একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটের রাতে নোয়াখালীর সুবর্ণচরে গৃহবধূকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের অভিযোগে করা মামলায় ১০ জনের ফাঁসি ও ছয়জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত৷
বিজ্ঞাপন
সেইসাথে আসামিদের প্রত্যেককে ৫০ হাজার টাকা করে জরিমানা এবং অনাদায়ে আরও দুই বছরের কারাদণ্ডের আদেশ দেওয়া হয়েছে।
আজ এই রায় ঘোষণা করেন নোয়াখালী নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-২ এর বিচারক (জেলা জজ) ফাতেমা ফেরদৌস। এর আগে গত ২৯ নভেম্বর অধিকতর যুক্তিতর্ক শেষে রায়ের জন্য ১৬ জানুয়ারি দিন ধার্য করেন বিচারক। তবে, রায় লেখা শেষ না হওয়ায় আদালত রায় ঘোষণার জন্য ৫ ফেব্রুয়ারি তারিখ পুনর্নির্ধারণ করেন।
ধর্ষণ: কিছু ঘটনা ও দায়বদ্ধতা
বাংলাদেশে প্রতিদিনই সংবাদপত্রের পাতায় একাধিক ধর্ষণের খবর প্রকাশ হয়৷ কোনোটি আলোচিত হয়, কোনোটি আড়ালেই থেকে যায়৷ এই প্রবণতা কোনো নির্দিষ্ট শ্রেণি, বয়সের গণ্ডিতে আটকে নেই৷ শিক্ষা, ধর্ম, আইন কোনো কিছুই মানছেন না ধর্ষকরা৷
ছবি: Mohammad Ponir Hossain/REUTERS
ক্ষমতার দাপট
গত বছরের ২৫ সেপ্টেম্বর সিলেটের এমসি কলেজে স্বামীর সঙ্গে বেড়াতে যাওয়া এক নারী ধর্ষণের শিকার হন৷ তাকে ধর্ষণ করেন কয়েকজন ছাত্রলীগ কর্মী৷ ৪ অক্টোবর নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে এক নারীকে বিবস্ত্র করে নির্যাতনের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়৷ এক মাস আগে ঘটলেও আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তার আগ পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা নেয়নি৷
ছবি: Mohammad Ponir Hossain/REUTERS
অনিরাপদ পরিবহণ
২০১৭ সালে টাঙ্গাইলে চলন্ত বাসে বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে কর্মরত এক তরুণীকে ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনা আলোচিত হয়৷ তবে এর পরেও নারীদের জন্য গণপরিবহণ নিরাপদ হয়ে ওঠেনি৷ গত ২৬ ডিসেম্বর সুনামগঞ্জে কলেজছাত্রীকে ধর্ষণের চেষ্টার অভিযোগে এক বাসচালককে গ্রেপ্তার করা হয়৷ যাত্রী কল্যাণ সমিতির হিসাবে, গত বছর গণপরিবহণে ৫২টি ঘটনায় ৫৯ নারী ধর্ষণ ও যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন৷
ছবি: Munir Uz Zaman/AFP/Getty Images
নিরাপত্তাহীন সড়ক
২০২০ সালের পাঁচ জানুয়ারি সন্ধ্যায় ঢাকার কুর্মিটোলায় ধর্ষণের শিকার হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী৷ বাস থেকে নামার পরপরই তাকে সড়কের পাশে তুলে নিয়ে যায় ধর্ষক মজনু৷ খোদ রাজধানীর ব্যস্ত সড়কে নারীর নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দেয় এই ঘটনায়৷
ছবি: Sazzad Hossain/DW
শিশুরাও ধর্ষণের শিকার
গণমাধ্যমে প্রায় প্রতিদিন শিশু ধর্ষণের খবর উঠে আসছে৷ মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন (এমজেএফ) এর হিসাবে ২০২০ সালে ৬২৬ শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে৷ আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাবে এই সংখ্যাটি ৯৭৪৷ এসব ঘটনায় অনেক ক্ষেত্রেই পরিবারের সদস্য বা স্বজনরাও জড়িত৷
ছবি: picture alliance/dpa/P. Pleul
বাদ নেই ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান
সম্প্রতি চট্টগ্রামে এক মাদ্রাসা শিক্ষক গত দুই বছর প্রতিরাতে শিশু ছাত্রদের যৌন নিপীড়নে বাধ্য করতেন বলে স্বীকার করেছেন৷ নভেম্বরে কুমিল্লার এক মাদ্রাসায় ১১ বছরের ছাত্রকে জোরপূর্বক ধর্ষণের অভিযোগে এক শিক্ষককে গ্রেফতার করে পুলিশ৷ গত ১২ মার্চ রাজধানীতে আট বছরের শিশুকে ধর্ষণের অভিযোগে এক মসজিদের ইমাম গ্রেপ্তার হন৷ অক্টোবরে ছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগে এক মাদ্রাসার প্রধান শিক্ষককে গ্রেপ্তার করা হয়৷
ছবি: Sazzad Hossain/DW
দেড় হাজার নারী
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, গত বছর নভেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশে ১,৫৪৬ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন৷ ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৫১ জনকে, আত্মহত্যা করেছেন ১৪ জন৷ ২০১৯ সালে ১,৪১৩ জন নারী, ২০১৮ সালে ৭৩২ জন ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন৷ বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ নভেম্বর পর্যন্ত দেশে ১,২৪৭টি নারী ও কন্যাশিশু ধর্ষণের তথ্য পেয়েছে৷ যদিও প্রকৃত ঘটনা এর চেয়েও বেশি বলে মনে করা হয়৷
ছবি: Munir Uz Zaman/AFP/Getty Images
রক্ষকের বিরুদ্ধে অভিযোগ
প্রথম আলোর প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১৫ জানুয়ারি ২০১৯ সালে খুলনা রেলওয়ে থানায় এক নারীকে ধর্ষণের অভিযোগ উঠে পুলিশের পাঁচ সদস্যের বিরুদ্ধে৷ একই বছর মানিকগঞ্জের সাটুরিয়া থানার দুই পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে তরুণীকে ধর্ষণের অভিযোগ উঠে৷ গত বছরের জানুয়ারিতে রাজধানীতে ধর্ষণের মামলায় পুলিশের এক উপপরিদর্শককে গ্রেপ্তার করা হয়৷ এক ছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগে অক্টোবরে রংপুরে পুলিশের এক এএসআইকে বরখাস্ত করা হয়৷
ছবি: Samir Kumar Dey/DW
বিচারহীনতা
২০১২ সাল থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে ২৫টি ধর্ষণ মামলা নিয়ে পর্যালোচনা করেছে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন৷ বাংলা ট্রিবিউনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, সেখানে তারা দেখেছে প্রতিটি মামলাতেই আসামি ১৫ দিনের মধ্যে জামিন পেয়েছে৷ তিন জন অভিযুক্ত কারাগারে রয়েছেন, দুই জন প্রভাবশালীর ছত্রছায়ায় রয়েছে, তারা ঘুরে বেড়াচ্ছে অথচ তাদের গ্রেফতার করা যায়নি৷ গত ১৪ জানুয়ারি এক সংবাদ সম্মেলনে তারা এই তথ্য জানিয়েছে৷
ছবি: Sazzad Hossain/DW
সমাধান বিয়ে!
ধর্ষণের পর সালিশ বা আদালতের মাধ্যমে সমাধান হিসেবে ধর্ষকের সঙ্গে ভুক্তভোগী নারীর বিয়ে হয়৷ প্রথম আলোর প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২৪ নভেম্বর কুমিল্লার আদালতে ধর্ষণ মামলার আসামির সঙ্গে ভুক্তভোগীর বিয়ে হয়েছে৷ ১৯ নভেম্বর ফেনী কারাগারে ধর্ষণ মামলার আসামির সঙ্গে ভুক্তভোগীর বিয়ে হয়৷ একইদিনে নাটোরেও এমন একটি ঘটনা ঘটে৷ ২২ অক্টোবর উচ্চ আদালতের নির্দেশে ধর্ষণের মামলায় যাবজ্জীবন আসামি ও ভুক্তভোগীর কারাফটকে বিয়ে হয়৷
ছবি: Sazzad Hossain/DW
দায় পোশাকের?
ধর্ষণের হাত থেকে শিশু, বৃদ্ধ নিস্তার পাচ্ছেন না কেউ৷ বাদ নেই স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই৷ তবুও এই প্রবণতার জন্য কেউ কেউ নারীর পোশাককে কটাক্ষ করেন৷ ধর্ষণের জন্য ‘অশালীন পোশাককে’ দায়ী করে এক ভিডিও বার্তা দিয়ে সমালোচিত হন চিত্রনায়ক অনন্ত জলিল৷ নভেম্বরে সংসদে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন বিলের আলোচনায় সংসদ সদস্য রেজাউল করিম বাবলু ধর্ষণের জন্য নারীদের পোশাককে দায়ী করে বক্তব্য দেন৷
ছবি: Mohammad Ponir Hossain/REUTERS
10 ছবি1 | 10
মামলার নথি থেকে জানা যায়, ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের রাতে স্থানীয় রুহুল আমিনের নেতৃত্বে স্বামী ও সন্তানদের বেঁধে রেখে গৃহবধূকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ করা হয়। ভুক্তভোগীর অভিযোগ, ভোটকেন্দ্রে থাকা ব্যক্তিদের পছন্দের প্রতীকে ভোট না দেওয়ার জেরে এ ঘটনা ঘটে।
ঘটনার পরদিন ভুক্তভোগী গৃহবধূর স্বামী বাদী হয়ে চরজব্বর থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা করেন। তদন্ত শেষে সুবর্ণচর উপজেলা আওয়ামী লীগের বহিষ্কৃত প্রচার সম্পাদক রুহুল আমিন মেম্বারসহ ১৬ জনের বিরুদ্ধে ২০১৯ সালের ২৭ মার্চ অভিযোগপত্র দেন জেলা গোয়েন্দা পুলিশ পরিদর্শক জাকির হোসেন।
এ মামলায় রাষ্ট্রপক্ষ ২৩ জন সাক্ষীর স্বাক্ষ্য নিয়েছে। মামলায় রুহুল আমিন মেম্বারসহ ১৬ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়েছে। পুলিশ ১৫ আসামিকে গ্রেপ্তার করেছে। ঘটনার পর থেকে আসামি মো. মিন্টু ওরফে হেলাল (২৮) পলাতক।
বাদীপক্ষের আইনজীবী মোল্লা হাবিবুর রছুল মামুন ডেইলি স্টারকে বলেন, সুবর্ণচরে নারীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনায় কারাগারে আছেন ১৫ জন। তাদের মধ্যে আট আসামি নিজেদের দোষ স্বীকার করে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।