জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে সংসদীয় আসনের সীমানা পুননির্ধারণ করার পর দেশের বিভিন্ন এলাকায় চলছে বিক্ষোভ আন্দোলন। আন্দোলনরতদের দাবি পুরণ আইনগতভাবে কতটা সম্ভব?
নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সদস্য ড. মোহাম্মদ আব্দুল আলীম ডয়চে ভেলেকে বলেন, " প্রতি পাঁচ বছর পর পর সংসদীয় আসনের সীমানা পুনর্নিধারণ করতে হয় জনসংখ্যার ভিত্তিতে। তবে আদমশুমারী না হলে তো করা যায় না। এবার সর্বশেষ আদমশুমারী ও ভোটারের ভিত্তিতে করা হয়েছে।ছবি: Partho Das/DW
বিজ্ঞাপন
অনেক এলাকায় স্থানীয়ভাবে সব দলই অংশ নিচ্ছে আন্দোলনে। এসব আন্দোলন কীভাবে সামাল দেয়া হবে?
তবে নির্বাচন কমিশনের সচিব ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছেন দাবি পূরণের বিষয়টি বিবেচনাতেই নেই তাদের৷ তিনি বলেন, " কমিশন যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে এটা চূড়ান্ত। এটা পরিবর্তনের কোনো সুযোগ কমিশনের দিক থেকে নাই।” তবে নির্বাচন-ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. বদিউল আলম মজুমদারের মতে," কী সমস্যা হয়েছে তা পর্যালোচনা করে দেখা যায়।”
নির্বাচন কমিশন এবার যে সংসদীয় আসনের সীমানাপুনর্নির্ধারণ করার পর ৩০০ আসনের ২৬১ আসনের সীমানা আগের মতো থাকলেও ৩৯টি আসনের সীমানা বদলে গেছে। এর ফলে বাগেরহাট জেলায় চারটি আসন থেকে একটি কমে হয়েছে তিনটি। গাজীপুর জেলায় একটি আসন বেড়েছে। সেখানে আগে ছিল পাঁচটি, এখন হয়েছে ছয়টি।। অন্য ৩৭টি আসনের মধ্যে কোনো আসনের সীমানা বেড়েছে আবার কোনোটিরর সীমানা কমেছে। ফলে কোনো আসন থেকে দুই-একটি ইউনিয়ন বাদ পড়েছে। সেগুলো আবার অন্য আসনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। সীমানা পুনর্নিধারণের কমপক্ষে তিনটি নীতিমালা আছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো, জনসংখ্যা। বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যাকে ৩০০ আসন দিয়ে ভাগ করলে যে ফল আসে তা থেকে একটি সংসদীয় এলাকার জনসংখ্যার একটি মান ঠিক করা হয়। কারণ, আসন সংখ্যা ৩০০ থাকবে। এবার প্রতিটি আসনের গড় জনসংখ্যা ধরা হয়েছে চার লাখ ২০ হাজার ৫০০। ফলে ভৌগোলিক সীমার চেয়ে জনসংখ্যার সাম্যকে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয় সীমানা নির্ধারণে, জানান বিশ্লেষকরা। এবার পার্বত্য তিন জেলার আসন সীমানায় কোনো পরিবর্তন আসেনি।
ফরিদপুরে বিক্ষোভের ফলে ভাঙচুরের ছবি৷ছবি: PA Tarik/DW
এই সীমানা পুনর্নিধারণ নিয়ে দেশের বিভিন্ন এলাকায় অন্দোলন সহিংসতায় রূপ নিয়েছে। হরতাল হচ্ছে। ফরিদপুরের ভাঙ্গা উপজেলা ও থানায় হামলা এবং সড়ক ও রেললাইন অবরোধের মতো ঘটনা ঘটেছে। আন্দোলন হচ্ছে বাগেরহাট, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও পাবনাসহ আরো কিছু এলাকায়। এই ইস্যু নিয়ে উচ্চ আদালতে রিটও করা হচ্ছে। কিন্তু নির্বাচন কমিশনের সীমানা পুননির্ধারণের বিষয়ে সাংবিধানিকভাবে কানো আদালতে চ্যালেঞ্জ করার সুয্গে নেই বলে জানান আইন বিশ্লেষকরা।
তা সত্ত্বেও পরিস্থিতি ভীষণ উত্তপ্ত৷ কারণ, যেসব এলাকার লোকজন নিজেদের ক্ষতিগ্রস্ত মনে করছেন, ওই এলাকার সব রাজনৈতিক দলই আন্দোলনে অংশ নিচ্ছে।
নির্বাচন নিয়ে জনমনে শঙ্কা-সংশয়
ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচন হওয়ার কথা। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অনৈক্য ও সার্বিক প্রস্তুতি নিয়েও মানুষের মধ্যে শঙ্কা রয়েছে। এসব বিষয়ে ডয়চে ভেলের সাথে কথা বলেছেন রাজনীতিবিদ, বিশ্লেষক, সাংবাদিক ও শিক্ষার্থীরা।
জনমনে স্বস্তি ফেরেনি, নির্বাচন হবে কীভাবে?: রুহিন হোসেন প্রিন্স, সাধারণ সম্পাদক, সিপিবি
নির্বাচন নিয়ে শঙ্কার তিনটি কারণ আছে। প্রথমত, জনজীবনে স্বস্তি ফেরেনি, এর মধ্যে নির্বাচন হবে কীভাবে? দ্বিতীয়ত, সরকার ও নির্বাচন কমিশনের আরও কিছু দৃশ্যমান পদক্ষেপ দরকার ছিল। যেমন, রাজনৈতিক দলগুলোকে নির্বাচনি যাত্রায় শামিল করার দরকার ছিল, যেটা তারা করেনি। তৃতীয়ত, সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ট রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনবিরোধী অবস্থান নিয়েই কথা বলছে। ফলে মানুষের মধ্যে সংশয় তৈরি হওয়াটাই স্বাভাবিক।
ছবি: DW
রাজনৈতিক অনৈক্য ও নিরাপত্তাহীনতা নির্বাচনে বাধা : মনিরা শারমিন, যুগ্ম আহবায়ক, এনসিপি
মানুষের মধ্যে শঙ্কার অনেক কারণ আছে। মূলত দলগুলোর মধ্যে ঐক্য তৈরি হয়নি। এটা নির্বাচন আয়োজনের ক্ষেত্রে বড় প্রভাবক। ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হলে এখন তো সবার মাঠে থাকার কথা। বিশেষ করে একটি দল যারা শুরু থেকেই নির্বাচনের কথা বলছে তারাও কিন্তু মাঠে নামেনি। তারাও জানে, রাজনৈতিক ঐক্য ছাড়া নির্বাচন সম্ভব না৷ মানুষ গত তিনটা নির্বাচনে ভোট দিতে পারেনি। নির্বাচনহীনতার একটা সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে।
ছবি: Privat
জামায়াত-এনসিপির শর্ত শঙ্কা তৈরি করেছে : ডা. জাহেদ উর রহমান, রাজনৈতিক বিশ্লেষক
কতগুলো যৌক্তিক কারণেই সংশয় তৈরি হয়েছে। এই মুহূর্তে আওয়ামী লীগ মাঠে নেই। মূল দল জামায়াত ও এনসিপি নানা ধরনের শর্ত দিচ্ছে নির্বাচন নিয়ে। যেগুলো দেখে মনে হতে পারে তারা নির্বাচন চায় না। এটাই মানুষের মধ্যে সংশয় তৈরি করেছে। এই মুহূর্তে সবার নির্বাচনের মাঠে থাকার কথা। কিন্তু জামায়াত-এনসিপি যেসব শর্ত দিচ্ছে সেগুলো পূরণ না হলে তারা নির্বাচন করবে না। ফলে আদৌ নির্বাচন হবে কিনা তা নিয়ে শঙ্কা তো আছেই।
ছবি: Samir Kumar Dey/DW
নির্বাচন ছাড়া সরকারের বিকল্প নেই : রোকসানা খন্দকার, আইনজীবী ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
দলগুলোর মধ্যে পারস্পরিক আস্থা ও বিশ্বাসের অভাব দেখা যাচ্ছে। কয়েকটি দল শর্ত দিচ্ছে, এটা না হলে, ওটা না হলে তারা নির্বাচনে যাবে না। এই শর্তের কারণে মানুষের মধ্যে নির্বাচন নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। তবে যতই শঙ্কা থাক, বর্তমান সরকার কিন্তু বুঝতে পেরেছে দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি, বিনিয়োগ নেই, কর্মসংস্থান নেই এতে মানুষ দারুনভাবে ক্ষুব্ধ। ফলে যত শঙ্কাই থাক না কেন, নির্বাচন দেওয়া ছাড়া এই সরকারের কোন বিকল্প নেই।
ছবি: Samir Kumar Dey/DW
আইন শৃঙ্খলা হচ্ছে বড় চ্যালেঞ্জ: মোস্তফা ফিরোজ, সিনিয়র সাংবাদিক
তিনটা দলকে গুরুত্ব দেন ড. ইউনূস। এর মধ্যে জামায়াত ও এনসিপি পিআর সিস্টেমে নির্বাচন চায়। তাদের এই দাবির কারণে এক ধরনের দ্বিধাদ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছে। আর বিএনপিও অগোছালো। তারেক রহমান দেশে নেই, প্রার্থী বাছাই করে যে তারা মাঠে নামবে সেটাও দেখা যাচ্ছে না। এসব কারণে অনিশ্চয়তা। আর আইনশৃঙ্খলা হচ্ছে বড় চ্যালেঞ্জ। পুলিশ আসলে প্রস্তুত না। সেনাবাহিনী দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া সম্ভব হবে না। এই কারণেও শঙ্কা বেড়েছে।
ছবি: Privat
নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা আছে : সাইদুর রহমান, রাজনীতি ও নির্বাচন বিষয়ক সম্পাদক, ইত্তেফাক
ভোট ব্যবস্থাপনার প্রতি মানুষের আস্থাহীনতা আছে। ভোটারদের কেন্দ্রে উপস্থিত নিশ্চিত করার পাশাপাশি আরেকটি চ্যালেঞ্জ নির্বাচন কমিশনকে কঠিন সংকটের মুখোমুখী ফেলতে পারে। সেটি হল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মিস-ইনফরমেশন এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) দিয়ে ছবি বা ভিডিও বানিয়ে ছড়িয়ে দেয়া। ভোট না হওয়া পর্যন্ত শঙ্কা থাকবে। এখনো নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা আছে।
ছবি: Samir Kumar Dey/DW
পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দেওয়ার সুযোগ চাই : অর্পিতা সাহা, শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
জীবনের প্রথম ভোট হিসেবে আমি চাই পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে। এই নির্বাচন যেন সুষ্ঠু, অবাধ ও অংশগ্রহণমূলক হয়। যেখানে প্রতিটি দল সমান সুযোগ পাবে। আমার প্রত্যাশা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এমন সরকার নির্বাচিত হবে, যারা সত্যি জনগণের আশা ও কল্যাণ বাস্তবায়নে এগিয়ে আসবে। বর্তমান সরকারের প্রতি জনগণের অনেক প্রত্যাশা ছিল, কিন্তু সেই প্রত্যাশাগুলো পূরণ হয়নি। তাই ফেব্রুয়ারির নির্বাচন অত্যন্ত জরুরি।
ছবি: Samir Kumar Dey/DW
নির্ভয়ে ভোট দিতে চাই : রাতুল হাসান রাফি, শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
জনগণ ভেবেছিল অন্তর্বর্তীকালীন সরকারই হবে পরিবর্তনের প্রতীক। ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করবে, দুর্নীতি কমাবে, উন্নয়নের গতি বাড়াবে। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল ব্যর্থতাই বেশি। জনগণের আস্থা টিকিয়ে রাখতে হলে আর সময়ক্ষেপণের সুযোগ নেই। ফেব্রুয়ারিতেই নির্বাচন হতে হবে। একেবারেই স্বচ্ছ ও প্রতিযোগিতামূলক, যেখানে কোনো দল বিশেষ সুবিধা না পায়। জীবনের প্রথম ভোট হিসেবে আমি নির্ভয়ে যোগ্য প্রার্থীকে ভোট দিতে চাই।
জাতীয় নির্বাচনে একজন তরুণ ভোটার হিসাবে আমার প্রধান প্রত্যাশা হলো সৎ ও যোগ্য নেতৃত্ব পাওয়া। আমি চাই শিক্ষা, কর্মসংস্থান প্রযুক্তিকে অধিক গুরুত্ব দেওয়া হোক। দুর্নীতি কমানোসহ নারী হিসাবে আমার সমান সুযোগ ও নিরাপদ পরিবেশ প্রত্যাশা করি। সবশেষে, আমি এমন নেতৃত্ব চাই যারা ন্যায়ভিত্তিক ও উন্নত বাংলাদেশ গড়বে।
ছবি: Privat
নির্বাচন যেন অবাধ সুষ্ঠু হয় : আবু বকর অনিক, শিক্ষার্থী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
আমি এখনও কোন নির্বাচনে ভোট দেইনি। জীবনে প্রথম ভোট দেবো রাকসু নির্বাচনে। আর ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোট দিতে চাই। সেই নির্বাচনটি যেন যেন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে অনুষ্ঠিত হয়। যাতে জনগণ তাদের পছন্দের প্রার্থীকে ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে নির্বাচিত করতে পারে এবং একজন প্রকৃত স্বদেশপ্রেমী প্রতিনিধির মাধ্যমে সংসদে তাদের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত হয়।
ছবি: Samir Kumar Dey/DW
10 ছবি1 | 10
ফরিদপুর-৪ (চরভদ্রাসন-সদরপুর-ভাঙা) আসনের অন্তর্গত দুইটি ইউনিয়ন আলগী ও হামিরদী জাতীয় সংসদীয় আসন ফরিদপুর-২ (নগরকান্দা-সালথা)-র অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু ওই দুই ইউনিয়নের বাসিন্দারা আগের সংসদীয় এলাকায়ই থাকতে চাচ্ছেন। ফরিদপুর জেলা বিএনপির আহ্বায়ক সৈয়দ মোদারেস আলী ইসা ডয়চে ভেলেকে বলেন, "যে দুইটি ইউনিয়ন বিচ্ছিন্ন করে ফরিদপুর-২ আসনে যুক্ত করা হয়েছে, তারা ওই আসনে যুক্ত হতে রাজি নন। কারণ, তাদের দূরত্ব প্রশাসনিক এলাকা থেকে ৩০-৪০ কিলোমিটার দূরে। তারা তাদের কাজের জন্য এত দূরে যেতে চান না। আর তারা সংসদীয় আসনে তাদের উপজেলা থেকেও বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছেন। এই কারণেই আন্দোলন। সব রাজনৈতিক দলই এই আন্দোলনে আছে। তবে আমরা আন্দোলন আগামী ২১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত স্থগিত করেছি সর্বশেষ কী হয় তা দেখার জন্য।”
এরই মধ্যে এই ঘটনায় হাইকোর্টে রিটও করা হয়েছে। জেলা প্রশাসক নির্বাচন কমিশনে চিঠি দিয়ে আগের সীমানা বহাল রাখার অনুরোধ করেছেন। তবে পুলিশ দাবি করেছে, চলমান আন্দোলনের সঙ্গে ফ্যাসিবাদের লোকজন যুক্ত।
আমরা সংবিধান, আইন, নীতিমালা সব মেনে এই সীমানা পুনর্নিধারণ করেছি: নির্বাচন কমিশনের সচিব
This browser does not support the audio element.
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগর উপজেলার বুধন্তী ও চান্দুরা ইউনিয়ন দুটি ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৩ (সদর-বিজয়নগর) আসন থেকে কেটে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ (সরাইল-আশুগঞ্জ)-এর সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু এটা মানতে রাজী নন বিজয়নগর উপজেলার বাসিন্দারা। তারাও আগের সীমানা বহাল চাইছেন। তারাও আন্দোলন, সড়ক অবরোধ করছেন। বিজয়নগর উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট ইমাম হোসেন বলেন, "বিজয়নগরের যে দুই ইউনিয়ন কেটে সরাইলের সঙ্গে দেয়া হয়েছে, ওই দুই ইউনিয়নের দূরত্ব সরাইল থেকে ৩০ কিলোমিটার। বিজয়নগর তাদের কাছে। তারা তো এখন বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। ” ওই এলাকার বাসিন্দাদের পক্ষেও হাইকোর্টে রিট করা হয়েছে। ইমাম হোসেন জানান, তাদের আন্দোলন অব্যাহত থাকবে।
একই ধরনের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে ফরিদপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, পাবনাসহ ৩৮টি সংসদীয় এলাকায়। আগের সীমানা পরিবর্তন হয়ে গেছে। পাবনা-১ আসনে জায়গা পেয়েছে সাঁথিয়া উপজেলা, বেড়া উপজেলার-বেড়া পৌরসভা, হাটুরিয়া নাকালিয়া, নতুন ভারেংগা, চাকলা ও কৈটোলা ইউপি। সুজানগর উপজেলা এবং বেড়া পৌরসভা, হাটুরিয়া নাকালিয়া, নতুন ভারেংগা, চাকলা ও কৈটোলা ইউপি ছাড়া বেড়া উপজেলার বাকি অংশ নিয়ে পাবনা-২ আসন করেছে ইসি। সেখানেও আন্দোলন হচ্ছে। হাইকোর্টে রিট হয়েছে।
তবে বাগেরহাট জেলার পরিস্থিতি একেবারেই ভিন্ন। ওই জেলায় একটি আসনই কমে গেছে। সেখানেও সড়ক অবরোধসহ নানা ধরনের আন্দোলন কর্মসূচি দেয়া হচ্ছে। রিট করা হয়েছে হাইকোর্টে। বাগেরহাটের বাসিন্দা ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ওই রিট আবেদন করেছেন। তিনি বলেন, "বাগেরহাটের একটি আসন কমেছে আর গাজীপুরে একটি বেড়েছে। আমাদের একটি আসন কমে যাওয়ায় পুরো জেলার সংসদীয় সব আসনের সীমানাই পরিবর্তন হয়ে গেছে। আমার নিজের আসন এখন আর নাই। একটি বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এতে পুরো জেলার মানুষ ক্ষুব্ধ। তারা হরতালও করেছে। আদালত রুল দিয়েছেন।”
প্রতি পাঁচ বছর পর পর সংসদীয় আসনের সীমানা পুনর্নিধারণ করতে হয় জনসংখ্যার ভিত্তিতে: ড. মোহাম্মদ আব্দুল আলীম
This browser does not support the audio element.
তার কথা, "বাগেরহাট দেশের ষষ্ঠ বৃহত্তম জেলা। এই জেলায় সীমানা পুননির্ধারণ করতে গিয়ে সংবিধান এবং আইন কোনোটাই মানা হয়নি।”
আইন অনুযায়ী দেশে প্রত্যেক আদমশুমারীর পরবর্তী জাতীয় নির্বাচনের আগে সংসদীয় আসনের সীমানা পুননির্ধারণ করা হয়, যাতে জনসংখ্যা ও ভোটের সাম্য থাকে। সর্বশেষ ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে সীমানা পুনর্নির্ধারন করা হয়েছিল। এরপর আবার এবার করা হলো। বাংলাদেশে সর্বশেষ জনগণনা হয় ২০২২ সালে । তখন দেশের জনসংখ্যা হিসাব করা হয় ১৬ কোটি ৫১ লাখ ১১ হাজার। আর বাংলাদেশে এখন ভোটার ১২ কোটি ৬১ লাখ।
নির্বাচন কমিশন সংসদীয় আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণ করে প্রথমে খসড়া প্রকাশ করে। এরপর যত অভিযোগ পড়ে, তার ওপর শুনানি হয়। শুনানি নিস্পত্তি করে এই নতুন সংসদীয় আসনের তালিকা গেজেট আকারেও প্রকাশ করা হয়েছে।
নির্বাচন বিশেষজ্ঞ এবং নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সদস্য ড. মোহাম্মদ আব্দুল আলীম ডয়চে ভেলেকে বলেন, " প্রতি পাঁচ বছর পর পর সংসদীয় আসনের সীমানা পুনর্নিধারণ করতে হয় জনসংখ্যার ভিত্তিতে। তবে আদমশুমারী না হলে তো করা যায় না। এবার সর্বশেষ আদমশুমারী ও ভোটারের ভিত্তিতে করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক নিয়ম হলো, প্রতিটি আসনের সঙ্গে যেন জনসংখ্যার সংখ্যা সাম্য থাকে। আর সেটা যেন প্লাস, মাইনাস পাঁচ শতাশের কম বা বেশি না হয়। এর সঙ্গে ভৌগোলিক সীমানা ও প্রশাসনিক ইউনিট যাতে না ভাঙে, তা-ও দেখতে হবে। এথনিক বাউন্ডারি যাতে না ভাঙে তা-ও দেখতে হবে।”
আমরা আন্দোলন আগামী ২১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত স্থগিত করেছি সর্বশেষ কী হয় তা দেখার জন্য: সৈয়দ মোদারেস আলী
This browser does not support the audio element.
তার কথা, "এবার সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব, সংস্কার সব কিছু বিবেচনায় নিয়ে নির্বাচন কমিশন কাজটি করেছে। কিন্তু যেহেতু তার ভিত্তিতে নতুন আইন এখনো হয়নি, তাই তারা পুরনো আইনের ভিত্তিতে নতুন সংস্কার প্রস্তাবগুলো মাথায় রেখে করেছে। তারপরও পুরোপুরি ত্রুটিমুক্ত হয়েছে তা আমি বলবো না। হয়তো সময় স্বল্পতার কারণে তারা পুরোপুরি ত্রুটিমুক্ত করতে পারেনি। জনসংখ্যার সাম্য আনতে বাগেরহাটে একটি আসন কমেছে, গাজীপুরে একটি কমেছে। তবে যে বিভিন্ন ইউনিয়ন কেটে অন্য আসনে নেয়া হয়েছে, এতে উপজেলার প্রশাসনিক ভাগ হয়েছে। হয়তো এগুলো এড়ানো যেতো।”
তিনি বলেন, "নির্বাচন কমিশনের এই সিদ্ধান্ত তো আদালতে চ্যালেঞ্জ করা যাবে না। কমিশনকে সেই ক্ষমতা দেয়া আছে। তবে এই সীমানা পুনর্নির্ধারণের আগে যে মানুষকে বোঝানো, তাদের সঙ্গে তথ্য বিনিয়ময়- এগুলো করা হলে এই ক্ষোভ তৈরি হতো না। এটা তো ঠিক যে, এক লাখ লোক দিয়ে একটি সংসদীয় আসনম আবার তিন লাখ লোক দিয়ে আরেকটি সংসদীয় আসন করা যায় না। এটা অসাম্য।”
নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের আরেক সদস্য ড. জাহেদ উর রহমান বলেন, "আসলে এবার সংসদীয় আসন পুনর্নির্ধারণ করা আসলেই নির্বাচন কমিশনকে চ্যালঞ্জের মুখে ঠেলে দিয়েছে। কারণ, গত ১৬-১৭ বছর ধরে তো এটা করা হয়নি। ফলে বিভিন্ন আসনের লোকজন, প্রার্থী ওই সীমানায় অভ্যস্ত হয়ে গেছে। প্রার্থীরা দীর্ঘদিন ধরে সেভাবেই ভোটারদের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করেছে। নতুন সীমানা হওয়ায় কোনো প্রার্থী ক্ষতির মুখে পড়েছেন। আবার কোনো প্রার্থী সুবিধাজনক অবস্থানে আছেন। আর বাগেরহাটে একটি আসন কমে যাওয়ায় ওখানে যারা এমপি হওয়ার আশায় ছিলেন, তারা তো বড় ক্ষতির মুখে পড়লেন। সমস্যাটা সেখানে।”
কেমন ছিল অন্তর্বর্তী সরকারের এক বছর?
13:05
This browser does not support the video element.
তবে এই নতুন করে সীমান নির্ধারণে কেউ কেউ আবার খুশি৷ দেশের কয়েকটি এলাকায় মিষ্টি বিতরণের ঘটনাও ঘটেছে। যেমন, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বিজয়নগরে ক্ষোভ দেখা দিলেও পাশের আরেকটি আসনের প্রার্থী মিষ্টি বিরতরণ করেছেন।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেন, "সীমানা পুনর্নির্ধারণের ক্ষমতা নির্বাচন কমিশনের। আইনে নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করা যাবে না বলা হলেও এটা কোনো সমস্যা নয়। যদি আইন ও সংবিধানের ব্যত্যয় ঘটে, সেটা হাইকোর্টে চ্যালেঞ্জ করে রিট করা যায়। রিটের অধিকার কখনোই বন্ধ হয় না। আর এটা সর্বোচ্চ আদালতের এখতিয়ার।”
"আর জনসংখ্যা বিবেচনা করে বিভিন্ন আসনের মধ্যে সাম্য আনতে সীমানা তো পুনর্নিধারণ করতে হয়। সেটা সব নিয়ম মেনে করলে কোনা সমস্যা হওয়ার কথা নয়,” বলেন তিনি।
নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. বদিউল আলম মজুমদারের মতে," কী সমস্যা হয়েছে তা পর্যালোচনা করে দেখা যায়। বিভিন্ন জায়গায় তো সমস্যা হচ্ছে। আন্দোলন হচ্ছে, হরতাল হচ্ছে। বাগেরহাটে তো একটি আসন নাই হয়ে গেছে। আমরা এখন সংস্কার নিয়ে কাজ করছি৷ এটা শেষ হওয়ার পর পর্যালোচনা করে দেখবো।”
নির্বাচন কমিশনের সচিব আখতার হোসেন ডয়চে ভেলেকে বলেন, " আমরা সংবিধান , আইন, নীতিমালা সব মেনে এই সীমানা পুনর্নিধারণ করেছি। প্রথমে খসড়া করা হয়েছে। তারপর যারা আপত্তি দিয়েছেন তার ওপর কমিশন শুনানি করে চূড়ান্ত নিস্পত্তি করে গেজেট প্রকাশ করেছে। এখন এটাই চূড়ান্ত।”
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, "সীমানা নির্ধারণ আইনের ৬(৩)-এ বলা হয়েছে, নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। আর ধারা ৭-এ বলা হয়েছে, এটা নিয়ে আদালতে চ্যালেঞ্জ করা যাবে না। তারপরও কয়েকটি রিট হয়েছে। রিট করা মৌলিক অধিকার। আদালত যদি কোনো সিদ্ধান্ত দেয় তা আমরা মেনে নেবো।”
যে ছয়টি বিষয়ে পরিবর্তন চান সব শ্রেণি, পেশার মানুষ
জুলাই অভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তিতে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলেছে ডয়চে ভেলে৷ দুর্নীতি, নারীবিদ্বেষ, চাঁদাবাজি, নিরাপত্তাহীনতা, বিচারহীনতা ও অনৈক্য - এই ছয়টি বিষয় নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেছেন তারা ৷ দেখুন ছবিঘরে...
ছবি: Arafatul Islam/DW
‘দুর্নীতি, বিচারহীনতা রয়ে গেছে, আমাদেরকে এসব সমস্যা দূর করতে হবে’: ফারজানা ওয়াহিদ সায়ান, সংগীতশিল্পী
২০২৪ সালের ৫ ই আগস্ট স্বৈরাচারী সরকারের পতনের আগে যে সকল সমস্যা ছিল, যেমন, দুর্নীতি, বিচারহীনতা- তার সবই রয়ে গেছে৷ আমাদেরকে এসব সমস্যা দূর করতে হবে। নির্বাচনে ফিরতে হবে, রাজনীতিতে প্রতিযোগিতা ফেরাতে হবে, বিচারব্যবস্থার প্রতি আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে। স্বৈরশাসকদের যেসকল অপরাধ ছিল তার বিচার করতে হবে।
ছবি: DW
‘যে মুক্তির স্বপ্ন দেখে নারীরাও পথে নেমেছিল, সেই মুক্তি আজ নারীবিদ্বেষী সামাজিকতার নিচে চাপা পড়ে যাচ্ছে’: ড.নাভিন মুরশিদ, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক
জুলাই অভ্যুত্থানের কাছে আমাদের প্রত্যাশা ছিল আকাশছোঁয়া। অথচ অভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় এবং হতাশাজনক যে পরিবর্তনটি আমরা দেখছি, তা হলো, তীব্র নারীবিদ্বেষ। আমার কাছে সবচেয়ে দুঃখজনক এটাই যে, যে মুক্তির স্বপ্ন দেখে নারীরাও পথে নেমেছিল, সেই মুক্তি আজ নারীবিদ্বেষী সামাজিকতার নিচে চাপা পড়ে যাচ্ছে।
ছবি: DW
‘নির্বাচিত সরকার আসলে দেশের পরিবর্তন সম্ভব হবে বলে আশা করি’: আমিরুল ইসলাম, সিএন জি চালক
জুলাই অভ্যুত্থানের ফলে দেশে কোনো পরিবর্তন আসেনি৷ আগে দেশে যে সকল সমস্যা ছিল তা এখনো রয়েছে। দেশের বিচার ব্যবস্থাকে সঠিকভাবে পরিচালিত করতে হবে। দেশে একটি সুস্থ নির্বাচন দিতে হবে। নির্বাচিত সরকার আসলে দেশের পরিবর্তন সম্ভব হবে বলে আশা করি৷
ছবি: DW
‘স্বপ্ন ক্রমশ দূরে চলে যাচ্ছে’: মীর হুযাইফা আল মামদূহ, গবেষক
শেখ হাসিনার পতনের প্রক্রিয়াতে যেভাবে মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়ে গিয়েছিল, তাতে আমাদের সবার একটা আশা তৈরি হয়েছিল যে, আমরা হয়ত এমন একটা রাষ্ট্র পাবো, যেই রাষ্ট্র কল্যাণরাষ্ট্র হবে, যাতে কেউ কোনো পরিচয়, বিশ্বাস কিংবা সংখ্যাগরিষ্ঠতা দিয়ে বিচার্য হবে না, বরং সব ছাপিয়ে নাগরিক তার মর্যাদা পাবে। কিন্তু নানা কারণেই তা আর হয়নি, সেই স্বপ্ন ক্রমশ দূরে চলে যাচ্ছে।
ছবি: DW
‘দেশের স্বার্থের চেয়ে ব্যক্তি ও দলের স্বার্থের প্রাধান্য বেশি’: সৌমিক আহমেদ, অভিনেতা ও উদ্যোক্তা
জুলাই আন্দোলনের আশা-প্রত্যাশা একটাই ছিল - পরিবর্তন আর মুক্তি। কিন্তু সাধারণ মানুষের আর পরিবর্তন হয়নি, সে একই হানাহানি, রেষারেষি যেন আমাদের রক্তে মিশে গিয়েছে। বর্তমানেও দেশের স্বার্থ থেকে ব্যক্তি ও দলের স্বার্থকে প্রাধান্য দিতে দেখা যাচ্ছে, যা মোটেও কাম্য ছিল না।
জুলাইয়ের গণভ্যুত্থান মানুষের ভেতরের দীর্ঘদিনের ক্ষোভ, বঞ্চনা ও পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা থেকেই জন্ম নিয়েছিল। কিন্তু আজ বর্ষপূর্তির আগমুহূর্তে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন উঠছে—এই আশা কতটা পূরণ হয়েছে?বাস্তবতা বলছে, সেই প্রত্যাশার অনেকটাই অপূর্ণ। ‘জুলাই স্পিরিট’ আজ বিভক্তির রাজনীতিতে ক্ষয়প্রাপ্ত। কার ভূমিকা কতটা ছিল—তা নিয়ে কৃতিত্বের লড়াই শুরু হয়েছে, যার ফলে বৈষম্যবিরোধী ঐক্যটিই ভেঙে পড়েছে।
ছবি: DW
‘চাঁদাবাজি, খুন, হত্যা বেড়েই চলেছে’: অদ্বিতীয়া, শিক্ষার্থী, ইসলামিক স্টাডিজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
শিক্ষা খাত, স্বাস্থ্য খাত তে অনিয়ম, বিশৃঙ্খলা, বিশেষ করে মানুষের নিরাপত্তার যে বিষয়টা, সেটা কোনোভাবেই এখন নিশ্চিত হচ্ছে না। প্রায় রোজ অপরাধ হয়েই যাচ্ছে, আর অপরাধীরা ধরা-ছোঁয়ার বাইরেই থেকে যাচ্ছে। চাঁদাবাজি, খুন, হত্যা বেড়েই চলেছে। কোন সমাধান হচ্ছে না বা সমাধানের কোনো সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছে না।