ঢাকা সফরে এসে বিস্ময়কর তথ্য হাজির করেছেন ভারতের পররাষ্ট্র সচিব হর্ষবর্ধন শ্রিংলা৷ সীমান্ত হত্যার জন্য অনুতাপের পাশাপাশি তিনি বলেছেন, সীমান্তে মৃত্যুর সংখ্যা বাংলাদেশ ও ভারতের জন্য ফিফটি-ফিফটি৷
ছবি: bdnews24.com
বিজ্ঞাপন
গড়ে প্রতি আট দিনে ঘটছে একজনের মৃত্যু৷ ২০১৯ সালে প্রাণ হারিয়েছেন মোট ৪৩ জন, যা আগের বছরের চেয়ে বেড়েছে তিনগুণ৷ শুধু জানুয়ারিতে মারা গেছেন ১৫ জন৷ কোনো স্বাভাবিক মৃত্যুর পরিসংখ্যান নয় এগুলো৷ ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী-বিএসএফের হাতে বাংলাদেশিদের প্রাণহানির সংখ্যা৷
এই দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে কোনো যুদ্ধাবস্থা নেই৷ দুই দেশের সরকার একে অন্যকে সবচেয়ে কাছের বন্ধু হিসেবে অভিহিত করে৷ অথচ বিশ্বে প্রাণঘাতী সীমান্তের তালিকায় বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত রয়েছে শীর্ষে৷ এই তালিকায় বাকি যে দেশগুলো রয়েছে তাদের মধ্যে হয় যুদ্ধ পরিস্থিতি নয়তো শরণার্থী-সংকট বিদ্যমান, যার কোনটিই নেই বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে৷
এমন পরিস্থিতি একদিন দুইদিন নয়, চলছে বছরের পর বছর ধরে৷ বিষয়টিকে ভারত বাংলাদেশের কোনো সরকারই অবাক করা কারণে আমলে নেয়নি কখনো৷ গত এক দশকে তারা ডজনের পর ডজন চুক্তি করেছে৷ কিন্তু সীমান্ত হত্যা বন্ধে কেউ কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেয়ার প্রয়োজন বোধ করেছে বলে মনে হয় না৷ দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর হাতে এই সমস্যা সুরাহার দায়িত্ব তুলে দিয়ে দৃশ্যত একে অন্যের বন্ধুত্বের গুণকীর্তনে ব্যস্ত থেকেছে তারা৷
ভারত বাংলাদেশ যত চুক্তি
সাম্প্রতিক সময়ে ভারত-বাংলাদেশ কূটনৈতিক সম্পর্ক পেয়েছে অন্য এক মাত্রা৷ দুই দেশের সরকারের মধ্যে বেড়েছে পারস্পরিক যোগাযোগ, হয়েছে নানা চুক্তি, আর একে অপরকে দিয়েছে ‘সবচেয়ে পছন্দের দেশের’ মর্যাদা৷
ছবি: AFP/P. Singh
১০০ কোটি ডলার ঋণ ও ১৪ প্রকল্প
২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার একবছর পর ২০১০ সালের জানুয়ারি মাসে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রথম ভারত সফরে যান৷ সেসময় ১০০ কোটি ডলারের এলওসি বা ঋণরেখা অনুমোদন করে ভারত৷ এই অর্থে জনপরিবহন, সড়ক, রেলপথ সেতু আর অভ্যন্তরীন নৌপথের ১৪ টি প্রকল্প বাস্তবায়নের চুক্তি হয়৷
ছবি: Getty Images/G. Crouch
বন্দী বিনিময়
২০১০ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরে দুই দেশের মধ্যে বন্দী বিনিময় চুক্তি হয়৷ ২০১১ সালের ১৩ই জানুয়ারি তা কার্যকর হয়৷ চুক্তি অনুযায়ী কোনো দেশের নাগরিক অন্য দেশে সাজাপ্রাপ্ত হলে তাকে অনুরোধক্রমে ফেরত পাঠাতে পারবে৷ তবে এর আগেই অনুপ চেটিয়াসহ ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদি নেতাদের গ্রেপ্তার করে দেশটিতে পাঠানো হয় বলে গণমাধ্যমে খবর বেরোয়৷
ছবি: Getty Images/AFP/J. Barreto
ছিটমহল বিনিময়
২০১৫ সালের জুন মাসে ভারত-বাংলাদেশের স্থল সীমান্ত চুক্তি অনুমোদন হয়৷ যার মাধ্যমে ২০১৫ সালের জুলাইতে দুই দেশের মধ্যে অমীমাংসিত ছিটমহল বিনিময় হয়৷ ভারতের ১১১টি ছিটমহল যুক্ত হয় বাংলাদেশের সাথে৷ একইভাবে ভারতের অভ্যন্তরে থাকা বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহলও হয়ে যায় ভারতের অংশ৷
ছবি: AFP/Getty Images
নদীর পানি বন্টন
বাংলাদেশের ভারতের অভিন্ন নদীর সংখ্যা ৫৪ টি৷ এর মধ্যে শুধু গঙ্গা নিয়ে দুই দেশের মধ্যে চুক্তি আছে৷ যদিও পানি বন্টনের ক্ষেত্রে এই চুক্তি ভারত মানছে না বলে অভিযোগ আছে৷ অন্যদিকে পাঁচ দশক ধরে তিস্তা চুক্তির চেষ্টা চললেও তা সম্ভব হচ্ছে না দেশটির উদাসীনতার কারণে৷ যার ফলে এখন একতরফাভাবে নদীটির পানি প্রত্যাহার করে নিচ্ছে ভারত৷
ছবি: DW/A. Chatterjee
ভারসাম্যহীন বাণিজ্য
১৯৭২ সালে প্রথম বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষর হয়৷ ২০১৫ সালে স্বাক্ষর হয় এ বিষয়ে নতুন চুক্তি৷ এর আওতায় দুই দেশের মধ্যে সীমান্ত হাটসহ আরো কিছু বাণিজ্য সম্পর্কিত চুক্তি হয়েছে৷ ২০১৭-১৮ অর্থবছরে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যের আকার ছিল ৯১৪ কোটি ডলার৷ যার সিংগভাগই ভারতের অনুকূলে৷
ছবি: Getty Images/AFP/D. Dutta
উন্নয়ন সহযোগিতার কাঠামো
২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফরকালে একটি উন্নয়ন সহযোগিতাবিষয়ক কাঠামোগত চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়৷ যার মধ্যে আছে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য, বিনিয়োগ, পানি সম্পদ; বিদ্যুৎ; শিক্ষা, সাংস্কৃতিক সহযোগিতা বৃদ্ধি ইত্যাদি৷
ছবি: Getty Images/AFP/M.U. Zaman
দ্বিপক্ষীয় বিনিয়োগ বৃদ্ধি
এই চুক্তি সম্পর্কে ভারতীয় দূতাবাসের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, ‘‘দ্বিপক্ষীয় বিনিয়োগ প্রবাহ বৃদ্ধির লক্ষ্যে এক দেশ অন্য দেশের ভূখণ্ড থেকে বিনিয়োগ বৃদ্ধি ও রক্ষার লক্ষ্যে এ চুক্তি হয়েছে৷ ভারত ও বাংলাদেশ একে অপরকে ‘সবচেয়ে পছন্দের দেশ’-এর মর্যাদা দিয়েছে৷’’
ছবি: picture-alliance/AP Photo/M. Swarup
বাংলাদেশ ভারতের পণ্য পরিবহন
দুই দেশের মধ্যে হওয়া বাণিজ্য চুক্তি অনুযায়ী এক দেশ আরেক দেশের জল, স্থল ও রেলপথ ব্যবহার করে তৃতীয় দেশে পণ্য ট্রানজিটের সুবিধা নিতে পারে৷ ২০১৬ সালে মাশুলের বিনিময়ে ভারতকে আশুগঞ্জ নৌ বন্দর দিয়ে বহুমাত্রিক ট্রানজিট সুবিধা দেয় বাংলাদেশ৷ সড়কপথে ট্রানজিট দিতে ২০১৫ সালে আখাউড়া অগরতলা সীমান্ত দিয়ে পরীক্ষামূলক চালান পাঠানো হয়৷ যা পরবর্তীতে নিয়মিত হয়নি৷
ছবি: DW/M. Mamun
ভারতের রেল যাবে বাংলাদেশ হয়ে
আগামী বছরের মাঝামাঝি সময়ে কোলকাতা থেকে ছেড়ে আসা ট্রেন বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে শিলিগুড়ি যাবে৷ ২০১১ সালে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের সময় এ বিষয়ক একটি চুক্তি হয়৷ চুক্তি অনুযায়ী এজন্য দুই দেশকে তাদের অংশের রেলপথ নির্মাণ করতে হবে৷ বাংলাদেশ অংশের সাত কিলোমিটার রেলপথ আগামী বছরে জুন মাসের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা৷
ছবি: DW/P. Mani
সাবরুমের মানুষে জন্য ফেনীর পানি
সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরে সাতটি সমঝোতা সই ও চুক্তি হয়েছে৷ একটি সমঝোতার আওতায় ফেনী নদীর ১ দশমিক ৮২ কিউসেক পানি প্রত্যাহার করতে পারবে ভারত৷ ওই পানি তারা ত্রিপুরার সাবরুম শহরে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ প্রকল্পে ব্যবহার করবে৷
ছবি: AFP/P. Singh
বন্দর ব্যবহার করে পণ্য পরিবহন
বাংলাদেশের চট্টগ্রাম ও মংলা সমুদ্র বন্দর ব্যবহার করে ভারত আটটি রুটে তার উত্তর পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোদে পণ্য আনা নেয়া করতে পারবে৷ এজন্য স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিওর বা পদ্ধতি কী হবে, তা নির্ধারণে একটি সমঝোতা স্বাক্ষর হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর সাম্প্রতিক সফরে৷
ছবি: DW/U. Danisman
চুক্তি থাকলেও হত্যা থেমে নেই
সীমান্তে হত্যা শূন্যে নামিয়ে আনতে ২০১১ সালে বিজিবি-বিএসএফ একটি চুক্তি করে৷ নেয়া হয় সীমান্ত পারাপারে অস্ত্র ব্যবহার না করার সিদ্ধান্ত৷ তবে সীমান্তে দেশটির আচরণে তার প্রতিফলন নেই৷ গত ১০ বছরে ২৯৪ বাংলাদেশি নাগরিককে হত্যা করেছে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনী বিএসএফ৷
ছবি: S. Rahman/Getty Images
12 ছবি1 | 12
বিএসএফ -বিজিবি পতাকা বৈঠক কিংবা কর্মকর্তাদের আলোচনায় সীমান্ত হত্যার বিষয়টি যে তোলা হয় না, তা নয়৷ কিন্তু আলোচনাটি গত কয়েক বছর ধরেই চলছে গৎবাঁধা প্রক্রিয়ায়৷ ভারতীয় গণমাধ্যমে দেশটির সরকারের যে ব্যাখ্যা পাওয়া যায় সেগুলো এমন-
‘‘আমরা আত্মরক্ষার্থে গুলি চালাই’’, ‘‘আমরা কখনো কাউকে হত্যার উদ্দেশ্যে গুলি চালাই না'', কিংবা ‘‘অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের উদ্দেশ্যে গুলি চালানো হয়’’৷ আছে চোরকারবারিদের প্রতিহত করার তত্ত্বও৷ কিন্তু কোনো অবস্থাতেই গুলি চালানো ও হত্যার বিষয়টি ধোপে টেকে না৷ কূটনৈতিকভাবে বিষয়টি সমাধান না হলে বাংলাদেশ এমনকি আইনি পদক্ষেপও নিতে পারে৷ সে সুযোগ আছে৷ তবে সেরকম পদক্ষেপ না নিলেও সরকারের পক্ষ থেকে অবশেষে কিছু যৌক্তিক বক্তব্য অন্তত আমরা পেয়েছি৷
সম্প্রতি ঢাকা সফরে আসা ভারতের পররাষ্ট্র সচিব হর্ষ বর্ধন শ্রিংলাকে উদ্দেশ্য করে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বলেছেন, ‘‘আপনারা আমাদের বন্ধু মানুষ৷ এই বন্ধুদের মধ্যে কিলিং হওয়া ঠিক না৷’’ জবাবে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব সীমান্ত হত্যা বন্ধে ‘চেষ্টা চালাবেন’ বলে আশ্বাস দিয়েছেন৷ এ আশ্বাসটি অবশ্য তারা গত এক দশক ধরেই দিয়ে আসছেন৷ এবারের চেষ্টার আন্তরিকতা কতটা? তার জবাবও মিলছে শ্রিংলার কাছ থেকে৷ ঢাকার এক অনুষ্ঠানে অবাক করা তথ্য হাজির করেছেন তিনি৷ তিনি বলেছেন, ‘‘সীমান্তে মৃত্যু কেবল বাংলাদেশিদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, একই সংখ্যায় ভারতীয়রও মৃত্যু হয়৷ যদিও সেই পরিসংখ্যান আপনাদের এখানে প্রতিফলিত হয় না৷ আমার হাতে থাকা পরিসংখ্যান বলছে, সীমান্তে মৃত্যুর সংখ্যা বাংলাদেশ ও ভারতের জন্য ফিফটি-ফিফটি৷’’
জনাব শ্রিংলা তার হাতে থাকা পরিসংখ্যানটি অবশ্য প্রকাশ করেননি৷ এই পরিসংখ্যান তিনি কোথা থেকে হাজির করেছেন সে এক বিরাট বিস্ময়৷ সত্যি কোনো ভারতীয় নাগরিক বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বিজিবির হাতে নিহত হয়েছেন, আর সে বিষয়ে ভারতের সরকার কোনো ব্যবস্থা নেয়নি, প্রতিবাদ করেনি, এমন কথা বিশ্বাস করা কঠিন৷ এ নিয়ে ভারতীয় গণমাধ্যমগুলোও কি কোনো সংবাদ প্রকাশ করেছে? না করলে কেন করেনি? বাংলাদেশের বিজিবির হাতে ভারতের নাগরিক নিহত হলে সে দেশের মানুষও তো কোনো-না-কোনোভাবে প্রতিক্রিয়া জানাতো৷ ভারতের গণমাধ্যম ঘেঁটেও তো তেমন কিছু পাওয়া গেল না৷
ফয়সাল শোভন, ডয়চে ভেলেছবি: Masum Billah
শ্রিংলা সীমান্ত হত্যা বন্ধে কিছু ‘কিন্তু’ এবং ‘যদি’ সূচক বাক্যও ব্যয় করেছেন একই অনুষ্ঠানে৷ তিনি বলেছেন, সীমান্তে একজন মানুষও যদি মারা যায়, সেজন্য ভারত ‘সত্যি অনুতপ্ত'৷ এই যদির সঙ্গে তিনি টেনেছেন আন্তঃসীমান্ত অপরাধের বিষয়গুলো৷ প্রশ্ন হলো, আন্তঃসীমান্ত অপরাধ হয়ে থাকলে তার জন্য কি শুধু বাংলাদেশ দায়ী৷ সীমান্তের অপর পারে অপরাধটা কে করছে? ভারতের দিক থেকে যারা অবৈধ কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে তাদেরকে কেন থামানো হচ্ছে না? সেখান থেকে যেসব অপরাধী বাংলাদেশে অবৈধভাবে পণ্য পাচার করছে, বিএসএফ তাদেরকে থামাতে কী ব্যবস্থা নিয়েছে?
এইসব প্রশ্নের কোনো জবাব ছিল না ভারতের পররাষ্ট্র সচিবের বক্তব্যে৷ তিনি এসেছিলেন বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে ঢাকায় মোদীর সফরের বিষয়টি নিশ্চিত করতে৷ তাকে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে আগেই আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল৷ এ নিয়ে এরইমধ্যে বাংলাদেশে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া হয়েছে৷ এই পর্যায়ে এসে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর আসন্ন সফর বাতিল করা কূটনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলাদেশের পক্ষে সম্ভব নয়৷ তবে, ‘যদি’, ‘কিন্তু’ বাদ দিয়ে মোদীর কাছ থেকে সীমান্ত হত্যা বন্ধের একটি ঘোষণা কি অন্তত বাংলাদেশ এই আয়োজন থেকে পেতে পারে?