সুদানের বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলির সঙ্গে ঐতিহাসিক চুক্তি অস্থায়ী সরকারের। গৃহযুদ্ধের অবসান হতে পারে বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
বিজ্ঞাপন
১৭ বছরেরও কিছু বেশি সময় ধরে গৃহযুদ্ধ চলছে সুদানে। সোমবার তার সমাধানসূত্র মিলল বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। সুদানের অস্থায়ী সরকারের সঙ্গে বিদ্রোহী জোটের ঐতিহাসিক চুক্তি সই হয়েছে এ দিন। সব ঠিক থাকলে আপাতত গোটা দেশে শান্তি সুনিশ্চিত হবে বলেই মনে করছে দুই পক্ষ। টেলিভিশনে চুক্তি সইয়ের অনুষ্ঠানটি দেখার পরে খুশি সুদানের সাধারণ মানুষও। তবে দুইটি গুরুত্বপূর্ণ বিদ্রোহী গোষ্ঠী এই চুক্তিতে অংশ নেয়নি। ফলে সমস্যার পুরোপুরি সমাধান হয়ে গিয়েছে, এখনই তা বলা যাচ্ছে না বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞদের অন্য অংশ।
দীর্ঘ ১৭ বছর ধরে গোষ্ঠী সংঘর্ষে উত্তাল সুদান। একের পর এক সরকারের পতন হয়েছে। সেনা বিদ্রোহে দেশ ছাড়তে হয়েছে সাবেক শাসকদের। এক একটি অঞ্চলের দখল নিয়েছে বিভিন্ন গোষ্ঠীর বিদ্রোহীরা। এ ভাবেই দীর্ঘ দিন ধরে গোলা বারুদের মধ্যে জীবন কাটছিল সুদানবাসীর। লাখ লাখ মানুষ একবার নয়, বার বার ঘরছাড়া হয়েছেন। তাঁদের দিন কাটছে আশ্রয়শিবিরে। ঘোর অনিশ্চয়তায়। এই পরিস্থিতিতে সোমবারের চুক্তিকে অধিকাংশ মানুষই ঐতিহাসিক বলে মনে করছেন।
২০১৯: বিক্ষোভের বছর
জাতিগত বৈষম্য, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, দুর্নীতি এবং জলবায়ু পরিবর্তন রোধের দাবি নিয়ে এবছর সারা বিশ্বের লাখো মানুষ বিক্ষোভ করেছেন৷ ভারত থেকে হংকং বা ইরাক থেকে সুদান, দাবি আদায়ে পুরো সাল জুড়েই রাস্তায় গণআন্দোলন চলেছে৷
ছবি: picture-alliance/Pacific Press/S. Sen
ভারতে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ
বছরের শেষ দিকে এসে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন নিয়ে পুরো ভারতে বিক্ষোভের আগুন জ্বলছে৷ ধর্মীয় বৈষম্যপূর্ণ ওই আইনের বিরুদ্ধে সব ধর্মের লোকজন একত্রিত হয়ে আন্দোলন করছেন, এক সপ্তাতেই ঝরেছে অন্তত ২৩ প্রাণ৷
ছবি: Reuters/D. Sissiqui
বিশ্ববিদ্যালয়ে হামলা
নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের বিরুদ্ধে রাজধানী দিল্লির জামিয়া মিলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলন শুরু হলে পুলিশ পাল্টা আঘাত করে; ক্যাম্পাস পরিণত হয় রণক্ষেত্রে৷
ছবি: Reuters/A. Abidi
হংকংয়ের স্থিতিশীলতায় ধাক্কা
চীনের মূলভূখণ্ডে বন্দি প্রত্যর্পণ নিয়ে প্রস্তাবিত একটি বিল বাতিলের দাবিতে জুন থেকে হংকংয়ে যে বিক্ষোভ শুরু হয়েছিল তা এখন স্বায়ত্তশাসিত এ অঞ্চলের স্বাধিকার আন্দোলনে পরিণত হয়েছে৷ গণদাবির মুখে সেপ্টেম্বরেই বিলটি বাতিল করা হলেও আন্দোলন থামেনি৷
ছবি: Reuters/T. Peter
নির্বাচনেও প্রভাব
হংকংয়ের স্বাধিকার আন্দোলনে লাখো মানুষ সড়কে নেমে বিক্ষোভ করছে৷ এ আন্দোলন সাধারণ মানুষের মধ্যে এতটাই সাড়া ফেলেছে যে নভেম্বরে এশিয়ার গুরুত্বপূর্ণ এই বাণিজ্য নগরীর স্থানীয় নির্বাচনে গণতন্ত্রপন্থিরা বিশাল জয় পেয়েছেন৷
ছবি: Reuters/T. Siu
আবারও উত্তপ্ত হচ্ছে ইরাক
সাবেক স্বৈরশাসক সাদ্দামের আমল থেকেও ‘খারাপ সময়ের’ মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন ইরাকিরা৷ দুর্নীতি, বেকারত্ব, সরকারের উপর ইরানের প্রভাব ইত্যাদি নানা অভিযোগ নিয়ে অক্টোবর থেকে সাধারণ মানুষ সড়কে নেমে বিক্ষোভ করছে৷ বিক্ষোভ দমনে সরকারের নৃংসতায় এরই মধ্যে ৪৬০ মানুষ নিহত এবং ২৫ হাজার মানুষ আহত হয়েছেন৷
ছবি: Reuters/A. Jadallah
বৈরুতে সংহতির মুষ্টি
জ্বালানি ও তামাক পণ্যের উপর বাড়তি করারোপ এবং ইন্টারনেট ব্যবহারের উপর বিধিনিষেধের বিরুদ্ধে লেবাননের রাজধানী বৈরুতে অক্টোবরে যে আন্দোলন শুরু হয় তা থামাতে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরে দাঁড়ান সাদ হারিরি৷ কিন্তু পদ থেকে সরে গেলেও হারিরি ক্ষমতার কেন্দ্রে থেকে যাওয়ায় বিক্ষোভ চলছে৷
ছবি: Reuters/A. M. Casares
ইরানে জ্বালানি তেল নিয়ে বিক্ষোভ
বিশ্বের বৃহৎ তেল উৎপাদনকারী দেশ ইরানের উপর যুক্তরাষ্ট্রের কঠোর নিষেধাজ্ঞার কারণে নভেম্বর থেকে দেশটিতে জ্বালানি তেলের উপর রেশনিং শুরু হয়, পেট্রোলের দাম প্রায় ৫০ শতাংশ বেড়ে গেছে৷ যার বিরুদ্ধে ২১টি নগরীতে সহিংস বিক্ষোভ হয়৷ বিক্ষোভে হাজারের বেশি মানুষকে হত্যা করা হয়েছে বলে দাবি যুক্তরাষ্ট্রের৷
ছবি: Getty Images/AFP
ক্ষমতার লড়াই
এপ্রিলে সুদানের ক্ষমতা থেকে ওমর আল-বশিরকে উৎখাতের পর থেকেই দেশটির সেনাবাহিনী ও গণতন্ত্রপন্থিদের মধ্যে ক্ষমতার কেন্দ্রে যাওয়ার লড়াই চলছে৷ যাতে কয়েক ডজন মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa/AP
রঙিন বিক্ষোভ
চলমান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা নিয়ে উদ্বেগ এবং আরো উন্নত স্বাস্থ্যসেবা, অবসর ভাতা এবং শিক্ষা ব্যবস্থার দাবিতে দুই মাস আগে চিলিতে বিক্ষোভ শুরু হয়৷ তবে বিক্ষোভে এখনো নৃশংসতার খবর পাওয়া যায়নি৷
ছবি: Reuters/I. Alvarado
স্বাধীনতার লড়াই
স্পেনের স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল বার্সেলোনা বহুদিন ধরেই স্বাধীনতা চাইছে৷ স্বাধীনতা প্রশ্নে গণভোটের আয়োজন হলেও কেন্দ্র সরকারের কঠোর হস্তক্ষেপে তা ভণ্ডুল হয়ে যায়৷ মাদ্রিদ সরকারের দমনের বিরুদ্ধে কাতালুনিয়ায় বিক্ষোভ তাই নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হয়েছে৷
ছবি: REUTERS/J. Nazca
10 ছবি1 | 10
সুদানের অস্থায়ী সরকারের সঙ্গে রেভোলিউশনারি ফ্রন্ট বা এসআরএফ-এর চুক্তি সই হয়েছে এ দিন। প্রায় নয় মাস ধরে এই চুক্তির পরিকল্পনা চলছিল। কিন্তু বিভিন্ন বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলিকে এক ছাতার তলায় আনা যাচ্ছিল না। দীর্ঘ আলোচনার পরে অধিকাংশ বিদ্রোহী গোষ্ঠী এক ছাতার তলায় আসতে রাজি হয়। সুদানের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী আবদাল্লা হামদাক চুক্তিতে সই করেছেন। বস্তুত, তাঁর চেষ্টাতেই এই চুক্তি সম্ভব হলো বলে মনে করছেন অধিকাংশ বিশেষজ্ঞ। দক্ষিণ সুদানের রাজধানী শহরে এই অনুষ্ঠান হয়েছে। পুরো অনুষ্ঠানটিই টেলিভিশনে সম্প্রচার করা হয়েছে। শান্তি প্রতিষ্ঠা ছাড়াও ক্ষমতায় বন্টন, ক্ষতিপূরণ ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়েরও উল্লেখ আছে চুক্তিতে। এর ফলে নীল নদের উপত্যকা ঘিরে দীর্ধদিন ধরে যে বিতর্ক ছিল, তারও সুরাহা হবে বলে মনে করা হচ্ছে। গৃহহীনরা তাঁদের বাসস্থানে ফিরতে পারবেন।
নীল নদের ধারে দক্ষিণ কোরদফান এবং পশ্চিম কোরদোফান নিয়ে দীর্ঘ দিন ধরে সমস্যা রয়েছে। চুক্তিতে বলা হয়েছে, ওই দুই অঞ্চলে স্বায়ত্ত্ব শাসনের সুযোগ দেওয়া হবে। বস্তুত, গত ১৭ বছর ধরে যে বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলিকে এক মঞ্চে আনা যায়নি, সোমবার তা-ই সম্ভব হয়েছে। বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলিও জানিয়েছে, এই চুক্তি শান্তি প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করবে। সাধারণ মানুষ যন্ত্রণার থেকে মুক্তি পাবেন।
তবে বিশেষজ্ঞদের একাংশের বক্তব্য, সুদানের সব চেয়ে বড় দুইটি বিদ্রোহী গোষ্ঠী এই চুক্তিতে অংশ নেয়নি। ফলে শান্তি প্রক্রিয়া কতদিন স্থায়ী হবে তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। ওই দুই বিদ্রোহী গোষ্ঠী শান্তির পক্ষে কথা না বললে ভবিষ্যতে সমস্যা আছে বলেই মনে করছেন অনেকে। তবে অস্থায়ী সরকার চুক্তিটি নিয়ে আশাবাদী। তাদের বক্তব্য, নতুন করে সুদানকে গড়ে তোলার বিষয়ে ভাবনাচিন্তা শুরু করা হয়েছে। সেনার বাজেট কমিয়ে তা মানুষের উন্নতিতে ব্যবহারের পরিকল্পনা করা হয়েছে।
সোমবারের এই ঐতিহাসিক চুক্তিকে স্বাগত জানিয়েছে অ্যামেরিকা, নরওয়ে এবং যুক্তরাজ্য। সুদানের উন্নতির জন্য তারা সাহায্য করতে প্রস্তুত বলে জানিয়েছে আন্তর্জাতিক মহল।