সুবর্ণচরে আবারো ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। এবার বাবা-মাকে বেঁধে কিশোরী মেয়েকে ধর্ষণ করা হয়েছে বলে অভিযোগ। নোয়াখালীর এক উপজেলা কেন বার বার ধর্ষণের কারণে সংবাদ শিরোনামে আসে? ধর্ষণ রোধে ব্যর্থতার দায় কার?
বিজ্ঞাপন
সুবর্ণচরের পশ্চিম চরমজিদ এলাকার আশ্রয়ণ প্রকল্পে বরিবার রাতে ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। পুলিশ এপর্যন্ত দুইজনকে গ্রেপ্তার করেছে। ধর্ষণের শিকার কিশোরীকে জেলা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
সুবর্ণচর প্রথম আলোচনায় আসে ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর৷ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ধানের শীষে ভোট দেয়ায় ওই দিন রাতে চর জুবিলি এলাকায় এক নারীকে ধর্ষণ করা হয়। এর মাত্র তিন মাস পরই উপজেলা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আবারো সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনা ঘটে।
‘‘জনপ্রতিনিধিরা সালিশের নামে অনেক ঘটনাই ধামাচাপা দেয়’’
স্থানীয় মানবাধিকার কর্মীরা মনে করেন ধর্ষণ ওই এলাকায় আরো বেশি হয়, তবে অনেক ঘটনাই প্রকাশ পায় না। কারণ, স্থানীয় পর্যায়ে মেম্বার চেয়ারম্যানরা ভিকটিমকে থানায় যেতে দেন না, মীমাংসা করে ফেলেন। নানা ধরনের হুমকি দেয়ায় আর সাংবাদিকরাও খবর প্রকাশ করতে পারেন না।
কেন সুবর্ণচরে বার বার ধর্ষণ
পার্টিসিপেটরি রিসার্চ অ্যাকশন নেটওয়ার্ক (রিন) নামে একটি স্থানীয় এনজিও সুবর্ণ চরের ধর্ষণ নিয়ে কয়েক বছর ধরে কাজ করছে। প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী নুরুল আলম মাসুদ বলেন, "দেশের অন্য যে কোনো এলাকার চেয়ে সুবর্ণচরে ধর্ষণের সংখ্যা বেশি। কিন্তু অধিকাংশ ঘটনায়ই থানায় মামলা হয় না।” তিনি বলেন," সুবর্ণচরের বেশিরভাগ মানুষ ভূমিহীন। এখানে অনেক খাস জমি আছে। দরিদ্রদের ওই খাস জমি দখলে রাখতে রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় অনেক সন্ত্রাসী গ্রুপ তৈরি হয়েছে। তারা জমির দখল নিতে প্রতিপক্ষকে দুর্বল করতে নারীদের টার্গেট করে। ধর্ষণ করে। কারণ, ভূমিহীনরা ওই খাস জমিতে থাকে। আবার ভোটের সময় ভয় সৃষ্টির জন্য নারীদের টার্গেট করা হয়।”
ধর্ষণ: কিছু ঘটনা ও দায়বদ্ধতা
বাংলাদেশে প্রতিদিনই সংবাদপত্রের পাতায় একাধিক ধর্ষণের খবর প্রকাশ হয়৷ কোনোটি আলোচিত হয়, কোনোটি আড়ালেই থেকে যায়৷ এই প্রবণতা কোনো নির্দিষ্ট শ্রেণি, বয়সের গণ্ডিতে আটকে নেই৷ শিক্ষা, ধর্ম, আইন কোনো কিছুই মানছেন না ধর্ষকরা৷
ছবি: Mohammad Ponir Hossain/REUTERS
ক্ষমতার দাপট
গত বছরের ২৫ সেপ্টেম্বর সিলেটের এমসি কলেজে স্বামীর সঙ্গে বেড়াতে যাওয়া এক নারী ধর্ষণের শিকার হন৷ তাকে ধর্ষণ করেন কয়েকজন ছাত্রলীগ কর্মী৷ ৪ অক্টোবর নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে এক নারীকে বিবস্ত্র করে নির্যাতনের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়৷ এক মাস আগে ঘটলেও আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তার আগ পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা নেয়নি৷
ছবি: Mohammad Ponir Hossain/REUTERS
অনিরাপদ পরিবহণ
২০১৭ সালে টাঙ্গাইলে চলন্ত বাসে বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে কর্মরত এক তরুণীকে ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনা আলোচিত হয়৷ তবে এর পরেও নারীদের জন্য গণপরিবহণ নিরাপদ হয়ে ওঠেনি৷ গত ২৬ ডিসেম্বর সুনামগঞ্জে কলেজছাত্রীকে ধর্ষণের চেষ্টার অভিযোগে এক বাসচালককে গ্রেপ্তার করা হয়৷ যাত্রী কল্যাণ সমিতির হিসাবে, গত বছর গণপরিবহণে ৫২টি ঘটনায় ৫৯ নারী ধর্ষণ ও যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন৷
ছবি: Munir Uz Zaman/AFP/Getty Images
নিরাপত্তাহীন সড়ক
২০২০ সালের পাঁচ জানুয়ারি সন্ধ্যায় ঢাকার কুর্মিটোলায় ধর্ষণের শিকার হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী৷ বাস থেকে নামার পরপরই তাকে সড়কের পাশে তুলে নিয়ে যায় ধর্ষক মজনু৷ খোদ রাজধানীর ব্যস্ত সড়কে নারীর নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দেয় এই ঘটনায়৷
ছবি: Sazzad Hossain/DW
শিশুরাও ধর্ষণের শিকার
গণমাধ্যমে প্রায় প্রতিদিন শিশু ধর্ষণের খবর উঠে আসছে৷ মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন (এমজেএফ) এর হিসাবে ২০২০ সালে ৬২৬ শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে৷ আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাবে এই সংখ্যাটি ৯৭৪৷ এসব ঘটনায় অনেক ক্ষেত্রেই পরিবারের সদস্য বা স্বজনরাও জড়িত৷
ছবি: picture alliance/dpa/P. Pleul
বাদ নেই ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান
সম্প্রতি চট্টগ্রামে এক মাদ্রাসা শিক্ষক গত দুই বছর প্রতিরাতে শিশু ছাত্রদের যৌন নিপীড়নে বাধ্য করতেন বলে স্বীকার করেছেন৷ নভেম্বরে কুমিল্লার এক মাদ্রাসায় ১১ বছরের ছাত্রকে জোরপূর্বক ধর্ষণের অভিযোগে এক শিক্ষককে গ্রেফতার করে পুলিশ৷ গত ১২ মার্চ রাজধানীতে আট বছরের শিশুকে ধর্ষণের অভিযোগে এক মসজিদের ইমাম গ্রেপ্তার হন৷ অক্টোবরে ছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগে এক মাদ্রাসার প্রধান শিক্ষককে গ্রেপ্তার করা হয়৷
ছবি: Sazzad Hossain/DW
দেড় হাজার নারী
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, গত বছর নভেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশে ১,৫৪৬ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন৷ ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৫১ জনকে, আত্মহত্যা করেছেন ১৪ জন৷ ২০১৯ সালে ১,৪১৩ জন নারী, ২০১৮ সালে ৭৩২ জন ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন৷ বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ নভেম্বর পর্যন্ত দেশে ১,২৪৭টি নারী ও কন্যাশিশু ধর্ষণের তথ্য পেয়েছে৷ যদিও প্রকৃত ঘটনা এর চেয়েও বেশি বলে মনে করা হয়৷
ছবি: Munir Uz Zaman/AFP/Getty Images
রক্ষকের বিরুদ্ধে অভিযোগ
প্রথম আলোর প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১৫ জানুয়ারি ২০১৯ সালে খুলনা রেলওয়ে থানায় এক নারীকে ধর্ষণের অভিযোগ উঠে পুলিশের পাঁচ সদস্যের বিরুদ্ধে৷ একই বছর মানিকগঞ্জের সাটুরিয়া থানার দুই পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে তরুণীকে ধর্ষণের অভিযোগ উঠে৷ গত বছরের জানুয়ারিতে রাজধানীতে ধর্ষণের মামলায় পুলিশের এক উপপরিদর্শককে গ্রেপ্তার করা হয়৷ এক ছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগে অক্টোবরে রংপুরে পুলিশের এক এএসআইকে বরখাস্ত করা হয়৷
ছবি: Samir Kumar Dey/DW
বিচারহীনতা
২০১২ সাল থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে ২৫টি ধর্ষণ মামলা নিয়ে পর্যালোচনা করেছে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন৷ বাংলা ট্রিবিউনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, সেখানে তারা দেখেছে প্রতিটি মামলাতেই আসামি ১৫ দিনের মধ্যে জামিন পেয়েছে৷ তিন জন অভিযুক্ত কারাগারে রয়েছেন, দুই জন প্রভাবশালীর ছত্রছায়ায় রয়েছে, তারা ঘুরে বেড়াচ্ছে অথচ তাদের গ্রেফতার করা যায়নি৷ গত ১৪ জানুয়ারি এক সংবাদ সম্মেলনে তারা এই তথ্য জানিয়েছে৷
ছবি: Sazzad Hossain/DW
সমাধান বিয়ে!
ধর্ষণের পর সালিশ বা আদালতের মাধ্যমে সমাধান হিসেবে ধর্ষকের সঙ্গে ভুক্তভোগী নারীর বিয়ে হয়৷ প্রথম আলোর প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২৪ নভেম্বর কুমিল্লার আদালতে ধর্ষণ মামলার আসামির সঙ্গে ভুক্তভোগীর বিয়ে হয়েছে৷ ১৯ নভেম্বর ফেনী কারাগারে ধর্ষণ মামলার আসামির সঙ্গে ভুক্তভোগীর বিয়ে হয়৷ একইদিনে নাটোরেও এমন একটি ঘটনা ঘটে৷ ২২ অক্টোবর উচ্চ আদালতের নির্দেশে ধর্ষণের মামলায় যাবজ্জীবন আসামি ও ভুক্তভোগীর কারাফটকে বিয়ে হয়৷
ছবি: Sazzad Hossain/DW
দায় পোশাকের?
ধর্ষণের হাত থেকে শিশু, বৃদ্ধ নিস্তার পাচ্ছেন না কেউ৷ বাদ নেই স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই৷ তবুও এই প্রবণতার জন্য কেউ কেউ নারীর পোশাককে কটাক্ষ করেন৷ ধর্ষণের জন্য ‘অশালীন পোশাককে’ দায়ী করে এক ভিডিও বার্তা দিয়ে সমালোচিত হন চিত্রনায়ক অনন্ত জলিল৷ নভেম্বরে সংসদে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন বিলের আলোচনায় সংসদ সদস্য রেজাউল করিম বাবলু ধর্ষণের জন্য নারীদের পোশাককে দায়ী করে বক্তব্য দেন৷
ছবি: Mohammad Ponir Hossain/REUTERS
10 ছবি1 | 10
নুরুল আলম মাসুদ বলেন, এমন অভিযোগও রয়েছে যে কোনো নারী ধর্ষণের শিকার হয়ে চেয়ারম্যানের কাছে গেছেন, কিন্তু বিচার না করে তাকে উল্টো বেঁধে রাখা হয়েছে। জনপ্রতিনিধিরা সালিশের নামে অনেক ঘটনাই ধামাচাপা দেয়।
তিনি বলেন, "চর মজিদে সর্বশেষ যে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে সেটা সরকারের আশ্রয়ণ প্রকল্পে। ওই এলাকা সন্ত্রাসী হোসেন বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে। তাদের আবার রাজনৈতিক গডফাদার আছে। ওই সন্ত্রাসী বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে আবার আশ্রয়ণ প্রকল্পের সব পুকুর । এটা স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যানের ছত্রছায়ায়ই হচ্ছে।”
তার কথা, "স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনও তেমন কোনো ব্যবস্থা নেয় না। যেগুলো আলোচনায় আসে, তারা সেগুলো নিয়ে তৎপর হয়।”
চেয়ারম্যান-মেম্বারদের প্রশ্নবিদ্ধ ভূমিকা
নোয়াখালী নারী অধিকার জোটের সভাপতি লায়লা পরভীন বলেন, "সুবর্ণচরে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনা বেশি। এর সঙ্গে জমিজমা ও স্বার্থের বিষয় আছে। তাদের জন প্রতিনিধি ও রাজনৈতিক নেতারা শেল্টার দেয়। ওই সন্ত্রাসী গ্রুপগুলো কোনো না কোনো প্রভাবশালী গ্রুপের আশ্রয়ে থাকে, ফলে বিচার হয় না। মিমাংসা করে দেয়া হয়। গত কয়েক মাসে বেশ কয়েকটি ধর্ষণের ঘটনা ধামাচাপা দেয়া হয়েছে।”
তার কথা, "সাংবাদিকরা এই বিষয়গুলো প্রকাশ করতে গেলে তারাও হয়রানির মুখে পড়েন। বেশ কয়েকজন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলাও করা হয়েছে। আর যারা ধর্ষণের শিকার হন, তারা দরিদ্র। তারাও প্রভাবশালীদের কথার বাইরে যেতে পারেন না।”
তিনি বলেন, "যদি মামলা হয়ও তারপরও সাক্ষীদের হয় ভয় দেখিয়ে, নয় হুমকি দিয়ে থামিয়ে দেয়া হয়। আর বাদিও শেষ পর্যন্ত এগোতে পারেন না। ফলে বিচার হয় না।”
স্থানীয় সাংবাদিক আবদুল বারি বাবলু বলেন, সূবর্ণচরের আটটি ইউনিয়নের প্রায় সবাই কৃষিজীবী। তবে অধিকাংশেরই জমি নাই। তারা প্রভাশালীদের জমি বা খাস জমি চাষ করেন। পুরুষরা বছরের ছয় মাসই উপজেলার বাইরে থাকেন কাজের খোঁজে। কেউ অন্য এলাকার ইটভাটায় কাজ করেন। আবার কেউ শহরে রিকশা চালান। ফলে নারীরা অধিকাংশ সময় একা থাকেন। ধর্ষকরা এর সুযোগ নেয়। তবে তার কথা, "এখানে ধর্ষণ মামলার পিছনে রাজনীতিও আছে। আবার ধর্ষণের পিছনেও আছে রাজনীতি। বছরে পর বছর ধরে এই অবস্থা চলছে।”
"সুবর্ণচরে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনা বেশি’’
পুলিশের বক্তব্য
সুবর্ণচর উপজেলার থানা হলো চর জব্বার। থানার ইন্সপেক্টর( তদন্ত) জয়নাল আবেদিন জানান, রোববারের সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনায় জড়িত সন্দেহে দুইজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং কিশোরীর জবানবন্দি নেয়া হয়েছে। মেয়েটির মেডিকেল টেস্টও করানো হয়েছে। অন্য আসামিদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তিনি বলেন, "হোসেন বাহিনীর হোসেন প্রভাবশালী হলেও তাকে আমরা গ্রেপ্তার করবো।”
আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, "গত মাসে কোনো ধর্ষণের মামলা হয়নি। এই মাসে হলো। তবে প্রতি মাসেই দুই-তিনটি ঘটনার খবর আমরা পাই। মামলা হলে আমরা পদক্ষেপ নিই।”
সুবর্ণ চরে ধর্ষণের ঘটনা দেশের অন্য এলাকার চেয়ে বেশি জানিয়ে তিনি বলেন, "এই এলাকায় জমিজমা নিয়ে অনেক দ্বন্দ্ব, অনেক সমস্যা। এছাড়া নানা ধরনের বিরোধও আছে। এসবের শিকার হন নারীরা।” তবে প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতেও কখনো কখনো ধর্ষণের মামলা হয় বলে তিনি দাবি করেন।
ধর্ষণ আর অপহরণের শিকার রোহিঙ্গা এতিম শিশুরা
মিয়ানমার সেনাদের সীমাহীন নির্যাতনের কারণে গত আড়াই মাসে ছয় লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা মুসলমান বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে৷ সবচেয়ে দুর্বিষহ পরিস্থিতির মুখে পড়েছে শিশুরা৷ জন ওয়েনস এর ছবিতে উঠে এসেছে সেইসব দুর্দশার কিছু কথা৷
ছবি: DW/J. Owens
গুলি আর ছুরিকাঘাত
গত আগস্ট থেকে এ পর্যন্ত ছয় লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে পালিয়েছে৷ তাদেরই একজন মোহাম্মদ বেলাল৷ দৌড়ে পালাতে পেরেছিল ১০ বছর বয়সি এই কিশোর৷ সে জানায়, ‘‘সেদিন সেনাবাহিনী এসে পুরো গ্রাম পুড়িয়ে দেয়৷ আমার মা পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিল, সেসময় তাঁকে গুলি করা হয়৷ আমার বাবা হাঁটতে পারছিলেন না, তারা তাঁকে ছুরি দিয়ে আঘাত করে৷ আমি নিজ চোখে এসব দেখেছি৷’’
ছবি: DW/J. Owens
আতঙ্কগ্রস্ত
মোহাম্মদ বেলালের বোন নূরও হত্যাযজ্ঞ দেখেছে৷ নিঃসঙ্গ হয়ে সে আর তার ভাই এখন বাংলাদেশে শিশুদের একটি আশ্রয়কেন্দ্রে আছে৷ এখানে সে নিয়মিত খাবার পাচ্ছে এবং খেলতে পারছে৷এ এক অদ্ভুত বৈপরীত্য৷ মিয়ানমারে থাকার সময় তাদের দুই ভাই-বোনকে বেশিরভাগ সময়ই না খেয়ে থাকতে হতো৷ তারপরও সাম্প্রতিক এই ট্রমা থেকে কিছুতেই বের হতে পারছে না সে৷ ‘‘আমি আমার বাবা-মা, বাড়ি আর দেশ, সবকিছুই ভীষণ মিস করছি,’’ জানায় নূর৷
ছবি: DW/J. Owens
গভীর সঙ্কট
৭০ বছরেরও বেশি সময় ধরে মিয়ানমারে চলছে এই সঙ্কট৷ সংঘাতে ২০১৬ সাল থেকে এ পর্যন্ত দু’ হাজারেরও বেশি মানুষ মারা গেছে৷ সাম্প্রতিক সেনা নিপীড়নের অভিজ্ঞতা জানাতে গিয়ে ১২ বছর বয়সি রহমান বলে, ‘‘তারা আমার বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয়৷ অসুস্থ ছিল বলে আমার মা পালাতেও পারেনি৷’’
ছবি: DW/J. Owens
শিশুদের বাঁচাও
বাবা-মাকে হত্যার দৃশ্য নিজ চোখে দেখার পর দিলু আরা তার বোন রোজিনার সাথে পালায়৷ এখন ক্যাম্পে আছে ৫ বছর বয়সি এই শিশু৷ ‘‘আমি খুব কাঁদছিলাম আর পুরোটা সময়ই আমাদের মাথার উপর দিয়ে বুলেট উড়ে যাচ্ছিল৷ কোনো রকমে আমি পালিয়ে এসেছি,’’ বলে শিশুটি৷ বাবা-মা ছাড়া কুতুপালংয়ে আসা এই শিশুদের সাহয়তা দিচ্ছে আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থা সেভ দ্য চিলড্রেন৷ বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গাদের শতকরা ৬০ ভাগই শিশু৷
ছবি: DW/J. Owens
পশুদের মতো শিকার
জাদেদ আলমও বাবা-মা ছাড়া কুতুপালংয়ে এসেছে৷তবে ভাগ্য ভালো বলে সে তার চাচীকে সাথে পায়৷চাচীই এখন তার দেখাশোনা করছেন৷ সে বলছিল ‘মান্দি পাড়া’ নামে এক গ্রামে বেড়ে উঠেছে সে৷ ফুটবল খেলতেও সে খুব পছন্দ করতো৷ তবে সেনা অভিযানের পর থেকে সবকিছুই বদলে যায়৷ সে জানায়, ‘‘তারা আমাদের বাড়ি ছেড়ে যেতে বলে৷ আমি আমার বাবা-মা’র সাথে দৌড়ে পালাচ্ছিলাম, এমন সময় তাঁদেরকে গুলি করে সেনারা৷ সাথে সাথে মারা যায় তারা৷’’
ছবি: DW/J. Owens
শিশু অপহরণ
এসব ঘটনার সময় সব পরিবারকেই যে আলাদা হতে হয়েছে, তা নয়৷ গত কয়েক সপ্তাহ ধরে রহমান আলী নামে এই ব্যক্তি এই ক্যাম্পে আছেন৷ তবে এখন তিনি তার ১০ বছর বয়সি ছেলে জিফাদকে খুঁজে পাচ্ছেন না৷ ক্যাম্প এলাকায় প্রায় সারা বছরই শিশু অপহরণের গুজব শোনা যায়৷ রহমানের আশংকা, তাঁর ছেলেও পাচারকারীদের হাতে পড়েছে৷ ‘‘আমি খেতে পারছি না, ঘুমাতে পারছি না৷ আমি মনে হয় পাগলই হয়ে গেছি,’’ বলে রহমান৷
ছবি: DW/J. Owens
‘আমি স্বাভাবিক নেই’
যখন গুলি শুরু হয়, তখন সকিনা খাতুন তাঁর বাচ্চাদের বাঁচাতে প্রাণপণে চেষ্টা করেছে৷ তারপরও ১৫ বছরের ইয়াসমিন আর ২০ বছরের জামালিকে বাঁচাতে পারেননি৷ ঘটনার সময় তারা পাশের গ্রামে ছিল৷ সকিনা বলছিল, ‘‘দাদা-দাদীর সামনে তাদের গলা কেটে হত্যা করা হয়৷ আমি এতটাই অনুভূতি শূণ্য হয়ে পড়েছি যে, এই কষ্টও অনুভব করতে পারছি না৷ তাই এই মুহূর্তে আমি স্বাভাবিক নেই৷’’ দুই সন্তানকে হারালেও বাকি নয় জনকে রক্ষা করতে পেরেছেন তিনি৷
ছবি: DW/J. Owens
হামলা, ধর্ষণ এবং লুটপাট
ইয়াসমিনের বয়স ১৫-র কাছাকাছি৷ তবে তাকে তার চেয়েও কম বয়সি বলে মনে হয়৷ গ্রামে থাকার সময় সে মার্বেল খেলতো আর বাড়ির কাছের মাঠে খেলতো৷ এখন অবশ্য ভিন্ন স্মৃতি তাড়িত করছে তাকে৷ মিয়ানমারের সেনারা তার বাবা ও ভাইদের প্রথমে মারধর ও পরে হত্যা করে৷ একদল সেনা তাকে ধর্ষণও করে৷ এখন ইয়াসমিন কেবল এটুকু বলতে পারে,‘‘আমার শরীরে ভীষণ ব্যথা৷’’