বাংলাদেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে গ্রাহকদের টাকা রাখার পরিমাণ বাড়ছে৷ সুদের হার বৃদ্ধি ও বিকল্প না থাকায় টাকা জমা রাখতে মানুষ আবারও ব্যাংকে ফিরছেন বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা৷
বিজ্ঞাপন
গ্রাহকদের আমানতের সুদহার বাড়িয়েছে বাংলাদেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো৷ এতদিন চাইলেও তাদের ইচ্ছামাফিক সুদহার বাড়ানোর স্বাধীনতা ছিল না৷ ২০২০ সালের এপ্রিলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশ অনুযায়ী ঋণের সুদহার নয় শতাংশ ও আমানতের সুদহার ছয় শতাংশের মধ্যে রাখার বাধ্যবাধকতা ছিল৷ সবশেষ মুদ্রানীতিতে সেই সীমা তুলে দেয়ার পর আমানত সংগ্রহের প্রতিযোগিতায় ব্যাংকগুলো সুদহার বাড়িয়েছে৷ এখন গ্রাহকদের আট শতাংশ পর্যন্তও সুদ দিচ্ছে কোনো কেনো ব্যাংক৷ যেখানে গত ডিসেম্বরে গড় সুদহার ছিল মাত্র চার শতাংশের কিছু বেশি৷
এরইমধ্যে যেসব ব্যাংক আমানতে সুদের হার বাড়িয়েছে তার মধ্যে আছে পদ্মা ব্যাংক,সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংক, এক্সিম ব্যংক, আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংক, রূপালী ব্যাংক, জনতা ব্যাংক, কৃষি ব্যাংক৷ জুলাই নাগাদ আরো অনেক ব্যাংকের সুদের হার বৃদ্ধির সম্ভাবনা আছে৷
অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘‘এখন সুদের হার কিছুটা বেড়েছে৷ মূল্যস্ফীতির চেয়ে সুদের হার অনেক কম থাকায় মানুষ ব্যাংকে টাকা রাখায় আগ্রহ হারাচ্ছিল৷”
বিশ্লেষকদের মতে ব্যাংকে মানুষ টাকা রেখে যাতে লাভবান হন সেজন্য আমানতের সুদহার হতে হবে মূল্যস্ফীতির হারের চেয়ে বেশি৷ বর্তমানে মূল্যস্ফীতি প্রায় সোয়া নয় ভাগ৷ সেই হিসেবে আমানতের সুদ হার এখনও কম৷
মানুষ ব্যাংকে টাকা রাখা শুরু করেছে: সালেহ উদ্দিন আহমেদ
বাড়ছে আমানতের পরিমাণ
বাংলাদেশে শেয়ার বাজারে অনিশ্চয়তা, সঞ্চয়পত্রে নানা বিধিনিষেধের কারণে ব্যাংকই সাধারণ মানুষের অর্থ জমা রাখার প্রধান মাধ্যম হয়ে উঠেছে৷ কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাংক খাতে নানা ঋণ জালিয়াতির খবরে গ্রাহকদের মধ্যে আস্থার ঘাটতি তৈরি হয়৷ কমে আসে আমানতের প্রবৃদ্ধির হারও৷ ২০২১ সালের মে মাসে যেখানে বার্ষিক আমানতের প্রবৃদ্ধি ছিল প্রায় সাড়ে ১৪ শতাংশ, সেখানে গত বছরের ডিসেম্বরে তা সাড়ে পাঁচ শতাংশে নেমে আসে৷ এই হার স্মরণকালের সর্বনিম্ন৷ বাংলাদেশ ব্যাংকের সবশেষ প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, মার্চে তা বেড়ে সাড়ে সাত শতাংশ হয়েছে৷ এক বছরে বাংলাদেশে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে এক লাখ ছয় হাজার ৬১৫ কোটি টাকার আমানত বেড়েছে৷ মোট আমানতের পরিমাণ বেড়ে হয়েছে ১৫ লাখ ২৩ হাজার কোটি টাকা, যা আগের বছরে ছিল ১৪ লাখ ১৬ হাজার কোটি টাকা৷
সুদের হার বৃদ্ধি ছাড়াও এর পেছনে আরো তিনটি কারণ উল্লেখ করছেন ব্যাংকাররা৷ তাদের মতে ইসলামী ব্যাংকের ঘটনায় ব্যাংক খাতে নিয়ে গ্রাহকদের মধ্যে যে অনাস্থা তৈরি হয়েছিল তা এখন অনেকটা কেটেছে৷ বিনিয়োগের অন্য কোনো বিকল্প না থাকায় মানুষ ব্যাংকেই ফিরে আসছেন৷ সেই সঙ্গে তারল্য সংকট কাটাতে ব্যাংকগুলো ঋণ দেয়ার ধীর নীতি অনুসরণ করছে৷
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, “ব্যাংকের প্রতি এর আগে মানুষ আাগ্রহ হারিয়ে ফেলছিলো৷ সুদের হার ছিলো অনেক কম৷ আর নানা কারণে আস্থার সংকটও তৈরি হয়েছিলো৷ অনেকে ব্যাংক থেকে টাকা তুলে জমি, ফ্ল্যাট বিলাস সামগ্রী কিনেছেন৷ কিন্তু জমি, ফ্ল্যাটে বিনিয়োগ করলে তাতে অর্থনীতির তেমন লাভ হয় না৷’’
উন্নতি হয়েছে, তবে যথেষ্ট নয়
আমানত বৃদ্ধির হারকে এখনও যথেষ্ট বলে মনে করেন না ব্যাংকাররা৷ ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়াম্যান ও পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘‘আমানতের সামান্য উন্নতি হয়েছে৷ তবে এটা যথেষ্ট নয়৷ আমানত না বাড়লে ব্যাংক কম ঋণ দেবে৷ বিনিয়োগ কম হবে৷”
তিনি বলেন, ‘‘এর আগে আমানত কমে যাওয়ার প্রধান কারণ ছিলো ডলার সংকট এবং ডলারের দাম বেড়ে যাওয়া৷ তার সঙ্গে ছিলে ব্যাংকের ওপর আস্থাহীনতা৷ তবে এক ব্যাংকের প্রতি আস্থা কমে গেলে সেখান থেকে টাকা তুলে আরেক ব্যাংকে রাখেন আমানতকারীরা৷”
ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদও মনে করেন, আমানতের বৃদ্ধি ইতিবাচক হলেও, যে হারে বাড়ছে তা এখনও যথেষ্ট নয়৷ তিনি বলেন, ‘‘সুদের হার কিছুটা বাড়ায় মানুষ ব্যাংকে টাকা রাখা শুরু করেছে৷ এটা ধরে রাখতে হবে৷’’
গত ডিসেম্বরের ছবিঘর দেখুন...
ব্যাংক খাতের আলোচিত কিছু অনিয়ম-দুর্নীতি
ভুয়া ঠিকানা ব্যবহার করে ইসলামী ব্যাংক থেকে কোটি কোটি টাকা ঋণ নেয়ার অভিযোগ সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে৷ ব্যাংক খাতে অনিয়ম-দুর্নীতির ঘটনা অতীতেও ঘটেছে৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
ইসলামী ব্যাংকে ঋণ অনিয়ম
সম্প্রতি প্রথম আলোর এক প্রতিবেদনে বলা হয় বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ভুয়া ঠিকানা ব্যবহার করে ইসলামী ব্যাংক থেকে ৭ হাজার ২৪৬ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে৷ এসব মূলত নামসর্বস্ব কোম্পানি৷ এই প্রতিবেদন প্রকাশের পর কেন্দ্রীয় ব্যাংক তদন্ত শুরু করেছে৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
স্যোশাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেডে অনিয়ম
বাংলাদেশে ডয়চে ভেলের কনটেন্ট পার্টনার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের এক প্রতিবেদন বলছে, নিয়ম না মেনে দুই কোম্পানিকে ব্যাক টু ব্যাক এলসি সুবিধায় বছরের পর বছর ধরে পণ্য আনার সুযোগ দিয়ে স্যোশাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেডের (এসআইবিএল) প্রায় ১৫৮ কোটি ৫৯ লাখ ডলার এখন আটকে গেছে৷ কোম্পানি দুটি হলো শার্প নিটিং অ্যান্ড ডাইং ইন্ডাস্ট্রিজ ও ব্লাইথ ফ্যাশনস লিমিটেড৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
হলমার্ক কেলেঙ্কারি ও সোনালী ব্যাংক
২০১২ সালে এই চাঞ্চল্যকর ঘটনা ফাঁস হয়৷ সে সময় কেবল সোনালী ব্যাংকের শেরাটন শাখা থেকে ২০১০-২০১২ সময়ে মোট তিন হাজার ৫৪৭ কোটি টাকা জালিয়াতির মাধ্যমে আত্মসাৎ করা হয়৷ এর মধ্যে অখ্যাত হলমার্ক গ্রুপ একাই আত্মসাৎ করে ২ হাজার ৬৮৬ কোটি ১৪ লাখ টাকা৷ এই ঘটনায় সোনালী ব্যাংকের কর্মকর্তা ও হলমার্কের মালিককে আটক করা হয়৷ সেই ঘটনার বিচারকাজ এখনো চলছে৷ টাকাও আদায় করতে পারছে না সোনালী ব্যাংক৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
বেসিক ব্যাংকে জালিয়াতি
রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ পাওয়া আব্দুল হাই বাচ্চু পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান নিয়োগ পাওয়ার পর ব্যাংকটি অনিয়ম ও দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়৷ ২০০৯ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে ব্যাংকটিতে সাড়ে চার হাজার কোটি টাকার ঋণ বিতরণে বড় ধরনের অনিয়ম পায় বাংলাদেশ ব্যাংক৷ ব্যাংকের টাকা মেরে দিতে উদ্দেশ্যমূলকভাবে অনেক ভুয়া প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দেয়া হয়৷ এসব ঋণের বেশিরভাগই আর ব্যাংকে ফেরত আসেনি৷
বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের আমলে ২০০৫ সালে ঘটে এই ঘটনা৷ ব্যাংকটির তৎকালীন উদ্যোক্তারা অনিয়মের মাধ্যমে হাতিয়ে নেন প্রায় ৬০০ কোটি টাকা৷ লুটপাটের কারণে ২০০৬ সালে ব্যাংকটি অতিরুগ্ন হয়ে পড়ে৷ মালিকপক্ষের হাতে থাকা ব্যাংকের ৮৬ শতাংশ শেয়ারও বাজেয়াপ্ত করা হয়৷ তা কিনে নেয় আইসিবি গ্রুপ৷ তারপর ব্যাংকটির নাম পরিবর্তিত হয়ে আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক হয়৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
বিসমিল্লাহ গ্রুপের কারণে সমস্যায় পাঁচ ব্যাংক
২০১২ ও ২০১৩ সালে বিসমিল্লাহ গ্রুপ কয়েকটি ব্যাংক থেকে ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছিল৷ এতে জনতা, প্রাইম, যমুনা, প্রিমিয়ার ও শাহ্জালাল ইসলামী ব্যাংক সমস্যায় পড়েছিল৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
সাবেক ফারমার্স ব্যাংক (বর্তমানে পদ্মা ব্যাংক)
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে অনুমোদন পাওয়া ফারমার্স ব্যাংকের ছয় শাখায় প্রায় ৪০০ কোটি টাকার ঋণ অনিয়ম পাওয়া যায়৷ পরে সরকারের উদ্যোগে সরকারি চার ব্যাংক ও একটি বিনিয়োগ সংস্থা মূলধন সহায়তা দেয়৷ বর্তমানে নাম পরিবর্তন করে ব্যাংকের নাম হয়েছে পদ্মা৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
অ্যাননটেক্স গ্রুপকে দেয়া ঋণ পাচ্ছে না জনতা ব্যাংক
অ্যাননটেক্স গ্রুপের মালিক ইউনুস বাদলকে জনতা ব্যাংক মাত্র ছয় বছরে ৫ হাজার ৫০৪ কোটি টাকার ঋণ ও ঋণসুবিধা দিয়েছিল৷ গ্রাহক এখন এই ঋণ এখন পরিশোধ করতে পারছেন না৷ ছবিতে অ্যাননটেক্স গ্রুপের কার্যালয় দেখা যাচ্ছে৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
ইউনিয়ন ব্যাংকের ঋণ বিতরণে অনিয়ম
প্রায় ৩০০ প্রতিষ্ঠান ট্রেড লাইসেন্সের ভিত্তিতে কোম্পানি গঠন করে ইউনিয়ন ব্যাংক থেকে ঋণের বড় অংশ তুলে নিয়েছে৷ অনেকের আবার ট্রেড লাইসেন্সও ছিল না৷ এসব ঋণের বেশিরভাগেরই এখন খোঁজ মিলছে না৷ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, ইউনিয়ন ব্যাংকের বিতরণ করা ঋণের ১৮ হাজার ৩৪৬ কোটি টাকা খেলাপি হওয়ার যোগ্য, যা ব্যাংকটির মোট ঋণের ৯৫ শতাংশ৷