শুরুটা হয়েছিল এপ্রিলে৷ বৈশাখের তীব্র দাবদাহে দেশ যখন পুড়ছিল, সিলেটের নিম্নাঞ্চলে ধেয়ে আসে অসময়ের বন্যা৷ তারপর মে মাসের মাঝামাঝিতে এসে আবারও পরিস্থিতি অবনতি হতে থাকে৷ যা গত দেড় যুগে সিলেটের ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ বন্যা৷
বিজ্ঞাপন
দিন দশেকের মধ্যে পরিস্থিতি অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে আসে৷ নামতে শুরু করে পানি৷ তার রেশ না কাটতেই ১০ জুন থেকে শুরু হয় বৃষ্টি৷ পাঁচ দিনের টানা বর্ষণে ১৫ জুন থেকে চলতি মৌসুমে তৃতীয় দফায় বন্যার মুখে পড়ে সিলেট অঞ্চলের মানুষ৷
ধেয়ে আসা পাহাড়ি ঢলে শুরু হয় সিলেটের ইতিহাসে ‘স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যা'৷ ঢলের সঙ্গে টানা বৃষ্টিতে পানিবন্দি হয়ে পড়েন লাখো মানুষ৷ তৃতীয় দফার প্রথম দিনে ভয়াবহতা বুঝতে কিছুটা দেরি হয়ে যায়৷ কারণ ছিল, বর্ষা মৌসুমে টানা বৃষ্টিতে সিলেট বিভাগের নিম্নাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হয়৷ যা দ্রুতই নিয়ন্ত্রণে চলে আসে৷
কিন্তু ১৬ জুন থেকে বোঝা যায় বন্যার ভয়াবহ রূপ৷ গণমাধ্যমকর্মীরাও ছুটে যান উপদ্রুত এলাকায়৷ পানিবন্দি মানুষের দুর্দশার চিত্র যেমন তুলে ধরা হচ্ছে, তেমনি উঠে আসছে দুর্গত জনপদের দুর্দশার চিত্র৷ বার্তাকক্ষেও ছিল না অবসর৷ খবর আসে, হু হু করে বাড়ছে প্লাবিত এলাকার সংখ্যা৷
স্থানীয় প্রতিনিধির সঙ্গে কেন্দ্রীয় অফিস অর্থাৎ ঢাকা থেকেও পাঠানো হয় রিপোর্টারদের৷ প্রতিকূল আবহাওয়া, বৃষ্টিপাতের মধ্যেও টেলিভিশন চ্যানেলগুলো প্রতি ঘণ্টায় ঘণ্টায় সবশেষ খবর জানাতে ব্যস্ত ছিল সরাসরি সম্প্রচারে৷
তথ্যপ্রযুক্তির সময়ে দেশে অনলাইন পোর্টালের সংখ্যা যেমন বেড়েছে, তেমনি মূলধারার প্রায় প্রতিটি সংবাদমাধ্যমে যোগ হয়েছে অনলাইন সংস্করণ৷ ফলে বন্যা পরিস্থিতি ও বন্যার্তদের খবর গুরুত্বসহকারে ওঠে আসে দেশের গণমাধ্যমে৷ টেক্সট রিপোর্টিংয়ের সঙ্গে অনলাইনের সাংবাদিকেরাও সরাসরি সম্প্রচারে যোগ দিয়ে দর্শকদের জানান সবশেষ পরিস্থিতি৷
বার্তাকক্ষ থেকে মাঠের রিপোর্টারদের দেয়া হয় নানা নির্দেশনা, মাঠের বাস্তবতার সঙ্গে বার্তা সংশ্লিষ্টদের অভিজ্ঞতার মিশেলে দেয়া হয় ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিকের প্রতিবেদন পরিকল্পনা৷
চলমান বন্যার মধ্যে প্রতিদিন ঢাকা থেকে আবহাওয়ার পূর্বাভাস, বন্যা সতর্কীকরণ কেন্দ্রের তথ্য নিয়ে মানুষকে করা হচ্ছে সচেতন৷ সচিবালয়ের প্রতিবেদকেরাও রাখছেন ত্রাণ নিয়ে সরকারের ব্যবস্থাপনার খোঁজখবর৷
দিন গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে পরিস্থিতির অবনতি হতে থাকে৷ বন্যার পানিতে বন্ধ হয়ে যায় সিলেটের সঙ্গে দেশের রেল যোগাযোগ৷ বানের জল ঠেকাতে না পেরে বন্ধ রাখা হয় বিমানবন্দর৷ ‘মরার ওপর খাড়ার ঘা’ যাতে না হয়, সেজন্য বিচ্ছিন্ন করা হয় বিদ্যুৎসংযোগ৷ যদিও সময়ের ব্যবধানে পানি নামতে শুরু করেছে৷ সচল হচ্ছে সবকিছু৷
বানের জল ঠেলে মূলধারার গণমাধ্যম ঠিকই ছুটে গেছে৷ শত প্রতিকূলতা মোকাবিলা করে তুলে ধরছে বন্যার্তদের হাহাকার৷ কোথায় ত্রাণ পৌঁছেছে, কোথায় পৌঁছেনি সেই খবরগুলোও কিন্তু জানিয়েছে গণমাধ্যম৷ সরকারও পেয়েছে তথ্য, নেয়া হচ্ছে ব্যবস্থা৷
বাংলাদেশের বন্যায় প্রকৃতি ও অপরিকল্পিত অবকাঠামোর দায়
বন্যা বাংলাদেশে নতুন কিছু নয়৷ প্রতিবছর দেশের প্রায় ২৬,০০০ বর্গ কিমি বা ১৮ শতাংশ ভূখন্ড প্লাবিত হয়৷ তবে সাম্প্রতিক সময়ের বন্যায় অবকাঠামোগত উন্নয়ন নিয়ে নতুন কিছু প্রশ্ন সামনে এনেছে৷
ছবি: Getty Images/AFP/D. Dutta
সাত বছরে একবার
বাংলাপিডিয়ার তথ্য অনুযায়ী, প্রতি শতাব্দীতে বঙ্গীয় বদ্বীপ প্রায় অর্ধডজন বন্যার মুখে পড়েছে, যেগুলো ব্যাপকতায় ১৯৮৮ সালের প্রলয়ঙ্করী বন্যার প্রায় সমান৷ ১৮৭০ থেকে ১৯২২ সাল পর্যন্ত মাঝারি আকারের বন্যা গড়ে প্রতি দুই বছরে একবার এবং ভয়াবহ বন্যা গড়ে ছয়-সাত বছরে একবার সংঘটিত হয়েছে৷ ১৯২৭ সালে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রতি সাত বছরে একবার ব্যাপক বন্যা আর ৩৩-৫০ বছরে একবার মহাপ্রলয়ংকরী বন্যা হয়৷
ছবি: picture-alliance/NurPhoto/R. Asad
ভয়াবহ যত বন্যা
১৯৬৮ সালে সিলেট অঞ্চলের বন্যায় সাত লাখ লোক ক্ষতিগ্রস্ত হন৷ ১৯৮৭ সালে সারা দেশের ৪০ শতাংশের বেশি এলাকা প্লাবিত হয়৷ ১৫ থেকে ২০ দিন স্থায়ী হলেও ১৯৮৮ সালের বন্যা গত শতকের অন্যতম ভয়াবহ, যাতে ৬০ শতাংশ এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত ও ব্যাপক প্রাণহানি হয়৷ এছাড়া ১৯৯৮ সালে দেশের দুই-তৃতীয়াংশের বেশি দুই মাসের বেশি বন্যা কবলিত থাকে, যা ১৯৮৮ সালের বন্যার সঙ্গে তুলনীয়৷ ২০০০, ২০০৭ ও ২০১৭ সালেও ভয়াবহ বন্যায় পড়ে বাংলাদেশ৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
প্রাকৃতিক, নাকি মানবসৃষ্ট?
বন্যার যেসব কারণের কথা বলা হয় তার মধ্যে রয়েছে: ভারি বৃষ্টিপাত, হিমালয়ের তুষার গলা, পলিতে নদীর তলদেশ ভরাট/দখল বা ভূমিধ্বস, প্রধান নদীগুলোর পানি বৃদ্ধি, প্রকৃতির উপর মানবীয় হস্তক্ষেপ, সমুদ্রপৃষ্ঠের পরিবর্তন, ভূমিকম্পসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক পরিবর্তন ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব৷
ছবি: Getty Images/AFP/D. Dutta
'উন্নয়ন': নতুন সংকট
সাম্প্রতিক সময়ে বন্যার জন্য অপরিকল্পিত অবকাঠামো নির্মাণকেও দায়ী করে আসছেন বিশেষজ্ঞরা৷ বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)-র চলতি মাসের সংবাদ সম্মেলন অনুযায়ী, মেঘনা অববাহিকায় ১৬টি আন্তঃদেশীয় নদী আছে৷ ভারত ইচ্ছেমতো সেখানে বাঁধ দিয়ে নদীর স্বাভাবিক প্রবাহে বাধা দিচ্ছে৷ উন্নয়নের নামে সিলেটের হাওর অঞ্চল ভরাট, রাস্তা, বাঁধ তৈরি করে পানির প্রবাহে বাধা দেয়াকেও চলতি বন্যার কারণ হিসেবে অভিহিত করেছে তারা৷
ছবি: picture-allaince/NurPhoto/R. Asad
ব্যবস্থাপনায় গলদ
বাংলাদেশে বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও নির্গমন প্রকল্প মূলত বাঁধ, পোল্ডারের মতো অবকাঠামো নির্ভর৷ কাঠামোগত পদ্ধতির ওপর নির্ভরশীলতা, সেই সঙ্গে সড়ক, মহাসড়ক ও রেলপথের মতো অন্যান্য স্থাপনাসমূহ পানির প্রবাহে বাধা সৃষ্টি করে৷ এর প্রভাবে অনেক ক্ষেত্রে দেশে বন্যা পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়। বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও নির্গমন প্রকল্পসমূহে প্রচুর বিনিয়োগ সত্ত্বেও এ ক্ষেত্রে ফলাফল সন্তোষজনক নয় বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা৷
ছবি: Samir Kumar Dey/DW
প্রতিরোধ পরিকল্পনা
১৯৮৯ সালে বন্যা প্রতিরোধ পরিকল্পনা প্রণয়ন করে সরকার৷ কাঠামোগত প্রতিরোধ কার্যক্রম এবং বন্যা প্রতিরোধের লক্ষ্যে ১১টি নির্দেশনামূলক নীতি প্রণয়ন করা হয়৷ এর অংশ হিসেবে বর্তমানে প্রতিবছর এক লাখ ৩০ হাজার হেক্টর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ নির্মাণের কৌশল অনুসরণ করছে সরকার৷ মুনাফা ও নিরাপত্তার দিক থেকে উপকারিতা থাকলেও দীর্ঘমেয়াদে এর পরিবেশগত প্রভাব যথাযথভাবে মূল্যায়ন করা হয়নি বলে অভিযোগ বিশেষজ্ঞদের৷
ছবি: Mahmud Hossain Opu/AP/picture alliance
যা প্রয়োজন...
কাঠামোগত পদক্ষেপের বাইরে বিকল্প কৌশল হিসেবে অ-কাঠামোগত পদক্ষেপগুলোকেও গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনার কথা বলছেন বিশেষজ্ঞরা৷ এর মধ্যে আছে নদ-নদীর উপচে পড়া পানি হ্রাসের জন্য ভূমি ব্যবস্থাপনা, ভূমি ব্যবহার পরিবর্তন এবং বিল্ডিং কোডের যথাযথ প্রয়োগসহ শস্যের বহুমুখীকরণ৷ আর সবশেষ প্লাবনভূমিগুলোকে বিভিন্ন অঞ্চলে ভাগ করা এবং উন্নয়ন কর্মকাণ্ডকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য ভূমি ব্যবহার জোন তৈরি করা৷
ছবি: picture-alliance/NurPhoto/R. Asad
7 ছবি1 | 7
কিন্তু নেটিজেনদের ধারণা বাংলাদেশের গণমাধ্যম এখন সরকারের প্রচারযন্ত্র৷ অনেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে বিশেষ করে ফেসবুককে এখন ভাবতে শুরু করেছে বিকল্প গণমাধ্যম হিসেবে৷
দেশের ‘সক্ষমতার প্রতীক’ মর্যাদা পাওয়া পদ্মা সেতুর উদ্বোধন আয়োজনকে বেশি প্রাধান্য দিতে গিয়ে বন্যা সম্পর্কিত সংবাদকে উপেক্ষা করা হচ্ছে বলে দাবি ওঠে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে৷ এসব দাবির সঙ্গে অনেক নেটিজেনদের সমর্থন জোগাতে দেখা যায়৷ কিন্তু বাস্তবতা কি তাই?
বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র বলছে, ভারতের মেঘালয়ের চেরাপুঞ্জিতে তিন দিনে (১৫ থেকে ১৭ জুন) যে বৃষ্টিপাত হয়েছে তার পরিমাণ দুই হাজার ৪৫৮ মিলিমিটার৷ যা সিলেটের সুরমা নদী হয়ে প্রবাহিত হচ্ছে৷ পুরো বাংলাদেশে এক বছরে গড় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ২ হাজার ৩০০ মিলিমিটার৷
ফলে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশের বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাতের পরিমাণকে ছাড়িয়ে গেছে চেরাপুঞ্জির তিন দিনের বৃষ্টি৷ পাহাড় গড়িয়ে ভারত থেকে ঢল আকারে নেমে আসা এই বিপুল পরিমাণ বৃষ্টির পানি এবারের বন্যার মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে রাষ্ট্রীয় সংস্থাটি৷
ভারতের আবহাওয়া অফিস বলছে, ১২২ বছরের মধ্যে দেশটির ওই অঞ্চলে সর্বাধিক বৃষ্টিপাত রেকর্ড করেছে তারা৷ ঢল এসে সীমান্তবর্তী মানুষকে বাস্তুহারা করে বানের পানি প্লাবিত করেছে সিলেটের ৮০ শতাংশ আর সুনামগঞ্জের ৯০ শতাংশ এলাকা৷ পানি নামতে শুরু করলেও, বুধবার রাত পর্যন্ত এই ছিল তথ্য৷
কিন্তু ফেসবুকে ছড়ানো হলো, সিলেটে বন্যার নেপথ্যে ভারত৷ দাবি করা হয় তিস্তার বাঁধের লকগেট খুলে দেয়ায় এই পরিস্থিতি হলো৷ অথচ কোথায় উত্তরবঙ্গ আর কোথায় সিলেট, সেই হিসাবটা কষে না দেখে ওই খবরে আস্থা রাখেন অনেক ফেসবুক ব্যবহারকারী৷
কিশোরগঞ্জের হাওরে ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম সড়কটিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আক্রমণের শিকার হয়৷ ব্যবহারকারীদের একাংশের দাবি, এ সড়কটির কারণেই বন্যার পানি নেমে যেতে পারছে না৷
এমনকি বৈশাখে সুনামগঞ্জে অকাল বন্যায়ও এই সড়কটি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক আলোচনা তৈরি হয়েছিল৷ তবে সে সময় সড়কের ১০ কিলোমিটারের আশপাশেও পানি ছিল না৷
এবারও দেখা গেছে, কিশোরগঞ্জে ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম হাওরে অল ওয়েদার সড়কের দুই পাশের পানির উচ্চতায় কোনো পার্থক্য নেই৷ সেখানকার পানিতে স্রোতও নেই৷ তবে অন্যান্য বছরের সঙ্গে তুলনা করলে, এই সময়ে পানি কিছুটা বেশি রয়েছে৷
এই বন্যায় দুর্গত মানুষের সহযোগিতায় যখন মূলধারার গণমাধ্যম যখন ছুটে বেড়াচ্ছে উপদ্রুত এলাকায়, তখন অনেকের দৃষ্টিতে ‘বিকল্প গণমাধ্যম ফেসবুক' জুড়ে গুজবের ছড়াছড়ি৷ এমন সব তথ্য সেখানে হাজির করা হচ্ছে, যার কোনো ভিত্তি নেই৷
চলমান এই বন্যার সংবাদ পরিবেশন করতে গিয়ে গণমাধ্যমকে পড়তে হয়েছে অন্য ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে৷ গুজব খণ্ডন বা ফ্যাক্টচেকও চালিয়ে যেতে হচ্ছে গণমাধ্যমকর্মীদের৷
ফেসবুকে বন্যার্তদের সংকট তুলে ধরতে নানা মানুষ নানা ছবি পোস্ট করেছেন, শেয়ার করেছেন৷ একটি ছবিতে দেখা যায় পানিতে প্রায় ডুবে যাওয়া এক শিশু মাথায় গামলা নিয়ে কোনোমতে একটি কুকুরছানাকে নিরাপদ আশ্রয়ের দিকে নিয়ে যাচ্ছে৷
কুকরছানা মাথায় নিয়ে পানি ঠেলে চলা শিশুটির ছবিটি কোথায় তোলা- সেটির অনুসন্ধান করতে গিয়ে সার্চ ইঞ্জিন ইয়াহুর আলোকচিত্র ব্লগ ‘ফ্লিকার'-এ তথ্য পাওয়া গেছে৷ ফ্লিকারে এই ছবিটি আপলোড করা হয় ২০০৯ সালের ২৮ নভেম্বর৷ এর বিবরণে লেখা হয়েছে ভিয়েতনামের বাক লিউ রাজ্যের পরিবেশগত পরিস্থিতি৷
এবার আসা যাক একটি ভিডিওচিত্রের গল্পে৷ দেখা যায়, বিস্তৃত জলরাশির মাঝে ভাসছে একটি নৌকা৷ নেই কোনো মাঝি৷ নৌকার আরোহী বলতে দুটো বানরছানা৷ দুটির একটিকে আক্রমণ করছে পানিতে ভেসে আসা দুটি কুকুর৷ কুকুরের আক্রমণ থেকে ছানাকে রক্ষার জন্য প্রাণান্ত লড়াই করছে সঙ্গী বানর৷
সিলেট আর সুনামগঞ্জে ভয়াবহ বন্যার মাঝে এমন একটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে৷ যা দেখে আঁতকে উঠছেন সবাই৷
নেটিজেনদের অনেকে আক্ষেপ করে বলছেন, বন্যায় মানুষের জীবনের সঙ্গে সঙ্গে পশুপাখির জীবনেও নেমে এসেছে বিপর্যয়৷ কেউ কেউ এই ভিডিওটি না করে বরং বানর দুটিকে বাঁচানোর চেষ্টার ওপর জোর দিচ্ছেন৷
ভিডিওটির উৎস খুঁজতে গিয়ে দেখা গেল, পুরো দৃশ্যায়নটি অভিনয়ের অংশ৷ যে দুটি বানর এই অভিনয়ে অংশ নিয়েছে ওদের নাম ‘লোরা’ এবং ‘কাকা’৷ আর ‘অভিনয়শিল্পী’ হিসেবে ভিডিওতে অংশ নেয়া মোটাতাজা কুকুর দুটির নাম ‘লাকি’ ও ‘লুকাস’৷
ক্যাম্বোডিয়ান এক বানরপ্রেমী নারী ‘মাঙ্কি ড্রিম’ নামে একটি ফেসবুক পেজে ভিডিওটি পোস্ট করেন ২০২১ সালের ৩ মে৷
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, সারা দেশে বন্যায় ১৭ মে থেকে বুধবার দুপুর পর্যন্ত মারা গেছে ৪২ জন৷ দুর্গত এলাকায় বন্যাসৃষ্ট দুর্ঘটনা এবং বিভিন্ন রোগে তাদের মৃত্যু হয়েছে বলেও জানিয়েছে অধিদপ্তর৷ এদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ২১ জনের মৃত্যু হয়েছে সিলেট বিভাগে৷
বন্যার ভয়াবহতা দেখতে ছুটে গেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা৷ মঙ্গলবার সকালে হেলিকপ্টার যোগে লো ফ্লাইং মোডে নেত্রকোণা, সুনামগঞ্জ ও সিলেটের বিভিন্ন এলাকা দেখে সিলেটে অবতরণ করেন তিনি৷ সেখানে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, আওয়ামী লীগের নেতা ও মাঠপ্রশাসনের কর্মকর্তাদের দিক নির্দেশনা দিয়েছেন৷
আগামী দু-তিন মাসের মধ্যে দেশের মধ্যাঞ্চল থেকে শুরু করে দক্ষিণাঞ্চলও বন্যায় আক্রান্ত হতে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করে সবাইকে সতর্ক করেছেন প্রধানমন্ত্রী৷ বলেছেন, সরকারের সব ধরনের প্রস্তুতি আছে, তাই দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই৷
প্রধানমন্ত্রীর সফর নিয়েও ফেসবুকে গুজব ছড়িয়েছে৷ বলা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রীর সফরের কারণে সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়কে যান চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়েছে৷ তাই ত্রাণ কার্যক্রম বন্ধ ছিল৷ অনেকে দাবি তুললেন, সড়ক বন্ধ থাকায় খাবার নষ্ট হয়েছে লাখ লাখ মানুষ অভুক্ত থেকেছে৷
অথচ এর কোনো সত্যতা মেলেনি৷ প্রশাসনের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়কে যান চলাচল বন্ধ করা হয়নি৷ প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তার স্বার্থে তার আসা-যাওয়ার সময়ে নগরের কিছু এলাকায় যান চলাচল বন্ধ ছিল৷
সবক্ষেত্রেই যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ভুল তথ্য পরিবেশন করছে তা নয়৷ অনেক প্রত্যন্ত এলাকার খবরের প্রাথমিক সোর্স হিসেবেও ভূমিকা আছে ফেসবুক৷ কিন্তু এবার বন্যায় ঢালাওভাবে যে অভিযোগের তীর মূলধারার গণ্যমাধ্যমের দিকে ছোঁড়া হয়েছে, সেটি একেবারেই ভ্রান্ত৷
বানভাসি মানুষের দুর্দশার খবর সংগ্রহের সঙ্গে গণমাধ্যমকর্মীদের লড়াই করতে হচ্ছে গুজবের বিরুদ্ধে৷ বাংলাদেশে বেশিরভাগ গুজবই এখন ফেসবুকের মাধ্যমে ছড়ানো হচ্ছে৷ অনেক ব্যবহারকারীরা সেসব তথ্য যাচাই না করেই রাখছে বিশ্বাস৷ ফলে গুজব ভাইরাল হতে সময়ও লাগছে না৷ তাই গণমাধ্যমকর্মীদের পড়তে হচ্ছে নতুন চ্যালেঞ্জের মুখে৷ বস্তুনিষ্ঠতা বজায় রাখার দায়িত্বটা যেমন কাঁধে আছে, তার সঙ্গে প্রতিহত করতে হচ্ছে গুজবকে৷
বন্যায় বিপর্যস্ত সুনামগঞ্জ
সুনামগঞ্জে শতাব্দীর ভয়াবহ বন্যার কারণে পানিবন্দি হয়ে পড়েছে কয়েক লাখ মানুষ। অতিবৃষ্টি এবং ভারতের চেরাপুঞ্জির পার্শ্ববর্তী অঞ্চল হওয়ার কারণে সুনামগঞ্জসহ আশেপাশের অঞ্চলগুলোর বন্যা পরিস্থিতি চরম আকার ধারণ করেছে।
ছবি: Mortaza Rashed/DW
ত্রাণের জন্য আশ্রয়কেন্দ্রের সামনে অপেক্ষা
সুনামগঞ্জ সদরের সরকারী জুবিলী উচ্চ বিদ্যালয়ের নৌবাহিনীর অস্থায়ী ক্যাম্পের সামনে সারাদিনই ভিড় করতে দেখা যায় বন্যাদুর্গত মানুষদের। নবীনগর থেকে ৪ দিন আগে আসা শেফালী হালদার জানান, বন্যার কারণে তাঁরা ঘর-বাড়ি ছেড়ে শহরে আশ্রয় নিয়েছেন। এখানে ত্রাণ দেওয়া হচ্ছে লোকমুখে এমন কথা শুনে আসলেও এখানকার কর্মকর্তারা বলছেন এখানে কোনো ত্রাণ দেওয়া হয় না।
ছবি: Mortaza Rashed/DW
‘অবলা প্রাণী কিছু কইতে পারছে না’
সুনামগঞ্জের বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার ফতেপুর ইউনিয়নের তাহের আলী বলেন, ‘‘আমরার সবার বাড়িত অই গবাদিপশু আছে। বন্যাত আমরা তেমন খাইতে পারছি না, পানি খায়া থাকোন লাগসে। কিন্তু গবাদি পশু তো অবলা প্রাণী, কিছু কইতে পারছে না, অগো খাইতেও দিতে পারছি না, তাইনেরে নিয়া বিরাট বিপদও আছলাম।’’
ছবি: Mortaza Rashed/DW
শুধু বাসার ছাদ দেখা গেছে
সুনামগঞ্জ জেলার জামালগঞ্জ উপজেলার বালিঝুড়ি গ্রামের রেণোদা বিশ্বাস জানান, বন্যা শুরু হলে রাতেই ঘরে পানি ঢুকে যায়। ভয়ে পরিবার নিয়ে কোনোমতে বাড়ি ছেড়ে নিকটবর্তী আশ্রয়কেন্দ্রে যান তাঁরা। একদিন পর নৌকায় করে বাড়ি দেখতে এসে দেখতে পান, শুধু বাড়ির ছাদ দেখা যাচ্ছে, বাকি অংশ পানির নীচে।
ছবি: Mortaza Rashed/DW
সব ধরনের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ছিল
সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার আনোয়ারপুর গ্রামের সেলিম মিয়া জানান, বন্যার শুরুর পরপরই বিদ্যুৎ ও মোবাইলের নেটওয়ার্ক চলে যাওয়ায় যেসকল আত্মীয়স্বজন শহরে কিংবা পাশের গ্রামেই থাকেন, তাদের কারো সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। এই দুর্যোগে কে কেমন আছে এ নিয়ে সবাই খুবই চিন্তিত ছিল।
ছবি: Mortaza Rashed/DW
বসতবাড়ি ভেঙে গেছে
সুনামগঞ্জের শনির হাওরের সাব্বির আহমেদ ও মো. আকাশ জানান, বন্যার স্রোতে তাদের টিনের বাসা পুরোপুরি ভেঙে গেছে। সেটি নতুনভাবে বানানো ছাড়া উপায় নেই আর। তাদের গ্রামের অনেকের বাসাবাড়ির চিহ্নটুকুও নেই।
ছবি: Mortaza Rashed/DW
ফসলের জমিতে ১০ ফুট পানি
সুনামগঞ্জ জেলার বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার অনন্তপুর গ্রামের সগির আলী জানান, তাঁর বসতবাড়ির সামনে যতদূর দেখা যায়, ফসলি জমি ছিল। অন্যান্য বছর জাদুকাটা নদী ও পার্শ্ববর্তী হাওরের পানি বাড়লেও এবছরের বন্যায় ফসলি জমি তলিয়ে গেছে কমপক্ষে ১০ ফুট পানির নীচে।
ছবি: Mortaza Rashed/DW
আবার ফেরত যাচ্ছেন আশ্রয়কেন্দ্রে
সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার বারোংকা গ্রামের হযরত আলী জানান, একটি ট্রলার ভাড়া করে আশ্রয়কেন্দ্রে থেকে বাড়িতে ফেরত গিয়েছিলেন। গিয়ে দেখেন সেখানে এখনো কোমর সমান পানি। অনেকের বাড়ির পানি নামলেও তার বাসারটা এখনো না নামায় আবার আশ্রয়কেন্দ্রে ফেরত যাচ্ছেন তারা।
ছবি: Mortaza Rashed/DW
বসতবাড়ি ডুবে যাওয়ায় সড়কে আশ্রয়
সিলেট-সুনামগঞ্জ সংযোগ সড়কের মদনপুর নামক স্থানে দেখা যায়, সেখানে কিছুদূর পরপর রাস্তায় পলিথিন দিয়ে অস্থায়ী তাঁবু বানিয়ে অবস্থান করছেন শতশত পরিবার। স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা যায়, এরা সবাই বন্যাদুর্গত এলাকা থেকে এসেছেন এবং এখানে খুবই মানবেতর জীবনযাপন করছেন।
ছবি: Mortaza Rashed/DW
ত্রাণ পর্যাপ্ত না
ত্রাণ কার্যক্রমে অংশ নেওয়া একটি বেসরকারি দাতব্য সংস্থার নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন স্বেচ্ছাসেবক বলেন, ‘‘আমরা সুনামগঞ্জে বন্যার শুরু থেকেই ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনা করছি। প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ টাকার ত্রাণ দিচ্ছি, কিন্তু তবু দিয়ে শেষ করতে পারছি না। আসলে এত মানুষের চাহিদা মেটানো খুবই কঠিন, কোনো উদ্যোগই যথেষ্ট না।’’
ছবি: Mortaza Rashed/DW
‘সাত-আট দিনে শুধু আজকে ত্রাণ পেলাম’
বন্যায় সুনামগঞ্জ জেলার অন্যতম ক্ষতিগ্রস্ত উপজেলা তাহিরপুরের নয়ানগর গ্রামের পরীবানু জানান, সকালে একটা দল এসে কিছু শুকনো খাবার দিয়ে গেছে, আর এখন রান্না করা খাবার পেলেন তারা। শহর থেকে প্রত্যন্ত অঞ্চল হওয়ায় তাদের এদিকে এর আগে ত্রাণ দিতে কেউ আসেননি।
ছবি: Mortaza Rashed/DW
দূরদুরান্ত থেকে নৌকায় ত্রাণ নিতে আসছেন
সরকারি এবং বেসরকারি উদ্যোগে বিভিন্ন ত্রাণবাহী ট্রলার অথবা স্পিডবোট নদীর মাঝামাঝি থাকাতেই লোকমুখে শুনে অনেকেই দূর থেকে নৌকা নিয়ে ত্রাণবাহী নৌকার কাছে চলে আসছেন। তবে বৈষম্য হতে পারে এই ভেবে কাউকেই এভাবে ত্রাণ দেওয়া হয়নি।
ছবি: Mortaza Rashed/DW
আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে মানবেতর জীবনযাপন
সুনামগঞ্জ জেলার বিশ্বম্ভরপুর, তাহিরপুর, জামালগঞ্জ, শিবগঞ্জ, শনির হাওর এলাকাগুলোর আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে ঘুরে দেখা যায় সেখানকার বন্যা উপদ্রুত মানুষেরা মানবেতর জীবনযাপন করছেন। ছোট একটি ঘরে ১০-১৫ জন বসবাস করছে। খাবারের সংকটের পাশাপাশি বিদ্যুৎ না থাকায় খাবার পানিরও সংকট তৈরি হয় সেখানে।
ছবি: Mortaza Rashed/DW
‘চকির উপ্রে চকি দিয়া থাকসি’
সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার নয়ানগর গ্রামের রুবিয়া আক্তার বলেন, ‘‘আমরার পরিবারে ৬ জন মানুষ। আমরা আশ্রয়কেন্দ্রে যাইতাম পারছি না। ঘরই চকির উপরে চকি দিয়া কোনরকম বাইচা আছিলাম। বন্যার স্রোতে বাড়ির সামনে পিছে ভাইঙ্গা লইয়া গেসে।’’
ছবি: Mortaza Rashed/DW
আশ্রয়কেন্দ্রে জায়গার সংকট
সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার আনোয়ারপুর গ্রামের জ্যোৎস্না বেগম জানান, বন্যার পানি বিপদজনকভাবে বাড়তে থাকায় স্বামী-সন্তানসহ কাছের এক আশ্রয়কেন্দ্রে গিয়েছিলেন তারা। কিন্তু আগে থেকে আশ্রয়কেন্দ্রটি মানুষের জায়গা হচ্ছিল না। তাই তারা আবার নিজ বসতবাড়িতে ফেরত এসেছেন।
ছবি: Mortaza Rashed/DW
ভ্রাম্যমাণ রান্নাঘর
বন্যায় সিলেট ও সুনামগঞ্জের বিভিন্ন এলাকা দূরবর্তী হওয়ায় নদীপথে একদিনে ফেরত আসা যায় না। তাই যেসব বেসরকারি উদ্যোগে ত্রাণ দেওয়া হচ্ছে, তারা ট্রলারেই রান্নার ব্যবস্থা করে নিয়েছেন। তারা টাটকা রান্না করা খাবার বন্যা উপদ্রুত এলাকার পরিবারগুলোর মাঝে বন্টন করে দিচ্ছেন।