নির্বাচনকালীন সর্বদলীয় মন্ত্রিসভার সদস্য হিসেবে সোমবার ৮ জন শপথ নিয়েছেন৷ তাঁরা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও ওয়ার্কার্স পার্টির সদস্য৷ মন্ত্রিসভায় পুরনো মন্ত্রিসভার সদস্যরাও আছেন৷ তাঁদের নাম এখনও প্রকাশ করা হয়নি৷
বিজ্ঞাপন
বিকেলে বঙ্গভবনে মন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়েছেন আওয়ামী লীগ নেতা আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, ওয়ার্কার্স পার্টির রাশেদ খান মেনন, জাতীয় পার্টির রওশন এরশাদ, রহুল আমিন হাওলাদার ও আনিসুল ইসলাম মাহমুদ৷ প্রতিমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়েছেন জাতীয় পার্টির সালমা ইসলাম ও মুজিবুল হক চুন্নু৷ এছাড়া জাতীয় পার্টির জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলুকে মন্ত্রীর পদ মর্যাদায় উপদেষ্টা নিয়োগ করা হয়েছে৷
শপথ নেয়ার পর বঙ্গভবনে মন্ত্রীরা বর্তমান রাজনৈতিক সংকট উত্তরণে তাঁদের ভূমিকা রাখার কথা বলেছেন৷ তোফায়েল আহমেদ বলেছেন, নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি করতেই মন্ত্রীত্ব নিয়েছেন তিনি৷ তাঁর কথায়, বিএনপি চাইলে এখনও সর্বদলীয় সরকারে যোগ দিতে পারে৷ এখনও প্রধানমন্ত্রীর আমন্ত্রণ বহাল আছে৷
রাশেদ খান মেনন বলেন, এবার তাঁদের মন্ত্রীত্ব মন্ত্রণালয় চালানোর জন্য নয়৷ এবার তাঁরা একটি সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনে সহায়তা করার দায়িত্ব পেয়েছেন৷ তিনি বলেন, এই সর্বদলীয় মন্ত্রিসভা সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনে সফল হবে৷
আনিসুল ইসলাম মাহমুদ বলেছেন, এখন দেশ একটি কঠিন সময় পার করছে৷ এই সংকটকে মোকাবেলা করাই তাঁদের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করেন তিনি৷ তিনি জানান, জানুয়ারির প্রথম দিকেই নির্বাচন হবে৷ আর তাঁদের কাজ হবে নির্বাচন অনুষ্ঠানে নির্বাচন কমিশনকে সহায়তা করা৷ আনিসুল ইসলাম মাহমুদ বলেন, সর্বদলীয় সরকারে বিএনপিকে যোগ দিতে নতুন করে আমন্ত্রণ জানানোর দরকার নেই৷ তাদের আগেই আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে৷
নতুন মন্ত্রীদের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং সাবেক রাষ্ট্রপতি এইচ এম এরশাদ ছাড়াও মন্ত্রিসভার সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন৷ শপথ পড়ান রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ৷
সর্বদলীয় মন্ত্রিসভায় পুরনো মন্ত্রিসভা থেকে আরো অন্তত ১২ থেকে ১৪ জন মন্ত্রী অন্তর্ভুক্ত হবেন৷ তবে তাঁদের নতুন করে শপথ নিতে হবে না৷
এদিকে বিএনপি সর্বদলীয় মন্ত্রিসভায় অংশ নেয়ায় বিরত থেকে, মন্ত্রিসভাকে তামাশা হিসেবে অভিহিত করে একে মহাজোট সরকারের বর্ধিত মন্ত্রিসভা বলেছে৷ শুধু তাই নয়, এর প্রতিবাদে সারা দেশে কালো পতাকা নিয়ে মিছিলও করেছে তারা৷ বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য হান্নান শাহ ডয়চে ভেলেকে বলেছেন, বিএনপিকো সর্বদলীয় মন্ত্রিসভায় যোগ দিতে আনুষ্ঠানিকভাবে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি৷ সরকার চায় একটি একদলীয় নির্বাচন৷ আর তারা সে দিকেই যাচ্ছে৷ কিন্তু এই নির্বাচন প্রতিহত করা হবে৷
তবে যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের দাবি করেছেন, বিরোধী দল বিএনপির সঙ্গে নেপথ্যে এখনও যোগাযোগ করা হচ্ছে৷ তারা চাইলে সর্বদলীয় সরকারে যোগ দিতে পারে৷
অন্যদিকে মন্ত্রীরা শপথ নেয়ার পর বিরোধী দলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদের সাক্ষাত্ চেয়েছেন৷ একথা সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন বিএনপির চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা শমসের মবিন চৌধুরী৷ জানা গেছে, চলমান রাজনৈতিক সংকট নিয়ে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে কথা বলতে চান খালেদা জিয়া৷ বিএনপির নির্দলীয় সরকারের দাবি উপেক্ষা করে সর্বদলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করার উদ্দেশ্য নিয়ে সরকার এগিয়ে যাওয়ায়, সর্বশেষ পদক্ষেপ হিসেবে রাষ্ট্রপতির হস্তক্ষেপ চাইতে পারেন বিএনপি চেয়ারপার্সন৷ শেষ পাওয়া খবর অনুযায়ী, মঙ্গলবার সন্ধ্যায় খালেদা জিয়াকে বঙ্গভবনে সাক্ষাতের সময় দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি৷
বাংলাদেশে রাজনৈতিক সংকট থামছে না
আগামী বছরের সূচনায় জাতীয় নির্বাচন, কিন্তু দুই মুখ্য রাজনৈতিক জোটের টানাপোড়েন অব্যাহত৷ অথচ দেশে-বিদেশে অনেকেই চান সংকট নিরসনে দুই বৈরী জোটের মধ্যে আলোচনা৷ কিন্তু সেটা কি আদৌ সম্ভব হবে?
ছবি: AP
দু’দলের দ্বন্দ্ব
বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন নির্দিষ্ট হয়েছে ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে৷ তবে মুখ্য বিরোধী দল বিএনপি এখনো নির্বাচনে অংশ নিতে রাজি নয়৷ তারা চায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন, শাসক আওয়ামী লীগের কাছে যা সংবিধান লঙ্ঘনের সমান৷
ছবি: Getty Images/AFP/FARJANA K. GODHULY
জাতিসংঘ চায় সংলাপ
জাতিসংঘ ইতিমধ্যেই দুই বিবাদী জোটের মধ্যে সংলাপের উদ্যোগ নিয়েছে৷ মহাসচিব বান কি-মুন গত ২৩ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধী নেত্রী খালেদা জিয়ার সঙ্গে টেলিফোনে কথাবার্তা বলেছেন৷ জাতিসংঘের মহাসচিব উভয় নেতার প্রতি চলতি রাজনৈতিক সংকটের শান্তিপূর্ণ অবসানের জন্য আলাপ-আলোচনায় বসার আহ্বান জানিয়েছেন৷
ছবি: Reuters
হাসিনা চান সংসদে আলোচনা
জাতিসংঘ বাংলাদেশি রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে মহাসচিবের ফোনালাপের কোনো খুঁটিনাটি প্রকাশ করেনি৷ তবে বাংলাদেশের একাধিক দৈনিকে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী হাসিনা ‘‘জাতিসংঘের প্রধানকে জানিয়েছেন যে, তিনি সংবিধান অনুযায়ী সরকারের তত্ত্বাবধানে নির্বাচন অনুষ্ঠান করার পরিকল্পনা করছেন৷’’ বিরোধীপক্ষ যদি গোটা প্রসঙ্গটি সংসদে আলোচনা করার কোনো প্রস্তাব দেয়, তবে তিনি তাকে স্বাগত জানাবেন, এমন আভাসও দিয়েছেন হাসিনা৷
ছবি: dapd
সরকারের তত্ত্বাবধানে নির্বাচনে বিএনপির ‘না’
বান কি-মুনের সঙ্গে ফোনালাপে বিএনপি প্রধান খালেদা জিয়াও সংকট সমাধানে সংলাপের সপক্ষে মতপ্রকাশ করেছেন, কিন্তু এ-ও স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে, ‘‘বিরোধীপক্ষ আওয়ামী লীগ সরকারের তত্ত্বাবধানে আয়োজিত সাধারণ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে না৷’’
ছবি: Reuters
তত্ত্বাবধায়ক সরকার কি ও কেন?
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মূল কাজ হলো মুক্ত ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টি করা৷ ১৯৯১ সালে এই পদ্ধতি চালু করা হয় কিন্তু আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকার ২০০৯ সালে সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে সেই পদ্ধতি বাতিল করে৷ বিএনপির নেতৃত্বাধীন বিরোধী পক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার দাবি তুলেছে৷
ছবি: AP
জার্মানি সংলাপ সমর্থন করে
সংলাপকে বাংলাদেশের দুই প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক জোটের মধ্যে অচলাবস্থা নিরসনের একমাত্র পন্থা বলে মনে করে জার্মানি৷ ‘ঢাকা কুরিয়ার’ নামক সাপ্তাহিক ম্যাগাজিনের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে ঢাকায় জার্মান রাষ্ট্রদূত ড. আলব্রেশট কনৎসে বলেছেন, ‘‘দু’টি মুখ্য রাজনৈতিক দলের মধ্যে সংলাপ হলো বর্তমান রাজনৈতিক অচলাবস্থা সমাধানের একমাত্র পথ৷’’
ছবি: DW/R. Manzoor
ইউনূস তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ডাক দিলেন
বাংলাদেশের একমাত্র নোবেল পুরস্কার বিজয়ী মুহাম্মদ ইউনূস একটি ‘‘নির্দলীয় নিরপেক্ষ (নির্বাচনকালীন) সরকার’’ বা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রতি তাঁর প্রকাশ্য সমর্থন ব্যক্ত করেছেন৷ গত ২২ আগস্ট ইউনূস একটি সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘‘নির্বাচন অতি অবশ্য হওয়া উচিত এবং তা একটি নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে হওয়া উচিত৷’’
ছবি: Getty Images
আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল (আইসিটি)
হাসিনা সরকারের সৃষ্ট আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল বা আইসিটি-র উদ্দেশ্য মুক্তিযুদ্ধের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার৷ কিন্তু তা শাসকদল এবং বিরোধীপক্ষের মধ্যে একটি বিতর্কিত বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ আইসিটি এখন পর্যন্ত ছ’জন অভিযুক্তকে শাস্তি দিয়েছে৷ বিরোধীপক্ষ এই বিচার প্রক্রিয়াকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত আখ্যা দিয়েছে৷ তাদের মতে এই প্রক্রিয়ার বাস্তবিক উদ্দেশ্য ন্যায়বিচার নয়, পুরাতন শত্রুতার প্রতিশোধ৷
ছবি: AP
আন্তর্জাতিক সমালোচনা
হিউম্যান রাইটস ওয়াচও আইসিটি-র সমালোচনা করেছে৷ এইচআরডাব্লিউ বিবৃতিতে বলেছে, জামায়াতে ইসলামীর সাবেক প্রধান গোলাম আযমের বিচার প্রক্রিয়া ‘‘গভীরভাবে ত্রুটিপূর্ণ’’ ছিল৷ প্রতিক্রিয়া হিসেব সরকারি কৌঁসুলির তরফ থেকে এইচআরডাব্লিউ-এর বিরুদ্ধে আদালতের অবমাননার অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে৷ ইতিমধ্যে মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মোজেনা বলেছেন, দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে এইচআরডাব্লিউ-এর ‘‘একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা’’ রয়েছে৷
ছবি: Munir Uz Zaman/AFP/Getty Images
ট্র্যাক রেকর্ড
আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোট ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে ক্ষমতায় আসে৷ বিদ্যুৎ উৎপাদন কিংবা কৃষি খাতে সরকারের সাফল্যের খতিয়ান যাই হোক না কেন, বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু প্রকল্পের অর্থায়ন থেকে সরে দাঁড়ানোর পর হাসিনা সরকারের অন্য সব সাফল্য ঐ একটি কেলেঙ্কারির আড়ালে ধামাচাপা পড়ে গেছে৷ আগামী নির্বাচনেও পদ্মা সেতু প্রকল্প প্রসঙ্গটি প্রভাব ফেলতে পারে বলে পর্যবেক্ষকদের ধারণা৷