সম্প্রতি এই অভয়ারণ্য দ্বিগুণের কিছু বেশি, অর্থাৎ ২৩ থেকে বাড়িয়ে ৫২ শতাংশ, করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার৷ প্রধান বন কর্মকর্তা শফিউল আলম বার্তা সংস্থা এএফপিকে এ তথ্য জানিয়েছেন৷
বিজ্ঞাপন
শফিউল আলম জানান, সুন্দরবনের বাংলদেশ অংশের প্রায় ৬,০১৭ বর্গকিলোমিটার এলাকার ২৩ শতাংশ আগে সংরক্ষিত ছিল৷ বাকি অংশে পর্যটক ও স্থানীয় অধিবাসীরা অবাধে ঘোরাফেরা করতে পারতেন৷ এই সিদ্ধান্তের ফলে সারা দুনিয়ায় বাঘের অন্যতম বড় আবাসভূমি হিসেবে পরিচিত সুন্দরবনে পরিসর বাড়ল সংরক্ষিত এলাকার৷ আর কমল মানুষের অবাধে বিচরণ এলাকা৷
এর আগে, ১৯৯৬ সালের ৬ এপ্রিল পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের এক প্রজ্ঞাপনে সুন্দরবনের পূর্ব, পশ্চিম ও দক্ষিণের ১ লাখ ৩৯ হাজার ৬৯৯ দশমিক ৪৯৬ হেক্টর এলাকাকে বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য ঘোষণা করা হয়৷
ওরা বাঘের ‘বন্ধু’, মানুষেরও বন্ধু
সুন্দরবনে বাঘ কমছে আশঙ্কাজনক হারে৷ বাঘ যাতে বিলুপ্ত না হয়, তা নিশ্চিত করতে কাজ করে যাচ্ছে এক দল মানুষ৷ তাঁরা ‘বাঘের বন্ধু’, আবার মানুষেরও বন্ধু৷ তাঁদের নিয়েই এই ছবিঘর...৷
ছবি: Golakhali ETRT
বাঘ কমছে
সুন্দরবন এক সময় ছিল রয়েল বেঙ্গল টাইগারের ‘অভয়ারণ্য’৷ কিন্তু এখন আর নেই৷ আশেপাশে যত জনবসতি বাড়ছে, তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কমছে বাঘ৷ ২০১৫ সালের এক শুমারি অনুযায়ী, সু্ন্দরবনে মাত্র একশটির মতো রয়েল বেঙ্গল টাইগার রয়েছে৷
ছবি: Getty Images/AFP/T. Fabi
বাঘের শত্রু
কেন বাঘ এত দ্রুত কমে যাচ্ছে? কারণ জলবায়ু পরিবর্তন এবং মানুষ৷ বাঘ শিকারি তো আছেই, এর বাইরে সুন্দরবনের আশেপাশের লোকালয়ের মানুষের আক্রমণেও অনেক বাঘের প্রাণ যায়৷ সুন্দরবনে অন্যান্য প্রাণী কমে যাওয়ার ফলে মাঝে মাঝে বাঘ খাবারের খোঁজে লোকালয়ে চলে আসে৷ গৃহৃপালিত পশু, এমনকি কখনো কখনো মানুষের ওপরও হামলা চালায় তারা৷ এ কারণে দেখা মাত্রই মানুষও সংঘবদ্ধ হামলা চালিয়ে বাঘ হত্যা করে৷
মানুষের হাত থেকে বাঘ এবং বাঘের কবল থেকে মানুষকে বাঁচাতে ২০০৭ সাল থেকে কাজ করে আসছে ‘ভিলেজ টাইগার রেসপন্স টিম’ (ভিটিআরটি)৷ প্রথমে সুন্দরবনের কাছের একটি গ্রামে কাজ শুরু করেছিল ছোট্ট একটি দল৷ কাজ মূলত বাঘ সম্পর্কে জনসচতেনতা বাড়ানো এবং সবাইকে বাঘের আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষার কৌশল শেখানো৷ ধীরে ধীরে সাধারণ মানুষও আগ্রহী হয়ে উঠছে৷ এখন মোট ৪৯টি ভিটিআরটি টিম রায়েছে সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকায়৷
ছবি: Golakhali ETRT
সবাই স্বেচ্ছসেবী
ভিটিআরটি-র পক্ষ থেকে মাহবুব আলম জানালেন, জনসচেতনতা বৃদ্ধি করে বাঘ রক্ষার স্বেচ্ছাসেবামূলক এ প্রয়াস তাঁরা অব্যাহত রাখবেন৷ মাহবুবুর আলমের আরেক পরিচয়, তিনি ‘বাঘ প্রজেক্ট’-এর সমন্বয়কারী৷ ‘বাঘ প্রজেক্ট’ বাংলাদেশভিত্তিক বেসরকারি সংস্থা ‘ওয়াইল্ড টিম’ এবং ইউএসএআইড-এর একটি যৌথ উদ্যোগ৷ প্রকল্পটি ২০১৪ সাল থেকে কাজ শুরু করেছে৷ ২০১৮ সাল পর্যন্ত চলবে তাদের কাজ৷
ছবি: Golakhali ETRT
5 ছবি1 | 5
এবার সেই প্রজ্ঞাপন বাতিল করে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় (বন শাখা-২) থেকে গত ২৯ জুন এই নতুন প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়৷ এতে বলা হয়, বর্তমানে উক্ত অভয়ারণ্য এলাকা সম্প্রসারণের প্রয়োজন হওয়ায় বন অধিদপ্তরের প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন ২০১২-র ধারা ১৩-র ক্ষমতাবলে আগের জারিকৃত প্রজ্ঞাপন অধিকতর সংশোধনক্রমে সরকার সংরক্ষিত এলাকাকে বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য হিসেবে ঘোষণা করেছে৷
সুন্দরবনের ৬২ শতাংশই বাংলাদেশে৷ বাকি অংশটুকু পূর্ব ভারতে পড়েছে৷ এর বনাঞ্চল ও জলাভূমি যেমন রয়েল বেঙ্গল টাইগার ও ইরাবতী ডলফিনের মতো বিরল প্রজাতির প্রাণীর আবাসস্থল, তেমনি চিত্রল হরিণ, কুমির, বানর, অসংখ্য প্রজাতির পাখি ও পোকামাকড় ধরে রেখেছে এখানকার প্রাণীবৈচিত্র্য৷
এ সব পশুপাখি ও সুন্দরী, কেওড়াসহ হাজারো রকমের গাছগাছালি এই ম্যানগ্রোভ বনে তৈরি করেছে একটি স্বতন্ত্র ইকোসিস্টেম, যা ভেঙে পড়লে সুন্দরবনের অস্তিত্ব রক্ষাই কঠিন হয়ে পড়বে বলে গবেষণায় প্রমাণিত৷
২০১৫ সালের বাঘশুমারী অনুযায়ী, তার আগের এক দশকে বাঘের সংখ্যা কমেছে আশঙ্কাজনক হারে৷ ২০০৪-এ সুন্দরবনে বাঘ ছিল ৪৪০টি৷ সেটি ২০১৫ সালে এসে নেমেছে ১০৬টিতে৷ এ বিষয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রানীবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও বাঘ গবেষক মনিরুল খান বলেন, এ সিদ্ধান্ত সুন্দরবনে ‘ওয়াইল্ড ক্যাট' বৃদ্ধিতে বিশেষ ভুমিকা রাখবে৷
‘‘আইনটি দরকার ছিল৷ এখন যেটি দরকার তা হলো, এর প্রয়োগ৷ যদি এটি ঠিকমত প্রয়োগ করা যায় তাহলে বন্যপ্রাণীর বংশবৃদ্ধিতে, বিশেষ করে বাঘের সংখ্যা বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে৷'' খান বলছিলেন৷
আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত করার আশ্বাস দিয়েছেন সরকারের বাঘ মনিটরিং সার্ভে প্রকল্পের প্রধান আমির হোসেন৷ বার্তা সংস্থা এএফপিকে দেয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, এই বর্ধিত এলাকাটি হবে বাঘের অবাধ বিচরণ ও বংশবিস্তারের অভয়ারণ্য৷ ‘‘এই অংশে সাধারণ মানুষের অবাধ চলাচল বন্ধ করা হবে৷''
সুন্দরবনের আশেপাশের প্রায় সাড়ে তিন লাখ মানুষের জীবিকা এই বনাঞ্চলের ওপর নির্ভরশীল৷ তাঁরা সুন্দরবন থেকে মাছ, মধু ও কাঠ সংগ্রহ করেন৷ এদের জন্য এই বর্ধিত সংরক্ষিত এলাকায় প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হবে বলে জানান আমির হোসেন৷
মধুর বন সুন্দরবন
সুন্দরবন মানেই শুধু সুন্দরী গাছ আর রয়েল বেঙ্গল টাইগার নয়৷ সেখানে পাওয়া যায় সুস্বাদু মধুও৷ সেগুলো যারা সংগ্রহ করেন তাদের বলা হয় মৌয়াল৷
ছবি: Getty Images/AFP/Munir Uz Zaman
মধু সংগ্রহের মরসুম
প্রতিবছর এপ্রিল থেকে জুন, এই তিনমাস মধু সংগ্রহ করা হয়৷ এ সময় বন বিভাগের অনুমতি নিয়ে দল বেঁধে বনে প্রবেশ করেন মৌয়ালরা৷
ছবি: Getty Images/AFP/Munir Uz Zaman
দোয়াদরুদ পড়ে নেয়া
মধু সংগ্রহ করতে যাওয়ার আগে বিশেষ প্রার্থনা করে নেন মৌয়ালরা৷ কারণ সেখানে বাঘের ভয়ের পাশাপাশি আছে ডাকাতের ভয়৷ কেউ কেউ পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে যান৷
ছবি: Getty Images/AFP/Munir Uz Zaman
কয়েকজনের দল
মৌয়ালরা বন বিভাগ থেকে কয়েকজন মিলে একটি দল গঠন করে মধু সংগ্রহ করতে যাওয়ার অনুমতি পান৷ এরপর নৌকা করে প্রায় মাসখানেকের জন্য বেরিয়ে পড়েন৷
ছবি: Getty Images/AFP/Munir Uz Zaman
নিয়মকানুন
মধু সংগ্রহের কিছু নিয়মনীতি ঠিক করে দিয়েছে বন বিভাগ৷ যেমন মৌচাক থেকে মৌমাছি সরানোর সময় আগুনের ধোঁয়া ব্যবহারের কথা বলা হয়েছে৷ কিন্তু অভিযোগ আছে মৌয়ালরা অনেক সময় নিয়ম না মেনে মৌচাকে আগুন ধরিয়ে দেন৷
ছবি: Getty Images/AFP/Munir Uz Zaman
মধু উৎপাদন হ্রাস
অনেকসময় নিয়মনীতি না মেনে মধু ও মোম সংগ্রহ করায় বিভিন্ন প্রজাতির মৌমাছির বংশ ধ্বংস হচ্ছে বলে গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনে অভিযোগ করা হয়েছে৷ এতে সুন্দরবন থেকে দিন দিন মধু সংগ্রহের পরিমাণ কমছে বলে জানা গেছে৷
ছবি: Getty Images/AFP/Munir Uz Zaman
বনে আগুন
মৌচাক থেকে মধু সংগ্রহ করতে গিয়ে কখনও কখনও সুন্দরবনে আগুন লাগার ঘটনাও ঘটে৷
ছবি: Getty Images/AFP/Munir Uz Zaman
মৌয়ালদের দুর্দশা
জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মধু ও মোম আনতে যান মৌয়ালরা৷ কিন্তু এরপর যে টাকা পান তা দিয়ে কোনোরকমে সংসার চালাতে হয় তাদের৷ নৌকা ভাড়া ও বনদস্যুদের চাঁদা দিতেই আয়ের একটা বড় অংশ চলে যায় মৌয়ালদের৷