বাংলাদেশের তিনদিকে ভারতের সীমান্ত৷ প্রায়ই ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ-এর গুলিতে জীবন দিতে হয় বাংলাদেশিদের৷ দুই দেশের শীর্ষ নেতারা সীমান্ত হত্যা শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনার কথা বললেও, তা শুধু আলোচনাতেই সীমাবদ্ধ রয়েছে৷
বিজ্ঞাপন
কেন সীমান্তে হত্যা বন্ধ করা যাচ্ছে না? বাংলাদেশ সরকারের এক্ষেত্রে কোনো শৈথিল্য আছে কি? শুধু অর্থনৈতিক অসচ্ছলতার কারণেই কি সীমান্ত এলাকার মানুষ রাতের আধাঁরে অবৈধ মালামাল এপার-ওপার আনা-নেয়া করেন? কী করলে সীমান্ত এলাকার মানুষদের এই অবৈধ কর্মকাণ্ড থেকে নিবৃত্ত করা যাবে? ডয়চে ভেলের সঙ্গে আলাপকালে এ সব বিষয় নিয়ে খোলামেলা কথা বলেন ভারতে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবীর৷ দু'বার ভারতের কলকাতা মিশনে দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি৷ প্রথমবার, ১৯৯১ থেকে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত প্রথম সচিব আর দ্বিতীয়বার, ১৯৯৯ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন ডেপুটি হাইকমিশনার৷ এছাড়া যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, নেপালসহ বিভিন্ন দেশে রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করেছেন বাংলাদেশের এই প্রবীণ কূটনীতিক৷
ডয়চে ভেলে: আপনি তো বিভিন্ন দেশে রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন৷ কলকাতা মিশনেও আপনি ডেপুটি হাইকমিশনার ছিলেন৷ তা বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে কেন আমরা এ ধরনের ‘হত্যার ঘটনা' বন্ধ করতে পারছি না? আন্তরিকতা দু'দেশেরই আছে৷ কিন্তু তার ফল আসে না কেন?
হুমায়ুন কবীর
হুমায়ুন কবীর: আমার মনে নয়, এক্ষেত্রে দু-একটা বিষয় কাজ করে৷ প্রথম হলো – নীতিগত পর্যায় থেকে আমরা চাই এ ধরনের ঘটনা না ঘটুক৷ এটাকে শূন্যের কোঠায় নিয়ে আসতে সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে আমরা প্রতিশ্রুতিও পাই৷ কিন্তু তা কাজে লাগে না৷ অর্থাৎ প্রতিশ্রুতি আর কাজের মধ্যে একটা তফাৎ আমরা দেখি৷ এর কারণ একটা হতে পারে যে, সীমান্তে যে ধরনের কর্মকাণ্ড চলে তা নিয়ে দুই পাশেই এক ধরনের নেতিবাচক ধারণা কাজ করে৷ এই ধরনের ঘটনা যে ঘটে, সেটা অধিকাংশ সময় রাতেরবেলায় ঘটে৷ ভারতীয় দিক দিয়ে বলা হয়, তারা মাঝে মধ্যে আক্রমণের শিকার হন৷ আমি জানি না এটা কতটা সত্য৷ কিন্তু আমার মনে হয়, ওদিকে এক ধরনের ‘নার্ভাসনেস' কাজ করে৷ বিএসএফ-এর যারা সীমান্তে পাহাড়া দেন তারা অনেক সময় ভীত থাকেন, যে কারণে খুব সহজেই তারা ‘কিলিংয়ে' যান৷ সীমান্তে যদি কোনো অন্যায় ঘটে, সেটা দেখার জন্য দু'দেশের মধ্যে ব্যবস্থা আছে৷ গ্রেপ্তার করা যেতে পারে, অন্যান্য ব্যবস্থাও নেয়া যায়৷ তাই আমার মনে হয়, কিলিংয়ের মতো চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে যাওয়াটা আসলে নার্ভাসনেস-এর ফলে৷
আরেকটা বিষয় হলো, এ ধরনের ঘটনাটা বেশি ঘটছে ২০০১ সালের পর থেকে৷ অর্থাৎ বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে সে সময় যে উত্তেজনা তৈরি হয়েছিল, তখন থেকে৷ তাছাড়া বিএসএফ-এ যাদের আনা হয়, তাদের অনেকেই এই অঞ্চলের ভাষা ও সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত না৷
এছাড়া তৃতীয়ত যে কারণটি হতে পারে সেটা হলো, স্থানীয় পর্যায়ে এমন কোনো বিষয় আছে যে কারণে নীতিগত পর্যায় থেকে বারবার বলার পরও সীমান্তে নিয়ন্ত্রণ আনা যাচ্ছে না৷
তাঁরা এখন স্বাধীন দেশের নাগরিক
৬৮ বছর পর বাংলাদেশের কিছু জায়গা সত্যি সত্যি বাংলাদেশের হলো৷ ভারতের ভেতরের কিছু জায়গাও হয়েছে ‘ভারত’৷ প্রায় সাত দশক রাষ্ট্র পরিচয়হীন থাকা ছিটমহলবাসীদের অবশেষে নাগরিক হয়ে ওঠার আনন্দ নিয়েই আজকের ছবিঘর৷
ছবি: picture-alliance/ZUMA Press/S. Islam
উড়ল পতাকা
২০১৫ সালের ১ আগস্টের প্রারম্ভেই ভারতের ১১১টি ছিটমহল বাংলাদেশের মানচিত্রের অংশ হয়ে গেল৷ দিনটিকে উৎসবের আনন্দে উদযাপন করা হয়৷ বাংলাদেশের অংশে ওড়ে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা আর ভারতে ওড়ানো হয় ভারতীয় পতাকা৷ ছবিতে কুড়িগ্রামের দাশিয়ারছরা উপজেলায় বাংলাদেশের পতাকা ওড়াচ্ছেন উপজেলার নির্বাহি কর্মকর্তা মো. নাসির উদ্দীন আহমেদ (মাথায় সাদা টুপি)৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo
স্মরণীয় মুহূর্ত
জাতীয় পতাকা ওড়ানোর পর শুরু হয় অন্যান্য আনুষ্ঠানিকতা৷ কুড়িগ্রামের দাশিয়াছরার এ নারী জীবনে এই প্রথম উপলব্ধি করলেন স্বাধীন সার্বভৌম দেশের নাগরিক হওয়ার আনন্দ৷ মোমবাতি জ্বালিয়ে উদযাপন করা মুহূর্তটি নিশ্চয়ই তাঁর জীবনে স্মরণীয় হয়ে থাকবে৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo
আগুনের পরশ
বাংলাদেশের পঞ্চগড়, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম ও নিলফামারী – এই চার জেলায় ভারতের ১৭ হাজার ১৬০ একর আয়তনের ১১১টি ছিটমহল এবং ভারতে বাংলাদেশের ৭ হাজার ১১০ একর আয়তনের ৫১টি ছিটমহলের ৫১ হাজার ৫৪৯ মানুষ এখন স্বাধীন দেশের নাগরিক৷ দাশিয়াছরায় আগুন জ্বালিয়ে মুহূর্তটি উদযাপন করা হয়৷
ছবি: picture-alliance/ZUMA Press/S. Islam
পঞ্চগড়ে উৎসব
৬৮ বছরের অবর্ণনীয় কষ্ট থেকে মুক্তির মুহূর্তে পঞ্চগড়ের ছিটমহলবাসীরাও হাতে তুলে নিয়েছিলেন প্রজ্বলিত মোমবাতি৷
ছবি: picture-alliance/ZUMA Press/S. Islam
বাড়ল নাগরিক
বাংলাদেশ ও ভারতের অংশের ১৬২টি ছিটমহলের ৫১ হাজার ৫৪৯ জন অধিবাসীর মধ্যে এতদিন ৩৭ হাজার ৩৩৪ জন ‘ভারতীয়’ বাংলাদেশের ছিটমহলগুলোতে এবং ১৪ হাজার ২১৫ জন ‘বাংলাদেশি’ ভারতের ছিটমহলগুলোতে বাস করেছেন৷ এ পর্যন্ত ৯৭৯ জন ভারতে চলে যাওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন বলে জানা গেছে৷ তারপরও বাংলাদেশের আয়তন এবং জনসংখ্যা বেড়েছে৷
ছবি: picture-alliance/ZUMA Press/S. Islam
‘শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান’ এবং একটি প্রশ্ন
সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়ন নিঃসন্দেহে দু’দেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের নিদর্শন৷ তারপরও বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত পুরোপুরি ‘শান্তিময়’ হবে এমন নিশ্চয়তা কি আছে? ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীবাহিনী বিএসএফ-এর গুলিতে সীমান্তে নিরীহ মানুষ হত্যা কি থামবে? প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে...৷
ছবি: Getty Images/G. Crouch
6 ছবি1 | 6
আমাদের সরকারের কি কোনো শৈথিল্য আছে? রাতেরবেলায় যে ঘটনাগুলো ঘটছে, যেটাকে আমরা চোরাচালান বা অনিয়মিত কাজ বলি, সেটা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হচ্ছে না কেন? কেন আজও আমাদের সীমান্ত এলাকার মানুষদের এপার-ওপার হতে গিয়ে জীবন দিতে হচ্ছে?
আমি আসলে সরকারের শৈথিল্য বলবো না৷ আসলে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত বলুন বা ভারত-মিয়ানমার সীমান্ত – আমাদের এই এলাকায় সীমান্ত এলাকার মানুষ অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল৷ ফলে বিভিন্ন ধরনের অনিয়মিত কর্মকাণ্ড ঘটে থাকে এ সব সীমান্তে৷ তাই এই এলাকাগুলোকে আমরা যদি আর্থিকভাবে সচল করতে পারতাম বা আকর্ষণীয় করতে পারতাম, তাহলে সীমান্তের উভয় পাড়ে যে অনিয়মিত কাজগুলো হয় সেগুলোকে বন্ধ করা যেত৷
আপনি নিজে যখন কলকাতার ডেপুটি হাইকমিশনার ছিলেন, তখনও নিশ্চয় এই বিষয়গুলো সরকারের নজরে এনেছেন? সরকারকে জানিয়েছে যে, আমাদের সীমান্ত এলাকার মানুষ দরিদ্র৷ তারা আসলে আর্থিক কারণেই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এপার-ওপার করে অনৈতিক কাজগুলো করছে৷ এক্ষেত্রে সরকারের মনোযোগ আকর্ষণ কি করা যায়নি?
সেটা তো বরাবরই করা হয়েছে৷ এই ধরনের কর্মকাণ্ড যাতে না ঘটে, সরকারি পর্যায় থেকে সেটা সবসময়ই চাওয়া হয়৷ আমরাও চেয়েছি৷ ভবিষ্যতে যারা আসবেন তারাও চাইবেন৷ তবে একটা জিনিস মনে রাখতে হবে৷ আমাদের এখানে সীমানাগুলো এমনভাবে চিহ্নিত হয়েছ যে, দু'পাশেই মানুষের বাস৷ ঐতিহাসিকভাবে এ সব এলাকায় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড আগেও চলেছে, এখনও চলছে৷ অনেকক্ষেত্রে নিয়মিত কর্মকাণ্ডও চলেছে৷ এটা নিয়ন্ত্রণে আনা, আমার মনে হয়, সরকারের ক্ষমতারও বাইরে৷ সরকার তো প্রত্যেকটা মানুষকে পাহাড়া দিতে পারে না৷ তাছাড়া মানুষ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয় তার নিজের প্রয়োজনে৷
এর সাধাধান কী? আসল ঘাটতিটা কোথায়? দুর্বলতাটাই বা কোনখানে?
গত দু'বছর ধরে দুই দেশের মধ্যে ‘কোঅর্ডিনেটেড'ভাবে সীমান্ত ব্যবস্থাপনার উন্নতি করার জন্য কাজ চলছে৷ আমি আশা করি, দুই দেশের সীমান্তরক্ষীরা যদি তাদের মধ্যে ‘কোঅর্ডিনেশন'টা বাড়াতে পারে, তাহলে সীমান্ত হত্যা অনেক কমে আসবে৷
আপনি কি সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবীরের সঙ্গে একমত? জানান নীচের ঘরে৷
ভারতের সিদ্ধান্তে সমস্যায় বাংলাদেশ
বাংলাদেশের মানুষ যেন গরুর মাংস খাওয়া ছেড়ে দেয় সেজন্য ভারত থেকে বাংলাদেশ গরু পাচার সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করতে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সদস্যদের নির্দেশ দিয়েছেন সে দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী৷
ছবি: S. Rahman/Getty Images
সীমান্তরক্ষীদের নতুন দায়িত্ব
ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের ২,২১৬ কিলোমিটার সীমান্ত পাহারা দেয়ায় নিয়োজিত প্রায় ৩০ হাজার ভারতীয় সৈন্যকে নতুন দায়িত্ব দেয়া হয়েছে৷ সেটা হলো, ভারতীয় গরু যেন কোনোভাবেই বাংলাদেশে পৌঁছতে না পারে৷ ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বিএসএফ সদস্যদের এই নির্দেশ দেন যেন ‘বাংলাদেশের মানুষ গরুর মাংস খাওয়া ছেড়ে দেয়’৷
ছবি: Str/AFP/Getty Images
গরু পবিত্র
হিন্দুদের কাছে গরু একটি পবিত্র প্রাণী৷ তাই ভারতের হিন্দুত্ববাদী বিজেপি সরকার গরুর মাংস খাওয়া নিষিদ্ধ করতে চায়৷ রাষ্ট্রীয় স্বেচ্ছাসেবক সংঘ আরএসএস এর পশ্চিমবঙ্গের মুখপাত্র বলেছেন, ‘‘গরু জবাই কিংবা চোরাই পথে চালান, আর হিন্দু মেয়েকে ধর্ষণ করা বা হিন্দু মন্দির ধ্বংস করা একই কথা৷’’
ছবি: Shaikh Azizur Rahman.
চার যুগের ইতিহাস
ভারত থেকে চোরাই পথে আসা গরুই এতদিন বাংলাদেশের মানুষের মাংসের প্রধান উৎস ছিল৷ গত চার দশক ধরে সেটা হয়ে আসছে৷ এর সঙ্গে প্রায় ৬০০ মিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য জড়িয়ে আছে৷
ছবি: Shaikh Azizur Rahman.
দাম বেড়ে গেছে
বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় গরুর মাংস রপ্তানিকারক বেঙ্গল মিট এর সৈয়দ হাসান হাবিব গত জুলাই মাসে রয়টার্সকে জানান, ভারতের এই সিদ্ধান্তের কারণে বাংলাদেশে গরুর মাংসের দাম প্রায় ৪০ শতাংশ বেড়ে গেছে৷ আর মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে তাঁর কোম্পানির মাংস রপ্তানি প্রায় ৭৫ শতাংশ কমে গেছে৷
ছবি: picture-alliance/Asia News Network/Jofelle P. Tesorio
চাকরি হারিয়েছে প্রায় ৪,০০০
বাংলাদেশ ট্যানারস অ্যাসোসিয়েশন এর প্রেসিডেন্ট শাহীন আহমেদ জানিয়েছেন, জুন পর্যন্ত চামড়া শিল্পে কর্মরত প্রায় চার হাজার কর্মীর চাকরি গেছে৷ আর ১৯০টি ট্যানারির মধ্যে ৩০টি সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে গেছে৷
ছবি: Shaikh Azizur Rahman
ভারতীয় গরুর মাংস ভালো
বেঙ্গল মিট এর সৈয়দ হাসান হাবিব বলেন, তিনি এখন নেপাল, ভুটান ও মিয়ানমার থেকে মাংস আমদানির চিন্তা করছেন৷ কিন্তু ভারতীয় মাংস ও চামড়ার মান ভালো বলে জানান তিনি৷ উল্লেখ্য, ভারত গরুর মাংসের সবচেয়ে বড় রপ্তানিকারক৷
ছবি: AFP/Getty Images
ভারতের সিদ্ধান্ত বলবৎ থাকবে
ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা রয়টার্সকে বলেছেন মাংসের জন্য বাংলাদেশকে নতুন উৎস খুঁজে বের করতে হবে কেননা ভারত তার সিদ্ধান্তে অটল থাকবে৷