এর্দোয়ান বলেছেন, সুইডেন ও ফিনল্যান্ড চুক্তি মেনে ৭৩ জনকে তুরস্কের হাতে না দিলে ন্যাটোর সদস্য হতে পারবে না।
বিজ্ঞাপন
ন্যাটোর শীর্ষ সম্মেলন শেষ হয়েছে বৃহস্পতিবার। তারপরই হুমকি দিয়েছেন এর্দোয়ান। তিনি বলেছেন, তুরস্ক যে ৭৩ জন 'জঙ্গি'কে চাইছে, তাদের না দিলে সুইডেন ও ফিনল্যান্ডের ন্যাটোর সদস্য পদ পাওয়া এখনও বন্ধ করতে পারে তারা।
এর্দোয়ান বলেছেন, সুইডেন তাদের হাতে ৭৩ জনকে তুলে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এরা সকলেই হয় কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টি(পিকেকে) বা অ্যামেরিকা-প্রবাসী ধর্মীয় নেতা ফতেউল্লাহ গুলেনের সমর্থক। ফতেউল্লাহ ২০১৬ সালের ব্যর্থ অভ্যুত্থানের পিছনে ছিলেন বলে তুরস্কের প্রেসিডেন্টের দাবি।
কী বলেছেন এর্দোয়ান?
মাদ্রিদে ন্যাটোর শীর্ষবৈঠকের পর এর্দোয়ান বলেছেন, ফিনল্যান্ড ও সুইডেনের সঙ্গে তুরস্কের দশ দফা চুক্তি হয়েছে। এটা পুরোপুরি তাদের কূটনৈতিক সাফল্য। সন্ত্রাসবাদের বিপদ নিয়ে তাদের উদ্বেগ মেনে নিয়েছে দুই দেশ।
যুদ্ধ ও শান্তি: ন্যাটো ও ভেটোর ভূমিকা
সোভিয়েত রাশিয়ার হুমকির প্রেক্ষিতে জন্ম হলেও নিজেদের উদ্দেশ্য থেকে পরে অনেকটা সরে এসেছে ন্যাটো৷ শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য গঠিত হলেও যুদ্ধ বন্ধে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের ভূমিকাও প্রশ্নবিদ্ধ৷
ছবি: picture-alliance/dpa/K. Nietfeld
ন্যাটোর জন্ম
১৯৪৯ সালের ৪ এপ্রিল নর্থ আটলান্টিক ট্রিটি স্বাক্ষরের মধ্যে দিয়ে যাত্রা শুরু করে ন্যাটো৷ চুক্তির পঞ্চম ধারা অনুযায়ী, ‘‘এক বা একাধিক সদস্যের উপর সশস্ত্র হামলা সবার উপর হামলা হিসেবে বিবেচিত হবে৷’’ জন্মলগ্নে জোটের ঘোষিত উদ্দেশ্য ছিল তিনটি: সোভিয়েত সম্প্রসারণ ঠেকানো, উত্তর অ্যামেরিকার শক্তিশালী উপস্থিতির মাধ্যমে ইউরোপের সামরিকায়ন নিষিদ্ধ করা এবং ইউরোপে রাজনৈতিক সংহতিকে উৎসাহ দেয়া৷
ছবি: Getty Images/Keystone
কারা সদস্য
শুরুতে ১২ সদস্য নিয়ে যাত্রা করে ন্যাটো৷ ১৯৫২ সালে যোগ দেয় গ্রিস ও তুরস্ক৷ পশ্চিম জার্মানি যোগ দেয় ১৯৫৫ সালে আর ১৯৮২ সালে স্পেন৷ ১৯৯৯ সালে পূর্ণ সদস্যপদ লাভ করে পোল্যান্ড, চেক রিপাবলিক ও হাঙ্গেরি৷ বর্তমানে জোটের সদস্য সংখ্যা ৩০৷
ছবি: AP
নিজেদের বিরোধ
ন্যাটোর সদস্য দেশগুলোর মধ্যে সামরিক পদক্ষেপ নিয়ে বিভিন্ন সময় মতভেদ তৈরি হয়েছে৷ প্রথমবার এমন ঘটনা ঘটে ১৯৫৬ সালে সুয়েজ সংকট নিয়ে৷ ১৯৬৬ সালে ন্যাটোর সামরিক কাঠামো থেকে বেরিয়ে আসার ঘোষণা দেয় ফ্রান্স এবং সে দেশ থেকে জোটের প্রধান কার্যালয় সরিয়ে নেয়ার অনুরোধ জানায়৷ নতুন কার্যালয় বসে বেলজিয়ামে৷ তবে ফ্রান্স জোটের মধ্যেই থেকে যায় এবং সংকটকালে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাও রাখে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/K. Nietfeld
সামরিক উত্তেজনা
১৯৭৯ সালে আফগানিস্তানে সোভিয়েত রাশিয়ার হামলা এবং ইউরোপে ব্যালাস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র স্থাপনকে কেন্দ্র করে নড়েচড়ে বসে ন্যাটো৷ পাল্টা জবাব হিসেবে পশ্চিম ইউরোপে ক্ষেপণাস্ত্র বসানোর সিদ্ধান্ত নেয় জোট৷ ১৯৮৭ সালে এক চুক্তির মাধ্যমে দুই পক্ষ ভূমি থেকে নিক্ষেপযোগ্য মাঝারিপাল্লার সব ব্যালাস্টিক ও ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র সরিয়ে নিতে সম্মত হয়, যাকে ঠান্ডা লড়াই সমাপ্তির প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হয়৷
ছবি: AP
ঠান্ডা লড়াই পরবর্তী যুগ
১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়া ও বার্লিন দেয়ালের পতনের পর ন্যাটোর অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন ওঠে৷ তবে সময়ের সাথে সাথে বরং উল্টো ন্যাটোর সম্প্র্রসারণ চলতে থাকে৷ এক দশক ধরে চলা যুগোস্লাভ যুদ্ধ ও কসভো-সার্বিয়া সংঘাতে হস্তক্ষেপ করে জোট৷ গড়ে ওঠে ন্যাটো-বহির্ভূত সমমনা দেশগুলোর সঙ্গে সহযোগিতার সম্পর্ক৷
ছবি: AP
নাইন-ইলেভেন: নতুন মোড়
২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের টুইন টাওয়ারে হামলার পর ন্যাটো সদস্যসহ বিভিন্ন রাষ্ট্র আফগানিস্তানে আল-কায়দার বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ নেয়৷ ২০০৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ইরাক যুদ্ধে সহায়তা কার্যক্রম চালায় ন্যাটো৷ সদস্য রাষ্ট্রগুলোর বাইরে অন্য রাষ্ট্রে সংঘাত, বিরোধেও নিজেদের কার্যক্রম সম্প্রসারণ করতে থাকে ন্যাটো৷ লিবিয়াসহ বিভিন্ন দেশে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে ভূমিকা রাখতে থাকে৷
ছবি: Chao Soi Cheong/AP/picture alliance
রাশিয়ার সঙ্গে নতুন বিরোধ
পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোতে ন্যাটোর সম্প্রসারণ নিরাপত্তা হুমকি হিসেবে দেখে রাশিয়া৷ ইউক্রেন যাতে ন্যাটোতে যোগ না দেয় সবশেষ সেই নিশ্চয়তা দাবি করে ক্রেমলিন৷ এমন প্রেক্ষিতে ২৪ ফেব্রুয়ারি দেশটিতে হামলা শুরু করেন প্রেসিডেন্ট পুটিন৷ পূর্ব ইউরোপে নিজেদের সামরিক সক্ষমতা বাড়ালেও এই যুদ্ধে সরাসরি যুক্ত হবে না বলে জানিয়ে আসছে ন্যাটো৷ এই সংঘাত সামনে কোন দিকে মোড় নেবে তা সময়ই বলে দেবে৷
ছবি: Yasin Ozturk/AA/picture alliance
নিরাপত্তা পরিষদ
জাতিসংঘের ওয়েবসাইটে দেয়া তথ্য অনুযায়ী, নিরাপত্তা পরিষদের মূল উদ্দেশ্য বিশ্বে শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষা৷ ১৫ সদস্যের মধ্যে স্থায়ী সদস্য পাঁচ পরমাণু শক্তিধর দেশ: চীন, ফ্রান্স, রাশিয়া, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র৷ তাদের সবার সম্মতি ছাড়া কোনো সিদ্ধান্ত পাস করা যায় না৷ বিপরীতভাবে কোনো সিদ্ধান্তে কেউ ভেটো দিলে তা বাতিল হয়ে যায়৷ বিভিন্ন সময়ে এই পাঁচ সদস্য তাদের স্বার্থ অনুযায়ী ভেটো ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়েছে৷
ছবি: Yorick Jansens/dpa/picture alliance
সবচেয়ে বেশি রাশিয়া
ভেটো ক্ষমতা সবচেয়ে বেশি প্রয়োগ করেছে রাশিয়া৷ ২৬৫টির মধ্যে ১১৯ বার ভেটো দিয়েছে তারা৷ ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত নিরাপত্তা পরিষদে যত ভেটো দেয়া হয়েছে তার সবগুলোই ছিল সোভিয়েত রাশিয়ার পক্ষ থেকে৷ শীতল যুদ্ধের যুগ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ভেটো দিয়ে আসছে রাশিয়া৷ ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের তোলা পাকিস্তানের যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবেও ভেটো দেয় রাশিয়া৷
ছবি: Reuters
রাশিয়ার সহযোগী চীন
চীন মোট ১৬ বার ভেটো দিয়েছে, এর মধ্যে ১৩ বারই রাশিয়ার সঙ্গে যৌথভাবে আর তিনবার এককভাবে৷ ১৯৭১ সালের ২৫ আগস্ট চীন তার প্রথম ভেটো ক্ষমতা প্রয়োগ করেছিল জাতিসংঘে বাংলাদেশের সদস্যপদ প্রাপ্তির বিরুদ্ধে৷
ছবি: ASSOCIATED PRESS/picture alliance
ইসরায়েলের পক্ষে যুক্তরাষ্ট্র
ভেটো ক্ষমতা প্রয়োগে রাশিয়ার পরে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র৷ ৮২ বার তারা এই ক্ষমতা প্রয়োগ করেছে৷ এর অনেকগুলোই ছিল ইসরায়েলকে নিয়ে৷ মধ্যপ্রাচ্য ও ফিলিস্তিনে সংঘাত ও হামলা নিয়ে দেশটির বিরুদ্ধে আনা প্রস্তাবে বরাবরই ভেটো দিয়ে এসেছে ওয়াশিংটন৷ তবে ২০১৬ সালে ওবামা ক্ষমতায় থাকাকালে ইসারেয়েলের বসতিস্থাপন বন্ধে আনা একটি প্রস্তাবে ভোট দানে বিরত থাকে তারা৷
ছবি: picture-alliance/Zumapress/A. Lohr-Jones
সহযোগী যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স
যুক্তরাজ্য ২৯ বার ও ফ্রান্স ১৬ বার ভেটো ক্ষমতা প্রয়োগ করেছে৷ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যৌথভাবে বিভিন্ন প্রস্তাব নাকচ করেছে তারা৷ তবে ১৯৮৯ সালের পর ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্য আর ভেটো ক্ষমতার ব্যবহার করেনি৷ সেবার পানামায় যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে নিন্দা প্রস্তাবে ভেটো দিয়েছিল দেশ তিনটি৷
ছবি: Reuters/C. Allegri
সবশেষ
নিরাপত্তা কাউন্সিলে তোলা প্রস্তাবে সবশেষ ভেটোর ঘটনাটি ঘটে চলতি বছরের ২৫ ফেব্রুয়ারি৷ ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলা বন্ধ ও নিন্দা জ্ঞাপনের প্রস্তাব আনে কয়েক ডজন দেশ৷ তবে রাশিয়ার একার ভেটোতে তা বাতিল হয়ে যায়৷
ছবি: picture-alliance/Zuma Press
13 ছবি1 | 13
এর্দোয়ান বলেছেন, ''যদি সুইডেন ও ফিনল্যান্ড এই চুক্তি থেকে পিছনে সরে যায়, তাহলে তুরস্কের পার্লামেন্ট এই চুক্তিকে অনুমোদন করবে না। তাহলে ওরাই বিপদে পড়বে।'' তুরস্কের প্রেসিডেন্টের দাবি, ''সুইডেন ও ফিনল্যান্ডকে তাদের প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে হবে। না করলে, আমরাও চুক্তি পার্লামেন্টে পাঠাবো না।''
গত মে মাসে এর্দোয়ান জানিয়েছিলেন, তুরস্কের জাতীয় সুরক্ষার পক্ষে বিপজ্জনক জঙ্গি গোষ্ঠীগুলিকে সমর্থন চালিয়ে গেলে সুইডেন ও ফিনল্যান্ডকে ন্যাটোর সদস্য হতে দেবে না তুরস্ক।
আইনি পদ্ধতি অনুসরণ করা হচ্ছে
সুইডেন জানিয়ে দিয়েছে, তুরস্কের উদ্বেগের কোনো কারণ নেই। আইনি প্রক্রিয়া মেনে কাজ করতে হচ্ছে। এই প্রক্রিয়া না মেনে কাউকে তুরস্কের হাতে তুলে দেয়া সম্ভব নয়।
সুইডেনের বিচারমন্ত্রী বলেছেন, সুইডেনে স্বাধীন বিচারবিভাগ এই আইন রূপায়ণ করে। কোনো সুইডিশ নাগরিককে অন্য কোনো দেশের হাতে তুলে দেয়া যায় না। যারা সুইডেনের নাগরিক নয়, অন্য দেশ চাইলে তাদের হাতে দেয়া যেতে পারে। কিন্তু তা সুইডেনের আইন এবং ইউরোপীয় রীতি মেনেই।
ফিনল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট বলেছেন, অন্য দেশের হাতে কাউকে তুলে দিতে গেলে তাদেরও আইন মেনে এগোতে হয়। সেক্ষেত্রে নিজেদের আইন এবং আন্তর্জাতিক চুক্তির কথা মাথায় রাখতে হয়। এই প্রক্রিয়ায় কোনো রাজনীতিক কোনোভাবে প্রভাব বিস্তার করতে পারেন না।
ডিডাব্লিউকে ফিনল্যান্ডের পররাষ্ট্রমন্ত্রী পেক্কা হাভিস্তো বলেছেন, ''তুরস্ক যাদের চাইছে, তাদের বিষয়ে দেশের আইন মেনে ব্যবস্থা নেয়া হবে।'' তবে তিনি জানিয়েছেন, তুরস্কের সঙ্গে চুক্তি নিয়ে তিনি সন্তুষ্ট।
তিনি বলেছেন, ''তুরস্কের সঙ্গে আমাদের তথ্য বিনিময় নিয়ে চুক্তি হয়েছে। সন্ত্রাসের প্রশ্নে ঘনিষ্ঠ সহযোগিতার কথা বলা হয়েছে। তুরস্কে সন্ত্রাস একটা প্রধান বিষয়। তাই এই চুক্তি আমাদের কাছে ভালো।''