সুন্দরবনের কাছে রামপালে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজ থামাতে বাংলাদেশের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে ইউনেস্কো৷ এই প্রকল্প বিশ্বের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ ফরেস্টের জন্য ক্ষতিকর মনে করছেন জাতিসংঘের সংস্থাটি৷
বিজ্ঞাপন
এদিকে, রামপালবিরোধীরা আবার হয়েছেন হামলার শিকার৷
জাতিসংঘের সংস্কৃতি এবং বিজ্ঞান বিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো বুধবার এক বিবৃতিতে বাংলাদেশ সরকারকে সুন্দরবনের কাছে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র না করার আহ্বান জানিয়েছে৷ সংস্থাটি মনে করে, সেখানে বিদ্যুৎকেন্দ্র হলে তা সুন্দরবনের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর হবে৷ আর বনটি ক্ষতিগ্রস্ত হলে ভবিষ্যতে বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতির মাত্রাও বাড়বে৷
এদিকে, সুন্দরবনের কাছে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিরোধিতা করে মঙ্গলবার ঢাকায় আয়োজিত এক মিছিলে পুলিশের বাধায় আহত হয়েছেন কয়েকজন৷ পুলিশ জলকামান ও টিয়ার সেল ছুঁড়ে মিছিলটি ছত্রভঙ্গ করে দেয়৷ রামপালে বিদ্যুৎকেন্দ্র বাতিলের দাবিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে লেখা খোলা চিঠি ঢাকাস্থ ভারতীয় হাইকমিশনে জমা দিতে মিছিলটির আয়োজন করা হয়৷
রামপাল বিরোধীদের মিছিলে পুলিশের বাধার বিষয়টি ফেসবুকে গুরুত্ব সহকারে জানিয়েছেন অনেকে৷ অ্যাক্টিভিস্ট লাকি আক্তার লিখেছেন, ‘‘সুন্দরবন বাঁচানোর লড়াইয়ে এ পর্যন্ত বহুবার আক্রমণ এসেছে৷ আজও (গতকাল) এর ব্যাতিক্রম ঘটেনি৷ রামপাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রকল্প বাতিল এবং সুন্দরবন বাঁচানোর দাবিতে ভারতীয় দূতাবাসের মাধ্যমে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর উদ্দেশে খোলা চিঠি প্রদান করতে জাতীয় কমিটির মিছিলে পুলিশের হামলার তীব্র নিন্দা জানাই৷''
তিনি লিখেছেন, ‘‘বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সংসদের সাধারণ সম্পাদক মশিউর সজীবসহ অনেক নেতাকর্মী আহত হয়েছেন৷ বিভিন্ন সংগঠনের অনেকেই আহত হয়েছেন৷ যত আক্রমণ আর বাধাই আসুক না কেন সুন্দরবন বাঁচানোর সংগ্রাম চলবেই৷ মশিউররা লড়বেই৷''
সুন্দরবন ও রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে প্রতিক্রিয়া
বিদ্যুৎ অবশ্যই দরকার, বিশেষ করে গরিবদের তো আরো বেশি দরকার৷ তারপরও রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র হলে তা হবে মর্মান্তিক৷ একদিকে দেশের-দশের প্রয়োজন, অন্যদিকে পরিবেশ বিপর্জয়ের ভয়৷ কী বলছে দেশের মানুষ?
ছবি: picture-alliance/dpa/Pacific Press/M. Hasan
মোশাহিদা সুলতানা, শিক্ষক
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালেয়ের শিক্ষক মোশাহিদা সুলতানা ঋতুর মতে, সুন্দরবনের পাশে এত বড় একটা কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র করে একে ঝুঁকির মধ্যে ফেলা কোনোভাবেই ঠিক হবে না৷ তাঁর মতে, সুন্দরবনের কোনো বিকল্প নেই, কিন্তু বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিকল্প আছে৷
ছবি: DW
সায়েম ইউ চৌধুরী, পাখি ও বন্যপ্রাণী গবেষক
৪০ বারেরও বেশি সুন্দরবনে গেছেন সায়েম৷ তিনি জানান, সম্প্রতি চট্টগ্রামের একটি সার কারখানা থেকে অ্যামোনিয়া গ্যাস নিঃসরণ হয়ে পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি হয়৷ পুকুরের মাছ, গাছপালা, প্রাণী – সব মারা পড়ে৷ এ রকম ছোট একটা সার কারখানার দুর্ঘটনা থেকে আমাদের পরিবেশ রক্ষা করার সক্ষমতা যেখানে নেই, সেখানে এত বড় একটি বিদ্যুৎকেন্দ্রে কোনো দুর্ঘটনা হলে আমাদের সরকার কী-ই বা করার থাকবে?
ছবি: DW
মারুফ বিল্লাহ, স্থানীয় বাসিন্দা
মারুফ বিল্লাহর জন্ম রামপালেই৷ ছোটবেলা থেকেই তিনি সুন্দরবনকে ধ্বংস হতে দেখে আসছেন৷ আর এখন সুন্দরবন ঘেঁষে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র করে একে ধ্বংসের আরেক পায়তারা করছে সরকার৷ তিনি জানান, সিডর আর আইলার পরে আমরা দেখেছি ঐ জনপদকে সে যাত্রায় বাঁচিয়েছিল সুন্দরবন৷ এখন যদি আমরাই তাকে মেরে ফেলি, তাহলে জনগণ কোথায় যাবে? তাই তাঁর প্রশ্ন, জীবন আগে, নাকি বিদ্যুৎ আগে?
ছবি: DW
সাইমুম জাহান হিয়া, শিক্ষার্থী
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সাইমুম জাহান হিয়া মনে করেন, সারা পৃথিবীতে বাংলাদেশের পরিচয় বহন করে বিশ্বের সবচেয়ে বড় এই ম্যানগ্রোভ বন৷ এর পাশে বিশাল আকারের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র হলে যে কখনো কোনো দুর্ঘটনা হবে না – এটা কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারবে না৷ তাঁর মতে, দেশের উন্নয়নের জন্য বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রয়োজন আছে, এটা ঠিক, তবে সেটা সুন্দরবনকে ধ্বংস করে নয়৷
ছবি: DW
হাসিব মোহাম্মদ, শিক্ষার্থী
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হাসিব মোহাম্মদ কয়েকবার সুন্দরবনে গেছেন৷ আসলে এই বনাঞ্চলের জীববৈচিত্র তাঁকে সবসময় টানে৷ তাই এ বনের কোনোরকম ক্ষতি করে তিনি এর কাছাকাছি রামপালের মতো কোনো বিদ্যুৎকেন্দ্র চান না৷ গত বছরের কয়েকটি ছোট ছোট জাহাজ সুন্দরবনে ডোবার পর যে ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল, সে কথাও মনে করিয়ে দেন তিনি৷ তাঁর আশঙ্কা, রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু হলে জাহাজ চলাচল বেড়ে গিয়ে দুর্ঘটনাও বাড়বে৷
ছবি: DW
মিমু দাস, শিক্ষার্থী
লেদার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছাত্র মিমু দাসও মনে করেন, সুন্দরবনের এত কাছে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র করা ঠিক হবে না৷ বিভিন্ন পত্র-পত্রিকার খবর পড়ে তাঁর মনে হয়েছে যে, এই বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি করবে৷ মিমু বিদ্যুৎকেন্দ্র চান, তবে সেটা অন্য কোথাও৷
ছবি: DW
আদনান আজাদ আসিফ, মডেল ও অভিনেতা
মডেল ও অভিনেতা আদনান আজাদ আসিফ একজন ওয়াইল্ডলাইফ ফটোগ্রাফারও৷ কয়েক বছর ধরে সময় পেলেই তিনি সুন্দরবনে ছুটে যান৷ বিশ্বের সবেচেয়ে বড় এই ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট বেঙ্গল টাইগারের একমাত্র আবাসস্থল৷ তাঁর মতে, সুন্দরবন বাংলাদেশের ফুসফুস৷ আর এমনিতেই নানা কারণে এখানে বাঘের সংখ্যা অস্বাভাবিক হারে হ্রাস পেয়েছে৷ তাই এর কাছাকাছি পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর এমন কোনো প্রকল্প করে এ বনকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়া ঠিক হবে না৷
ছবি: DW
আমিনুর রহমান, চাকুরিজীবী
ঢাকার একটি পরিবহন সংস্থায় কাজ করেন আমিনুর রহমান৷ তাঁর মতে, দেশের উন্নয়নের জন্য বিদ্যুৎ দরকার৷ তাই বড় কোনো বিদ্যুৎকেন্দ্র হলে দেশের জন্য ভালোই হবে৷ তাছাড়া তিনি শুনেছেন যে, রামপালে বিদ্যুৎকেন্দ্র হলে তা সুন্দরবনের কোনো ক্ষতিই করবে না৷
ছবি: DW
আব্দুল আজীজ ঢালী, মধু চাষি
সুন্দরবনে গত ৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে মধু আহরণ করেন সাতক্ষীরার আব্দুল আজীজ ঢালী৷ জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এ বনের সঙ্গে থাকতে চান তিনি৷ সুন্দরবনে থাকলেও রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র সম্পর্কে কিছুই জানেন না আব্দুল আজীজ৷
ছবি: DW
ভবেন বিশ্বাস, মাছ শিকারি
ভবেন বিশ্বাসের জীবিকার অন্যতম উৎস সুন্দরবন৷ উদবিড়াল দিয়ে এ বনে তিনি মাছ ধরেন ৩০ বছরেরও বেশি সময় ধরে৷ তাঁর বাবা ও ঠাকুরদাদার এ পেশা এখনো তিনি ধরে রেখেছেন৷ রামপালে বিদ্যুৎকেন্দ্র হচ্ছে এ খবর তিনি শুনে থাকলেও, এর ভালো বা খারাপের দিকগুলো – কিছুই জানা নেই তাঁর৷ তবে সুন্দরবনকে তিনি ভালোবাসেন, খুব ভালোবাসেন৷
ছবি: DW
10 ছবি1 | 10
আরেক অ্যাক্টিভিস্ট ব্রাত্য আমিন ফেসবুকে একাধিক ভিডিও পোস্ট করেছেন৷ একটি ভিডিওতে তিনি মিছিলে অংশ নেয়া সন্তানসহ এক মা'কে দেখিয়ে লিখেছেন, ‘‘একজন মা তাঁর সন্তানকে কোলে নিয়ে শ্লোগান দিতে দিতে যাচ্ছে সুন্দরবনকে বাঁচানোর সেই মিছিলে৷ আপনার শিশু না হয় থাকবে বিদেশে, কিন্তু এই শিশুরা কিভাবে বাঁচবে এই দেশে, যদি সুন্দরবনই না থাকে!''
ব্রাত্য আমিন মিছিলে পুলিশের টিয়ার সেল ছুঁড়ে মারার একটি ভিডিও ফেসবুকে প্রকাশ করেছেন৷ তিনি লিখেছেন, ‘‘এটা নাকি একটা স্বাধীন দেশ! আমরা নাকি স্বাধীন দেশের নাগরিক! এই কথাগুলো বলতে বা ভাবতে একটুও লজ্জা করে না আপনাদের? এই দেশের কোনো কিছুতেই কি আর আমাদের কিছুই যায় বা আসে না! আমরা এতটাই বোধশূন্য হয়ে যাচ্ছি! চারদিকে এত অন্যায়-অবিচার-অসততা দেখেও আমরা কি অদ্ভুত নির্বিকার! আমরা মানুষ তো, না!''
বলাবাহুল্য, পুলিশের বাধার মুখে পড়লেও রামপাল বিরোধীদের একটি দল মঙ্গলবার ভারতীয় দূতাবাসে চিঠিটি পৌঁছে দিতে সক্ষম হয়৷ একইদিন ভারতের একদল রামপাল বিরোধী আন্দোলনকারীও সেদেশের প্রধানমন্ত্রীকে এ সংক্রান্ত একটি চিঠি দিয়েছেন৷ অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট কল্লোল মুস্তফা এই বিষয়ে লিখেছেন, ‘‘বাংলাদেশের আন্দোলনকারীদের সাথে সংহতি জানিয়ে একই দিনে ভারতের আন্দোলনকারীরাও ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশ্যে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র বাতিলের দাবিতে চিঠি দিয়েছে৷ সেই সাথে দিল্লি সলিডারিটি গ্রুপের উদ্যোগে রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্প বাতিলের দাবিতে দিল্লি প্রেস ক্লাবে একটি সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়৷''