ভারতে বন্দি সুখরঞ্জন বালিকে দেশে ফিরিয়ে আনার দাবি করেছেন জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর আইনজীবী ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক৷ তিনি দাবি করেন, পুলিশ সুখরঞ্জনকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের গেট থেকে ধরে নিয়ে যায়৷
বিজ্ঞাপন
সাঈদীর আইনজীবী প্যানেলের প্রধান ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক বলেন, ‘‘সুখরঞ্জন বালিকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের গেট থেকে যশোরের বেনাপোল সীমান্তে নিয়ে গিয়ে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স (বিএসএফ)-এর হাতে তুলে দেয়৷ বিএসএফ তাকে অবৈধভাবে ভারতে অনুপ্রবেশের অভিযোগে গ্রেপ্তার করে দমদমের একটি কারাগারে তোলে৷ পরে ভারতীয় আদালত তাকে ১১০ দিনের কারাদণ্ড দেয়৷’’
সুখরঞ্জন নিজেও এসব কথা স্বীকার করেছেন – এ কথা উল্লেখ করে আবদুর রাজ্জাক বলেন, ‘‘বিভিন্ন গণমাধ্যমে ইতিমধ্যে এ সকল তথ্য এসেছে৷ এখন আমাদের দাবি, তাকে নিরাপদে যত দ্রুত সম্ভব দেশে ফিরিয়ে আনা হোক৷’’
সাঈদীকে ফাঁসির রায়, জামায়াতের তাণ্ডব
একাত্তরে যুদ্ধাপরাধের একাধিক অভিযোগ প্রমাণ হওয়ায় বৃহস্পতিবার দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে ফাঁসির আদেশ দিয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল৷ এই রায় ঘোষণার পর গোটা বাংলাদেশে তাণ্ডব চালিয়েছে জামায়াত-শিবির৷ এতে হতাহত অনেক৷
ছবি: AFP/Getty Images
ট্রাইব্যুনালের রায়
দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে ২০টি অভিযোগে গণহত্যা, হত্যা, ধর্ষণ, লুটতরাজসহ মানবতা বিরোধী অপরাধের কথা বলা হয়েছে৷ কয়েকটি অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ হওয়ায় ট্রাইব্যুনাল-১ এর প্রধান বিচারপতি এটিএম ফজলে কবীরের নেতৃত্বে ৩ সদস্যের আদালত মৃত্যুদণ্ডের রায় ঘোষণা করেন৷ অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম জানান, তার বিরুদ্ধে মানবতা বিরোধী ২০টি অভিযোগের ৮টি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ হয়েছে৷
ছবি: AP
রায়ের পরই তাণ্ডব
সাঈদীকে মৃত্যুদণ্ডের রায় ঘোষণার পরপরই রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় সক্রিয় হয়ে ওঠে জামায়াত-শিবির৷ শুধু বৃহস্পতিবার বিভিন্ন স্থানে সংঘর্ষে প্রাণ হারিয়েছে কমপক্ষে ৩৫ ব্যক্তি৷ বার্তাসংস্থা এএফপি এবং আমাদের কন্টেন্ট পার্টনার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম নিশ্চিত করেছে এই তথ্য৷ তবে শুক্রবার মৃতের সংখ্যা আরো বেড়েছে৷
ছবি: Reuters
আক্রান্ত পুলিশ
বৃহস্পতিবার জামায়াতের তাণ্ডবে প্রাণ হারান চার পুলিশ সদস্য৷ এদের মধ্যে তিনজন নিহত হন গাইবান্ধা জেলায়৷ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোরডটকম জানিয়েছে, ‘পুলিশ ফাঁড়িতে পিটিয়ে মারা হয় তাদের’৷ অপর একজন প্রাণ হারান চট্টগ্রামের লোহাগড়ায় সংঘর্ষের সময়৷ বার্তাসংস্থা এএফপি জানিয়েছে, আহত এক পুলিশ সদস্য শুক্রবার প্রাণ হারান৷ সবমিলিয়ে সাঈদীর রায় ঘোষণার পর শুক্রবার দুপুর অবধি পুলিশ সদস্য নিহতের সংখ্যা ৫৷
ছবি: STR/AFP/Getty Images
‘অধিকাংশই জামায়াত-শিবির কর্মী’
জামায়াত দাবি করেছে, ‘‘পুলিশের গুলিতে তাদের ৫০ জন ‘নিরপরাধ’ সমর্থক নিহত হয়েছে৷ পুলিশ তাদেরকে ‘পাখির মতো গুলি করে’ হত্যা করেছে৷’’ তবে মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের প্রধান সুলতানা কামাল পুলিশের উপর সন্ত্রাসী হামলার জন্য জামায়াতকে দায়ী করেছেন৷
ছবি: AFP/Getty Images
প্রাণ হারাচ্ছে নিরীহ মানুষও
জামায়াতের তাণ্ডবে পুলিশ সদস্য প্রাণ হারিয়েছেন, নিহত হয়েছেন আওয়ামী লীগ সমর্থকও৷ তবে সাধারণ মানুষও মরছে এই তাণ্ডবে৷ ঢাকায় বৃহস্পতিবার প্রাণ হারান এক পথচারী, নোয়াখালি এবং বাঁশখালীতে নিহত হন হিন্দু সম্প্রদায়ের দুই ব্যক্তি৷ শুক্রবারও গাইবান্ধায় এক রিকশা চালক নিহত হয়েছেন ক্ষমতাসীন দলের এবং জামায়াতের সমর্থকদের মধ্যকার সংঘর্ষের মাঝে পড়ে৷ নিরীহ প্রাণহানির এরকম খবর আরো শোনা যাচ্ছে৷
ছবি: AFP/Getty Images
‘ফেসবুক বন্ধ’
সাঈদীর বিরুদ্ধে রায় ঘোষণার সময় বাংলাদেশ থেকে কম্পিউটার ব্যবহার করে স্বাভাবিক উপায়ে ফেসবুকে প্রবেশ করা যাচ্ছিল না৷ নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসি’র ভাইস চেয়ারম্যান গিয়াসউদ্দিন আহমেদ জানান, ‘কারিগরি সমস্যার জন্য এমনটা হয়েছে’৷ তবে তথ্য প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ জাকারিয়া স্বপন বলেন, ‘বৃহস্পতিবার তারা (বিটিআরসি) কিছুক্ষণের জন্য ফেসবুক বন্ধ করে দিয়েছিল এবং পুনরায় আবারো চালু করেছে৷’
সতর্ক নিরাপত্তা বাহিনী
জামায়াত-শিবির তাণ্ডব আর নাশকতা রুখতে গোটা দেশে সতর্ক রয়েছে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা৷ বৃহস্পতিবার রাতেই বিভিন্ন এলাকায় মোতায়েন করা হয়েছে বিজিবি৷
ছবি: Reuters
ভিন্ন চিত্র
তবে সাঈদীর ফাঁসির রায়ে সামগ্রিকভাবে সন্তুষ্ট সাধারণ মানুষ৷ বৃহস্পতিবার এই রায় ঘোষণার পর উল্লাসে ফেটে পড়েন শাহবাগে অবস্থানরতরা৷ বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় মিষ্টি বিতরণ করা হয়৷ ফেসবুকে প্রতিক্রিয়া জানান অগুনতি মানুষ৷
ছবি: Reuters
‘শহীদের আত্মা শান্তি পাবে’
সাঈদীর বিরুদ্ধে একটি মামলার বাদি ও প্রথম সাক্ষী মাহবুবুল আলম হাওলাদার৷ রায় ঘোষণার পরে ডয়চে ভেলেকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘সাঈদীর ফাঁসির আদেশ হওয়ায় দেশমাতৃকা কিছুটা পাপমুক্ত হয়েছে, যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তির জন্য ৪২ বছরের অপেক্ষার অবসান হতে চলেছে৷’
ছবি: DW/Harun Ur Rashid
আরো রায় বাকি
এখন পর্যন্ত তিন যুদ্ধাপরাধীর বিরুদ্ধে রায় ঘোষণা করছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল৷ বাকি আছে আরো যুদ্ধাপরাধীর বিচার৷ মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তি অপেক্ষায় আছে সব যুদ্ধাপরাধীর বিচার দেখার৷ বর্তমান তরুণ প্রজন্মও তাই জেগে আছে প্রজন্ম চত্বরে৷
ছবি: AP
10 ছবি1 | 10
তবে সাঈদীর আইনজীবী প্যানেলের এই দাবি অযৌক্তিক আখ্যা দিয়ে রাষ্ট্রপক্ষের প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট সৈয়দ হায়দার আলী ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘সুখরঞ্জন ছিলেন সাঈদীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী৷ অথচ রাষ্ট্রপক্ষে যখন সাক্ষ্য চলছিল তখনই তাকে পাওয়া যাচ্ছিল না৷ এ কারণে তার পরিবার তখন থানায় সাধারণ ডায়েরিও করে৷ এরপর তাকে বাদ দিয়েই রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষ্য শেষ করা হয়৷ আসামিপক্ষেও ১৭ জন সাক্ষী সাক্ষ্য দেন৷ তখনও তারা (আসামিপক্ষ) বলেননি যে সুখরঞ্জন তাদের পক্ষে সাক্ষী দেবেন৷ উভয় পক্ষের সাক্ষী যখন শেষ, তখন একদিন হুট করেই সাঈদীর আইনজীবীরা বললেন যে, সুখরঞ্জন তাদের পক্ষে সাক্ষী দিতে ট্রাইব্যুনালে আসার সময় গেট থেকেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাকে ধরে নিয়ে গেছে৷ আসলে মামলাটিকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার জন্যই তারা এই দাবি তুলেছেন৷‘‘
তিনি প্রশ্ন তুলে বলেন, ‘‘সুখরঞ্জনকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কেন ধরে নিতে যাবে? সুখরঞ্জন সাঈদীর পক্ষে সাক্ষী দিলেই যে সবকিছু তার পক্ষে চলে যাবে, এমন তো নয়৷’’ তিনি দাবি করেন, আসলে সাঈদীর পক্ষের লোকজনই সুখরঞ্জনকে সরিয়ে ফেলেছে এবং রাষ্ট্রপক্ষে সাক্ষী দিতে দেয়নি৷
সরকারি প্রসিকিউটরের এমন বক্তব্যকে মানতে রাজি নন ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক৷ তিনি বলেন, ‘‘সুখরঞ্জন ছিলেন সাঈদীর পক্ষের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একজন সাক্ষী৷ যে কারণেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাকে ধরে নিয়ে গেছে৷ সরকারি আইনজীবীরা এ নিয়ে মিথ্যাচার করছেন৷ তাই সুখরঞ্জনকে দেশে ফিরিয়ে আনলেই সব বিষয় পরিষ্কার হয়ে যাবে৷’’
তিনি বলেন, গণমাধ্যমের রিপোর্টে এসব ব্যাপার অবশ্য পরিষ্কার হয়ে গেছে ইতিমধ্যেই৷
গত বছরের ৫ নভেম্বর জামায়াতের নায়েবে আমীর দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর পক্ষে সাক্ষ্য দিতে এসে যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের গেট থেকে অপহৃত হন সুখরঞ্জন – শুরু থেকেই এমন দাবি করে আসছেন সাঈদীর আইনজীবীরা৷ এদিকে, সুখরঞ্জনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে বাংলাদেশ ও ভারতীয় কর্তৃপক্ষকে আহ্বান জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডাব্লিউ)৷ এইচআরডাব্লিউ-এর এশিয়া বিষয়ক পরিচালক ব্রাড এডামস এক বিবৃতিতে বলেন, যুদ্ধাপরাধের বিচার চলাকালে এভাবে সাক্ষী অপহরণের ঘটনা রাষ্ট্রপক্ষ, বিচারক ও সরকারের আচরণের বিষয়ে গভীর উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে৷
আসামিপক্ষের এমন অভিযোগ ট্রাইব্যুনালের নজরে আনা হলে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীদের বিষয়টি তদন্তের নির্দেশ দেয় আদালত৷ তবে রাষ্ট্রপক্ষ পরে আদালতকে জানায় যে, আসামিপক্ষের এই অভিযোগ সত্যি নয়৷ এ ধরনের কোনো ঘটনা ঘটেইনি এবং এ বিষয়ে আদালত আর কোনো আদেশও দেয়নি৷