সিলটি-লন্ডনি আর প্রবাসীদের ‘পলিটিক্স'
২০ ডিসেম্বর ২০১৯সিলেটকে যে বাংলাদেশের লন্ডন বলা হয়ে থাকে, তা মোটামুটি সবাই জানেন, নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না৷ আবার লন্ডনে এত সিলটির আবাস যে ইংরেজি না জেনেও দিব্যি কিছুদিন কাটিয়ে দেয়া সম্ভব, এমনকি প্রমিত বাংলাও না জানলে চলে৷ বাংলাদেশের নানা অঞ্চলের মানুষই ইংল্যান্ডে থাকলেও রাজধানী লন্ডনে সিলেট থেকে যাওয়া প্রবাসীদের একটা বড় সংখ্যা রয়েছে৷ মূলত পঞ্চাশের দশক থেকে ব্রিটেনে ব্যাপক হারে পাড়ি জমান সিলটিরা৷ এখন বিশেষ করে লন্ডন ও এর আশেপাশে শক্ত ভিত গড়ে নিয়েছেন তারা৷
২০১০ সাল৷ ব্রিটেনে জাতীয় নির্বাচন৷ ব্রিটিশদের সামনে প্রশ্ন, প্রধানমন্ত্রী কে হবেন, কনজারভেটিভ পার্টির ডেভিড ক্যামেরন, নাকি লেবার পার্টির গর্ডন ব্রাউন৷ কিন্তু সেই নির্বাচনি জ্বরে আক্রান্ত হয়ে পড়ল বাংলাদেশের একটি অঞ্চল- সিলেট৷ হবে না-ই বা কেন৷ সিলটিরা তো এতদিনে আর শুধু প্রবাসী হিসেবে খাতায় নাম লিখিয়ে বসে নেই৷ কয়েক প্রজন্ম পর এখন তারা রীতিমতো ব্রিটিশ পলিটিক্সে নাম লিখিয়েছেন, স্বপ্ন দেখাচ্ছেন একদিন যে দেশের উপনিবেশ তারা ছিলেন, সে দেশের সর্বোচ্চ পদে যাওয়ার৷
লন্ডনের বেথনাল গ্রিন অ্যান্ড বো আসনসহ আরো কয়েকটি আসনে সিলটিদের মারাত্মক প্রভাব৷ এই আসন থেকেই ২০১০ সালের নির্বাচনে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে প্রথম বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত সংসদ সদস্য হন সিলটি রুশনারা আলী৷ সবশেষ নির্বাচনসহ টানা চারবার এমপি হয়েছেন তিনি৷
এই রুশনারার আবার জন্ম ও ছোটবেলা কেটেছে সিলেটের বিশ্বনাথে৷ সাত বছর বয়সে বাবা-মায়ের সঙ্গে ইংল্যান্ডে যান তিনি৷ ফলে স্বভাবতই তার আত্মীয়-স্বজন শুভানুধ্যায়ীরা এখনো সিলেটের অনেক স্থানেই রয়েছেন৷
নির্বাচন সামনে রেখে তাই রুশনারা সিলটিদের মন জয় করতে নিজেই চলে আসেন সিলেটে প্রচারণা চালাতে৷ সঙ্গে আসে লেবার পার্টির একটি প্রতিনিধি দল৷ সিলেটের বিশ্বনাথ, গোলাপগঞ্জ, বালাগঞ্জ, ওসমানীনগর এবং মৌলভীবাজার ও সুনামগঞ্জের কয়েকটি উপজেলায় ব্যাপক প্রচারণা চালান তারা৷ প্রতিনিধি দল এসব এলাকায় বেশ কয়েকটি সভা-সমাবেশও করে৷ এর ফলও মেলে, প্রথমবার সিলেটি রুশনারা যান ব্রিটিশ পার্লামেন্টে৷
মজার ব্যাপার হলো, প্রবাসীদের আত্মীয়রা যেমন হাজার মাইল দূরে থেকেও লন্ডনের নির্বাচনে প্রভাব রাখেন, ঠিক এর উলটোটাও ঘটে৷ ২০১৫ সালে সিলেট বিভাগের ১৬টি পৌরসভায় নির্বাচন হয়৷ এর মধ্যে কয়েকটি পৌরসভায় যুক্তরাজ্য প্রবাসীরাও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন৷ এই প্রচারণায় অংশ নিতে ইংল্যান্ডে থেকে অনেক প্রবাসী দেশে ফিরেছেন৷ আবার যুক্তরাজ্যে অবস্থানরত সিলটিদের কাছে প্রার্থীদের স্বজনরা ভোট প্রার্থনা করছেন৷
এবার আসি আসল কথায়৷
বিদেশে থাকা মানেই প্রবাসীরা সবচেয়ে আনন্দে রয়েছেন, সুখে রয়েছেন, এমনটা না-ও হতে পারে৷ এই বিষয়টা আরো বেশি করে বুঝতে পেরেছি যখন নিজেই এই প্রবাসী জীবনের অংশ হয়েছি৷ প্রিয়জনকে ছেড়ে হাজার হাজার মাইল দূরে অচেনা পরিবেশে, অচেনা সমাজে আর্থিক উন্নতি হলেও মানসিক ও সামাজিক যে চাপের মধ্য দিয়ে যেতে হয়, সেটি নিজে এমন পরিস্থিতিতে না পড়লে হয়তো বোঝা সম্ভব নয়৷
ফলে যেখানেই বাংলাদেশের মানুষ, সেখানেই এক ধরনের কমিউনিটি ফিলিং গড়ে ওঠাই স্বাভাবিক৷ আর কে না জানে, বাঙালি কতটা রাজনীতির পোকা৷ এ কারণেই পৃথিবীর অপর প্রান্তে বসেও দেশে ঘটতে থাকা নানা বিষয় নিয়ে শুধু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম নয়, রাজপথেও সরব হতে দেখা যায় প্রবাসীদের৷
এ নিয়ে অনেক ধরনের মত রয়েছে৷ কেউ মনে করেন, যারা দেশে না থেকে ‘আরামে' বিদেশ বসে আছেন, তাদের আবার দেশ নিয়ে মত দেয়া কেন? অন্যপক্ষ এমন মনোভাবের তীব্র বিরোধী৷ তারা মনে করেন, রেমিটেন্স পাঠিয়ে দেশের অর্থনীতি সচল রাখায় তাদের ভূমিকাও অনেক৷
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় প্রতিটি নাগরিকই রাজনীতির অংশ৷ জিনিসপত্রের দাম থেকে শুরু করে রাষ্ট্রনীতি প্রবাসীদেরও সমানভাবে প্রভাবিত করে৷ ফলে প্রতিটি নাগরিকের মত দেয়ার অধিকার রয়েছে এবং সে মত গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনাও করতে হবে৷ বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশনের বিধি অনুযায়ী কোনো রাজনৈতিক দলের বিদেশে শাখা থাকতে পারবে না৷ জার্মানিসহ প্রায় প্রতিটি দেশেই অন্য কোনো দেশের রাজনৈতিক দলের হয়ে কর্মকাণ্ড চালানোর ব্যাপারেও নিষেধাজ্ঞা রয়েছে৷ কিন্তু এটা কেবলই কাগজে কলমে৷
বিদেশে দেশের রাজনীতি থেমে নেই৷ বড় রাজনৈতিক দলগুলোর প্রায় প্রতিটিরই ইউরোপ-অ্যামেরিকার বিভিন্ন দেশে শাখা রয়েছে, সেখানে কমিটি হয়, কমিটি গঠন নিয়ে তুলকালাম হয়৷ দলগুলোর কর্তাব্যক্তিরা সেটা দেখেও দেখেন না৷ ফলে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি না থাকলেও তলে তলে নানা ‘সুবিধার' আদানপ্রদানে কোনো পক্ষেরই কোনো সমস্যা হয় না৷
কিন্তু যে ব্যাপক সংখ্যক রাজনীতিসচেতন প্রবাসী সরাসরি কোনো রাজনৈতিক দলের অংশ না হয়েও তাদের মত প্রকাশ করতে চান, তাদের সুযোগ একেবারেই অল্প৷ গত জাতীয় নির্বাচনে ডাকযোগে ভোট দেয়ার একটি সুযোগ প্রবাসীদের জন্য রাখা হলেও এ নিয়ে প্রচার-প্রচারণা এতটাই কম ছিল, প্রক্রিয়া এত জটিল ছিল যে বলতে গেলে কেউই আর তাতে আগ্রহী হয়ে ওঠেননি৷
যে দেশে প্রবাসীরা থাকেন, সেখানে দেশের হয়ে সামাজিক-অর্থনৈতিক, এমনকি কূটনৈতিক ক্ষেত্রেও প্রবল ভূমিকা রাখতে পারেন প্রবাসীরা৷ বিভিন্ন দেশে এখন গণতন্ত্রের মোড়কে ফ্যাসিবাদের উত্থানের শঙ্কা দেখা দিয়েছে৷ মুক্তবুদ্ধির মানুষেরা যেখানে সীমানা ভুলে বিশ্বনাগরিক হতে চাইছেন, এরা তখন নিজের দেশের নাগরিকদেরই কোণঠাসা করে ফেলছেন৷
মানুষ যখন বিশ্বসৃষ্টির রহস্য অনুসন্ধানে মহাকাশের অন্যপ্রান্তে, তখন কৃত্রিম সীমানার বেড়াজালে ভাষা, সংস্কৃতি, অর্থনীতি, রাজনীতিকে আটকে রাখার চিন্তা বোকামি৷ প্রবাসীদের শুধু ‘রেমিটেন্স পাঠানোর মেশিন' না ভেবে তাদের রাজনীতি ও মত প্রকাশের অধিকার রক্ষা করার দায়িত্বও রাষ্ট্রেরই৷
প্রিয় পাঠক, আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷