সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী, বাংলাদেশের সুন্দরবনে আর মাত্র ১০০টি বাঘ বা রয়েল বেঙ্গল টাইগার অবশিষ্ট আছে৷ ক্যামেরা ক্যাপচার পদ্ধতিতে পাওয়া এ সংখ্যায় বিস্মিত হয়েছেন বিশেষজ্ঞসহ অনেকই৷
বিজ্ঞাপন
বন অধিদপ্তরের বন্যপ্রাণী অঞ্চলের বন সংরক্ষক তপন কুমার দে ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘ক্যামেরা ক্যাপচার পদ্ধতির জরিপে বাংলাদেশ এবং ভারতীয় সুন্দরবনে ৮৩ থেকে ১৩০টি বাঘের সন্ধান পাওয়া গেছে৷ এর গড় হিসেবে বাংলাদেশ অংশে প্রকৃত বাঘের সংখ্যা সর্বোচ্চ ১০৬টি হতে পারে৷''
অথচ এর আগে, ২০০৪ সালে, জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) ও ভারতের বিশেষজ্ঞদের সহায়তায় পায়ের ছাপের ওপর ভিত্তি করে পরিচালিত জরিপে ৬,০০০ বর্গকিলোমিটারের সুন্দরবনে ৪৪০টি রয়েল বেঙ্গল টাইগার গণনা করা হয়৷ এর মধ্যে ১২১টি পুরুষ, ২৯৮টি বাঘিনী এবং ২১টি শিশু বাঘ ছিল বলে জানা যায়৷ এরপর ২০০৬ সালে ক্যামেরা ট্র্যাপিং ও আপেক্ষিক সংখ্যা পদ্ধতি অনুসরণ করে সুন্দরবনের এক শুমারিতে ২০০টি বাঘের কথা বলা হয়েছিল৷ কিন্তু এবার ক্যামেরা ক্যাপচার পদ্ধতিতে এই গণনা করা হলে আগের করা পায়ের ছাপ পর্যবেক্ষণ বা ‘পাগ মার্ক' পদ্ধতির ফলাফলটি ভুল প্রমাণিত হলো৷
তপন কুমার দে বলেন, ‘‘সর্বশেষ জরিপে সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশে যে বাঘের সংখ্যার কথা বলা হচ্ছে, তা মোটামুটি নির্ভুল৷ তিনি বলেন, ক্যামেরা ফুটেজ বিশ্লেষণ করে জরিপ শেষ হয় গত এপ্রিল মাসে৷ এর আগে সুন্দরবনের ভারতীয় অংশে ৭৪টি বাঘ থাকার কথা বলা হয় অন্য একটি জরিপে৷'' উল্লেখ্য, সুন্দরবনের মাত্র ৪০ শতাংশ ভারতের মধ্যে পড়ে৷'
বিলুপ্তির পথে বাঘ
২৯শে জুলাই আন্তর্জাতিক বাঘ দিবস৷ মূলত বিশ্বের অন্যতম রাজকীয় এই প্রাণীর উপর সবার দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য পালন করা হয় এই দিবস৷ বর্তমানে গোটা বিশ্বের বাঘের সংখ্যা মাত্র ৩,২০০টি৷ তাদের রক্ষায় কী করা হচ্ছে, জানুন এই ছবিঘর থেকে৷
ছবি: dapd
নাটকীয় হারে কমছে
২৯শে জুলাই আন্তর্জাতিক বাঘ দিবস৷ মূলত বিশ্বের অন্যতম রাজকীয় এই প্রাণীটি রক্ষায় উদযাপন করা হচ্ছে এই দিবস৷ গত শতকে গোটা বিশ্বে বাঘের সংখ্যা ছিল এক লাখ৷ আর বর্তমানে জঙ্গলে বাঘের এই সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে ৩,২০০তে৷ এভাবে কমতে থাকলে আগামী দশ বছরের মধ্যে পৃথিবী থেকে পুরোপুরি হারিয়ে যেতে পারে বাঘ৷
ছবি: AP
পৌরাণিক কাহিনিতে বাঘ
মানুষের কাছে অন্যতম সম্মানিত প্রাণী হিসেবে বাঘের কথা বিভিন্ন সংস্কৃতির পুরাণে রয়েছে৷ চীনের রাশিচক্রে উল্লিখিত ১২টি প্রাণীর একটি বাঘ৷ এই প্রাণীকে বনের রক্ষক এবং ক্ষমতা, শক্তি ও সৌন্দর্য্যের প্রতীক মনে করা হয়৷ চীনে পরবর্তী বাঘের বছর ২০২২ সাল৷
ছবি: picture-alliance/dpa
উপপ্রজাতিগুলোও হুমকির মুখে
উনিশ শতক অবধি বাঘের নয়টি উপপ্রজাতির দেখা মিলেছিল গোটা বিশ্বে৷ বর্তমানে, ইন্দো-চায়না, মালয়, রয়েল বেঙ্গল টাইগার এবং আমুর বাঘ বিপন্ন অবস্থায় রয়েছে৷ আর সুমাত্রান এবং দক্ষিণ চীনের বাঘের অবস্থা আরো সঙ্গিন৷ বালি দ্বীপ, জাভা এবং কাস্পিয়ান অঞ্চলের বাঘ গত ৮০ বছরে বিলুপ্ত হয়ে গেছে৷ বাঘের বিভিন্ন উপপ্রজাতির মধ্যে আকার, রং এবং লোমের আচ্ছাদনে পার্থক্য রয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
আবাসস্থল ধ্বংস হচ্ছে
ঐতিহাসিকভাবে এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চল, তুরস্ক, রাশিয়ার পূর্ব উপকূল, চীন এবং সার্বিয়া থেকে ইন্দোনেশিয়ার বিভিন্ন দ্বীপপুঞ্জে ছড়িয়ে রয়েছে বাঘের আবাসভূমি৷ কিন্তু বর্তমানে বাঘের আবাসের ৯৭ শতাংশই ধ্বংস হয়ে গেছে৷ মানুষের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড – যেমন বাসস্থান সম্প্রসারণ, চাষাবাদ এবং রাস্তা নির্মাণের মতো কারণে বাঘের আবাসস্থল ধ্বংস হচ্ছে৷ থাকার জায়গার সংকটের কারণে সহজেই শিকারিদের ফাঁদে ধরা পড়ছে বাঘ৷
ছবি: AP
অবৈধ বাণিজ্য
গত এক হাজারেরও বেশি সময় ধরে চীন এবং এশিয়ার বিভিন্ন দেশে প্রথাগত ঔষধ তৈরিতে বাঘের শরীরের বিভিন্ন অংশ ব্যবহার করা হচ্ছে৷ মূলত বাত এবং চর্ম রোগেই চিকিৎসায় এসব ব্যবহার করা হয়৷ ১৯৮৭ সাল থেকে অবশ্য বাঘের দেহের বিভিন্ন অংশ বিক্রি আন্তর্জাতিকভাবে নিষিদ্ধ৷ তবে এখনো কালোবাজারে বাঘের চাহিদা অনেক৷
ছবি: picture-alliance/dpa
খামারে বাঘ
জঙ্গলে খুব অল্প কিছু বাঘ টিকে থাকলেও বিভিন্ন খামার এবং চীন ও এশিয়ার বিভিন্ন চিড়িয়াখানায় বর্তমানে বন্দি আছে পাঁচ হাজারের মতো বাঘ৷ পরিবেশ বিষয়ক অনুসন্ধানী এজেন্সি গত ফেব্রুয়ারি মাসে জানিয়েছে, খামারে পালন করা বাঘের চামড়া এবং হাড় ব্যবহার করে বিলাসী আসবাব এবং ওয়াইন তৈরি করা হয়৷ এ কারণে জঙ্গলে মুক্ত পরিবেশে থাকা বাঘও শিকার করা হচ্ছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
বিনোদনে বাঘ
সেই সতেরো শতক থেকে সার্কাসে ব্যবহার হচ্ছে বাঘ৷ প্রাণিবাদিরা সার্কাসে বাঘের এ ধরনের ব্যবহার নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করছেন৷ বিশেষ করে বাঘকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার পদ্ধতি, ক্রমাগত ভ্রমণ এবং অপ্রাকৃতিক পরিবেশ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন তারা৷ ব্রিটিশ সরকার বিষয়টি আমলে নিয়ে সার্কাসে বনের প্রাণী ব্যবহারের বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা আরোপের চিন্তা করছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
মানুষের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা
ভূমি দখল নিয়ে বাঘ এবং মানুষের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতার কারণে জঙ্গলের বাঘ আরো হুমকির মুখে পড়ছে৷ জঙ্গলের পরিধি কমায় খাদ্যের সন্ধানে বাঘ লোকালয়ে হাজির হচ্ছে, হামলা চালাচ্ছে বিভিন্ন গবাদি পশুর উপর৷ ছবিতে একটি বাঘিনীর মরদেহ পরীক্ষা করছেন ভারতের বন কর্মকর্তারা৷
ছবি: picture-alliance/dpa
সংরক্ষণের প্রচেষ্টা
২০১০ সালের নভেম্বরে রাশিয়ায় অনুষ্ঠিত একটি সম্মেলনে বাঘ আছে বাংলাদেশ সহ এমন ১৩টি দেশ ২০২২ সালের মধ্যে বাঘের সংখ্যা দ্বিগুণ করার লক্ষ্য নির্ধারণ করে৷ এজন্য বাঘ শিকার বন্ধ এবং বাঘের আবাসস্থল সংরক্ষণ ও উন্নয়নের দিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়৷ ছবিতে শুল্ক বিভাগের হাতে আটক বাঘের চামড়া দেখানো হচ্ছে৷
ছবি: AP
চিড়িয়াখানায় অথবা জঙ্গলে, নাকি দু’টোতেই?
এমনকি স্বনামধন্য চিড়িয়াখানাতেও বাঘের প্রজনন প্রক্রিয়ার কার্যকারিতা নিয়ে মতভেদ রয়েছে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে৷ এক্ষেত্রে চিড়িয়াখানাগুলোর মন্তব্য হচ্ছে, তারা গবেষণা এবং জীনগতভাবে বৈচিত্র্যময় বাঘের বংশ বৃদ্ধিতে সহায়তা করছে৷ তবে ‘‘বর্ন ফ্রি’’ এর মতো সংগঠনগুলো চায়, বাঘ রক্ষায় জঙ্গলেই আরো উদ্যোগ নেওয়া হোক৷
ছবি: dapd
10 ছবি1 | 10
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যার অধ্যাপক ও বাঘ বিশেষজ্ঞ মনিরুল খান ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘নতুন জরিপে বাঘ কমে যাওয়ার আশঙ্কাই সত্যি হলো৷ তবে বাঘের সংখ্যা আমাদের শঙ্কার চেয়েও অনেক কমে গেছে৷''
তিনি জানান, ‘‘এর আগে আমার নিজস্ব গবেষণায় ২০০টির কাছাকাছি বাঘ থাকার তথ্য পেয়েছি৷'' তাঁর কথায়, ‘‘চোরাশিকার ও বনাঞ্চলের আশেপাশে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের কারণেই বাঘের সংখ্যা কমছে৷ বাঘের খাবার এবং আবাস এখন হুমকির মুখে৷ তাই সরকারের উচিত বাঘ রক্ষায় আরও পদক্ষেপ নেয়া৷''
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের চেয়ারম্যান ও ওয়াইল্ডলাইফ ট্রাস্টের প্রধান নির্বাহী অধ্যাপক মো. আনোয়ারুল ইসলাম সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘‘বনবিভাগ আগে ৪৪০টি বাঘ থাকার কথা বলেছে, এখন বলছে ১০৬টি৷ সরকারি এই তথ্য আমাদের মানতে হবে৷ তবে বাঘ যে কমে যাচ্ছে, এটাই সত্য৷ চোরাকারবারিদের শিকার আর খাবার সংকটে বাঘ কমছে৷''
তাই তিনি বাঘের সংখ্যা কমে যাওয়ার প্রবণতা রোধ এবং বিপন্ন এ প্রজতি রক্ষায় এখনই সুন্দরবনে পুলিশ, সেনাবাহিনীসহ সব ধরনের প্রতিনিধির অংশগ্রহণে স্বাধীন ‘অ্যান্টি পোচিং ইউনিট' গঠনের দাবি জানান৷
ওদিকে ‘দ্য ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ডলাইফ ফান্ড' জানিয়েছে যে, বিশ্বব্যাপী বাঘ বিলুপ্তির শঙ্কায় রয়েছে তারা৷ প্রায় এক লাখ বাঘ থেকে এই সংখ্যা এখন ১,৯০০ থেকে ৩,২০০-তে নেমে এসেছে৷
‘ওয়াইল্ডলাইফ ইনস্টিটিউট অফ ইন্ডিয়া'-র ওয়াই. ভি. ঝালা সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘‘এ সংখ্যা এক ধরনের বাস্তবতা৷ তাঁর মতে, ‘‘সুন্দরবনে আগে ৪৪০টি বাঘ থাকার তথ্য একটি কল্পকথা৷ সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশে সর্বোচ্চ ২০০টি বাঘ থাকতে পারে৷''