বাংলাদেশে আজ সুশীল সমাজের সদস্যরা নিস্ক্রিয়৷ কোনো কিছুর প্রতিবাদ করার ক্ষমতা তাঁদের নেই৷ সরকারই সেটা করতে দিচ্ছে না৷ তবে এর জন্য দায়ী সুশীলরাও৷
বিজ্ঞাপন
একটা সময় ছিল যখন স্বাধীনতার আগে ও পরে সমাজ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন সুশীল সমাজের সদস্যরা৷ নব্বইয়ের দশকে স্বৈরশাসন হটিয়ে দেশে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার লড়াইয়েও রাজনৈতিক নেতাদের পাশাপাশি সুশীল সমাজের ভূমিকা ছিল৷ বিভিন্ন সময়ে দেয়া তাঁদের বুদ্ধি ও পরামর্শ আন্দোলনকে সফল করেছিল৷
কিন্তু আজ সেই সুশীলদের বেহাল দশা৷ একদিকে যেমন তাঁরা সরকারের সমালোচনা করতে পারছেন না৷ অন্যদিকে কোনো সুশীল কিছু বললে আজকাল অনেকেই তাঁদের কথায় কোনো গুরুত্ব দিচ্ছেন না৷ কারণ জনগণ বুঝে গেছে কিংবা চিনে গেছে, কোন সুশীল কী বলতে পারেন৷ সুশীলদের এই অবস্থার জন্য তাঁরা নিজেরাই দায়ী৷ বিভিন্ন সুবিধা পেতে তাঁরা নিজেরাই দেশের প্রধান দু'টি রাজনৈতিক দল কিংবা তাদের মতবাদের সঙ্গে মিশে গেছেন৷ ফলে মত প্রকাশ করতে গিয়ে তাদের দলীয় মনোভাব প্রকাশ পেয়ে যায়৷ তাছাড়া সরকার সুশীল সমাজের উপর হামলে পড়লে অন্যপক্ষের সুশীলরা তার প্রতিবাদ করেন না৷ উলটো সুশীলরা তাঁদের প্রতিপক্ষের সুশীলদের ঘায়েল করতে সরকারি ব্যবস্থার দ্বারস্থ হন৷
বাংলাদেশে জঙ্গি হামলার শিকার যারা
চলতি বছর ইসলামপন্থিরা একের পর এক হামলা চালিয়ে বাংলাদেশকে কাঁপিয়ে দিয়েছে৷ এতে প্রাণ হারিয়েছেন বেশ কয়েকজন৷ চলুন জানা যাক ২০১৫ সালের কবে, কারা হামলার শিকার হয়েছেন...৷
ছবি: Getty Images/AFP/Uz Zaman
বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ব্লগার খুন
একুশে বইমেলা থেকে ফেরার পথে ২৭ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে খুন হন ব্লগার এবং লেখক অভিজিৎ রায়৷ কমপক্ষে দুই দুর্বৃত্ত তাঁকে কুপিয়ে হত্যা করে৷ এসময় তাঁর স্ত্রী বন্যা আহমেদও গুরুতর আহত হন৷ বাংলাদেশি মার্কিন এই দুই নাগরিককে হত্যার দায় স্বীকার করেছে নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি গোষ্ঠী ‘আনসারুল্লাহ বাংলা টিম’৷ পুলিশ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত সন্দেহে একাধিক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করেছে৷
ছবি: Getty Images/AFP/M. Uz Zaman
বাড়ির সামনে খুন
ব্লগার ওয়াশিকুর রহমান বাবুকে হত্যা করা হয় ঢাকায়, গত ৩০ মার্চ৷ তিন দুর্বৃত্ত মাংস কাটার চাপাতি দিতে তাঁকে কোপায়৷ সেসেময় কয়েকজন হিজরে সন্দেহভাজন দুই খুনিকে ধরে ফেলে, তৃতীয়জন পালিয়ে যায়৷ আটকরা জানায়, তারা মাদ্রাসার ছাত্র ছিল এবং বাবুকে হত্যার নির্দেশ পেয়েছিল৷ কে বা কারা এই হত্যার নির্দেশ দিয়েছে জানা যায়নি৷ বাবু ফেসবুকে ধর্মীয় উগ্রপন্থিদের বিরুদ্ধে লিখতেন৷
ছবি: Munir Uz Zaman/AFP/Getty Images
সিলেটে আক্রান্ত মুক্তমনা ব্লগার
শুধু ঢাকায় নয়, ঢাকার বাইরে ব্লগার হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে৷ গত ১২ মে সিলেটে নিজের বাসার কাছে খুন হন নাস্তিক অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট এবং ব্লগার অনন্ত বিজয় দাস৷ ভারত উপমহাদেশের আল-কায়েদা, যাদের সঙ্গে ‘আনসারুল্লাহ বাংলা টিম’-এর সম্পর্ক আছে ধারণা করা হয়, এই হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করেছে৷ দাস ডয়চে ভেলের দ্য বব্স জয়ী মুক্তমনা ব্লগের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন৷
ছবি: picture-alliance/EPA/Str
বাড়ির মধ্যে জবাই
ব্লগার নিলয় চট্টোপাধ্যায়কে, যিনি নিলয় নীল নামেই বেশি পরিচিত ছিলেন, হত্যা করা হয় ঢাকায় তাঁর বাড়ির মধ্যে৷ একদল যুবক বাড়ি ভাড়ার আগ্রহ প্রকাশ করে ৮ আগস্ট তাঁর বাড়িতে প্রবেশ করে এবং তাঁকে কুপিয়ে হত্যা করে৷ নিজের উপর হামলা হতে পারে, এমন আশঙ্কায় পুলিশের সহায়তা চেয়েছিলেন নিলয়৷ কিন্তু পুলিশ তাঁকে সহায়তা করেনি৷ ‘আনসারুল্লাহ বাংলা টিম’ এই হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করেছে, তবে তার সত্যতা যাচাই করা যায়নি৷
ছবি: Getty Images/AFP/Uz Zaman
জগিংয়ের সময় গুলিতে খুন বিদেশি
গত ২৮ সেপ্টেম্বর রাতে জগিং করার সময় ঢাকার কূটনৈতিক এলাকায় খুন হন ইটালীয় এনজিও কর্মী সিজার তাবেলা৷ তাঁকে পেছন থেকে পরপর তিনবার গুলি করে দুর্বৃত্তরা৷ জঙ্গি গোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট বা আইএস এই হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করেছে বলে দাবি করেছে জিহাদিদের অনলাইন কর্মকাণ্ডের দিকে নজর রাখা একটি সংস্থা৷ তবে বাংলাদেশে সরকার এই দাবি অস্বীকার করে বলেছে ‘এক বড় ভাইয়ের’ তাঁকে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/ A.M. Ahad)
রংপুরে নিহত এক জাপানি
গত ৩ অক্টোবর রংপুরে খুন হন জাপানি নাগরিক হোশি কুনিও৷ মুখোশধারী খুনিরা তাঁকে গুলি করার পর মোটরসাইকেলে করে পালিয়ে যায়৷ ইসলামিক স্টেট এই হত্যাকাণ্ডেরও দায় স্বীকার করেছে, তবে সরকার তা অস্বীকার করেছে৷ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্বাস করেন না যে তাঁর দেশে আন্তর্জাতিক জঙ্গি গোষ্ঠীটির উপস্থিতি রয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo
হোসনি দালানে বিস্ফোরণ, নিহত ১
গত ২৪ অক্টোবর ঢাকার ঐতিহ্যবাহী হোসনি দালানে শিয়া মুসলমানদের আশুরার প্রস্তুতির সময় বিস্ফোরণে এক কিশোর নিহত এবং শতাধিক ব্যক্তি আহত হন৷ বাংলাদেশে এর আগে কখনো শিয়াদের উপর এরকম হামলায় হয়নি৷ এই হামলারও দায় স্বীকার করেছে ইসলামিক স্টেট, তবে সরকার সে দাবি নাকোচ করে দিয়ে হামলাকারীরা সম্ভবত নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি গোষ্ঠী জেএমবি-র সদস্য৷ সন্দেহভাজনদের একজন ইতোমধ্যে ক্রসফায়ারে মারা গেছে৷
ছবি: Getty Images/AFP/M. Zaman
ঢাকায় প্রকাশক খুন
গত ৩১ অক্টোবর ঢাকায় দু’টি স্থানে কাছাকাছি সময়ে দুর্বৃত্তরা হামলা চালায়৷ এতে খুন হন এক ‘সেক্যুলার’ প্রকাশক এবং গুরুতর আহত হন আরেক প্রকাশক ও দুই ব্লগার৷ নিহত প্রকাশক ফয়সাল আরেফিন দীপনের সঙ্গে ঢাকায় খুন হওয়া ব্লগার অভিজিৎ রায়ের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল৷ জঙ্গি গোষ্ঠী ‘আনসার-আল-ইসলাম’ হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করেছে৷
ছবি: Getty Images/AFP/M. Uz Zaman
প্রার্থনারত শিয়াদের গুলি, নিহত ১
গত ২৭ নভেম্বর বাংলাদেশের বগুড়ায় অবস্থিত একটি শিয়া মসজিদের ভেতরে ঢুকে প্রার্থনারতদের উপর গুলি চালায় কমপক্ষে পাঁচ দুর্বৃত্ত৷ এতে মসজিদের মুয়াজ্জিন নিহত হন এবং অপর তিন ব্যক্তি আহত হন৷ তথকথিত ইসলামিক স্টেট-এর সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ততা দাবি করা স্থানীয় একটি গোষ্ঠী হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করেছে৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo
9 ছবি1 | 9
সুশীলদের এই দুই অংশের বাইরেও একটি অংশ আছে, যার সদস্য সংখ্যা খুবই নগণ্য৷ বর্তমান সরকার এই অংশকে বিভিন্ন উপায়ে চাপে রেখেছে৷ তাঁদের ভয়ভীতি দেখানো হচ্ছে৷ কেউ আবার দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে নিজে থেকেই স্বনিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়েছেন৷ তাঁরা ভাবছেন, মত প্রকাশ করতে গিয়ে যদি জীবনটাই চলে যায় তাহলে চুপ থাকাই ভালো৷
পরিণতি যা হতে পারে
বিরোধী রাজনৈতিক মতবাদকে সরকার আগেই দমন করেছে৷ এরপর সুশীলদেরও মুখ বন্ধ করে দিয়েছে৷ ফলে এখন আর সমালোচনা করার কেউ নেই৷ সব কিছু মিলিয়ে পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে, সরকার এখন কোনো সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে বেশি কিছু ভাবছে না৷ পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকদেরও এমন অবস্থা হয়েছিল৷ তাই তো পূর্ব পাকিস্তানের বিষয়ে তারা ছিল উদাসীন৷ সেসময়কার আওয়ামী লীগের প্রতি মানুষের সমর্থনকে পশ্চিম পাকিস্তানিরা গুরুত্ব দিতে চায়নি৷ বরং দমন-পীড়ন করে পূর্ব পাকিস্তানকে শাসন করতে চেয়েছিল৷ কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি৷ জন্ম হয়েছিল বাংলাদেশের৷ দুঃখের বিষয়, যে আওয়ামী লীগ সেসময় দমনের শিকার হয়েছিল সেই আওয়ামী লীগ এবার দমনকে হাতিয়ার হিসেবে বেছে নিয়েছে৷ বিরোধী কোনো রাজনৈতিক দলকে দাঁড়ানোর সুযোগ দিতে চাইছে না তারা৷ স্বাধীনতার কিছু দিন পর বঙ্গবন্ধুও একই কাজ করতে চেয়েছিলেন৷ কিন্তু স্বৈরাচারী সরকারের মতো দেশ পরিচালনার পরিণতি কখনও ভালো হতে পারে না৷ এরকম সরকার বেশিদিন ক্ষমতায় থাকতে পারে না৷ মানুষ একসময় প্রতিবাদী হয়ে উঠে৷ দমন-পীড়ন দিয়েও তখন কাজ হয় না৷ দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশের ইতিহাস তা-ই বলে৷
এছাড়া দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটতে পারে৷ ব্লগার হত্যা থেকে শুরু করে সংখ্যালঘুদের উপর হামলার ঘটনা তারই প্রমাণ৷ বিদেশিদের উপরও হামলা হচ্ছে৷ ঘটনাগুলোর তদন্ত ও বিচারে মনে রাখার মতো অগ্রগতি হচ্ছে না৷ ফলে অপরাধ করে পার পেয়ে যাওয়ার মতো একটি বিশ্বাস অপরাধীদের মনে গেঁড়ে বসছে৷ এই সুযোগে জঙ্গিবাদের বিস্তার ঘটতে পারে৷ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন জঙ্গি গোষ্ঠীগুলোও সুযোগ কাজে লাগাতে তৎপর হয়ে উঠতে পারে৷
নিজেদের আসন শক্ত করতে সরকার সামরিক বাহিনীকে নিয়ন্ত্রণে রাখার কৌশল নিয়েছে৷ ব্যবসায়িকভাবে তাদের লাভবান হওয়ার ব্যবস্থা করে দেয়া হচ্ছে৷ কিন্তু মানুষ প্রতিবাদী হয়ে উঠলে একসময় যে সামরিক বাহিনী সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নেবে না, তা নিশ্চিত করে বলা যায় না৷
লেখকের সঙ্গে কি আপনি একমত? জানান নীচে মন্তব্যের ঘরে...