বন এলাকায় শিল্প কারখানা স্থাপন, যান্ত্রিক নৌযান চলাচল, বিষ দিয়ে মাছ শিকারসহ নানা কারণে দূষণ বাড়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্টরা৷
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক আবদুল্লাহ হারুন চৌধুরী বলেন, ‘‘২০১০ সালে সুন্দরবনের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত পশুর নদের প্রতি লিটার পানিতে তেলের পরিমাণ ছিল সর্বোচ্চ ১০ দশমিক ৮ মিলিগ্রাম৷ আর এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬৮ মিলিগ্রামে; যেখানে স্বাভাবিক মাত্রা হলো ১০ মিলিগ্রাম৷ সুন্দরবনের মধ্য দিয়ে বয়ে চলা নদ-নদীর পানি ও মাটিতে দূষণ বেড়ে যাওয়ায় অনেক জায়গায় আগের মতো আর গাছের চারা গজাচ্ছে না ৷ তাছাড়া পানিতে তেলের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে জলজ প্রাণী৷ যেসব রুটে নৌযান চলাচল করে, ওই রুটগুলোর বনের পাশে এখন আর তেমন হরিণ, বানরসহ অন্যান্য বন্যপ্রাণী দেখা যায় না৷’’
বঙ্গোপসাগরের তীর ঘেঁষে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় শ্বাসমূলীয় বনাঞ্চল সুন্দরবন৷ এই বনের জলে-স্থলে বাস করে নানা রকম বন্যপ্রাণী৷ সুন্দরবনের উল্লেখযোগ্য কিছু বন্যপ্রাণীর তথ্য থাকছে ছবিঘরে৷
ছবি: DW/M. M. Rahmanসুন্দরবনে আছে প্রায় ৩২ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ৩৫ প্রজাতির সরীসৃপ, ৮ প্রজাতির উভচর, ৩২০ প্রজাতির আবাসিক ও পরিযায়ী পাখি আর প্রায় ৪০০ প্রজাতির মাছ৷ এছাড়া অগণিত কীটপতঙ্গও আছে এ বনে৷
ছবি: DW/M. M. Rahmanসুন্দরবনের প্রাণিদের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো এদের প্রত্যেকেই সাঁতার কিংবা উড়তে সক্ষম৷ দুটির কোনো একটি বৈশিষ্ট্য না থাকলে সে প্রাণী সুন্দরবনে বেঁচে থাকতে পারেনা৷
ছবি: DW/M. M. Rahmanসুন্দরবেনের প্রধান পশু বেঙ্গল টাইগার বা বাংলার বাঘ৷ বাংলাদেশের জাতীয় পশুও এটি৷ সুন্দরবনের অতন্দ্র প্রহরী এ প্রাণীটিই এর জীববৈচিত্র্য, খাদ্য শৃঙ্খল ও পরিবেশ চক্রের প্রধান নিয়ন্ত্রক৷ অত্যন্ত বিপন্ন একটি প্রাণী হিসেবে বাঘ বেঁচে আছে আমাদের সুন্দরবনে৷ ২০১৫ সালে বন বিভাগ ক্যামেরা পদ্ধতিতে গণনা করে সুন্দরবনে ১০৬টি বাঘের সন্ধান পায়৷
ছবি: DW/M. M. Rahmanসুন্দরবনে সবচেয়ে বেশি যে প্রাণীটি দেখা যায় তা হলো চিত্রা হরিণ৷ সুন্দরবনের সব জায়গাতেই দলে দলে চিত্রা হরিণ দেখা যায়৷ স্ত্রী চিত্রা হরিণের কোনো শিং নেই তবে প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ চিত্রা হরিণের তিন শাখা বিশিষ্ট শিং থাকে৷ চিত্রা হরিণ বাঘের সবচেয়ে প্রিয় খাবার৷
ছবি: DW/M. M. Rahmanসুন্দরবনে খুবই কম পরিমাণে আছে মায়া হরিণ৷ দেখতে অনেকটা ছাগলের মতো বলে অনেকে একে বন ছাগলও বলে থাকে৷ গাঢ় বাদামি রংয়ের এ হরিণ বনের ভেতরে একা চলতে ভালোবাসে৷
ছবি: DW/M. M. Rahmanসুন্দরবনে প্রাণীদের তালিকায় হরিণের পরই বানরের স্থান৷ সুন্দরবনে এরা হরিণের সঙ্গে সহাবস্থান করে থাকে৷ এজন্য হরিণকে বানরের সুহৃদও বলা হয়৷ বাঘের আগমনের খবরও হরিণকে দেয় বানর৷ সুন্দরবনের গাছে ডালেই তাদের বসবাস৷
ছবি: DW/M. M. Rahmanসুন্দরবনের শুকর আকারে বেশ বড়৷ কালো ও লাল মিশ্রিত গায়ের রং৷ এসব বন্য শুকর দেখতে অনেকটা ভল্লুকের মতো৷ অনেকটা শান্ত স্বভাবের প্রাণি হলেও দাঁতাল পুরুষ বন্য শুকর খুবই হিংস্র স্বভাবের হয়৷ হরিণের পরেই শুকর বাঘের প্রিয় খাবার৷
ছবি: DW/M. M. Rahmanউদ্বিড়াল বা ভোঁদড় দেখতে অনেকটা বেজির মতো৷ এদের গায়ের রং কালচে সাদা৷ সুন্দরবনের খালের পাড়ে এদের বিচরণ দেখা যায়৷ পানির মধ্যে ডুব দিয়ে এরা সহজেই মাছ শিকার করতে পারে৷
ছবি: DW/M. M. Rahmanসুন্দরবনে সরীসৃপ প্রজাতির সবচেয়ে বৃহৎ সদস্য কুমির৷ সাধারণত এরা ৫-৭ মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে৷ সারা বছর গভীর পানিতে থাকলেও বেশি শীতের রৌদ্রময় দিনে খালের চরে এদের রোদ পোহাতে দেখা যায়৷
ছবি: DW/M. M. Rahmanগুই সাপ দেখতে অনেকটা কুমিরের মতো৷ একটি পূর্ণবয়স্ক গুইসাপের ওজন পাঁচ থেকে ছয় কেজি পর্যন্ত হয়৷ এরা গড়ে লম্বায় এক মিটার পর্যন্ত হয়৷ এদের জিহ্বা সাপের জিহ্বার মতো লম্বা৷ চোখ উজ্জ্বল ও মাঝারি৷ এরা খুব দ্রুত গাছে উঠতে, পানিতে সাঁতরাতে ও ডাঙায় চলতে পারে৷
ছবি: DW/M. M. Rahmanনানা রকম সাপ রয়েছে সুন্দরবনে৷ এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো অজগর, সঙ্খচুড়, গোখরা, বেড়া, ফনিমনসা, গেছো সাপ ইত্যাদি৷
ছবি: DW/M. M. Rahmanসুন্দরবনের নদীতে দেখা যায় দুই প্রজাতির ডলফিন৷ এর একটি শুশুক এবং অন্যটি ইরাবতি৷ সুন্দরবনের নদী ও খালের মোহনায় এদের দেখা যায়৷ তবে সাম্প্রতিক সময়ে সুন্দরবনের নদীগুলো দিয়ে মালবাহী জাহাজ চলাচল করায় বিপন্ন এ প্রাণীটির অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়েছে৷
ছবি: DW/M. M. Rahmanসুন্দরবনকে পাখির স্বর্গরাজ্য বলা যায়৷ খাদ্যের প্রাচুর্য, অফুরন্ত গাছ আর জনমানবহীন পরিবেশের কারণে পাখিদের কাছে সুন্দরবন খুবই নিরাপদ আশ্রয়স্থল৷ এ বনের অধিবাসী ৪০০ প্রজাতির পাখির মধ্যে ৩২০ প্রজাতির স্থানীয় বা আবাসিক, আর ৫০ প্রজাতিরও বেশি অনাবাসিক বা পরিযায়ী৷
ছবি: DW/M. M. Rahmanসুন্দরবনে দেখা যায় নানান রংবেরংয়ের প্রজাপতি৷
ছবি: DW/M. M. Rahman শিল্প কারখানা স্থাপন, যান্ত্রিক নৌযান চলাচল, বিষ দিয়ে মাছ শিকারসহ বিভিন্ন তৎপরতা বনের গাছপালা, বন্যপ্রাণী ও জলজ প্রাণীর ওপর প্রভাব পড়ছে৷ সুন্দরবন অ্যাকাডেমির নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক আনোয়ারুল কাদির বনবিভাগ ও প্রশাসনের বিভিন্ন দপ্তরের সমন্বয়হীনতায় সুন্দরবনে পরিবেশগত ঝুঁকি বাড়ছে বলে মনে করেন৷
দূষণের কারণে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য এখন হুমকির মুখে বলে মনে করেন সুন্দরবন ও উপকূল সুরক্ষা আন্দোলনের সমন্বয়ক নিখিল চন্দ্র ভদ্র৷ বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) খুলনার সমন্বয়কারী এম বাবুল হাওলাদার বলেন, ‘‘বনের কিছু এলাকায় শিল্প কারখানা ও বনের মধ্য দিয়ে জলযান চলার কারণে সুন্দরবনে দূষণ বেড়েছে৷’’
অধ্যাপক আনোয়ারুল কাদির বলেন, ‘‘বিষ দিয়ে মাছ ধরা বন্ধে বন বিভাগের উদ্যোগ পুরোপুরি কার্যকর হচ্ছে না৷ এ অবস্থা নিরসনে রাষ্ট্রীয়ভাবে সুন্দরবন দিবস পালনের দাবি জানাই, এতে সুন্দরবন সুরক্ষায় রাষ্ট্রীয় দায়বদ্ধতা তৈরি হবে৷’’
খুলনা সার্কেলের বন সংরক্ষক মো. মঈনুদ্দিন খান, বাংলাদেশ বন গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিভাগীয় কর্মকর্তা আ স ম হেলাল সিদ্দিকী এবং বন ও পরিবেশ উপমন্ত্রী হাবিবুন নাহার সুন্দরবন সুরক্ষায় বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণের কথা জানিয়েছেন৷
এনএস/এসিবি (বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম)
পৃথিবীর সবচেয়ে বড় শ্বাসমূলীয় বন সুন্দরবনের সঙ্গে নানান পেশার মানুষের জীবন ও জীবিকা সম্পৃক্ত৷ সুন্দরবনকে ঘিরে এরকম নানান পেশার কিছু মানুষের কথা থাকছে ছবিঘরে৷
ছবি: DW/M. Zahidul Haque সুন্দরবনে কাঠুরিয়া ও গোলপাতা সংগ্রহকারীদের বলা হয় বাওয়ালি৷ বনবিভাগ থেকে পাস নিয়ে সাধারণত সেপ্টেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বাওয়ালিরা সুন্দরবনে অবস্থান করেন৷ তবে সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর সুন্দরবনে কাঠ কাটার মৌসুম আর নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি গোলপাতা কাটার মৌসুম৷
ছবি: DW/M. Zahidul Haque স্বাধীনতা-উত্তরকালে সুন্দরবন থেকে গরান, হেতাল, গেওয়া, সুন্দরী, পশুর, ধুন্দল, গোলপাতা ও বাইন কাঠ কাটার অনুমতি প্রদান করত বনবিভাগ৷ আশির দশকে পশুর কাঠ কাটার অনুমতি বন্ধ করে দেয়া হয়৷ নব্বই দশকে সুন্দরী, গেওয়া ও হেতালের পারমিটও বন্ধ করে দেয় বনবিভাগ৷ ২০০৭ সালে সাইক্লোন সিডরের আঘাতে সুন্দরবন লন্ডভন্ড হয়ে পড়লে ওই বছর থেকে গরান গাছ কাটার অনুমতিও দেয়া হচ্ছে না৷
ছবি: DW/M. Zahidul Haque সব মৌসুমেই জেলেরা সুন্দরবনে মাছ শিকার করে থাকে৷ তবে শীত মৌসুমে সবচেয়ে বেশি জেলে সুন্দরবনে আসেন মাছ ধরতে৷ বন বিভাগের অনুমতি নিয়ে জেলেরা সুন্দরবনের ভেতরের নদী ও খালে মাছ শিকার করেন৷
ছবি: DW/M. Zahidul Haque সুন্দরবন থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে বহুকালের ঐতিহ্য ভোঁদর জেলে৷ নড়াইলের চিত্রা নদী তীরের একদল মৎস্যজীবী ছোট ছোট নৌকায় চেপে সুন্দরবনের ভেতরে উদ্বিড়াল বা ভোঁদর দিয়ে মাছ ধরেন৷ জাল পেতে পোষা ভোঁদরদের তারা ছেড়ে দেন নদীতে৷ পানির মধ্য থেকে মাছ তাড়িয়ে আনলে জাল তুলে ফেলেন তারা৷
ছবি: DW/M. Zahidul Haque এক শ্রেণীর পেশাজীবী আছেন যাঁরা কেবল সুন্দেরবনে আসেন কাঁকড়া শিকার করতে৷ ছোট ছোট নৌকাযোগে এসব মানুষ সুন্দরবনের খালে, নদীতে কাঁকড়া শিকার করেন৷
ছবি: DW/M. Zahidul Haque সুন্দরবনের নদী-খালে এরা মাছের পোনা সংগ্রহ করে চাষীদের নিকট বিক্রি করে জীবীকা নির্বাহ করেন৷ সুন্দরবনের পার্শ্ববতী এলাকাগুলোর অনেক নারী ও শিশু এ পেশায় নিয়োজিত৷
ছবি: DW/M. Zahidul Haque সুন্দরবনের গহীনে মধু সংগ্রহ করেন এঁরা৷ সাতক্ষীরা জেলার মুন্সীগঞ্জ ও শ্যামনগরেই এদের বসবাস৷ এপ্রিল থেকে জুলাই মাসে বনবিভাগ থেকে অনুমতি নিয়ে এরা একেক যাত্রায় সাধারণত পনের দিন বনের ভেতর মধু সংগ্রহ করেন৷
ছবি: DW/M. Zahidul Haque সুন্দরবনের ভেতরে বিভিন্ন স্থানে অনেক তৃণভূমিতে জন্ম নেয় প্রচুর ছন গাছ৷ ডিসেম্বর-জানুয়ারি মাসে এসব ছন কাটার জন্য একদল পেশাজীবী সুন্দরবনে আসেন৷ ছন গাছ বিভিন্ন এলাকায় ঘরের ছাউনি ছাড়াও পানের বরজে ব্যবহৃত হয়৷
ছবি: DW/M. Zahidul Haque সুন্দরবনের জলে কুমির, ডাঙ্গায় বাঘ৷ এরকম নানান হিংস্র বন্যপ্রাণীকে মোকাবেলা করে বছরের বড় একটা অংশ জঙ্গলে কাটিয়ে দেন সুন্দরবনের উপর নির্ভরশীল পেশাজীবীরা৷ প্রতিবছর এসব পেশাজীবীদের অনেকেই প্রাণ নিয়ে আর ফিরে আসতে পারেন না৷ নিজেদের খাবারের সন্ধানে গিয়ে বাঘের খাবার হন তাঁরা৷
ছবি: DW/M. Zahidul Haque