ভারতের অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র ফতেহপুর সিক্রিতে দুষ্কৃতিকারীদের হামলার শিকার হয়েছেন দুই সুইস তরুণ-তরুণী৷ মাথায় গুরুতর আঘাত পেয়েছেন তরুণ এবং হাত ভেঙে গেছে তরুণীর৷ তাঁরা এখন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন৷
বিজ্ঞাপন
পুলিশ জানিয়েছে, সুইজারল্যান্ডের লুজানের অধিবাসী ২৪ বছরের কোয়েন্টিন জেরেমি ক্লার্ক এবং তাঁর বান্ধবী মারি ড্রক্সজ গত ৩০শে সেপ্টেম্বর আগ্রায় বেড়াতে গিয়েছিলেন৷ গত শনিবার তাজমহল দেখে পরের দিন ফতেহপুর সিক্রিতে ঘুরতে যান ওই জুটি৷ ফতেহপুর সিক্রি দিল্লির কাছে অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র৷ ‘টাইমস অফ ইন্ডিয়া'কে ঐ তরুণ-তরুণী জানিয়েছেন, হামলাকারীরা তাদের পথ রোধ করে এবং তরুণীর সঙ্গে জোর করে সেলফি তোলার চেষ্টা করে৷ এরপর তাঁরা রাজি না হলে লাঠি আর পাথর নিয়ে হামলে পড়ে তাঁদের উপর৷ লাঠির বাড়ি মাথায় পড়লে তরুণটি মাটিতে পড়ে যায়৷
ছোট পোশাক পরাই কি ধর্ষণের কারণ?
ভারতে প্রতিদিন অন্তত ৯২ জন নারী ধর্ষণের শিকার হন৷ যখনই এ ধরনের কোন মামলা আদালতে উঠেছে তখন প্রথম যে প্রশ্নটি সামনে এসেছে তা হলো, ধর্ষণের শিকার ঐ নারী কি ধরনের পোশাক পরেছিলেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa
যুগের সাথে পোশাক
যুগে যুগে পোশাকের ধরনে পরিবর্তন এসেছে৷ আদিমকালে ছিল পশুর চামড়া, গাছের ছাল আর এখন রয়েছে নানা ধরনের পোশাক৷ বর্তমানে দেশ, সংস্কৃতি, সমাজ ব্যবস্থা, কাজের ধরন, অনুষ্ঠান, পছন্দ ও ফ্যাশানের ভিত্তিতে বহু ধরনের পোশাক পরে থাকেন নারীরা৷
ছবি: AP
শরীর প্রদর্শন মানেই কি ধর্ষককে আমন্ত্রণ?
ভারতে বেশিরভাগ ধর্ষণ মামলায় দেখা গেছে, ধর্ষিতা সালোয়ার কামিজ বা শাড়ি পরেছিলেন৷ অর্থাৎ যাকে বলা হয় ভারতীয় নারীর আদর্শ পোশাক, সে ধরনের পোশাকই তাঁরা পরেছিলেন৷ অর্থাৎ এ জরিপ থেকেই প্রমাণিত হচ্ছে যে, শরীর প্রদর্শন না করে বা তথাকথিত ‘আধুনিক’ পোশাক না পরেও শ্লীলতাহানির শিকার হচ্ছেন নারীরা৷
ছবি: Reuters
আইনের ভয় নেই
২০১৩ সালে এক জরিপে দেখা গেছে যে, এশীয় প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশগুলোতে প্রতি চারজনের মধ্যে একজন পুরুষ জীবনে অন্তত একবার কোনো নারীকে ধর্ষণ করেছে৷ এর মধ্যে বেশিরভাগ পুরুষকেই কোনো আইনি ঝামেলা পোহাতে হয়নি৷
ছবি: Fotolia/DW
ধর্ষণ যখন বিনোদনের মাধ্যম
ভারতের উত্তর প্রদেশে ধর্ষণের ঘটনা বেড়েই চলেছে৷ এর কারণ হিসেবে পুলিশ নারীদের উপর পশ্চিমা সংস্কৃতির প্রভাব, মেয়েদের মোবাইল ব্যবহার ও ছোট পোশাক পরিধানকে উল্লেখ করেছে৷ নারীদের নিরাপত্তা দিতে পুরোপুরি ব্যর্থ পুলিশ বলেছে, সেখানকার পুরুষরা তাদের বিনোদনের অভাব পূরণ করছে ধর্ষণের মাধ্যমে৷
ছবি: dapd
নারীদের দাবিয়ে রাখার হাতিয়ার
রাস্তা, অফিস বা যে কোনো পাবলিক প্লেসে পুরুষের যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছেন নারীরা৷ বিশেষ করে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ হওয়ায় নারীদের দাবিয়ে রাখতে পুরুষরা ধর্ষণকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে৷
ছবি: UNI
পরিচিতদের দ্বারাই বেশি ধর্ষণ
২০১৩ সালে ভারতের ন্যাশনাল ক্রাইম ব্যুরোর রিপোর্ট বলছে, সে বছর ১০০ জন ধর্ষণের শিকার নারীর মধ্যে ৯৮ জন এমন ব্যক্তিদের দ্বারা ধর্ষিত হয়েছেন, যারা তাঁদের পরিচিত৷ আদালতে যেসব মামলা ওঠে, বা গণমাধ্যমে যেসব ঘটনা প্রকাশ পায় সেগুলো বেশিরভাগই বাইরের লোকের হাতে৷ ফলে পরিচিত ব্যক্তি দ্বারা ধর্ষণের ব্যাপারটি ধামাচাপা পড়ে যায়৷
ছবি: Reuters/Ahmad Masood
যৌন নিগ্রহ সর্বত্র
ভারতে জন্মের আগে ভ্রুণের লিঙ্গ নির্ধারণ বেআইনি হলেও, খুব সাধারণ ঘটনা৷ ফলে পৃথিবীর আলো দেখতে পাওয়া মেয়েদের সংখ্যা এত কম যে, সমাজে নারী-পুরুষের অনুপাতে হেরফের হয়৷ এছাড়া বাল্যবিবাহ, কম বয়সে মা হওয়া, সন্তান জন্ম দিতে গিয়েও মৃত্যুবরণ করছেন নারীরা৷ পরিবারের ভেতরেও চলে যৌন নির্যাতন এবং ধর্ষণ৷ এরপরও কি আপনারা ধর্ষণের জন্য পোশাককে দায়ী করবেন?
ছবি: picture-alliance/dpa
7 ছবি1 | 7
ফতেহপুর সিক্রির রেলস্টেশনের কাছে গত রবিবার ঘটেছে এই ঘটনা৷ পথচারীরা মোবাইল ফোনে ঘটনার ভিডিও ধারণ করেছেন, যেখানে আহত ঐ জুটিকে মাটিতে পড়ে থাকতে দেখা গেছে৷
টাইমস অফ ইন্ডিয়া'র প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে সংবাদ সংস্থা ডিপিএ জানিয়েছে, হামলার পর তাঁদের উদ্ধার করে স্থানীয় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে৷ কিন্তু পরে তাঁদের শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে দিল্লির একটি বেসরকারি হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়৷ চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, যুবকটির মাথার খুলি ফেটে গেছে৷ তাঁর মস্তিষ্কে রক্ত জমেছে৷ আর তরুণীটির হাত ভেঙে গিয়েছে৷
এরইমধ্যে উত্তরপ্রদেশ রাজ্য সরকারের কাছে ঘটনার বিস্তারিত জানতে চেয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ৷ টুইটারে লিখেছেন, ‘‘আমি এই প্রতিবেদনটি এইমাত্র দেখেছি৷ রাজ্য সরকারের কাছ থেকে এ সংক্রান্ত রিপোর্ট চেয়ে পাঠিয়েছি৷''
এর পরের টুইটে তিনি জানিয়েছেন, আহত ঐ যুগলের খোঁজ-খবর নিতে রওনা হয়েছেন তাঁর কর্মকর্তারা৷ রাজ্য পুলিশের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, হামলার পেছনে চারজন ব্যক্তির হাত রয়েছে বলে মনে করছেন তাঁরা৷
রাজ্যের সিনিয়র পুলিশ কর্মকর্তা অমিত পাঠক সংবাদ সংস্থা এএফপিকে ফোনে জানিয়েছেন, আগ্রার পুলিশ হামলাকারীদের কয়েকজনকে চিহ্নিত করেছে৷ তিনি জানিয়েছেন, ‘‘এদের মধ্যে কয়েকজন অপ্রাপ্তবয়স্ক৷ আমরা তদন্ত করছি৷ তারা অপ্রাপ্তবয়স্ক হলেও আইন অনুযায়ী, তাদের কিশোর আদালতে পাঠানো হবে৷'' অন্য এক পুলিশ কর্মকর্তা প্রদীপ কুমার পরে জানিয়েছেন, সন্দেহভাজন একজনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করেছেন তাঁরা৷
যৌন হয়রানির হাত থেকে কীভাবে বাঁচাবেন শিশুকে
শিশুরা বিকৃতকাম মানুষের সহজ শিকার৷ সারল্যের সুযোগ নিয়ে সহজে ভোলানো যায় তাদের৷ অনেক সময় শিশুরা বুঝতে পারে না, চিনতে পারে না পিশাচের থাবা৷ আর বুঝলেও করতে পারে না প্রতিবাদ, প্রতিরোধ৷ শুধু একটা অস্বস্তি থেকে যায় সারাটা জীবন৷
ছবি: picture alliance/abaca
ভয়াবহ অবস্থা ভারতে
ভারতের জাতীয় ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশের অর্ধেকেরও বেশি বাচ্চা যৌন নিগ্রহের শিকার৷ তবে সবচেয়ে ভয়ংকর সত্য হলো, নাবালিকা বা শিশুর ওপর যৌন হেনস্থার ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটছে পরিবারের মধ্যে, পরিবারেরই কোনো মানসিক বিকারগ্রস্ত সদস্যের হাতে৷ তাই সে সব ঘটনা পুলিশের কাছে পৌঁছাচ্ছে না, হচ্ছে না কোনো ডাইরি অথবা মামলা৷
ছবি: Fotolia/Gina Sanders
হারিয়ে যাচ্ছে শৈশব
এভাবে প্রতিদিন বিকৃত যৌন নির্যাতনে হারিয়ে যাচ্ছে অগুন্তি শৈশব৷ অনেকক্ষেত্রেই শিশুরা বুঝে উঠতে পারছে না, বলে উঠতে পারছে না তাদের অমানবিক সেই সব অভিজ্ঞতার কথা৷ তাই শিশুদের প্রতি যৌনাসক্ত, বিকৃত মানুষগুলো থেকে যাচ্ছে লোকচক্ষুর আড়ালে৷ সমাজবিদরা বলছেন, এ জন্য আগাম সতর্কতার দায়িত্ব নিতে হবে অভিভাবক এবং স্কুলের৷ শিশুকে দিতে হবে তার প্রাপ্য শৈশব৷
ছবি: Fotolia/Kitty
যেভাবে বোঝাবেন বাচ্চাদের
সহজ ভাষায় খেলা বা গল্পচ্ছলে শিশুদের এ বিষয়ে একটা ধারণা গড়ে তোলা যেত পারে৷ বাচ্চাদের বলতে হবে যে, তাদের শরীরটা শুধুমাত্র তাদের৷ অর্থাৎ কেউ যেন তাদের ‘গোপন’ জায়গায় হাত না দেয়৷ তাই কোনো আত্মীয় বা পরিচিত ব্যক্তির আচরণ অস্বস্তিকর ঠেকলে, কেউ তাদের জোর ঘরে কোনো ঘরে নিয়ে গেলে, খেলার ছলে চুমু দিলে বা শরীরের কোথাও হাত দিলে – তা যেন মা-বাবাকে জানায় তারা৷
ছবি: picture-alliance/dpa
চিনিয়ে দিন যৌনাঙ্গ
অনেক বাবা-মা নিজ সন্তানের সঙ্গে যৌনাঙ্গ নিয়ে কথা বলতে কুণ্ঠা বোধ করেন৷ কিন্তু এই লজ্জা কাটিয়ে উঠতে হবে এবং খুব ছোটবেলাতেই ছবি এঁকে অথবা গল্পে-গানে বাচ্চাকে তার শরীরের অন্য সব অঙ্গের মতো যৌনাঙ্গ, লিঙ্গ ইত্যাদি চিনিয়ে দিতে হবে৷ এমনটা করলে কেউ যদি তাদের সঙ্গে পিশাচের মতো ব্যবহার করে, তাহলে শিশুরা সহজেই বলতে পারবে কে, কখন, কোথায় হাত দিয়েছিল৷
ছবি: DW/S.Rahman
শিশুর কথা শুনুন, তার পক্ষ নিন
শিশু যাতে আপনাকে বিশ্বাস করতে পারে, বন্ধুর মতো সবকিছু খুলে বলতে পারে – সেটা নিশ্চিত করুন৷ আপনার বাচ্চা যদি পরিবারের কাউকে বা আপনার কোনো বন্ধুকে হঠাৎ করে এড়িয়ে যেতে শুরু করে অথবা আপনাকে খুলে বলে বিকৃত সেই মানুষের কৃতকর্মের কথা, তবে সময় নষ্ট না করে শিশুটির পক্ষ নিন আর তিরস্কার করে বাড়ি থেকে বার করে দিন ঐ ‘অসুস্থ’ লোকটাকে৷
ছবি: Fotolia/pegbes
স্কুলেরও দায়িত্ব আছে
বাচ্চারা দিনের অনেকটা সময় স্কুলে কাটায়৷ তাই যৌন শিক্ষার ক্ষেত্রে স্কুলের একটা বড় দায়িত্ব থেকে যায়৷ তবে স্কুলের মধ্যে, বিদ্যালয় চত্বরেও ঘটতে পারে শিশু নির্যাতনের ঘটনা৷ তাই স্কুল থেকে ফেরার পর বাচ্চা যদি অতিরিক্ত চুপচাপ থাকে, একা একা সময় কাটায় বা পড়াশোনা করতে না চায়, তাহলে ওর সঙ্গে কথা বলুন৷ জানতে চান কী হয়েছে, প্রয়োজনে স্কুল কর্তৃপক্ষকেও জানান৷
ছবি: picture-alliance/blickwinkel
ছেলে-মেয়ে সমান!
আমাদের সমাজে ছোট থেকেই মেয়েদের সঙ্গে বৈষম্যমূলক আচরণ করা হয়৷ মেয়ে হলেই হাতে একটা পুতুল আর ছেলে হলে ধরিয়ে দেয়া হয় বল বা খেলনার পিস্তল৷ ছেলের পাতে যখন তুলে দেয়া হয় মাছের বড় টুকরোটা, তখন মেয়েটির হয়ত এক গ্লাস দুধও জোটে না৷ এ বৈষম্য বন্ধ করুন৷ বাবা-মায়ের চোখে ছেলে-মেয়ে সমান – সেভাবেই বড় করুন তাদের৷ তা না হলে নারীর ক্ষমতায়ন হবে কীভাবে? কীভাবে কমবে শিশু নির্যাতন?
ছবি: picture alliance/abaca
7 ছবি1 | 7
তবে ঠিক কী কারণে সুইস যুগলের উপর হামলা চালানো হলো, সেটা এখনও পরিষ্কার নয়৷
সাম্প্রতিক সময়ে ভারতে যৌন সহিংসতা ভয়াবহ রূপ নিয়েছে এবং অনেক পশ্চিমা দেশ ভারত সফরের সময় হামলার ঝুঁকি আছে বলে পর্যটকদের সতর্কও করে দিয়েছে৷
সুইস দূতাবাসের ওয়েবসাইটে পর্যটকদের ভারতে ‘ভয়ংকর' সব অপরাধের ব্যাপারে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে, বিশেষ করে জনপ্রিয় স্থানগুলোতে৷
এদিকে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এই ঘটনা নিয়ে নিন্দার ঝড় উঠেছে৷ অনেকেই পর্যটকদের যথার্থ নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হওয়ায় উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের সমালোচনা করেছেন৷ বিরোধী দল কংগ্রেস পার্টির এক নেতা মিলিন্দ দেওরা টুইটারে লিখেছেন, ‘‘ভারতের সবচেয়ে বড় রাজ্যে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির যে কী ভয়াবহ অবনতি হয়েছে, এটা তারই লজ্জাজনক একটি উদাহরণ৷ যোগী আদিত্যনাথ কী শুনতে পাচ্ছেন?''
ভারতে বিদেশি পর্যটকদের নিরাপত্তার বিষয়টি নিয়ে আগেও প্রশ্ন উঠেছে৷ ২০১৩ সালেই বিদেশি নারী পর্যটকদের শ্লীলতাহানি ও ধর্ষণের বেশ কিছু ঘটনা ঘটে৷ সে বছরের জানুয়ারিতে মধ্যপ্রদেশে ধর্ষিতা হন এক কোরীয় নারী৷ এছাড়া কলকাতায় এক আইরিশ নারী, মানালিতে অ্যামেরিকান নারী , মধ্যপ্রদেশের দাতিয়া জেলায় এক সুইস মহিলা ধর্ষণের শিকার হন৷ এর আগে ২০১২ সালের ডিসেম্বরে দিল্লিতে এক বিদেশিনীকে ধর্ষণ করা হয়৷