সিরীয়দের মনেও ইতিবাচক স্মৃতিগুলো ফিরিয়ে আনতে চাই৷’’
ছবি: Fadi Elias/In-Haus Media 2022
সিরিয়ায় বিরল সিরিয়ার অতীত!
সিরিয়ার প্রায় সব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যই ধ্বংস করে দিয়েছে তথাকথিত জঙ্গি সংগঠন আইএস৷ ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের স্বীকৃতি পাওয়া অনেক প্রাচীন নিদর্শনই গুঁড়িয়ে দিয়েছে তারা৷ জব্বার আব্দুল্লাহর জন্ম সিরিয়ার প্রাচীন শহর পালমিরায়৷ সেখানে ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের স্বীকৃতি পাওয়া যত স্থাপনা ছিল তার অধিকাংশই শেষ করে দিয়েছে আইএস৷ প্রদর্শনীতে স্থান পাওয়া ছবিগুলো জার্মানির সংগ্রহশালা থেকে ধার করেছেন আয়োজকেরা৷
ছবি: Lutz Jaekel
ধর্মীয় ঐক্য ছিল
এক সময় সিরিয়ায় সব ধর্মের মানুষই খুব শান্তিতে বাস করতো৷ ছবিতে সিরিয়ার ধর্মীয় ঐতিহ্যের ছোট্ট এক নিদর্শন৷
ছবি: Lutz Jaekel
ইহুদিরাও ছিলেন
২০১৪ সালে সিরিয়া থেকে মিশর হয়ে জার্মানিতে চলে আসা জব্বার আব্দুল্লাহ চান সিরিয়ার উদার ধর্মীয় সংস্কৃতির অতীতের কথা সবাইকে জানাতে৷এক সময় ইহুদিদের জন্যও সংখ্যাগুরু মুসলমানদের সঙ্গে শান্তিতে বসবাসের পরিবেশ ছিল সিরিয়ায়৷ কিন্তু এখন মাত্র একটা সিনাগগ আছে সিরিয়ায়৷ ১৯৪৭ সালে ইহুদিদের বিরুদ্ধে ব্যাপক হামলার ঘটনা ঘটে৷ ইহুদিরা তারপর থেকে সিরিয়া ছাড়তে শুরু করেন৷ নব্বই দশকের গোড়ার দিকে অনেক ইহুদিই দেশ ছাড়েন৷
ছবি: Chrystie Sherman
5 ছবি1 | 5
তিন নেতাই জানিয়েছেন, তারা সিরিয়ার সমস্যার সমাধান আলোচনার মাধ্যমে করতে চান। তারা সিরিয়ার দুর্দশাগ্রস্ত লাখ লাখ মানুষকে সাহায্য করতে চান।
পুটিন বলেছেন, ''সিরিয়ার ভবিষ্যৎ সিরীয়রাই ঠিক করবে। বাইরের থেকে কেউ কোনো নির্দেশ দেবে না।''
যৌথ বিবৃতি
এই তিন নেতা একসঙ্গে বৈঠক করেন, তাছাড়া দ্বিপাক্ষিক বৈঠকও হয়েছে। তারপর তিন নেতা যৌথ বিবৃতি জারি করেছেন। সেখানে বলা হয়েছে, সন্ত্রাসবাদের মোকাবিলায় তারা একসঙ্গে কাজ করবেন। কিন্তু সন্ত্রাসবাদের মোকাবিলার নামে সিরিয়ায় নতুন ব্যবস্থা চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা চলছে। সিরিয়ার সার্বভৌমত্বের সঙ্গে আপস করা হবে না। আর সিরিয়ায় যে ত্রাণ দেয়া হচ্ছে, তা নিয়ে কোনোরকম বিভেদ, রাজনীতি করা যাবে না, কোনো পূর্বশর্ত রাখা যাবে না।