বার্লিনে গত ৯ই ডিসেম্বরের ট্রাক আক্রমণ শহরের প্রকাশ্য স্থানগুলিতে আরো বেশি ভিডিও নজরদারির দাবি জোরদার করেছে৷
বিজ্ঞাপন
সিসিটিভি বসানোর সমর্থকরা আপাতত যে দু'টি দৃষ্টান্ত দিচ্ছেন, তার প্রথমটি ঘটে সপ্তাহ দুয়েক আগে রাজধানীর হ্যারমানস্ট্রাসে মেট্রো স্টেশনে৷ স্থানটি ব্রাইটশাইডপ্লাৎস থেকে তিন স্টপ দূরে৷ হ্যারমানস্ট্রাসে মেট্রো স্টেশনের ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, একজন পুরুষ কীভাবে এক তরুণীকে বিনা প্ররোচনায় পিছন থেকে লাথি মেরে সাবওয়েতে নামার সিঁড়ি দিয়ে ফেলে দিচ্ছে৷
ঘটনায় সংশ্লিষ্ট মহিলার হাত ভেঙে যায়৷ ভিডিও ফুটেজ থেকে মহিলার আক্রমণকারীকে শনাক্ত করা সম্ভব হয়৷ ২৭ বছর বয়সি বুলগেরীয় যে বুলগেরিয়ায় পলায়ন করেছে, তদন্ত থেকে তা-ও জানা যায়৷
এ ধরনের দ্বিতীয় ঘটনা ঘটেছে ঐ বার্লিনেই, যেখানে গত ২৪শে ডিসেম্বর সাতজন কিশোর বা তরুণ এক রাস্তায় শোয়া নিরাশ্রয় ব্যক্তির গায়ে আগুন ধরিয়ে দেবার চেষ্টা করে৷ আক্রমণটি ঘটে শ্যোনলাইনস্ট্রাসে মেট্রো স্টেশনে৷ ১৫ থেকে ২১ বছরের কিশোর ও তরুণরা এক ৩৭ বছর বয়সি নিরাশ্রয় ব্যক্তির বিছানায় আগুন ধরিয়ে দেয়৷ আক্রান্ত ব্যক্তির কোনো ক্ষতি না ঘটলেও তাঁর জিনিসপত্র সব পুড়ে যায়৷ মেট্রো ট্রেনের এক ড্রাইভার সহ পথচারীরা একটি ‘ফায়ার এক্সটিঙ্গুইশার' ব্যবহার করে আগুন নিভিয়ে ফেলেন৷
বার্লিন হামলা: বিশেষ কয়েকটি তথ্য
বার্লিনে ক্রিসমাস মার্কেটে ট্রাক হামলার ঘটনার তদন্ত করছে কর্তৃপক্ষ৷ এ ঘটনায় এ পর্যন্ত ১২ জনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছে তারা৷ ছবিঘরে থাকছে ঘটনা সংক্রান্ত কিছু তথ্য৷
ছবি: picture-alliance/dpa/M. Kappeler
ঘটনা যেখানে
ব্রাইটশাইড প্লাৎস, কাইজার ভিলহেল্ম মেমোরিয়াল গির্জার সামনের চত্বর, যা পর্যটকদের কাছে একটি জনপ্রিয় ও সুপরিচিত স্থান৷ এর উত্তর পূর্ব দিকে বার্লিনের চিড়িয়াখানা ও তার সংলগ্ন রেল স্টেশন৷ আর দক্ষিণে কেনাকাটার জন্য বিখ্যাত কুয়রফ্যুয়র্স্টেনডাম বা কুডাম স্ট্রিট৷
ছবি: Google Earth
নিস-এ যা হয়েছিল
এই ছবিটি জুলাইয়ে নিস হামলার কথা মনে করিয়ে দেয়, যেখানে ৮৬ জন মানুষ নিহত হয়েছিল৷ ফ্রান্সের সেই শহরেও ভিড়ের মধ্যে দিয়ে ট্রাক চালিয়ে দেয়া হয়েছিল৷ বার্লিনের এই ঘটনায় ফ্রান্সের ক্রিসমাস মার্কেটে নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে৷
ছবি: Reuters/F. Bensch
যাঁরা হামলার শিকার
পুলিশ এ পর্যন্ত ১২ জনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছে৷ আহত অন্তত ৫০ জনের মধ্যে কয়েকজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে জানা গেছে৷ বার্লিনের মেয়র মিশেল ম্যুলার নির্দেশ দেন আহতদের যাতে তৎক্ষণাত ইউনিভার্সিটি হসপিটাল চ্যারিটিতে নিয়ে যাওয়া হয়৷
ছবি: Reuters/P. Kopczynski
বার্লিন পুলিশ
ঘটনার পর পরই ব্রাইটশাইড প্লাৎস-এর আশেপাশের সড়ক বন্ধ করে দেয় পুলিশ৷ সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে পুলিশ বার্লিনের জনগণের ঘটনাস্থলে না আসার এবং গুজবে কান না দেয়ার অনুরোধ জানান৷ কোনো জিজ্ঞাস্য থাকলে +৪৯৩০৫৪০২৩১১১ – এই নম্বরে ফোন করার পরামর্শ দিয়েছে পুলিশ৷
ছবি: Reuters/F. Bensch
সন্দেহভাজন
পুলিশ সন্দেহভাজন একজনকে আটকের খবরটি নিশ্চিত করেছে৷ ট্রাকে একজনের মৃতদেহ পাওয়া গিয়েছে৷ তবে হামলাকারীর সম্পর্কে বিস্তারিত কোনো তথ্য জানায়নি পুলিশ৷
ছবি: Reuters/F. Bensch
তদন্ত চলছে
পুলিশের বিশেষ বাহিনী ব্রাইটশাইড প্লাৎস ঘিরে রেখেছে৷ এছাড়া বানহফ চিড়িয়াখানার আশপাশে পুলিশ টহল দিচ্ছে৷ বার্লিনের অপরাধ বিষয়ক পুলিশ এবং অ্যাটর্নি জেনারেল ঘটনার তদন্ত করছে৷
ছবি: Reuters/P. Kopczynski
প্রতিক্রিয়া
জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেলের মুখপাত্র জানিয়েছেন, ম্যার্কেল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং বার্লিনের মেয়রের সঙ্গে যোগাযোগ করে যাচ্ছেন৷ জার্মান প্রেসিডেন্ট ইওয়াখিম গাউক জানিয়েছেন তিনি শোকাহত৷ বার্লিন ও পুরো জার্মানির জন্য এটা একটা কালো সন্ধ্যা৷
ছবি: REUTERS/P. Kopczynski
7 ছবি1 | 7
পরে পুলিশ একটি সাবওয়ে ট্রেনের কামরায় সংশ্লিষ্ট কিশোর-তরুণদের ভিডিও ফুটেজ প্রকাশ করলে পর, সন্দেহভাজনদের ছ'জন স্বেচ্ছায় পুলিশের কাছে ধরা দেয়৷ জানা যায় যে, তাদের সাতজন এসেছে সিরিয়া থেকে আর সপ্তম জন এসেছে লিবিয়া থেকে৷
আনিস আমরির কাহিনি
ব্রাইটশাইডপ্লাৎসের বড়দিনের বাজারে ট্রাক নিয়ে যে আক্রমণ চালায়, সেই আনিস আমরি কিন্তু ভিডিও নজরদারির ধার ধারেনি৷ ১৯শে ডিসেম্বর আক্রমণ চালানোর পর আমরি যে ইউরোপীয় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা সত্ত্বেও কী করে পুলিশে ও গোয়েন্দা বিভাগের নজর এড়িয়ে ফ্রান্স হয়ে ইটালি পৌঁছাল, তা নিয়ে এখনও জল্পনা-কল্পনা চলেছে৷ ২৪ বছর বয়সি টিউনিশীয় চারদিন পরে মিলানে ইটালীয় পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারায়৷
জার্মান ডাব্লিউডিআর টেলিভিশন সংস্থার বিবরণ অনুযায়ী, আমরি নর্থরাইন ওয়েস্টফালিয়া রাজ্যের রুয়র শিল্পাঞ্চলের ১২টি বিভিন্ন মসজিদে গেছে, এছাড়া জার্মানির অন্যত্র আরো তিনটি মসজিদে তার যাতায়াত ছিল৷ আমরি সব মিলিয়ে আটটি ভুয়ো নাম ব্যবহার করেছে, তার মধ্যে একটি ওবারহাউজেনে তার রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন দাখিল করার সময়৷
২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাস থেকে আমরি মোটামুটি বার্লিনেই ছিল, যদিও তার নর্থরাইন ওয়েস্টফালিয়া রাজ্য ছাড়ার কথা নয়, কেননা তার রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন ঐ রাজ্যে জমা পড়েছে৷ এমনকি রাজ্য গোয়েন্দা দপ্তর মে মাসের ১০ তারিখে আমরিকে ঝুঁকিপূর্ণ ব্যক্তিদের পর্যায়ভুক্ত করে৷ আমরি বার্লিনে বিশেষভাবে সন্দেহজনক আচরণ করে; উগ্রপন্থি সালাফি ও ইসলামপন্থিদের সঙ্গেও তার সংযোগ ছিল৷ বার্লিনে সে যাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে, তাদের মধ্যে দু'জন সন্ত্রাসী আক্রমণের পরিকল্পনা করছে, বলে পুলিশের কাছে খবর ছিল৷ নর্থরাইন-ওয়েস্টফালিয়া রাজ্যের ডর্টমুন্ডে আমরির দুই ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগ ছিল, যাদের দৃশ্যত তথাকথিত ইসলামিক স্টেটের সঙ্গে সংযোগ আছে৷
জার্মানিতে যেসব সন্ত্রাসী হামলার চেষ্টা হয়েছিল
গত আঠারো মাসে বেশ কয়েকবার জার্মানিতে সন্ত্রাসী হামলার চেষ্টা করা হয়েছে, যার অধিকাংশই অবশ্য পুলিশ আগেভাগে প্রতিরোধ করতে সক্ষম হয়৷ আন্তর্জাতিক জঙ্গি গোষ্ঠী ‘ইসলামিক স্টেট’ বা আইএস-এর অন্যতম টার্গেট এখন ইউরোপের এই দেশটি৷
ছবি: Reuters/M. Rehle
লাইপসিশ, অক্টোবর ২০১৬
লাইপসিসের পুলিশ দু’দিন ধরে তল্লাশি চালানোর পর ২২ বছর বয়সে সিরীয় শরণার্থী জাবের আল-বাকেরকে গ্রেপ্তারে সক্ষম হয়৷ চেমনিৎসে তার অ্যাপার্টমেন্টে বিস্ফোরক এবং বোমা তৈরিত সরঞ্জাম পাওয়ার পর তাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ৷ সন্দেহ করা হয় যে, বার্লিন বিমানবন্দরে সন্ত্রাসী হামলার পরিকল্পনা করছিল সে৷ গ্রেপ্তারের দুই দিন পর অবশ্য কারাগারে আত্মহত্যা করে এই সিরীয় শরণার্থী৷
ছবি: picture-alliance/dpa/S. Willnow
আন্সবাখ, জুলাই ২০১৬
গত জুলাই মাসে জার্মানিতে দু’টি হামলার দায় স্বীকার করে জঙ্গি গোষ্ঠী ‘ইসলামিক স্টেট’ বা আইএস৷ দু’টি হামলাই শরণার্থীরা ঘটিয়েছিল৷ এর মধ্যে বাভারিয়ার আন্সবাখ শহরে একটি মিউজিক ফেস্টিভ্যালের প্রবেশ মুখে এক সিরীয় শরণার্থী বিস্ফোরণ ঘটালে ১৫ ব্যক্তি আহত হন৷ হামলায় হামলাকারী অবশ্য নিজেও প্রাণ হারায়৷
ছবি: picture alliance/AP Photo/D. Karmann
ভ্যুয়র্ত্সবুর্গ, জুলাই ২০১৬
১৭ বছর বয়সি এক শরণার্থী ভ্যুয়র্ত্সবুর্গে একটি ট্রেনের মধ্যে কুড়াল ও ছুরি নিয়ে যাত্রীদের উপর হামলা চালায়৷ এতে হংকং থেকে আসা এক পর্যটক পরিবারের চার সদস্য এবং অন্য একজন আহত হন৷ পুলিশ হামলাকারীকে গুলি করে হত্যা করে৷ পুলিশ জানায়, হামলাকারী তথাকথিত ইসলামিক স্টেট-এর সদস্য না হলেও এই জঙ্গি গোষ্ঠীর আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে হামলা চালিয়েছিল৷
ছবি: picture-alliance/dpa/K. Hildenbrand
ড্যুসেলডর্ফ, মে ২০১৬
ইসলামিক স্টেট-এর তিন সন্দেহভাজন সদস্যকে নর্থ রাইনওয়েস্টফেলিয়া, ব্রান্ডেনবুর্গ এবং বাডেন ভ্যুর্টেনবের্গ থেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ৷ কর্তৃপক্ষ জানায়, গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে দু’জন ড্যুসেলডর্ফের শহরতলীতে আত্মঘাতী হামলার পরিকল্পনা করেছিল৷ অপরজন এবং ফ্রান্সে গ্রেপ্তারকৃত চতুর্থ জিহাদি বন্দুক ও বিস্ফোরক নিয়ে পথচারীদের হামলার পরিকল্পনা করছিল বলে খবর৷
ছবি: picture-alliance/dpa/M. Hitij
এসেন, এপ্রিল ২০১৬
এসেনে একটি শিখ মন্দিরে বোমা বিস্ফোরণের ঘটনায় তিনজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ৷ বিস্ফোরণে তিন ব্যক্তি আহতও হন৷ সিসিটিভি ফুটেজ প্রচারের পর ১৬ বছর বয়সি এক সন্দেহভাজন নিজেই পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করে৷ আর অন্য তরুণ সন্দেহভাজনকে বাড়ি থেকে আটক করে স্পেশাল পুলিশ৷
ছবি: picture-alliance/dpa/M. Kusch
হানোফার, ফেব্রুয়ারি ২০১৬
১৬ বছর বয়সি জার্মান-মরোক্কান তরুণী সোফিয়া এস. হানোফার ট্রেন স্টেশনে এক পুলিশ কর্মকর্তাকে ছুরিকাঘাত করে৷ ধারণা করা হয়, ইসলামিক স্টেট-এর সদস্যরা তাকে এই হামলায় প্ররোচিত করেছিল৷
ছবি: Polizei
বার্লিন, ফেব্রুয়ারি ২০১৬
বার্লিনে সন্ত্রাসী হামলার পরিকল্পনার অভিযোগে ইসলামিক স্টেট-এর সন্দেহভাজন তিন আলজেরীয় সদস্যকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ৷ বার্লিনের প্রসিকিউটরের দপ্তরের তথ্য আনুযায়ী, রাজধানীতে হামলা করার জন্য তাদের সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা সম্পর্কে অবগত ছিল কর্তৃপক্ষ৷
ছবি: Reuters/F. Bensch
ওবারউরসেল, এপ্রিল ২০১৫
এশবর্ন-ফ্রাংকফুর্ট সিটি লুপ বাইক রেস বাতিল করে পুলিশ, কেননা তারা সন্দেহ করছিল যে সেই রেসে ইসলামিক স্টেট হামলা চালাতে পারে৷ হামলা পরিকল্পনায় জড়িত সন্দেহে পুলিশ ৩৫ বছর বয়সি এক তুর্কি বংশোদ্ভূত জার্মান এবং তাঁর ৩৪ বছর বয়সি স্ত্রীকে গ্রেপ্তার করে৷ বাইক রুটের কাছে তাদের বাড়ি থেকে বোমা তৈরির উপকরণও উদ্ধার করে পুলিশ৷
ছবি: picture-alliance/dpa/A. Dedert
8 ছবি1 | 8
‘সিসিটিভি দিয়ে সন্ত্রাস রোখা যায় না'
এ কথা বলেছেন জার্মান পুলিশ সংগঠন সমিতির উপপ্রধান অ্যার্নস্ট ভাল্টার৷ বলেছেন, ‘‘কিন্তু আততায়ীদের ধরতে তা কাজে লাগানো যেতে পারে৷ জার্মানিতে সেটা কত খারাপ, তা আমরা দেখলাম৷ আমরি উধাও হলো, আমরা তাকে গ্রেপ্তার কতে পারলাম না৷''
অপরদিকে জার্মান বিচারক সমিতির মুখপাত্র ইয়েন্স নিসা ডিপিএ সংবাদ সংস্থাকে বলেছেন, প্রকাশ্য ভিডিও নজরদারির ফলে সন্ত্রাসবাদীরা উৎসাহিত বোধ করতে পারে, বলে বিচারক সমিতির আশঙ্কা৷ ভিডিও ফুটেজ সন্ত্রাসীদের আরো বেশি পাবলিসিটি এনে দেবে৷
একটি সাম্প্রতিক ইউগভ জরিপে কিন্তু ৬০ শতাংশ জার্মান বলেছেন যে, ভিডিও নজরদারি জার্মানিকে আরো নিরাপদ করে তুলবে, বলে তাঁদের ধারণা৷
সিসিটিভি কি সত্যিই সন্ত্রাস রুখতে পারবে? আপনার কী মনে হয়? লিখুন নীচের ঘরে৷