কাশ্মীরে পণ্ডিতদের বিতাড়নের উপর তৈরি সিনেমা 'দ্য কাশ্মীর ফাইলস' নিয়ে তীব্র বিতর্ক। তবে ইতিমধ্যেই সিনেমাটি সুপারহিট।
বিজ্ঞাপন
সন্ত্রাসবাদীদের আক্রমণের শিকার হয়ে কাশ্মীর থেকে হিন্দু পণ্ডিতদের গণপ্রস্থান বা গণবিতাড়ন নিয়ে সিনেমা বানিয়েছেন বিবেক অগ্নিহোত্রী। অনুপম খের, মিঠুন চক্রবর্তী, পল্লবী জোশি অভিনীত এই ছবিতে বর্তমান সময়ের কোনো বড় তারকা নেই, তথাকথিত বলিউডি ছবির মতো নাচ-গান বা মনোরঞ্জনের ব্যবস্থা নেই, দর্শক আকর্ষণের চিরাচরিত মশলাও নেই। পরিচালকের দাবি, 'বাস্তব ভিত্তিক সিনেমা' তৈরি করেছেন তিনি। তাসত্ত্বেও এই সিনেমা বক্স অফিসে সুপার ডুপার হিট।
আর সেই সঙ্গে এই সিনেমা নিয়ে দেশজুড়ে শুরু হয়েছে ভয়ংকর বিতর্ক। সমালোচকরা বলছেন, এটা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ছবি। অর্ধসত্য ও অনেকটা মিথ্যার উপর ভিত্তি করে সিনেমা বানানো হয়েছে। প্রায় প্রতিদিনই সামাজিক মাধ্যমে হিসাব আসছে, কাশ্মীরে কতজন পণ্ডিত খুন হয়েছেন এবং কতজন কাশ্মীরের মুসলিম ও শিখ সন্ত্রাসের শিকার হয়েছেন।
সেখানে কেউ বলছেন, কাশ্মীরের লাখ লাখ পণ্ডিত যে ভিটেমাটি ছেড়ে চলে এসেছিলেন এটা বাস্তব। পাশাপাশি এটাও বাস্তব, সেসময় বিশ্বনাথ প্রতাপ সিং প্রধানমন্ত্রী। বিজেপি সেই সরকারকে সমর্থন করছিল। তারা পণ্ডিতদের ইস্যুতে বিশ্বনাথপ্রতাপের উপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করেনি, করেছিল মণ্ডল-কমণ্ডলের ইস্যুতে।
মোদীর বক্তব্য
বিজেপি সংসদীয় দলের বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বলেছেন, ''যারা হামেশা মতপ্রকাশের অধিকার নিয়ে সোচ্চার হন, তারা গত কয়েকদিন ধরে খুবই বিচলিত হয়ে পড়েছেন। কাশ্মীর ফাইলসকে তথ্যের আধারে বিশ্লেষণ করার বদলে, শিল্পের নিরিখে বিচার করার জায়গায়, তারা এই সিনেমাকে কলঙ্কিত করছেন, সুনামহানি করছেন।'' মোদীর বক্তব্য, ''কেউ সত্যকে সামনে আনছেন, আর সেই সত্যকে কিছু মানুষ স্বীকার করতেই প্রস্তুত নন। গত পাঁচ-ছয়দিন ধরে তাই ষড়যন্ত্র চলছে।''
কাশ্মীরে বহুদিনের সংঘাত, বহুদিনের ক্ষত
স্বাধীনতার পর থেকেই ভারত ও পাকিস্তানের সম্পর্কে যেন গলার ফাঁস হয়ে রয়েছে কাশ্মীর৷ তাই কাশ্মীর সংক্রান্ত ঘটনাবলী আজ নিজেরাই ইতিহাস৷
ছবি: Getty Images/AFP/R. Bhat
১৯৪৭
বলা হয় দেশবিভাগের পর পাকিস্তান থেকে আগত উপজাতিক যোদ্ধারা কাশ্মীর আক্রমণ করে৷ তখন কাশ্মীরের মহারাজা ভারতের সাথে সংযোজনের চুক্তি করেন, যা থেকে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়৷
ছবি: dapd
১৯৪৮
ভারত জাতিসংঘে কাশ্মীর প্রসঙ্গ উত্থাপন করলে পর, ৪৭ ক্রমিক সংখ্যক প্রস্তাবটি গৃহীত হয়৷ ঐ প্রস্তাব অনুযায়ী গোটা কাশ্মীরে গণভোট অনুষ্ঠিত হবার কথা রয়েছে৷
ছবি: Keystone/Getty Images
১৯৪৮
কিন্তু পাকিস্তান প্রস্তাব অনুযায়ী, কাশ্মীর থেকে সৈন্যাপসারণ করতে অস্বীকার করে৷ অতঃপর কাশ্মীরকে দু’ভাগে ভাগ করা হয়৷
ছবি: Getty Images
১৯৫১
ভারতীয় কাশ্মীরে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ও ভারতের সঙ্গে সংযোজনকে সমর্থন করা হয়৷ অতঃপর ভারত বলে, আর গণভোট অনুষ্ঠানের কোনো প্রয়োজন নেই৷ জাতিসংঘ ও পাকিস্তানের মতে, গণভোট অনুষ্ঠিত হওয়া আবশ্যক৷
ছবি: picture-alliance/dpa/F. Khan
১৯৫৩
কাশ্মীরের ‘প্রধানমন্ত্রী’ শেখ আব্দুল্লাহ গণভোটের সমর্থক ছিলেন ও ভারতের সঙ্গে সংযোজনকে বিলম্বিত করার চেষ্টা করেন৷ ফলে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়৷ জম্মু-কাশ্মীরের নতুন সরকার ভারতের সঙ্গে কাশ্মীরের সংযোজনকে পাকা করেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa/F. Khan
১৯৬২-৬৩
১৯৬২ সালের যুদ্ধে চীন আকসাই দখল করে৷ তার আগের বছর পাকিস্তান কাশ্মীরের ট্রান্স কারাকোরাম ট্র্যাক্ট এলাকাটি চীনকে প্রদান করে৷
ছবি: Getty Images
১৯৬৫
কাশ্মীরকে কেন্দ্র করে আবার ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ হয়৷ কিন্তু যুদ্ধশেষে উভয় দেশের সেনা তাদের পুরোনো অবস্থানে ফিরে যায়৷
ছবি: picture-alliance/dpa/J. Singh
১৯৭১-৭২
আবার ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ৷ যুদ্ধে পাকিস্তানের পরাজয়ের পর সিমলা চুক্তি সম্পাদিত হয় ১৯৭২ সালে৷ যুদ্ধবিরতি রেখাকে লাইন অফ কন্ট্রোল বা নিয়ন্ত্রণ রেখায় পরিণত করা হয় ও আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে বিবাদ সমাধান সম্পর্কে ঐকমত্য অর্জিত হয়৷
ছবি: AP
১৯৮৪
ভারত সিয়াচেন হিমবাহ নিজ নিয়ন্ত্রণে আনার পর পাকিস্তান তা একাধিকবার দখল করার চেষ্টা করেছে, কিন্তু সফল হতে পারেনি৷
ছবি: AP
১৯৮৭
জম্মু-কাশ্মীরে বিতর্কিত নির্বাচনের পর রাজ্যে বিচ্ছিন্নতাবাদী স্বাধীনতা আন্দোলন শুরু হয়৷ ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে উগ্রপন্থাকে উসকানি দেওয়ার অভিযোগ করে, কিন্তু পাকিস্তান সে দোষারোপ চিরকাল অস্বীকার করে এসেছে৷
ছবি: AP
১৯৯০
গওকাদল সেতুর কাছে ভারতীয় সিআরপি রক্ষীবাহিনী কাশ্মীরি বিক্ষোভকারীদের উপর গুলি চালালে পর শতাধিক আন্দোলনকারী নিহত হন৷ প্রায় সমস্ত হিন্দু কাশ্মীর উপত্যকা ছেড়ে চলে যান৷ জম্মু-কাশ্মীরে সেনাবাহিনীকে আফসা বা আর্মড ফোর্সেস স্পেশাল পাওয়ার্স অ্যাক্ট অনুযায়ী বিশেষ ক্ষমতা প্রদান করা হয়৷
ছবি: AFP/Getty Images/Tauseef Mustafa
১৯৯৯
কাশ্মীর ভ্যালিতে গোটা নব্বই-এর দশক ধরে অশান্তি চলে৷ ১৯৯৯ সালে আবার ভারত-পাকিস্তানের লড়াই হয়, এবার কারগিলে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
২০০১-২০০৮
ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে আলাপ-আলোচনার যাবতীয় প্রচেষ্টা প্রথমে নতুন দিল্লির সংসদ ভবন ও পরে মুম্বই হামলার ফলে ব্যর্থ হয়৷
ছবি: picture-alliance/Pacific Press/F. Khan
২০১০
ভারতীয় সেনার গুলি লেগে এক বিক্ষোভকারীর মৃত্যুর পর কাশ্মীর ভ্যালি উত্তেজনায় ফেটে পড়ে৷ বিক্ষোভ চলে বেশ কয়েক সপ্তাহ ধরে, প্রাণ হারান অন্তত ১০০ জন৷
ছবি: picture-alliance/Pacific Press/U. Asif
২০১৩
সংসদ ভবনের উপর হামলার মুখ্য অপরাধী আফজল গুরুকে ফাঁসি দেওয়া হয়৷ এর পর যে বিক্ষোভ চলে, তা-তে দু’জন প্রাণ হারায়৷ এই বছরই ভারত আর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীদ্বয় মিলিত হয়ে উত্তেজনা উপশমের কথা বলেন৷
ছবি: Reuters
২০১৪
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ উপস্থিত থাকেন৷ কিন্তু এর পর নতুন দিল্লিতে পাকিস্তানি হাই কমিশনার কাশ্মীরি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সঙ্গে মিলিত হওয়ায় ভারত আলাপ-আলোচনা স্থগিত রাখে৷
ছবি: Reuters
২০১৬
আজাদ কাশ্মীর ভিত্তিক হিজবুল মুজাহিদীন-এর অধিনায়ক বুরহান ওয়ানি-র মৃত্যুর পর কাশ্মীরে স্বাধীনতা সমর্থকরা আবার পথে নেমেছেন৷ এই আন্দোলনে এ পর্যন্ত অন্তত ১০০ জনের মৃত্যু হয়েছে ও বিক্ষোভ অব্যাহত আছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/R.S.Hussain
২০১৯
২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে জম্মু-কাশ্মীরের পুলওয়ামা সেন্ট্রাল রিজার্ভ পুলিশ ফোর্স (সিআরপিএফ)-এর গাড়িবহরে বোমা হামলার ঘটনা ঘটে৷ এতে ৪২ জওয়ান নিহত হন৷ বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন জৈশ-ই-মোহাম্মদ হামলার দায় স্বীকার করেছে৷ এরপর ২৬ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান সীমান্তের ভেতরে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের ঘাঁটিতে বিমান হামলা চালায় ভারতীয় বিমান বাহিনী৷
ছবি: picture-alliance/ZUMA Wire/P. Kumar Verma
২০১৯
ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ নং ধারা অনুযায়ী, জম্মু ও কাশ্মীরের কাছে কিছু বিশেষ অধিকার ছিল। ৫ আগস্ট স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ ৩৭০ ধারাটি অবসানের দাবি তোলেন৷ বিল পাস হয়। একই দিনে তাতে সই করেন ভারতের রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ৷ ফলে, কাশ্মীরের ‘বিশেষ মর্যাদা' বাতিল হয়। তাছাড়া মোদী সরকারের সিদ্ধান্তের ফলে জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের মর্যাদা হারায়। জম্মু ও কাশ্মীর ও লাদাখ নামে দুইটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল গঠিত হয়।
ছবি: Reuters
19 ছবি1 | 19
মোদী বলেছেন, ''সত্যকে ঠিকভাবে দেশের সামনে আনতে হবে। এটাই দরকার। যার মনে হচ্ছে, এটা ঠিক নয়, তারা আরেকটি সিনেমা বানান। কে মানা করেছে?''
বিজেপি-শাসিত রাজ্যে
বিজেপি-শাসিত অনেক রাজ্যই কাশ্মীর ফাইলসকে করমুক্ত বলে ঘোষণা করেছে। গুজরাট, হরিয়ানা, মধ্যপ্রদেশের মতো রাজ্যগুলি ইতিমধ্যেই কাশ্মীর ফাইলসকে করমুক্ত করে দিয়েছে। হরিয়ানায় তো এক বিজেপি নেতা বিনা পয়সায় এই সিনেমা মানুষকে দেখাচ্ছেন বলে অভিযোগ।
শিবসেনা নেতা সঞ্জয় রাউত বলেছেন, ''গুজরাট ও রাজস্থানে ভোট আসছে। সেদিকে লক্ষ্যে রেখেই বিজেপি এই কাজ করছে।''
বক্স অফিসে সাফল্য
সিনেমা সমালোচক তরণ আদর্শ টুইট করে বলেছেন, ''আগামী বুধ, বৃহস্পতিবারের মধ্যে 'দ্য কাশ্মীর ফাইলস' দুইশ কোটি টাকার বাণিজ্য করবে। গত শুক্রবার ১৯ কোটি ১৫ লাখ, শনিবার ২৪ কোটি ৮০ লাখ এবং রোববার ২৬ কোটি ২০ লাখের ব্যবসা করেছে এই ফিল্ম।''
বক্সঅফিসডটকম জানিয়েছে, প্রথম সাতদিনেই দ্য কাশ্মীর ফাইলস একশ কোটি টাকার বেশি ব্যবসা করেছে। অষ্টম দিনে করেছে ১৯ কোটি ৫০ লাখ টাকার। সমালোচকদের মতে, বক্স অফিসে সুনামি তুলেছে এই সিনেমা।
ওমর আবদুল্লার বক্তব্য
কশ্মীরের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লা বলেছেন, ''আমার মনে হয় না, পরিচালক সৎ উদ্দেশ্য নিয়ে এই সিনেমা তৈরি করেছেন। সত্য হলো, কাশ্মীর থেকে পণ্ডিতদের যখন গণপ্রস্থান হয়েছে, তখন ফারুখ আবদুল্লা মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন না। এটা রাজ্যপালের শাসনে হয়েছিল এবং জগমোহন তখন রাজ্যপাল ছিলেন।''
ওমরের দাবি, ''সিনেমায় একবারের জন্যও দেখানো হয়নি, তখন কেন্দ্রে বিশ্বনাথ প্রতাপ সিং প্রধানমন্ত্রী ছিলেন এবং বিজেপি সরকারকে সমর্থন করছিল।'' ওমর বলেছেন, ''আমি পণ্ডিতদের খুন করার তীব্র নিন্দা করছি। কিন্তু কাশ্মীরে মুসলমানরাও মারা গেছেন। শিখরাও মারা গেছেন।''
আমির খান যা বলেছেন
আনন্দবাজার জানাচ্ছে, আমির খান সম্প্রতি দক্ষিণ ভারতীয় পরিচালক রাজামৌলীর আগামী ছবি ‘আর আর আর'-এর সাংবাদিক সম্মেলনে ছিলেন। সেখানে কাশ্মীর ফাইলস নিয়ে প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছেন, ‘‘আমি এখনও সিনেমাটি দেখিনি। আমি অবশ্যই দেখব। আমি মনে করি, প্রত্যেক ভারতীয়ের এই ছবি দেখা উচিত। কাশ্মীর ফাইলসে যে ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে, তা হৃদয়বিদারক। দেশবাসীর সেই ইতিহাস জানা উচিত।''
আমির জানিয়েছেন, ''যারা মানবতায় বিশ্বাস করেন, এই সিনেমাটি তাদের মন ছুঁয়ে গিয়েছে।''
বিবেক অগ্নিহোত্রীকে নিরাপত্তা
কেন্দ্রীয় সরকার কাশ্মীর ফাইলসের নির্মাতা বিবেক অগ্নিহোত্রীকে ওয়াই ক্যাটাগরির নিরাপত্তা দিয়েছে। সরকারি সূত্র সংবাদসংস্থা এএনআই-কে জানিয়েছে, তিনি এখন থেকে দেশের যেখানেই যান না কেন, সিআরপিএফ জওয়ানরা তার সুরক্ষা নিশ্চিত করবেন।