ইউরোপীয় দেশগুলো সীমান্তে নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণ বাড়িয়েছে৷ তাই প্রশ্ন উঠেছে, নিয়ন্ত্রণহীন ভ্রমণের প্রতিশ্রুতি নিয়ে গড়ে ওঠা শেঞ্জেন অঞ্চল, যা একসময় ইউরোপীয় ঐক্যের ‘মুকুট' হিসেবে পরিচিত ছিল, এখন কি সংকটে পড়েছে?
বিজ্ঞাপন
১৯৮৫ সালে লুক্সেমবার্গে সই হয় শেঞ্জেন চুক্তি৷ শেঞ্জেন অঞ্চলে এখন ২৫টি ইইউ দেশ ও চারটি নন-ইইউ দেশ রয়েছে৷ এর মূল নীতি হলো অবাধ চলাচল৷ কিন্তু তা এখন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি৷
লুক্সেমবার্গের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লিওন গ্লোডেন গত ১২ ডিসেম্বর ইইউ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠকে সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ পুনর্বহালের সমালোচনা করেন৷ তিনি বলেন, ‘‘লুক্সেমবার্গের জন্য এটি অগ্রহণযোগ্য৷ শেঞ্জেন ইইউর অন্যতম বৃহৎ সাফল্য৷ আমরা মানুষের মনে আবার সীমান্ত স্থাপনের অনুমতি দিতে পারি না৷''
নজিরবিহীন অভ্যন্তরীণ সীমানা নিয়ন্ত্রণ
শেঞ্জেন প্রতিষ্ঠার পর থেকে ২০২৪ সালে অভ্যন্তরীণ সীমান্তে নিয়ন্ত্রণ সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে৷ জার্মানিও এখন তার প্রতিটি সীমান্তে নিয়ন্ত্রণ কার্যকর করছে, যা আগে শুধু দক্ষিণ সীমান্তে অস্ট্রিয়ার সাথে সীমিত ছিল৷ ২০১৫ সাল থেকে জার্মানি এই সীমান্তে নিয়ন্ত্রণ চালিয়ে আসছে৷ ফ্রান্স, ২০১৫ সালের সন্ত্রাসী হামলার পর থেকে সীমিতভাবে সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ চালু করেছে, এবং সাম্প্রতিক সময়ে এটি আরও জোরদার করা হয়েছে৷
সম্প্রতি, নেদারল্যান্ডসও জার্মানি ও বেলজিয়ামের সাথে তাদের সীমান্তে নিয়ন্ত্রণ শুরু করেছে৷৷ এর পাশাপাশি, ৯ ডিসেম্বর ইইউ সিদ্ধান্ত নিয়েছে বুলগেরিয়া ও রোমানিয়াকে পূর্ণাঙ্গ শেঞ্জেন সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার৷ তবে, ইউরোপীয় কমিশন বারবার জোর দিয়ে বলছে, অভ্যন্তরীণ সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ ‘একেবারে শেষ উপায়' হওয়া উচিত৷ তবু কয়েকটি দেশ এই নিয়ন্ত্রণকে এক দশক পর্যন্ত বাড়িয়ে রেখেছে৷
জার্মান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ন্যান্সি ফেজার চলমান নিয়ন্ত্রণের সপক্ষে যুক্তি দিয়েছেন যে অভিবাসনের উচ্চ সংখ্যা এর কারণ৷ তিনি বলেন, ‘‘যতদিন জার্মানিতে (অভিবাসীর) সংখ্যা এত বেশি থাকবে, ততদিন নিয়ন্ত্রণ অব্যাহত থাকবে৷'' তিনি আরও বলেন, ‘‘শেঞ্জেন অঞ্চল জার্মানির জন্য গুরুত্বপূর্ণ, তবে শরণার্থীদের সমান বণ্টনও প্রয়োজন৷''
নিরাপত্তা বনাম মুক্ত চলাচল
ইইউর নতুন অভ্যন্তরীণ বিষয়ক ও অভিবাসন কমিশনার অস্ট্রিয়ার মাগনুস ব্রুনার সমস্যাগুলো স্বীকার করেছেন৷ তিনি বলেন, ‘‘আমাদের ইউরোপীয় অঞ্চলের নিরাপত্তা উন্নত করতে হবে৷'' তবে শেঞ্জেনের আইনি কাঠামো মেনে চলার ওপরও তিনি জোর দেন৷
যখন শেঞ্জেন ২০২৫ সালে তার ৪০তম বার্ষিকী উদযাপন করতে প্রস্তুতি নিচ্ছে, তখন সীমান্তহীন ইউরোপের স্বপ্ন বড় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি৷ এই টানাপোড়েন সমাধান হবে কিনা তা এখনও অনিশ্চিত, যা ইইউর অন্যতম মূল্যবান অর্জনকে একটি প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়েছে৷
ব্যর্ন্ডট রিগার্ট/জেডএ/এআই
অনিয়মিত অভিবাসন ঠেকাতে ইইউর যত পদক্ষেপ
অনিয়মিত অভিবাসীদের আগমন ঠেকাতে তৎপর ইউরোপীয় ইউনিয়ন৷ জোটগত সিদ্ধান্তের পাশাপাশি সদস্য রাষ্ট্রগুলো নিজেদের মতো করেও নানা পদক্ষেপ নিচ্ছে৷
ছবি: picture-alliance/NurPhoto/N. Economou
অনিয়মিত পথে অভিবাসীদের ঢল
ক্ষুধা, দারিদ্র্য, সংঘাত ও যুদ্ধ থেকে পালিয়ে উন্নত জীবনের আশায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ইউরোপ পাড়ি জমাতে চান আফ্রিকা, এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের নানা প্রান্তের মানুষ৷ ইউরোপীয় বর্ডার অ্যান্ড কোস্ট গার্ড এজেন্সি (ফ্রন্টেক্স) এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, বছরের প্রথম আট মাসে মোট এক লাখ ৩৯ হাজার ৮৪৭টি অনিয়মিত সীমান্ত পারাপারের প্রচেষ্টা নথিভুক্ত করা হয়েছে৷
ছবি: Europa Press/ABACA/picture alliance
নানামুখী পদক্ষেপ
অনিয়মিত পথে আসা অভিবাসনপ্রত্যাশীদের ঠেকাতে নানা পরিকল্পনা করছে ইউরোপের দেশগুলো৷ যুক্তরাজ্য ও ইটালি এরই মধ্যে তৃতীয় বা ইউরোপের বাইরের কোনো দেশে অভিবাসনপ্রত্যাশীদের আবেদন যাচাই-বাছাইয়ের পদক্ষেপ নিয়েছে৷ তবে আদালতের বাধার মুখে তাদের পরিকল্পনা এখনো আলোর মুখ দেখেনি৷ অনিয়মিত অভিবাসীদের নিয়ন্ত্রণে জার্মানি, ডেনমার্ক, অস্ট্রিয়ার মতো ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশেও এমন পরিকল্পনা নেয়া হচ্ছে৷
ছবি: Attila Husejnow/ZUMA Press Wire/IMAGO
ইটালির আলবেনিয়া পরিকল্পনা
ভূমধ্যসাগর তীরের এই দেশটিতে এশিয়া ও আফ্রিকার হাজার হাজার অভিবাসনপ্রত্যাশী প্রতিবছর সমুদ্র পাড়ি দিয়ে হাজির হন৷ ইটালির জর্জা মেলোনির নেতৃত্বাধীন রক্ষণশীল সরকার অভিবাসীদের এই স্রোত সামলাতে নানা পদক্ষেপ নিচ্ছে৷ এর অংশ হিসেবে আলবেনিয়ার সাথে চুক্তি করেছে দেশটি৷ এরইমধ্যে গত ১৩ অক্টোবর সাগর থেকে উদ্ধার হওয়া ১০ বাংলাদেশি ও ৬ মিশরীয়কে আলবেনিয়াতে পাঠানো হয়েছে৷
ছবি: Florion Goga/REUTERS
যুক্তরাজ্যের রুয়ান্ডা পরিকল্পনা
অনিয়মিত পথে ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিয়ে যুক্তরাজ্যে আশ্রয় নিতে চাওয়া অভিবাসনপ্রত্যাশীদের আবেদন যাচাই-বাছাইয়ের জন্য আফ্রিকার দেশ রুয়ান্ডার সাথে চুক্তি করেছিলেন যুক্তরাজ্যের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক৷ তবে রাজনৈতিক দলগুলোর বিরোধিতার মুখে এবং আদালতের নিষেধাজ্ঞায় শেষ পর্যন্ত বাতিল হয়ে যায় ওই চুক্তি৷
যুক্তরাজ্য ও ইটালির মতো তৃতীয় কোনো দেশে অনিয়মিত অভিবাসনপ্রত্যাশীদের আবেদন যাচাই-বাছাই নিয়ে নিজেদের পরিকল্পনার কথা জানায় ইউরোপের আরেক দেশ অস্ট্রিয়া৷ ইউরোপের অন্যান্য দেশগুলোকে উৎসাহী করতে আলোচনা শুরুর কথাও জানান দেশটির চ্যান্সেলর কার্ল নেহামের ৷ ইউনিয়নের ১৪টি দেশ এই পরিকল্পনায় সমর্থন দেয়৷
ছবি: JOHN THYS/AFP
কঠোর অবস্থানে ডেনমার্ক
অ-নথিভুক্ত অভিবাসীদের আবেদন যাচাই-বাছাই তৃতীয় কোনো দেশে করার কথা স্ক্যান্ডিনেভিয়ার দেশ ডেনমার্কও ভাবছে৷ এই লক্ষ্যে অস্ট্রিয়ার সাথে মিলে ইউরোপীয় ইউনিয়নকে চিঠিও দিয়েছে দেশটি৷
প্রত্যাখ্যাত আশ্রয়প্রার্থীদের ডিপোর্ট করা বা নিজ দেশে ফেরত পাঠানোর বদলে আফ্রিকার দেশ উগান্ডায় পাঠানোর কথা ভাবছে নেদারল্যান্ডস৷ ১৬ অক্টোবর দেশটির বৈদেশিক বাণিজ্য বিষয়ক মন্ত্রী টেলিভিশন চ্যানেল এনওএস-কে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে এ কথা বলেছেন৷ পরিকল্পনা অনুযায়ী, প্রত্যাখ্যাত আশ্রয়প্রার্থীদের অভ্যর্থনা শিবিরে স্থান দেবে উগান্ডা৷ সেখানে তাদেরকে আর্থিক ক্ষতিপূরণও দেয়া হবে৷
ছবি: Remko de Waal/ANP/IMAGO
সীমান্ত নজরদারিতে জার্মানি
১৬ সেপ্টেম্বর থেকে নয়টি প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে থাকা সব স্থল সীমান্তে নিয়ন্ত্রণ শুরু করেছে জার্মান পুলিশ৷ ছয় মাসের এই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে দেশটি অনিয়মিত অভিবাসন ও আন্তঃসীমান্ত অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করতে চায়৷ এই সিদ্ধান্তের আলোকে লুক্সেমবুর্গ, বেলজিয়াম, নেদারল্যান্ডস ও ডেনমার্ক সীমান্তে জার্মান পুলিশ নজরদারি শুরু করছে৷ এর আগেও সীমান্তে এমন কড়াকড়ি শুরু হয়েছিল৷
ছবি: Christoph Hardt/Panama Pictures/IMAGO
ভিন্ন চিন্তা ফ্রান্সের
ফ্রান্স অবশ্য ইটালি বা যুক্তরাজ্যের মতো কোনো পরিকল্পনা করছে না বলে জানা গেছে৷ দেশটির প্রধানমন্ত্রী মিশেল বার্নিয়ের এরই মধ্যে এমন ইঙ্গিত দিয়েছেন৷ তবে ফ্রান্স সরকার অভিবাসীদের ট্রানজিট দেশগুলোর সঙ্গে, অর্থাৎ যেই পথ ধরে অভিবাসনপ্রত্যাশীরা যাত্রা করেন ওই দেশগুলোর সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করতে চায়৷
ছবি: Christopher Furlong/Getty Images
টিউনিসিয়ার সাথে ইউরোপের চুক্তি
অনিয়মিত পথে অভিবাসন থামাতে যাত্রা পথেই তাদেরকে আটকে দিতে চায় ইইউ৷ এই লক্ষ্যে উত্তর আফ্রিকার দেশ টিউনিশিয়ার সাথে একটি চুক্তিও স্বাক্ষর করেছে ইউনিয়ন৷ চুক্তি অনুযায়ী, ইইউর সহযোগিতায় ঝুঁকিপূর্ণ এসব যাত্রা আটকে দিতে কাজ করছে টিউনিশিয়ার আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী৷ চলতি বছর ইইউ-র সঙ্গে যৌথ সহযোগিতার ফলে টিউনিশিয়ার উপকূলরক্ষীরা অভিবাসীদের বহনকারী প্রায় ২৪ হাজার নৌকা আটকে দিয়েছে৷