বাংলাদেশে সুশীল সমাজের ধরণ নিয়ে বিতর্ক থাকলেও, এরা যে তেমন সক্রিয় নন, তা নিশ্চিত৷ বার বার সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছেন সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা৷ ইইউ ও ‘সিভিকাস’ মনে করে বাংলাদেশের সুশীল সমাজ আজ চাপের মুখে৷
বিজ্ঞাপন
গত বছরের জুন মাসে সুশীল সমাজের আন্তর্জাতিক জোট বা গ্লোবাল সিভিল সোসাইটি অ্যালায়েন্স (সিভিকাস) এক বিবৃতিতে দাবি করে, ‘‘বাংলাদেশের সুশীল সমাজ, সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মীদের মধ্যে যাঁরা মানবাধিকারের কথা বলেন, তাঁরা হুমকি এবং চাপের মুখে আছেন৷''
বাংলাদেশের সুশীল সমাজ-এর চরিত্র নিয়ে সিভিকাস-এর পর্যবেক্ষণ বেশ স্পষ্ট৷ ২০১৫ সালে তাদের বাৎসরিক প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘‘বাংলাদেশের রাজনীতি যেভাবে বিভক্ত, সুশীল সামাজও সেইভাবেই বিভক্ত৷ যদিও তারা রাজনীতি নিরপেক্ষ চরিত্রের জন্য চেষ্টা করছে৷''
‘‘আল্লাহ’র নামে আর কোনো হত্যাকাণ্ড নয়’’
বাংলাদেশে মুক্তমনাদের উপর হামলা নিয়ে বার্লিনে মানববন্ধনে প্রদর্শন করা প্ল্যাকার্ডের ছিল বিশেষ কিছু বার্তা৷ চলুন সেগুলো দেখে নেয়া যাক৷
ছবি: DW/A. Islam
‘‘জাতিগত ও ধর্মীয় সহিংসতাকে ‘না’ বলুন’’
বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে জাতিগত ও ধর্মীয় সহিংসতার কারণে প্রাণ হারাচ্ছে অসংখ্য মানুষ৷ তাই এই বার্তা বেশ তাৎপর্যপূর্ণ৷ আরেকটি প্ল্যাকার্ডে লেখা ছিল, ‘‘ধর্মীয় সন্ত্রাসকে আপনার মুখ বন্ধ করতে দেবেন না৷’’
ছবি: DW/A. Islam
‘‘আল্লাহ’র নামে কোনো হত্যাকাণ্ড নয়’’
এই বার্তাটাও পরিষ্কার৷ ডয়চে ভেলেকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে ধর্মীয় মৌলবাদীদের হামলার শিকার আহমেদুর রশীদ চৌধুরী (টুটুল) বলেছিলেন, ‘‘আল্লাহু আকবর’’ বলে তাঁকে কোপানো হয়েছিল৷ বার্লিনে মানববন্ধনে আরেকটি প্ল্যাকার্ডে আল্লাহ’র জায়গায় সৃষ্টিকর্তার কথা উল্লেখ করা হয়৷
ছবি: DW/A. Islam
‘‘ধর্মভিত্তিক সহিংসতা বন্ধ কর’’
ধর্মভিত্তিক সহিংসতা বন্ধের দাবি জানান মানববন্ধনে অংশ নেয়া এক প্রবাসী বাঙালি৷ ধর্মভিত্তিক রাজনীতিরও বিপক্ষে অবস্থান তাঁর৷
ছবি: DW/A. Islam
‘‘ধর্মীয় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সরব হোন’’
ধর্মের নামে যারা সন্ত্রাসী কার্যকলাপ চালাচ্ছেন তাদের বিরুদ্দে সরব হওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে এই প্ল্যাকার্ডের মাধ্যমে৷ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ইসলামি জঙ্গি গোষ্ঠীগুলো সন্ত্রাসী কার্যকলাপ চালাচ্ছে৷
ছবি: DW/A. Islam
বাংলা প্ল্যাকার্ড
বাংলা ভাষায় লেখা প্ল্যাকার্ডও প্রদর্শন করা হয়েছে মানববন্ধনে৷
ছবি: DW/A. Islam
‘‘নাস্তিকতার জন্য মৃত্যু নয়’’
নাস্তিকতা কারো মৃত্যু বা কারাভোগের কারণ হতে পারে না, এমন প্ল্যাকার্ড নিয়ে দাঁড়িয়েছেন একাধিক ব্যক্তি৷ মানবন্ধনে অংশ নেয়াদের সবাই নাস্তিক নন, তবে তাঁরা বাকস্বাধীনতায় বিশ্বাসী৷
ছবি: DW/A. Islam
‘‘শব্দ হত্যা করে না, মানুষ করে’’
গত ফেব্রুয়ারিতে ঢাকায় খুন হওয়া ব্লগার, লেখক অভিজিৎ রায়ের ছবির সঙ্গে এই বাক্যটি লেখা প্ল্যাকার্ডও ছিল বার্লিনের ব্রান্ডেনবুর্গ গেটের সামনে আয়োজিত মানববন্ধনে৷ চলতি বছর বাংলাদেশে খুন হয়েছেন চারজন ব্লগার এবং একজন প্রকাশক৷
ছবি: DW/A. Islam
7 ছবি1 | 7
চলতি বছরের নভেম্বর মাসে ঢাকায় জার্মান রাষ্ট্রদূত টোমাস প্রিনৎস সুশীল সমাজের ওপর চাপ এবং তাদের কথা বলার এলাকা সংকুচিত হয়ে যাওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেন৷ তিনি সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘‘সুশীল সমাজ এবং সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা সুশাসন ও গণতন্ত্রের জন্য অপরিহার্য৷ একই অভিমত জানিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নও বাংলাদেশে সুশীল সমাজের ওপর চাপের সমালোচনা করে৷
বাংলাদেশ অধ্যয়ন কেন্দ্রের সম্পাদক এবং সিভিল সোসাইটির গবেষক অরূপ রাহী ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমরা সিভিল সোসাইটির বাংলা করেছি সুশীল সমাজ৷ সেই হিসেবে বাংলাদেশে সুশীল সমাজের কোনো অস্তিত্ব আছে কিনা – তা নিয়ে বিতর্ক আছে৷ যাঁরা সুশীল সমাজ বলে পরিচিত বা যাঁদের সুশীল সমাজের প্রতিনিধি হিসেবে ধরা হয়, তাঁরা মূলত বিভিন্ন ধরণের নাগরিক সংগঠনের সদস্য, অবসরপ্রাপ্ত আমলা, সামরিক কর্মকর্তা, অধ্যাপক বা এনজিও নেতা৷ এঁরাও রাজনৈতিকভাবে বিভক্ত৷ ফলে এ দেশে সুশীল সমাজের কোনো চরিত্র দাঁড়ায়নি এবং তাঁদের ভূমিকাও স্পষ্ট নয়৷''
বাংলাদেশে সুশীল সমাজের প্রতিনিধি হিসেবে যাঁরা পরিচিত, তাঁরা বিভিন্ন নাগরিক ইস্যুতে রাজপথে সক্রিয় হন৷ এর বাইরে সংবাদমাধ্যমে মতামতও প্রকাশ করেন তাঁরা৷ বিশেষ করে বেসরকারি টেলিভিশনগুলোর ‘টকশো'-তে তাঁদের সক্রিয় হতে দেখা যায়৷ কিন্তু পর্যবেক্ষণ বলছে, ২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনের পর সংবাদমাধ্যমে তাঁদের সক্রিয় উপস্থিতি কমে আসছে৷ এমনকি ‘ব্যক্তিগত' কারণে টকশো-র কয়েকজন জনপ্রিয় উপস্থাপককেও নিস্ক্রিয় হতে হয়েছে৷
সারা দেশে হত্যা ও হামলার প্রতিবাদ
জাগৃতি প্রকাশনীর প্রকাশককে হত্যা এবং শুদ্ধস্বরের কর্ণধারসহ তিন জনকে হত্যাচেষ্টার প্রতিবাদ চলছে সারা দেশে৷ ছবিঘরে প্রতিবাদ কর্মসূচির কিছু মুহূর্ত৷
ছবি: Getty Images/AFP/M. Uz Zaman
বর্বরোচিত হামলায় প্রকাশক হত্যা
শনিবার ঢাকার আজিজ সুপার মার্কেটে জাগৃতি প্রকাশনীর কার্যালয়ে প্রকাশনীর স্বত্তাধিকারী ফয়সাল আরেফিনকে কুপিয়ে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা৷ শনিবার তাঁর দাফন সম্পন্ন হয়৷ ছবিতে দীপনের মরদেহ দেখে তাঁর স্ত্রীর কান্নায় ভেঙে পড়ার মূহূর্ত৷
ছবি: Getty Images/AFP/M. Uz Zaman
আরেক প্রকাশকসহ তিনজন গুরুতর আহত
একই দিনে আরেক হামলায় শুদ্ধস্বর প্রকাশনের স্বত্তাধিকারী আহমেদুর রশীদ টুটুল, লেখক তারেক রহিমক এবং কবি ও ব্লগার রণদীপম বসুকে কুপিয়ে জখম করে দুর্বৃত্তরা৷ জাগৃতির লালমাটিয়ার কার্যালয়ে এ হামলার ঘটনা ঘটে৷ ছবিতে চিকিৎসাধীন আহমেদুর রশীদ টুটুল৷
ছবি: Getty Images/AFP/M. Uz Zaman
তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ
প্রকাশক ও লেখকদের ওপর হামলার প্রতিবাদে শনিবারই রাজপথে নামে মানুষ৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/ A.M. Ahad
দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি
প্রকাশক ও লেখকদের ওপর হামলার প্রতিবাদে ঢাকায় বিক্ষোভ মিছিল৷ প্রতিবাদমুখর জনতা হামলায় জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি করেন৷
ছবি: Getty Images/AFP/M. Uz Zaman
বই প্রকাশ অপরাধ?
এই প্রথম বাংলাদেশে বই প্রকাশের জন্য প্রকাশককে প্রাণ দিতে হলো৷
ছবি: Getty Images/AFP/M. Uz Zaman
‘আসুন লেখালেখি বন্ধ রাখি’
প্রতিবাদ সমাবেশের একটি ব্যানারে লেখা, ‘আসুন লেখালেখি বন্ধ রাখি’৷ হত্যাকারীদের আইনের আওতায় নিয়ে এসে এমন তৎপরতা রোধে প্রশাসন ব্যর্থ – এমন ক্ষোভই প্রকাশ পেয়েছে লেখালেখি বন্ধ রাখার কথায়৷ তবে বাংলাদেশের একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের টক শো-তে গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ইমরান এইচ সরকার জানান, হাসপাতালে চিকিৎসাধীন প্রকাশক টুটুল জানিয়েছেন যে, তাঁর ওপর যত হামলাই হোক, ভবিষ্যতেও তিনি বই প্রকাশ করবেন৷
ছবি: Getty Images/AFP/M. Uz Zaman
হরতালে পিছালো জেএসসি
জাগৃতি প্রকাশনীর প্রকাশককে হত্যা এবং শুদ্ধস্বরের কর্ণধারসহ তিন জনকে হত্যার চেষ্টার সঙ্গে জড়িতদের গ্রেপ্তারের দাবিতে মঙ্গলবার সারাদেশে আধাবেলা হরতাল ডেকেছে গণজাগরণ মঞ্চ৷ এই কর্মসূচির কারণে মঙ্গলবারের জেএসসির পরীক্ষা সকাল ১০টার পরিবর্তে দুপুর ২টা থেকে শুরু করা হবে৷ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে পরীক্ষাসূচির এই পরিবর্তনের কথা জানানো হয়৷ (ফাইল ফটো)
ছবি: picture-alliance/landov
মামলা
ফয়সল আরেফিন দীপন হত্যার ঘটনায় তাঁর স্ত্রী ডা. রাজিয়া রহমান শাহবাগ থানায় মামলা করেছেন৷ শুদ্ধস্বরের কর্ণধারসহ তিনজনের ওপর হামলার ঘটনায় মোহাম্মদপুর থানায় একটি হত্যা চেষ্টা মামলা হয়েছে৷ ওপরের ছবিতে কবি, ব্লগার রণদীপম বসু৷
ছবি: Getty Images/AFP/M. Uz Zaman
8 ছবি1 | 8
বেসরকারি টেলিভিশন একুশে টিভির টকশো ‘একুশের রাত'-এর উপস্থাপক মনজুরুল আলম পান্না ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমরা এক ধরণের অদৃশ্য চাপ অনুভব করি৷ এখন যাঁরা টকশো-তে আসেন, তাঁরা নিজেরাই ‘সেন্সর' করে কথা বলেন৷ তাঁদের দেখে আমি পরিস্থিতি বুঝতে পারি৷ তাই প্রশ্ন করার ক্ষেত্রেও আমি সাবধান থাকি৷''
তিনি আরো বলেন, ‘‘সুশীল সমাজের একটি অংশ এখন আর টকশো-তে আসতে চান না৷ তাঁদের কথা, যদি প্রাণ খুলে কথা বলা না যায় তাহলে টকশো-তে গিয়ে কী লাভ?''
চাপটি ঠিক কোন দিক থেকে জানতে চাইলে পান্না বলেন, ‘‘মালিক পক্ষের চাপটি সরাসরি বোঝা যায়৷ তবে সরকারের দিক থেকে কোনো চাপ আমি এখনো অনুভব করি না৷ সবাই যেন ‘সেলফ সেন্সরশিপ' করছে৷ কেমন যেন একটা ভয় কাজ করছে তাঁদের৷''
চাপের বিষয়টি স্পষ্ট হয় সিভিকাস-এর সর্বশেষ প্রতিবেদনে৷ তাদের প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘‘সরকারি পর্যায় থেকে সুশীল সমাজকে যখন ক্যানসার ও দেশদ্রোহী বলা হয়, তখন তাদের সক্রিয় থাকা কষ্টকর৷'' প্রতিবেদনে আরো বলা হয় যে, ‘‘সুশীল সমাজ ও মানবাধিকার নিয়ে যাঁরা কাজ করেন, তাঁদের অর্থায়ন বাধাগ্রস্ত করা বাংলাদেশে এখন সাধারণ নীতিতে পরিণত হয়েছে৷''
বাংলাদেশে সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা নানা নামে বিভিন্ন সময় সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করেছেন৷ ২০১১ সালে ব্যারিস্টার রফিকুল হক ও সাবেক আওয়ামী লীগ নেতা মাহমুদুর রহমান মান্নার নেতৃত্বে গঠন করা হয় ‘নাগরিক সমাজ'৷ তবে মান্না এরপর ‘নাগরিক ঐক্য' গঠন করে একে রাজনৈতিক সংগঠনে পরিণত করেন৷
মাহমুদুর রহমান মান্না সরকারবিরোধী ষড়যন্ত্রের অভিযোগে গ্রেপ্তার হন গত ২৫শে ফেব্রুয়ারি৷ তিনি এখনো কারাগারে আছেন৷ তবে তিনি গ্রেপ্তার হওয়ার বেশ কয়েক মাস আগে থেকেই সুশীল সমাজের আরেকটি প্লাটফর্ম গড়ার চেষ্টা করেন নেপথ্যে থেকে৷ এর সঙ্গে এনজিও নেতা, সম্পাদক, সাবেক আমলাসহ সুশীল সমাজের বেশ কিছু প্রতিনিধি যুক্ত ছিলেন৷ কিন্তু মান্না গ্রেপ্তার হওয়ার পর তাঁরা আর সক্রিয় হননি৷
প্রতিহিংসা আর ধ্বংসের নির্মম রাজনীতি আর কতকাল
বাংলাদেশে হরতাল, অবরোধ নতুন কিছু নয়৷ বড় দুটো দলতো বটেই, অনেক ছোট দলও অতীতে এমন কর্মসূচি দিয়েছে৷ জনদুর্ভোগ বেড়েছে, সম্পদ বিনষ্ট এবং প্রাণহানিও হয়েছে৷ তবে সাম্প্রতিক হরতাল, অবরোধগুলো দুঃস্বপ্নকেও হার মানিয়েছে৷
ছবি: JEWEL SAMAD/AFP/Getty Images
হামলার শিকার সাংবাদিক
বাংলাদেশে সাংবাদিক নির্যাতন এবং হত্যার ঘটনা আগেও ঘটেছে৷ এখনো সাগর-রুনি হত্যার বিচার হয়নি৷ তবে বিরোধী দলের কর্মসূচিতে সাংবাদিকের আহত হওয়ার ঘটনা চলমান আন্দোলনেই প্রথম ঘটছে৷ এ বছর হেফাজত-এ-ইসলামের সমাবেশে প্রহৃত হন সাংবাদিক নাদিয়া শারমিন৷ গত দুই সপ্তাহে হরতাল এবং অবরোধের সময় ককটেল হামলায় আহত হয়েছেন বেশ কয়েকজন সাংবাদিক৷ ছবিতে নাদিয়া শারমিনের ওপর হামলার প্রতিবাদ জানাতেচ্ছেন নারী সংগঠন কর্মীরা৷
ছবি: picture-alliance/dpa
যানবাহনে আগুন, রেললাইন উপড়ানো
হরতাল-অবরোধ মানেই রাস্তায় যানচলাচল বন্ধ৷ কর্মসূচির এ লক্ষ্য পূরণের পথে বাধা হলে গাড়ি ভাঙচুর এবং আগুন লাগানো বাংলাদেশে অনেক দিন ধরেই স্বাভাবিক ঘটনা৷ তবে গত এক বছরে জ্বালাও-পোড়াওয়ের এই ধ্বংসলীলা অন্য মাত্রা পেয়েছে৷ হরতালের আগের রাতেই শুরু হয়ে যায় ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ৷ তাই বিরোধী দল ঘোষণা অনুযায়ী কর্মসূচি পালন শুরুর আগেই জনমনে ছড়িয়ে পড়ে আতঙ্ক৷ ছবিতে মোটর সাইকেলে পেট্রোল ঢালছেন জামায়াত কর্মীরা৷
ছবি: Reuters/Andrew Biraj
শিশুরাও অসহায়, নিরাপত্তাহীন
যানবাহনে ঘুমন্ত চালক, হেল্পার বা চালকের সন্তানের আগুনে ঝলসে মৃত্যুর ঘটনাও ঘটছে৷ ঢাকা শহর দেখতে এসে লাশ হয়ে বাড়ি ফিরেছে কাভার্ডভ্যান চালকের সন্তান মুনির৷ এমন হতভাগ্যদের তালিকায় আরো নাম যোগ হয়েছে৷ স্কুলে, রাস্তায়, এমনকি বাড়িতেও শিশুদের জীবন সংকটাপন্ন দেখে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ইউনিসেফ৷ছবিতে সর্বশেষ অবরোধ কর্মসূচির প্রথম দিনে রাস্তায় আগুন জ্বালিয়ে স্লোগানরত জামায়াত কর্মীরা৷
ছবি: Reuters/Andrew Biraj
নিরাপত্তা কর্মীদেরও নিরাপত্তার অভাব
একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের কারণে রায় ঘোষণার পর নেতাদের শাস্তির আদেশ প্রত্যাহার এবং মুক্তির দাবিতে জামায়াত-ই-ইসলামী ও ইসলামী ছাত্র শিবির পুলিশের ওপর ব্যাপক হামলা চালিয়েছে৷ হামলায় নিহত হয়েছেন বেশ কয়েকজন পুলিশ কর্মী৷ রাজশাহীতে দায়িত্ব পালনের সময় পুলিশ সদস্যের মাথা ইটের আঘাতে থেতলে দেয়া হয়৷ বিরোধী দলের সর্বশেষ অবরোধ কর্মসূচিতেও কর্মরত পুলিশ ও বিজিবি সদস্য প্রাণ হারিয়েছেন দায়িত্বরত অবস্থায়৷
ছবি: Getty Images/Afp/Munir uz ZAMAN
সংখ্যালঘুদের বাড়ি-মন্দিরে আগুন
সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার ঘটনায় স্থানীয়ভাবে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদেরও জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে অনেক সময়৷ তবে শীর্ষ নেতাদের শাস্তি ঘোষণার পর জামায়াত ও শিবিরের কর্মীরা সংখ্যালঘুদের বাড়ি-ঘর-মন্দির-ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ব্যাপক হামলা চালায়৷ ছবিতে নিজের শিশুসন্তান কোলে সাতক্ষিরার অমিয় দাশ৷ ঘরবাড়িতে লুটপাট, অগ্নিসংযোগের সময় শিশুটিকে আগুনে ছুড়ে মারতে চেয়েছিল শিবির কর্মীরা৷
ছবি: Shayantani Twisha
কবে হবে অবসান!
প্রধান বিরোধীদল বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৮ দলের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবিকে অগ্রাহ্য করে আওয়ামী লীগ জাতীয় পার্টি ও মহাজোটের শরিক কয়েকটি দল নিয়ে নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করেছে৷ ফলে রাজনীতির মাঠে উত্তেজনা বেড়েছে৷ ৫ জানুয়ারি সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা নিয়ে তফশিল ঘোষণা করেছে নির্বাচন কমিশন৷ তারপর থেকে বিরোধী দলের হরতাল, অবরোধ চলছে প্রায় বিরামহীনভাবে৷
ছবি: JEWEL SAMAD/AFP/Getty Images
6 ছবি1 | 6
বাংলাদেশ অধ্যয়ন কেন্দ্রের সম্পাদক অরূপ রাহী ‘সিভিল সোসাইটি পর্যালোচনা' নামে একটি গ্রন্থ সম্পাদনাও করেছেন৷ তার আলোকে তিনি বলেন, ‘‘এখানে কথিত সুশীল সমাজ এক ধরণের ‘পাওয়ার এলিট'৷ তাঁরা তাঁদের স্বার্থে কখনো এক হন৷ আবার কখনো নানা শিবিরে ভিভক্ত হন৷ ফলে সত্যিকারের সিভিল সোসাইটি এখানে গড়ে ওঠেনি৷''
জার্মান রাষ্ট্রদূত টোমাস প্রিনৎস-এর সংবাদমাধ্যমে যে বক্তব্য প্রকাশিত হয়েছে তা হল, ‘বাস্তবে এখানো কোনো বিরোধী দল নেই৷ তাই সংবাদমাধ্যম এবং সুশীল সমাজকে সক্রিয় ও স্বাধীন হতে দিতে হবে উন্নয়ন ও সুশাসনের জন্য'৷
এছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক এবং সিভিল সোসাইটি গবেষক ড. শান্তনু মজুমদার ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘যে নামেই ডাকি না কেন, সুশীল সমাজের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা আছে৷ তারা বেঙ্গল রেনেসাঁর উত্তরাধিকার৷ বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনে তাঁদের ভূমিকা অনন্য৷''
তিনি বলেন, ‘‘সুশীল সমাজের কাজ হলো জনগণ এবং গণতন্ত্রের পক্ষে শাসকদের সঙ্গে আলোচনা, দর কষাকষি এবং প্রয়োজন হলে চাপ সৃষ্টি করা৷ কিন্তু এ সময়ে এসে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, সিভিল সোসাইটি, এনজিও ও ডোনার কেন্দ্রিক হয়ে গেছে৷ তাঁরা জোর করে হলেও একটি দ্বিদলীয় ব্যবস্থার কথা বলে৷ ফলে অনেক সময় তাঁরা মূল জায়গায় থাকেন না৷ তাই তাঁরা জনগণের জন্য কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছেন না৷ আমাদের প্রয়োজন স্বাধীন বুদ্ধিজীবী ভিত্তিক সুশীল সমাজ, যা অতীতে ছিল৷''
"সুশীল সমাজ, সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মীদের মধ্যে যাঁরা মানবাধিকারের কথা বলেন, তাঁরা হুমকি এবং চাপের মুখে আছেন'' – কথাটি কি সত্য? মন্তব্য জানান নীচের ঘরে৷