বিশ্বজুড়ে লক্ষ লক্ষ নারী সন্তান জন্ম দিতে ঝুঁকিপূর্ণ ‘সি-সেকশন’ বা সিজারিয়ান করাচ্ছেন৷ এ প্রবণতা ধীরে ধীরে ‘মহামারী'-র আকার ধারণ করছে বলে জানাচ্ছে একটি গবেষণা৷
বিজ্ঞাপন
২০০০ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে সারা বিশ্বে এ প্রবণতা আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে৷
শুধু মা বা শিশুর জীবন বাঁচাতে অথবা ভ্রূণের অস্বাভাবিকতার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় এই ‘সি-সেকশন’-এর অত্যধিক ব্যবহার একাধারে স্বাস্থ্যে ফেলে দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব৷ সি-সেকশন বা সিজারিয়ান খরচসাপেক্ষও বটে৷
এমনই মতামত ‘দ্য লানসেট’ নামের একটি চিকিৎসা বিষয়ক পত্রিকার৷
বিশেষজ্ঞদের অনুমান, ১০ থেকে ১৫ শতাংশ জন্মের ক্ষেত্রে ‘সি-সেকশন’ অর্থাৎ সিজারিয়ান অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন হয়৷ কিন্তু গবেষকরা বলছেন, ২০০০ সালের ১২ শতাংশ জন্ম সিজারিয়ান অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে করা হলেও ২০১৫ সালের মধ্যে এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২১ শতাংশে৷
ইউনিসেফ ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরিসংখ্যানভিত্তিক এই গবেষণায় ভৌগোলিক অঞ্চলগুলির মধ্যে বিশাল বৈষম্য দেখা যাচ্ছে৷ ৬০ শতাংশ রাষ্ট্রে ‘সি-সেকশন’ প্রয়োজনের অধিক ব্যবহৃত হয় এবং ২৫ শতাংশ রাষ্ট্রে ‘সি-সেকশন’-এর ব্যবহার প্রয়োজনের চেয়ে অনেক কম৷
কমপক্ষে ১৫টি দেশে ৪০ শতাংশেরও বেশি জন্ম ‘সি-সেকশন’-এর মাধ্যমে হয়৷ এই তালিকার শীর্ষে আছে ডোমিনিকান প্রজাতন্ত্র, যেখানে ৫৮ দশমিক ১ শতাংশ শিশুর জন্ম হয় ‘সি-সেকশন’ করে৷
সন্তান জন্ম দেয়ার সাত উপায়
সন্তানের মা হওয়ার চেয়ে আনন্দের কিছু অনেকেই খুঁজে পাবেন না৷ এ যেন এক স্বর্গীয় অনুভূতি৷ তবে সেই সন্তান জন্ম দেয়ার বা মা হওয়ার রয়েছে বেশ কয়েকটি উপায়৷ চলুন সেগুলো জেনে নেয়া যাক৷
ছবি: Imago/Westend61
ভেজাইনাল বা যোনি ডেলিভারি
প্রাকৃতির নিয়মে সবচেয়ে আদিম উপায় হচ্ছে ‘ভেজাইনাল ডেলিভারি’৷ এই উপায়ে সন্তান ‘বার্থ ক্যানেলের’ মাধ্যমে, মানে যোনিনালী দিয়ে মাতৃগর্ভ থেকে বেরিয়ে আসে৷ অবশ্য ঠিক কখন প্রসব হবে, তা আগেভাবে সঠিকভাবে জানা যায় না৷ অধিকাংশ নারী এই প্রক্রিয়াতেই গর্ভধারণের ৩৮-৪১ সপ্তাহের মধ্যে সন্তান প্রসব করেন৷ এভাবে জন্ম নেয়া শিশুর রোগবালাই সংক্রমণের মাত্রা কম৷ তবে সন্তান প্রসবের সময় প্রচণ্ড ব্যথা হয়৷
ছবি: picture-alliance/dpa/R. Yongrit
সিজারিয়ান সেকশন বা সি-সেকশন
বাস্তবতা হচ্ছে, সব শিশুর জন্ম ভেজাইনাল বার্থের মাধ্যমে হয় না৷ বিশেষ করে জন্মদানের সময় জটিলতা সৃষ্টি হলে ‘সি-সেকশন’, অর্থাৎ নারীর তলপেট এবং জরায়ুর চামড়া কেটে বাচ্চা বের করে আনতে হয়৷ কেউ কেউ প্রসববেদনা এড়াতে এবং যোনির প্রসারতা ঠেকাতেও সিজারিয়ান অপশন বেছে নেন৷ কারো কারো বিশ্বাস যে, যোনিপথে সন্তান জন্ম দিলে পরবর্তীতে যৌনজীবনে নেতিবাচক প্রভাব পরতে পারে৷
ছবি: picture-alliance/D. Karmann
সিজারিয়ানের পর ভেজাইনাল বার্থ
অতীতে মনে করা হতো, একবার সি-সেকশনের মাধ্যমে সন্তান জন্ম দিলে সেই নারী পরবর্তীতে আর প্রাকৃতিক উপায়ে, অর্থাৎ যোনিনালীর মাধ্যমে সন্তান জন্ম দিতে পারবেন না৷ তবে চিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে এই ধারণায় পরিবর্তন এসেছে৷ সিজারিয়ানের পর ভেজাইনাল বার্থ অবশ্যই সম্ভব৷ আর সিজারিয়ানে বাচ্চা জন্মদানের পর কোনো কোনো ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদে নারীর নানারকম শারীরিক জটিলতা সৃষ্টির নজিরও রয়েছে৷
ছবি: Imago/Westend61
ভেক্যুয়াম এক্সট্রাকশন
ভেজাইনাল ডেলিভারির সময় কোনো কারণে নবজাতক বার্থ ক্যানেলে আটকে গেলে ভেক্যুয়াম পাম্পের মাধ্যমে তাকে বের করে আনা হয়৷ এই পদ্ধিততে একটি নরম, অনমনীয় কাপ শিশুর মাথায় আটকে দেয়া হয়৷ এরপর ভেক্যুয়ামের মাধ্যমে সেটি টেনে বের করে আনা হয়৷
ছবি: Imago/StockTrek Images
ফোরক্যাপস ডেলিভারি
এটাও ভেজাইনাল বা নর্মাল ডেলিভারির সময় জটিলতা তৈরি হলে ব্যবহার করা হয়৷ এই পন্থায় বড় দু’টো চামচের মতো দেখতে ফোরক্যাপস শিশুর মাথা আটকে বার্থ ক্যানেল থেকে তাকে সহজে বের করে আনা হয়৷ সাধারণত গর্ভধারিণী প্রসবের সময় পর্যাপ্ত চাপ দিতে না পারলে এই পন্থা কাজে লাগানো হয়৷
ছবি: picture-alliance/akg-images/J. Meyer
ইন ভিট্রো ফার্টিলাইজেশন (আইভিএফ)
অনেক নারীর জন্য গর্ভধারণই জটিল৷ এক্ষেত্রে সন্তান জন্ম দেয়ার একটি আধুনিক পন্থা হচ্ছে আইভিএফ৷ এ পন্থায় চিকিৎসক নারীর ডিম্বাণু সূচের মাধ্যমে বের করে আনেন এবং ল্যাবরেটরিতে তা শুক্রাণুর সঙ্গে মেলান৷ পরে ভ্রুণ সৃষ্টির পর সেটা ক্যাথিটার ব্যবহার করে নারীর জরায়ুতে প্রবেশ করানো হয়৷ কিছু কিছু ক্ষেত্রে এরপর ভ্রুণটি নিজে থেকেই মাতৃগর্ভে প্রতিস্থাপিত হয়৷ দাতার ডিম্বাণু ও শুত্রাণুর মাধ্যমেও এভাবে মা হওয়া যায়৷
ছবি: picture-alliance/dpa/W. Grubitzsch
সারোগেসি
যেসব নারী একেবারেই সন্তান জন্ম দিতে অক্ষম বা সন্তান জন্ম দেয়া যাঁদের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ ব্যাপার, তাঁদের ক্ষেত্রে মা হওয়ার একটি উপায় হচ্ছে সারোগেসি বা অন্য নারীর গর্ভ ভাড়া নেয়া৷ এক্ষেত্রে আইভিএফ পদ্ধতিতে গর্ভ ভাড়া দেয়া নারীর জরায়ুতে ভ্রুণ বা শুক্রাণু প্রবেশ করানো হয়৷ দ্রষ্টব্য: জনসন ম্যামোরিয়াল হেল্থ ব্লগ এবং উইম্যান’স হেল্থ ম্যাগাজিন থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে গ্যালারিটি তৈরি করা হয়েছে৷
ছবি: Colourbox
7 ছবি1 | 7
ব্রাজিল, মিশর ও তুরস্কে অর্ধেকেরও বেশি শিশু সিজারিয়ানের মাধ্যমে জন্মায়৷ অন্যদিকে, পশ্চিম ও মধ্য আফ্রিকার বেশ কিছু অংশে এই পদ্ধতিটি শুধুমাত্র ৪ দশমিক ১ শতাংশ জন্মের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়৷
নারীদের আর্থ-সামাজিক অবস্থা অনুযায়ী, রাষ্ট্রগুলির ভেতরেও অঞ্চল অনুসারে সিজারিয়ান অস্ত্রোপচারের হারে তারতম্য রয়েছে৷
উদাহরণস্বরূপ, চীনে সিজারিয়ান অস্ত্রোপচারের হার ৪ শতাংশ থেকে ৬২ শতাংশের মধ্যে ঘোরাফেরা করে ও ভারতে তা থাকে ৭ থেকে ৪৯ শতাংশের মধ্যে৷
নিম্ন ও মাঝারি আয়ের দেশগুলিতে জনসংখ্যার দরিদ্রতম অংশের চেয়ে ধনীদের মধ্যেই সিজারিয়ান অস্ত্রোপচারের হার প্রায় পাঁচগুণ বেশি ছিল৷
কেনিয়ার আগা খান বিশ্ববিদ্যালয় ও বেলজিয়ামের গেন্ট ইউনিভার্সিটিতে এই গবেষণায় নেতৃত্ব দেন বিশেষজ্ঞ মারলিন টেমারম্যান৷ তিনি বলেন, ‘‘সি-সেকশন ব্যবহারের বৃদ্ধি নারী ও শিশুদের জন্য ঝুঁকির কারণ, কেননা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তা করা হয় ডাক্তারি পরামর্শ না নিয়ে৷’’
‘সি-সেকশন’-এর সাথে জড়িত রয়েছে নানা রকমের ঝুঁকি৷ গর্ভাশয়ের ক্ষতি, অস্বাভাবিক প্লেসেন্টেশন, এক্টোপিক গর্ভাবস্থা, ভ্রূণের মৃত্যু এমনকি সময়ের আগে জন্মের মতো আরো অনেক ঝুঁকির আশঙ্কা থাকতে পারে৷
ইতিমধ্যে প্রমাণিত হয়েছে যে, শিশুর হরমোন, শারীরিক ও অন্যান্য বিকাশের উপর প্রভাব ফেলতে পারে এই অস্ত্রোপচার৷ যথাযথ স্বাস্থ্যপরিষেবা ও দক্ষতার অনুপস্থিতিতে, মা ও শিশুর জীবনও হতে পারে বিপন্ন৷
গবেষণা এ-ও বলে যে, কিছু নারী অতীতের নেতিবাচক অভিজ্ঞতার কারণে অপ্রয়োজনীয় সি-সেকশন বেছে নিলেও অনেক ক্ষেত্রে এটি ‘ফ্যাশনেবল’ হয়ে উঠেছে৷
এর ফলে বেশ কিছু দেশে ‘সি-সেকশন’-কে ‘আধুনিক’ বা নিরাপদ বলেও প্রচার করা হয়৷
গবেষকেরা বলেন, সিজারিয়ান অস্ত্রোপচার কমানোর জন্য চিকিৎসা ক্ষেত্রে জরুরিভিত্তিতে হস্তক্ষেপের প্রয়োজন রয়েছে৷