বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে প্রাণহানির খবর মাঝেমাঝেই চোখে পড়ে৷ সব মৃত্যু হয়ত ফেলানী হত্যাকাণ্ডের মতো আলোড়ন তোলে না, কিন্তু তাই বলে হত্যা থেমে নেই৷ প্রশ্ন হচ্ছে, কিভাবে থামানো যেতে পারে সীমান্ত হত্যা?
বিজ্ঞাপন
সেই ২০০৪ সালের কথা৷ কলকাতায় এক তথ্য-প্রযুক্তি মেলায় যাওয়ার নিমন্ত্রণ পেলাম৷ আমরা কয়েকজন সাংবাদিক সড়কপথে রওয়ানা হই৷ রাতে ঢাকা ছেড়ে খুব ভোরে বেনাপোল পৌঁছালাম বাসে৷ দুই দেশের সীমান্তের মধ্যকার কিছু অংশ পার হতে হয় পায়ে হেঁটে৷ তখন সীমান্তের দুই পাশে মরণাস্ত্র হাতে থাকা সীমান্তরক্ষীদের দেখলে ভয় হয়, পা চলতে চায় না৷ সাহস করে সেই অংশটুকু পার হয়ে ভারতের সীমান্তে পৌঁছানোর পর নানা প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছিল৷ কেন যাচ্ছি? কতদিন থাকবো? কত টাকা সঙ্গে আছে? ফেরার নিশ্চয়তা কী? এরকম নানা প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়েছে৷ সব প্রশ্ন মনেও নেই৷ সীমান্তের সেই নিরাপত্তা চৌকি পার হবার পর অবশ্য আর কোনো ঝামেলা পোহাতে হয়নি৷ বরং ভালো লেগেছে ভারতীয় বাঙালিদের সান্নিধ্য৷
ভারতের সিদ্ধান্তে সমস্যায় বাংলাদেশ
বাংলাদেশের মানুষ যেন গরুর মাংস খাওয়া ছেড়ে দেয় সেজন্য ভারত থেকে বাংলাদেশ গরু পাচার সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করতে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সদস্যদের নির্দেশ দিয়েছেন সে দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী৷
ছবি: S. Rahman/Getty Images
সীমান্তরক্ষীদের নতুন দায়িত্ব
ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের ২,২১৬ কিলোমিটার সীমান্ত পাহারা দেয়ায় নিয়োজিত প্রায় ৩০ হাজার ভারতীয় সৈন্যকে নতুন দায়িত্ব দেয়া হয়েছে৷ সেটা হলো, ভারতীয় গরু যেন কোনোভাবেই বাংলাদেশে পৌঁছতে না পারে৷ ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বিএসএফ সদস্যদের এই নির্দেশ দেন যেন ‘বাংলাদেশের মানুষ গরুর মাংস খাওয়া ছেড়ে দেয়’৷
ছবি: Str/AFP/Getty Images
গরু পবিত্র
হিন্দুদের কাছে গরু একটি পবিত্র প্রাণী৷ তাই ভারতের হিন্দুত্ববাদী বিজেপি সরকার গরুর মাংস খাওয়া নিষিদ্ধ করতে চায়৷ রাষ্ট্রীয় স্বেচ্ছাসেবক সংঘ আরএসএস এর পশ্চিমবঙ্গের মুখপাত্র বলেছেন, ‘‘গরু জবাই কিংবা চোরাই পথে চালান, আর হিন্দু মেয়েকে ধর্ষণ করা বা হিন্দু মন্দির ধ্বংস করা একই কথা৷’’
ছবি: Shaikh Azizur Rahman.
চার যুগের ইতিহাস
ভারত থেকে চোরাই পথে আসা গরুই এতদিন বাংলাদেশের মানুষের মাংসের প্রধান উৎস ছিল৷ গত চার দশক ধরে সেটা হয়ে আসছে৷ এর সঙ্গে প্রায় ৬০০ মিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য জড়িয়ে আছে৷
ছবি: Shaikh Azizur Rahman.
দাম বেড়ে গেছে
বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় গরুর মাংস রপ্তানিকারক বেঙ্গল মিট এর সৈয়দ হাসান হাবিব গত জুলাই মাসে রয়টার্সকে জানান, ভারতের এই সিদ্ধান্তের কারণে বাংলাদেশে গরুর মাংসের দাম প্রায় ৪০ শতাংশ বেড়ে গেছে৷ আর মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে তাঁর কোম্পানির মাংস রপ্তানি প্রায় ৭৫ শতাংশ কমে গেছে৷
ছবি: picture-alliance/Asia News Network/Jofelle P. Tesorio
চাকরি হারিয়েছে প্রায় ৪,০০০
বাংলাদেশ ট্যানারস অ্যাসোসিয়েশন এর প্রেসিডেন্ট শাহীন আহমেদ জানিয়েছেন, জুন পর্যন্ত চামড়া শিল্পে কর্মরত প্রায় চার হাজার কর্মীর চাকরি গেছে৷ আর ১৯০টি ট্যানারির মধ্যে ৩০টি সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে গেছে৷
ছবি: Shaikh Azizur Rahman
ভারতীয় গরুর মাংস ভালো
বেঙ্গল মিট এর সৈয়দ হাসান হাবিব বলেন, তিনি এখন নেপাল, ভুটান ও মিয়ানমার থেকে মাংস আমদানির চিন্তা করছেন৷ কিন্তু ভারতীয় মাংস ও চামড়ার মান ভালো বলে জানান তিনি৷ উল্লেখ্য, ভারত গরুর মাংসের সবচেয়ে বড় রপ্তানিকারক৷
ছবি: AFP/Getty Images
ভারতের সিদ্ধান্ত বলবৎ থাকবে
ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা রয়টার্সকে বলেছেন মাংসের জন্য বাংলাদেশকে নতুন উৎস খুঁজে বের করতে হবে কেননা ভারত তার সিদ্ধান্তে অটল থাকবে৷
ছবি: S. Rahman/Getty Images
7 ছবি1 | 7
ভারতে এরপর যাওয়া হয়েছে আরো কয়েকবার, কখনো সড়ক পথে, কখনো আকাশপথে৷ সড়ক পথের অভিজ্ঞতা সবসময় একই রকম৷ ইউরোপে না আসলে হয়ত বুঝতামই না সড়ক পথে সীমান্ত পারাপারের ব্যাপারটি বাংলাদেশ-ভারত সীমানার মতো জটিল নয়৷ ইউরোপের শেঙেনভুক্ত কয়েকটি দেশে গিয়েছি সড়কপথে৷ কখন যে সীমান্ত পার হয়ে গেছি টের পাইনি৷ মাঝে মাঝে রাস্তার পাশে সাইনবোর্ড বা মোবাইল ম্যাসেজ দেখে বুঝেছি জার্মানি থেকে অন্য দেশে চলে গেছি৷ এমনটা বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের বা মিয়ানমারের সীমান্তে কল্পনা করাও অসম্ভব৷
বলছি না, শুধুমাত্র এই দুই দেশের সীমান্তেই কড়াকড়ি৷ বিশ্বের আরো অনেক দেশের সীমান্তে কড়াকড়ি আছে, থাকবে৷ কিন্তু হতাশার জায়গাটা হচ্ছে, বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে অসংখ্য প্রাণহানি৷ এই দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কটা দীর্ঘদিনের, বন্ধুত্বের৷ দুই দেশের অনেক পরিবার একসময় ছিলেন একত্রে, দেশভাগের পর ধীরে ধীরে তাদের মধ্যে জেগে উঠেছে কাটাতারের বেড়া৷ বৈধ, অবৈধ পথে সেই বেড়া ডিঙাতে হয় অনেকের জীবনের প্রয়োজনে৷ তাই বলে কি তাদের পাখির মতো গুলি করে মারতে হবে?
গত কয়েকবছরে সীমান্তে প্রাণ হারিয়েছেন সহস্রাধিক নিরস্ত্র মানুষ৷ এদের প্রায় সবাই নিহত হয়েছেন ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনী বিএসএফ-এর হাতে৷ অন্যদিকে, বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবি-র গুলিতে কোনো ভারতীয় নাগরিকের প্রাণহানির খবর গত কয়েক বছরে শুনেছি বলে মনে পড়ছে না৷ তাই সীমান্তে গুলির বিষয়টি আমার কাছে একপাক্ষিক মনে হচ্ছে৷ বিএসএফ সেটা করছে নির্বিচারে৷ ভাবটা এমন, তাদের জবাবদিহিতার কোনো জায়গা নেই, প্রয়োজনও নেই৷
একাধিক মানবাধিকার সংগঠন মনে করে, সীমান্তে কোনো রকম পূর্ব ঘোষণা বা সতর্ক না করেই বিএসএফ গুলি চালায়৷ এমনকি যেসব ক্ষেত্রে কোনো রকম মরণাস্ত্র ব্যবহারের কোনো প্রয়োজন নেই, সেসব ক্ষেত্রেও তা ব্যবহার করছে সীমান্তরক্ষীরা৷ আর শুধু গুলি নয়, সীমান্ত পারপারের চেষ্টা করায় পিটিয়ে মারার ঘটনাও বিএসএফ ঘটিয়েছে বেশ কয়েকবার৷ বাংলাদেশ যে ভারতের একটি বন্ধুপ্রতীম রাষ্ট্র, সেটা বিএসএফ-এর আচরণ থেকে বোঝার কোনো উপায় নেই৷
আমি বলছি না, বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত ইউরোপের দেশগুলোর মতো খুলে দেয়া হোক৷ সেটা অলিক কল্পনা৷ বরং কেউ অবৈধ পথে সীমান্ত পাড়ি দিতে চাইলে তাকে গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনা যেতেই পারে৷ তবে তাদের বিচারের দায়িত্ব কোনোভাবেই সীমান্তরক্ষীদের নয়৷
বাংলাদেশ এবং ভারতের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রক্ষায়, এগিয়ে নিতে সীমান্ত হত্যা বন্ধ করতে হবে এক্ষুনি৷ এ জন্য যেসব কারণে মানুষ অবৈধপথে সীমান্ত পার হচ্ছে, সেগুলো চিহ্নিত করে সমাধানের চেষ্টা করতে হবে৷ যেসব পণ্য বৈধভাবে আমদানি, রপ্তানি করা যায়, সেগুলো অবৈধভাবে করা বন্ধ করতে হবে৷ প্রয়োজনে নীতিগত পরিবর্তন আনা যেতে পারে৷ যারা নিয়মিত দু'দেশের মধ্যে যাতায়াত করেন, কাজ করতে চান, তাদের জন্য একাধিকবার ব্যবহার উপযোগী দীর্ঘমেয়াদের ভিসা সহজলভ্য করতে হবে৷ সবচেয়ে বড় কথা, সীমান্তরক্ষীদের মরণাস্ত্র ব্যবহার থেকে দূরে রাখতে হবে৷ আর যারা নির্বিচারে গুলি করে, তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে৷
আপনারও কি এমন অভিজ্ঞতা আছে? লিখে জানান আমাদের, নীচের ঘরে৷
বিশ্বের কয়েকটি বিপজ্জনক সীমান্ত
দুই দেশের মধ্যে সীমানা নিয়ে যুদ্ধ কিংবা উন্নত জীবনের আশায় এক দেশের নাগরিকের প্রতিবেশী দেশে যাওয়া – ইত্যাদি কারণে বিশ্বের কয়েকটি সীমান্ত বিপজ্জনক বলে পরিচিত৷ ছবিঘরে থাকছে সেগুলোর কথা৷
ছবি: picture alliance/AP Photo
ভারত-পাকিস্তান সীমান্ত
এই সীমান্তের ৪০টি ‘স্পর্শকাতর’ অংশে ‘লেজার’-এর বেড়া দেয়া হবে বলে জানিয়েছে ভারত৷ পাকিস্তান থেকে ভারতে অবৈধ প্রবেশ ঠেকাতে এই ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে৷ এর ফলে বেড়ার সংস্পর্শে কিছু আসলে উচ্চস্বরে সাইরেন বেজে উঠবে৷ ২০১১ সালের জুনে ‘ফরেন পলিসি’ ম্যাগাজিনে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১৮০০ মাইল দীর্ঘ এই সীমান্তে নিহত হয়েছে এক লক্ষ ১৫ হাজারের বেশি মানুষ৷ প্রতিবেদনটি পড়তে উপরে ‘+’ চিহ্নে ক্লিক করুন৷
ছবি: Arif Ali/AFP/Getty Images
বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাব অনুযায়ী, ২০১৫ সালে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে বিএসএফ এর হাতে ৪৬ জন বাংলাদেশি নিহত হয়েছে৷ আহত হয়েছে ৭৩ জন৷ এছাড়া অপহরণ করা হয়েছে ৫৯ জনকে৷ কয়েক সপ্তাহ আগে ভারতের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং অবৈধ অনুপ্রবেশ বন্ধ করতে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত শিগগিরই বেড়া দেয়ার কাজ শেষ করার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে বলে জানান৷
ছবি: Str/AFP/Getty Images
যুক্তরাষ্ট্র-মেক্সিকো সীমান্ত
উন্নত জীবনের আশায় মেক্সিকো থেকে প্রতিবছর অনেক মানুষ যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি দেয়ার চেষ্টা করেন৷ আর তা করতে গিয়ে প্রাণ যায় অনেকের৷ আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা আইওএম-এর ২০১৪ সালে প্রকাশিত প্রতিবেদন বলছে, গত ১৪ বছরে যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণাঞ্চলের সীমান্ত পাড়ি দিতে গিয়ে ৬,০০০ এর বেশি লোক নিহত হয়েছে৷ প্রতিবেদনটি পড়তে উপরে ‘+’ চিহ্নে ক্লিক করুন৷
ছবি: Gordon Hyde
ভূমধ্যসাগর
যুদ্ধ আর সংঘাত এড়াতে মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ থেকে ইউরোপে শরণার্থী প্রবেশ করছে৷ এদের একটি বড় অংশ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সাগরপথে ইউরোপে ঢোকার চেষ্টা করে৷ এতে প্রাণ যায় অনেকের৷ জার্মান ম্যাগাজিন ‘ডেয়ার স্পিগেল’ গত অক্টোবরে এক প্রতিবেদনে ভূমধ্যসাগরকে বিশ্বের সবচেয়ে প্রাণঘাতী সীমান্ত বলে আখ্যা দেয়৷ ২০১৫ সালে ভূমধ্যসাগরে নিহতের সংখ্যা ছিল ৩,৭৭০৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/S. Palacios
আফগানিস্তান-পাকিস্তান সীমান্ত
প্রায় দেড় হাজার মাইল দীর্ঘ ‘ডুরান্ড লাইন’ নামে পরিচিত সীমান্ত এখনও মেনে নেয়নি আফগানিস্তান৷ পাকিস্তানের খাইবার-পাখতুনখা রাজ্যের পশতুন অধ্যুষিত এলাকা নিজেদের বলে দাবি করে আফগানিস্তান৷ এই সীমান্তকে ঘিরে দুই দেশের সামরিক বাহিনীর মধ্যে গুলি বিনিময়ের ঘটনা প্রায়ই ঘটে থাকে৷
ছবি: Reuters
উত্তর কোরিয়া-দক্ষিণ কোরিয়া
বিশ্বের সবচেয়ে সামরিক সজ্জায় সজ্জিত সীমান্ত বলা হয় একে৷ ১৯৫৩ সালে কোরিয়া যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর প্রায় দেড়শো মাইল দীর্ঘ এই সীমান্তের দুই পাশ থেকে সৈন্যদের সরিয়ে দেয়া হয়৷ তখন থেকেই দুই দেশের সৈন্যরা প্রায় আড়াই মাইল প্রশস্ত এই সীমান্তের দুই পাশে অবস্থান করছে৷