সুন্দরবনের শেলা নদীতে অয়েল ট্যাংকার ডুবে যাওয়ার পরপরই তেল যাতে না ছড়ায় তার ব্যবস্থা নেয়া যেত৷ কিন্তু তা না করায় একশ’ কিলোমিটারেরও বেশি এলাকায় তেল ছড়িয়ে পড়েছে, মনে করেন পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা৷
ছবি: STRDEL/AFP/Getty Images
বিজ্ঞাপন
সুন্দরবনের আশপাশের নদীতে এবং ভিতরের খালে ছড়িয়ে পড়া তেল সরানোর কাজ এখনো চলছে স্থানীয় পদ্ধতিতে৷ এলাকার সাধারণ মানুষ ফোম বা অন্য কোনো উপায়ে ছড়িয়ে পড়া তেল সংগ্রহ করে ৩০ টাকা লিটার দরে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের কাছে বিক্রি করছেন৷ আর এই আর্থিক সুযোগ দেয়ায় সাধারণ মানুষের মধ্যে তেল সংগ্রহে ব্যাপক সাড়াও পড়েছে৷ তাঁরা নৌকাযোগে হাড়ি-পাতিল নিয়ে যে যাঁর মতো ছড়িয়ে পড়া তেল সংগ্রহ করছেন৷
দুর্ঘটনা কবলিত অয়েল ট্যাংকার ‘ওটি সাউদার্ন স্টার-৭'-এ ৩ লাখ ৫৭ হাজার ৬৬৪ লিটার ফার্নেস অয়েল ছিল এবং ট্যাংকারের তলদেশ ফেটে যাওয়ায় পুরো তেলই ১০০ কিলোমিটার এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে৷ কিন্তু গত দু'দিনে এর সামান্য পরিমাণ তেলই স্থানীয় পদ্ধতিতে অপসারণ সম্ভব হয়েছে৷
মহাবিপর্যয়ের মুখে সুন্দরবন
সুন্দরবনের শেলা নদী থেকে পশুর নদী পর্যন্ত তেল ছড়িয়ে পড়েছে৷ সাড়ে তিন লাখ লিটারের বেশি তেল সুন্দরবনের ৩৪ হাজার হেক্টর এলাকায় এরই মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে৷ দেখা দিয়েছে পরিবেশ বিপর্যয়৷
ছবি: Ingrid Kvale
শেলা নদীতে ট্যাংকার দুর্ঘটনা
৯ ডিসেম্বর, মঙ্গলবার ভোরের দিকে সুন্দরবনের চাঁদপাই রেঞ্জের কাছে শেলা নদীতে সাড়ে তিন লাখ লিটারের ফার্নেল ওয়েলবাহী ট্যাংকার ডুবির পর, ছড়িয়ে পড়েছে তেল৷ সুন্দরবনের ৩৪ হাজার হেক্টর এলাকায় এরই মধ্যে তেল ছড়িয়ে পড়েছে বলে বন কর্মকর্তারা জানিয়েছেন৷
ছবি: STR/AFP/Getty Images
পরিবেশ বিপর্যয়
তেল ছড়িয়ে পড়ায় পরিবেশ বিপর্যয়ের আশঙ্কা প্রকাশ করে বন সংরক্ষক জানিয়েছেন, এই তেলের ক্ষতিকর প্রভাব এখনই বোঝা যাবে না৷ একটু সময় লাগবে৷ তেলের কারণে সুন্দরবনের গাছপালা আস্তে আস্তে শুকিয়ে মারা পর্যন্ত যেতে পারে৷ সুন্দরবনের নদী-খালে অন্তত ৩০০ প্রজাতির মাছের বিচরণ রয়েছে ছোট প্রজাতির কিছু মাছ এরই মধ্যে মরতে শুরু করেছে৷
ছবি: DW/M, Mamun
বিশ্ব ঐতিহ্যের জন্য বিপর্যয়
পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই তেল ক্রমেই যেভাবে ছড়িয়ে পড়ছে, তাতে এই বিশ্ব ঐতিহ্যের জন্য বিপর্যয় বয়ে আনতে পারে৷
শেলা নদীর জয়মনি এলাকাটি ডলফিনদের অভয়াশ্রম৷ সেখানে একটু পর পর ডলফিন লাফিয়ে উঠত৷ স্থানীয় জেলেরা জানিয়েছেন, তেল ছড়িয়ে পড়ার পর মঙ্গলবার বিকাল থেকে আর কোনো ডলফিন উঠতে দেখা যাচ্ছে না৷ তেলের কারণে তারা হয় মরে গেছে অথবা দূরে কোথাও সরে গেছে৷
ছবি: Rubaiyat Mansur
গাছে গাছে তেলের আবরণ
বন কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সুন্দরবনের ওই সব এলাকায় সুন্দরী গাছ বেশি৷ শেলা নদী সংলগ্ন বনের সুন্দরী, কেওড়া, বাইনসহ গুল্ম জাতীয় গাছের পাতায় তেলের আবরণ লেগে রয়েছে৷ কোথাও কোথাও জোয়ারের পানি বনভূমিতে উঠে বনের গাছের শ্বাসমূলে লেগে আছে তেল৷
ছবি: DW/M, Mamun
ডলফিনদের রক্ষা
নদী থেকে তেল দ্রুত অপসারণ করা না গেলে বিরল প্রজাতির ডলফিনের এই অভয়াশ্রম রক্ষা করা কঠিন হবে বলে মনে করছেন পরিবেশবিদরা৷
ছবি: Ingrid Kvale
7 ছবি1 | 7
সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে কর্তৃপক্ষ
গত মঙ্গলবার ভোরে দুর্ঘটনা ঘটে এবং এরইমধ্যে চার দিন পার হয়ে গেলেও শুধু ট্যাংকারটি টেনে তোলা ছাড়া দুর্যোগ মোকাবেলায় কার্যকর কোনো পদ্ধতি চোখে পড়ছে না৷ ছড়িয়ে পড়া ফার্নেস অয়েলের কার্যকারিতা রোধে কোনো কেমিকেল ব্যবহার করা হবে কিনা – সে ব্যাপারে শনিবার অবধি সিদ্ধান্ত নেয়নি সরকার৷
সুন্দরবন (পশ্চিম) বিভাগীয় বন কর্মকর্তা জহির উদ্দিন আহমদ ডয়চে ভেলেকে জানান, বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, ‘‘ফার্নেস অয়েলের কার্যকারিতা রোধে কেমিকেল ব্যবহার করা হলে সুন্দরবনের ইকোসিস্টেমের ওপর প্রভাব পড়তে পারে৷ এমনিতেই ফার্নেস অয়েলের কারণে সেখানে অক্সিজেনের পরিমাণ কমে গেছে৷ আবার যদি কোনো কেমিকেল ব্যবহার করা হয় তবে অক্সিজেনের পরিমাণ আরও কমে যাবে৷''
নৌমন্ত্রী শাহজাহান খান অবশ্য দাবি করেছেন, তেলের প্রভাবে সুন্দরবনের তেমন ক্ষতি হবে নাছবি: STRDEL/AFP/Getty Images
বিভাগীয় এই বন কর্মকর্তা বলেন, ‘‘আমরা এখন পর্যন্ত মনে করছি ম্যানুয়ালি যতটা তেল অপসারণ করা যায় তা করব৷ ন্যাচারালি এক থেকে ছয় সপ্তাহ পর তেল পানির নীচে পড়ে যাবে৷''
ফার্নেস অয়েলের প্রভাবে এরইমধ্যে জলজ প্রাণি ক্ষতির মুখে পড়ছে৷ মরে যাচ্ছে কাঁকড়া এবং কচ্ছপ৷ সুন্দরবন এলাকার নদীতে ইরাবতী ডলফিন দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না৷ আর গাছের ঠেসমূল জাপটে ধরেছে তেলের পুরু আস্তরণ৷ মাছও দুর্বল হয়ে পড়ছে৷ এর প্রভাব পড়বে অন্য স্থল ও জলজ প্রাণি এবং গাছপালার ওপর৷
‘সুন্দরবনের তেমন ক্ষতি হবে না'
নৌ-মন্ত্রী শাহজাহান খান অবশ্য দাবি করেছেন, তেলের প্রভাবে সুন্দরবনের তেমন ক্ষতি হবে না৷ শনিবার দুপুরে সুন্দরবন এলাকার জয়মনি নদীর তীরে দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে তদন্ত কমিটির সঙ্গে বৈঠক শেষে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘‘তেলের কারণে সুন্দরবনে খুব বেশি নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না৷ ডলফিনেরও ক্ষতি হবে না৷ তেল বনের ভেতর বিস্তৃত হয়নি৷ খালের মুখে জাল (মাছধরা জাল) দিয়ে বাধা দেয়ায় তেল বনে ডুকতে পারেনি৷ ভাসমান তেল চলে যাচ্ছে, তাছাড়া স্থানীয়রা তেল উঠিয়ে নেয়ায় আস্তে আস্তে তেলের প্রভাব কমছে৷''
অন্যদিকে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. এ কে এম মাকসুদ কামাল ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘অদক্ষতা এবং কর্তৃপক্ষের উদাসীনতার কারণে এরইমধ্যে সুন্দরবনের পরিবেশ এবং জীববৈচিত্র হুমকির মুখে পড়েছে৷ শুধু স্বল্পমেয়াদেই নয় দীর্ঘমেয়াদেও এই ক্ষতি অব্যাহত থাকবে৷''
তিনি বলেন, ‘‘তেলের ট্যাংকার ডুবে যাওয়ার পর এটা যে ক্ষতির কারণ হতে পারে সে ব্যাপারে সজাগ করে গণমাধ্যম৷ শুরুতেই যদি সরকারের নীতি নির্ধারকরা বিষয়টি বুঝে ব্যবস্থা নিতে পারতেন তাহলে তেল ছড়িয়ে পড়তো না৷ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এই ধরনের দুর্যোগ মোকাবেলায় কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া হয়৷ আর আমরা চেয়ে চেয়ে দেখছি৷''
বিশ্বের বিরলতম প্রাণী বাংলাদেশের শুশুক
ডলফিন সাধারণত লবণ পানিতে বাস করে৷ শুধুমাত্র বাংলাদেশের শুশুক আর আমাজনের ‘বোতো’ এই দুই প্রজাতির ডলফিন সারা বছরই স্বাদু পানিতে থাকে৷ সেদিক দিয়ে শুশুক বিশ্বে খুবই বিরল একটা প্রাণী৷
ছবি: picture-alliance/dpa
খুবই বিরল
ডলফিন সাধারণত লবণ পানিতে বাস করে৷ শুধুমাত্র বাংলাদেশের শুশুক আর আমাজনের ‘বোতো’ এই দুই প্রজাতির ডলফিন সারা বছরই স্বাদু পানিতে থাকে৷ সেদিক দিয়ে শুশুক বিশ্বে খুবই বিরল একটা প্রাণী৷
ছবি: Rubaiyat Mansur
বিপন্ন প্রাণী
২৫-৩০ বছর আগেও বাংলাদেশের নদীগুলোতে অনেক শুশুক বা ডলফিন দেখা যেত৷ কিন্তু এখন আর সেটা যাচ্ছে না৷ তাই ১৯৯৬ সাল থেকে বিপন্ন প্রাণীর তালিকায় নাম উঠে গেছে শুশুকের৷
ছবি: Rubaiyat Mansur
মাছ ধরতে শুশুকের তেল
শুশুকের তেল মাছ ধরার জন্য বেশ কার্যকর৷ তাই জেলেরা গণহারে শুশুক ধরছে৷ এছাড়া জাটকা ধরার জন্য যে কারেন্ট জাল ব্যবহার করেন জেলেরা, তাতেও মারা পড়ছে শুশুকের দল৷ ছবিতে এমনই একটি মৃত শুশুক দেখা যাচ্ছে৷
ছবি: Ingrid Kvale
আবাস ও প্রজননস্থল ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে
নদীতে বাঁধ দেয়া, সেতু তৈরি ইত্যাদি কারণে নদীর নাব্যতা কমে গিয়ে হারিয়ে যাচ্ছে শুশুকের আবাস ও প্রজননস্থল৷ এছাড়া যেখানে সেখানে ফেলে রাখা পলিথিন নদীর পানিতে মিশে গিয়েও নষ্ট করছে শুশুকের আবাস৷ শিল্প-কারখানা দূষিত বর্জ্যও শুশুকের শত্রু৷
ছবি: Rubaiyat Mansur
অভয়ারণ্য ঘোষণা
শুশুক রক্ষায় সরকার দেড় বছর আগে সুন্দরবনের অন্তর্গত ৩১ কিলোমিটার জলজ এলাকায় অভয়ারণ্য ঘোষণা করেছে৷ তবে বাস্তবায়নের কাজ এখনো শুরু হয় নি৷
ছবি: Munir Uz Zaman/AFP/Getty Images
বিসিডিপি-র উদ্যোগ
বেসরকারি সংস্থা ‘বাংলাদেশ সেটাসিয়ান ডাইভারসিটি প্রজেক্ট’ বা বিসিডিপি সরকারের বন বিভাগের সহায়তায় অভয়ারণ্য পরিকল্পনা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিচ্ছে৷
ছবি: shushuk.org
শুশুক মেলা
বিসিডিপি-র উদ্যোগে সুন্দরবন এলাকায় গত চার বছর ধরে শুশুক মেলা হচ্ছে৷ এর মাধ্যমে শুশুক রক্ষায় জনসাধারণকে সচেতন করার চেষ্টা চলছে৷ গত ফেব্রুয়ারিতে মংলায় হয়ে গেলো মাসব্যাপী চতুর্থ শুশুক মেলা৷
ছবি: Munir Uz Zaman/AFP/Getty Images
শুশুকপ্রেমী রুবাইয়াত মনসুর
তিনি বিসিডিপি’র প্রধান গবেষক৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, জুলাই মাস থেকে অভয়ারণ্য ঘোষিত এলাকার আশেপাশের লোকজনের সঙ্গে আলোচনা শুরু হবে৷ বিশেষ করে জেলেদের বলা হবে তারা যেন মাছ ধরতে এমন জাল ব্যবহার করেন যেটা শুশুকের জন্য ক্ষতিকর হবে না৷
ছবি: Rubaiyat Mansur
বৈদেশিক মুদ্রা আয় সম্ভব
রুবাইয়াত মনসুর বলছেন, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ডলফিনের খেলা দেখিয়ে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয় করছে৷ বাংলাদেশও চাইলে শুশুক দিয়ে আর্থিকভাবে লাভবান হতে পারে বলে মনে করেন তিনি৷
ছবি: picture-alliance/dpa
9 ছবি1 | 9
অধ্যাপক মাকসুদ কামাল বলেন, ‘‘এ নিয়ে কাজ করার জন্য সরকারে দক্ষ এবং যোগ্য লোকের অভাব আছে সত্য৷ তবে তার চেয়ে বড় অভাব হলো সচেতনতার৷ উদাসীনতা৷''
এই বিশেষজ্ঞ মনে করেন, সরকারে সক্ষম ও দক্ষ বিশেষজ্ঞ না থাকলেও সুন্দরবনের তেল বিপর্যয় প্রতিরোধে সক্ষম অনেক বাংলাদেশি বিশেষজ্ঞ আছেন৷ তারা দেশের বাইরেও এ নিয়ে কাজ করেছেন৷ সরকারের উচিত হবে দ্রুত তাদের পরামর্শ নিয়ে এই বিপর্যয় মোকাবেলায় কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া, বলেন মাকসুদ কামাল৷