মস্কো সফরে গেছেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী৷ কিন্তু সিরিয়ায় রাসায়নিক হামলা ও সে দেশের বিমানঘাঁটির উপর মার্কিন ক্ষেপণাস্ত্র হামলার ফলে দু'পক্ষের মধ্যে উত্তেজনা বেড়ে চলেছে৷ জাতিসংঘ তদন্তের উদ্যোগ নিচ্ছে৷
বিজ্ঞাপন
সিরিয়ায় বিমানঘাঁটির উপর মার্কিন ক্ষেপণাস্ত্র হামলার কারণে রাশিয়া কতটা রুষ্ট হয়েছে, মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেক্স টিলারসনের মস্কো সফরের সময়ে তা স্পষ্ট হয়ে গেল৷ বুধবার রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভের সঙ্গে আলোচনার আগেই পরিবেশ অত্যন্ত থমথমে হয়ে উঠেছে৷ দু'পক্ষের বাকযুদ্ধ নতুন মাত্রা পাচ্ছে৷ ফলে ট্রাম্প প্রশাসন ক্ষমতায় আসার পর রাশিয়ায় মন্ত্রী পর্যায়ের প্রথম সফরের উপর কালো ছায়া পড়ছে৷ ব্যক্তিগত পর্যায়ে রুশ প্রশাসনের সঙ্গে টিলারসনের অতীত উষ্ণ সম্পর্ক সত্ত্বেও রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুটিন এ যাত্রায় তাঁর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করবেন না বলেও শোনা যাচ্ছে৷
সিরিয়ায় রাসায়নিক হামলার জন্য বাশার আল-আসাদ প্রশাসনকে রাশিয়া সাহায্য করেছিল, কিছু মার্কিন কর্মকর্তার মুখ থেকে এমন গুরুতর অভিযোগ শোনা গেছে৷ হোয়াইট হাউসের মুখপাত্র শন স্পাইসার বলেছেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে এমনকি হিটলার-ও রাসায়নিক অস্ত্র প্রয়োগ করেননি৷ তবে সেই তথ্য ভুল হওয়ায় প্রবল সমালোচনার মুখে তাঁকে পিছু হঠতে হয়েছে৷
মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী জেমস মাটিস বলেছেন, এই রাসায়নিক হামলার পেছনে আসাদের ভূমিকা সম্পর্কে তিনি পুরোপুরি নিশ্চিত৷ তিনি বলেন, আসাদ আন্তর্জাতিক আইন অমান্য করে গোপন রাসায়নিক অস্ত্র প্রয়োগ করলে অ্যামেরিকা হাত গুটিয়ে বসে থাকবে না৷
মস্কোর উদ্দেশ্যে রওয়ানা হবার আগে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী টিলারসন বলেন, রাশিয়া আসাদ প্রশাসন, ইরান ও হেজবোল্লাহ গোষ্ঠীর সঙ্গে আঁতাত গড়ে তুলেছে৷ কিন্তু তার ফলে রাশিয়ার দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থের ক্ষতি হবে বলে তিনি ইঙ্গিত করেন৷ তাঁর মতে, এর বদলে অ্যামেরিকা, পশ্চিমা জগত ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলির সঙ্গে মস্কোর সহযোগিতা করা উচিত৷
অন্যদিকে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুটিন অভিযোগ করেছেন, সিরিয়ার বিদ্রোহীরাই রাসায়নিক হামলা চালিয়ে আসাদ প্রশাসনের উপর তার দায় চাপানোর চেষ্টা করছে৷ তিনি জাতিসংঘের উদ্যোগে এই হামলার বিস্তারিত তদন্তের দাবি করেছেন৷ এই প্রসঙ্গে তিনি ২০০৩ সালে ইরাকের উপর মার্কিন হামলার বিষয়টি টেনে আনেন৷ পুটিন বলেন, সেবারও সাদ্দাম হুসেনের হাতে মারণাত্মক অস্ত্রের অজুহাত দিয়ে অ্যামেরিকা আগ্রাসন চালিয়েছিল৷
তুরস্ক জানিয়েছে, রাসায়নিক হামলায় আহতদের রক্ত ও মূত্র পরীক্ষায় নিষিদ্ধ সারিন নার্ভ এজেন্টের চিহ্ন পাওয়া গেছে৷ ফলে আসাদ প্রশাসনের বিরুদ্ধে অভিযোগের তির আরও জোরদার হচ্ছে৷ কারণ চুক্তি অনুযায়ী সিরিয়ার রাসায়নিক অস্ত্রভাণ্ডার পুরোপুরি ধ্বংস করে ফেলার কথা ছিল৷
এদিকে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ বুধবার সিরিয়া সংক্রান্ত একটি প্রস্তাব অনুমোদন করার প্রস্তুতি নিচ্ছে৷ তাতে সিরিয়ার প্রশাসনের উদ্দেশ্যে রাসায়নিক হামলার আন্তর্জাতিক তদন্তে সম্পূর্ণ সহযোগিতার ডাক দেওয়া হবে৷ তবে রাশিয়া এই প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ভেটো প্রয়োগ করবে বলে ধরে নেওয়া হচ্ছে৷
সিরিয়ায় আসলে কারা, কাদের বিরুদ্ধে লড়ছে?
মধ্যপ্রাচ্য এবং উত্তর আফ্রিকার ২০১১ সালের সেই আরব বসন্তের জেরে সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধের সূচনা হয়৷ গত ছয় বছরে সেই সংঘাতের বিস্তৃতি অনেক বেড়েছে, যোগ হয়েছে নতুন মিত্র, মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে পুরনো শত্রুতা৷
আসাদের প্রতি অনুগতরা
সিরিয়ার সেনাবাহিনী, যারা আনুষ্ঠানিকভাবে সিরিয়ান আরব আর্মি (এসএএ) হিসেবে পরিচিত, ২০১১ সালের শরতে তারা বড় এক জটিলতার মধ্যে পড়ে যায়৷ সেনাবাহিনীর একটি অংশ বিদ্রোহ করে আসাদ বিরোধী ‘অ্যান্টি-আসাদ ফ্রি সিরিয়ান আর্মি’ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে৷ তবে এসএএকে ন্যাশনাল ডিফেন্স ফোর্সসহ আসাদপন্থি বিভিন্ন মিলিশিয়া গ্রুপ সমর্থন দিচ্ছে৷
ছবি: picture alliance/dpa/V. Sharifulin
মডারেট দল
আসাদের শাসনের বিরুদ্ধে জনগণের প্রতিবাদ সহিংস রূপ নিলে ‘ফ্রি সিরিয়ান আর্মি’ তৈরির পথ প্রশস্ত হয়৷ জিহাদি নয়, এমন বিভিন্ন বিদ্রোহী গ্রুপের সঙ্গে মিলে তারা আসাদকে ক্ষমতাচ্যুত করতে লড়াই করছে৷ উদ্দেশ্য হচ্ছে, সিরিয়ায় গণতান্ত্রিক পথে সরকার গঠন করা৷ তবে বেশ কয়েকটি লড়াইয়ে হারার পর সেই দলের অনেকে বিভিন্ন সন্ত্রাসী গোষ্ঠীতে চলে যায়৷
ছবি: Reuters
সন্ত্রাসের নতুন রূপ
সিরিয়ায় বিশৃঙ্খলার সুযোগ নিয়ে সে দেশ এবং ইরাকের একটা বড় অংশ দখল করে নিজেদের তথাকথিত খেলাফত প্রতিষ্ঠা করে তথাকথিত জঙ্গি গোষ্ঠী ‘ইসলামিক স্টেট (আইএস)’৷ নিজের কালো পতাকাতলে ইসলামের উগ্রতম রূপ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে অসংখ্য মানুষকে অত্যাচর এবং হত্যা করেছে জঙ্গি গোষ্ঠীটি৷ রাকা শহরে গোষ্ঠীটি শক্ত অবস্থান গড়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
এক পুরনো জিহাদ
তবে আইএসই সিরিয়ায় অবস্থান নেয়া একমাত্র জঙ্গি গোষ্ঠী নয়৷ আল-কায়দার সঙ্গে সম্পৃক্ত আল-নুসরা ফ্রন্টসহ আরো কয়েকটি জঙ্গি গোষ্ঠী সিরিয়ায় লড়ছে৷ আল-নুসরা ফ্রন্ট নিজেদের মধ্যে লড়াই ছাড়াও আসাদ এবং মডারেট বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধেও লড়ছে৷ সম্প্রতি জঙ্গি গোষ্ঠীটি সমমনা আরো কয়েকটি গোষ্ঠীকে নিয়ে জোট গড়েছে৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/Nusra Front on Twitter
আসাদের এক শক্তিশালী মিত্র
প্রেসিডেন্ট আসাদের শক্তিশালী মিত্র ক্রেমলিন৷ সিরিয়ার সেনাবাহিনীকে কয়েকবছর ধরে রসদ সরবরাহের পর ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে আনুষ্ঠানিকভাবে সিরিয়া সংঘাতে যোগ দেয় রাশিয়ার পদাতিক বাহিনী৷ তবে রাশিয়ার বিমান হামলায় অনেক বেসামরিক প্রাণহানির কারণে মাঝেমাঝেই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমালোচনার মুখে পড়ে মস্কো৷
ছবি: picture-alliance/AP/Russian Defense Ministry
অনাগ্রহী পশ্চিম
আসাদের সমালোচনা এবং নীরবে মডারেট বিদ্রোহী গোষ্ঠীকে সমর্থন জানালেও তাদের হয়ে আসাদের বিরুদ্ধে লড়তে পদাতিক বাহিনী পাঠাতে আগ্রহী নয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা অন্য কোনো ন্যাটোভুক্ত দেশ৷ তবে ২০১৪ সালের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে প্রায় ষাটটি দেশের মার্কিন নেতৃত্বাধীন এক জোট সে দেশে ইসলামিক স্টেট এবং অন্যান্য জঙ্গি গোষ্ঠীর আস্তানায় বিমান হামলা চালাচ্ছে৷
ছবি: AFP/Getty Images/John Macdougall
সীমান্তে নিরাপত্তা
সিরিয়ার প্রতিবেশি দেশগুলো নিজেদের সীমান্ত রক্ষার স্বার্থেই এই লড়াইয়ে যোগ দিয়েছে৷ মার্কিন নেতৃত্বাধীন আইএসবিরোধী জোটে থাকা তুরস্কও আসাদবিরোধী জোটকে সহায়তা করছে৷ তবে কুর্দি যোদ্ধাদের মার্কিনিদের সহায়তা নিয়ে সে দেশের সঙ্গে শীতল সম্পর্ক বিরাজ করছে তুরস্কের, কেননা কুর্দরা নিজেদের রাষ্ট্র চায়, যা তুরস্ক সমর্থন করে না৷
ছবি: picture alliance/dpa/S. Suna
প্রক্সি ওয়ার
সিরিয়ার সংঘাতে কার্যত এক প্রক্সি লড়াইও চলছে, যেখানে একদিকে রয়েছে রাশিয়া এবং ইরান, অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তুরস্ক৷ সংশ্লিষ্ট অঞ্চলে ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষায় আসাদকে ক্ষমতায় রাখতে চায় ইরান৷ ফলে রাশিয়ার পাশাপাশি সে দেশও কৌশলগত সহায়তা, সামরিক প্রশিক্ষণ, এবং পদাতিক সেনা দিয়ে দামেস্ককে সহায়তা করছে৷
ছবি: Atta Kenare/AFP/Getty Images
যুদ্ধ থামার কোনো লক্ষণ নেই
ছয় বছর হয়ে গেলেও সিরিয়ায় বহুমুখী লড়াই বন্ধের কোনো সুস্পষ্ট ইঙ্গিত এখনো দেখা যাচ্ছে না৷ জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় তৈরি বিভিন্ন শান্তি চুক্তি করা হলেও তা তেমন একটা সফল হয়নি৷ ফলে প্রতিদিন সে দেশে নানা হামলায় মারা যাচ্ছেন অসংখ্য মানুষ, যাদের মধ্যে শিশু, নারীসহ অনেক বেসামরিক নাগরিকও রয়েছেন৷