অস্ট্রেলিয়ার চার আইনজীবী মেলবোর্নের একটি আদালতে এ সংক্রান্ত আবেদন দাখিল করেছেন৷ এ ব্যাপারে চলতি সপ্তাহে সিদ্ধান্ত জানা যেতে পারে৷ রোহিঙ্গা নির্যাতনের ঘটনায় সু চির বিরুদ্ধে তাঁরা মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আনতে চান৷
বিজ্ঞাপন
‘ইউনিভার্সাল জুরিসডিকশন'-এর আওতায় সু চি'র বিরুদ্ধে এই অভিযোগ আনতে আগ্রহী ঐ আইনজীবীরা৷ অস্ট্রেলিয়া ইউনিভার্সাল জুরিসডিকশন নীতির অনুমোদন দিয়েছে৷ এই নীতি বলছে, দেশের ভেতর অপরাধের ঘটনা না ঘটলেও সেই অপরাধের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে মামলা করা যেতে পারে৷ যেমন গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ ইত্যাদি ক্ষেত্রে যে কোনো দেশের নাগরিকের বিরুদ্ধে মামলা করা সম্ভব৷ অস্ট্রেলিয়া যেহেতু ইউনিভার্সাল জুরিসডিকশনের অনুমোদন দিয়েছে, তাই রোহিঙ্গা নির্যাতনের ঘটনা সে দেশে না ঘটলেও সু চি'র বিরুদ্ধে মামলা করার সুযোগ রয়েছে৷ তবে বিচারকাজ শুরুর জন্য দেশটির অ্যাটর্নি জেনারেলের অনুমতি পেতে হবে৷ সেই অনুমতি পাওয়া যাবে কিনা তা এই সপ্তাহে জানা যেতে পারে৷
মামলার আবেদনে ঐ চার আইনজীবী বলেছেন, ‘‘অভিযোগ আছে, সু চি তাঁর ক্ষমতা প্রয়োগ করতে ব্যর্থ হয়েছেন৷ এভাবে সু চি রোহিঙ্গাদের ঘর-বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য করাতে মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীকে অনুমতি দিয়েছেন৷''
রোহিঙ্গা সংকট: কার কী অবস্থান?
হিংসালীলা ও বৈরি মনোভাবের মুখে মিয়ানমার থেকে দলে দলে পালাতে হচ্ছে রোহিঙ্গাদের৷ তাদের পরিস্থিতি সম্পর্কে আন্তর্জাতিক সমাজে সহানুভূতি সত্ত্বেও মূলত কৌশলগত কারণে বিভিন্ন দেশ ভিন্ন ভিন্ন অবস্থান নিচ্ছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/B. Armangue/AP
বাংলাদেশ
মিয়ানমারের রাখাইন থেকে বাংলাদেশেই আশ্রয় নিচ্ছে বেশিরভাগ রোহিঙ্গা শরণার্থী৷ এত সংখ্যক মানুষকে আশ্রয় দেওয়া অবশ্যই বিশাল চ্যালেঞ্জ৷ আন্তর্জাতিক ত্রাণ সংগঠনের সঙ্গে সমন্বয়ের উদ্যোগ চলছে৷ শরণার্থীদের পরিচয় নিশ্চিত করতে তাদের আঙুলের ছাপ সংগ্রহ নিয়ে তথ্যভাণ্ডার গড়ার কথা চলছে৷
ছবি: picture-alliance/AA/Z. H. Chowdhury
ভারত
দেশের উত্তর পূর্বে বিদ্রোহীদের মোকাবিলা করতে এবং চীনের প্রভাব সীমিত রাখতে ভারতের একের পর এক সরকার মিয়ানমারের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখার চেষ্টা করে চলেছে৷ বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীও প্রথম মিয়ানমার সফরে গিয়ে সে দেশের সরকারের প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন৷ রাখাইনের অর্থনৈতিক উন্নতির লক্ষ্যেও প্রকল্পে অংশ নিচ্ছে ভারত৷
ছবি: Getty Images/AFP/M. Sharma
তুরস্ক
রোহিঙ্গাদের পরিস্থিতি নিয়ে সোচ্চার হয়ে উঠেছে তুরস্ক৷ শুধু কথায় নয়, বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য সাহায্য দিতেও তৎপর সে দেশ৷ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও ফার্স্ট লেডি শরণার্থী শিবির পরিদর্শন করে যাবতীয় সাহায্যের আশ্বাস দিয়েছেন৷ জাতিসংঘে রোহিঙ্গা ইস্যু তুলে ধরতেও তৎপর হতে চায় তুরস্ক৷
ছবি: picture-alliance/abaca/K. Ozer
মালয়েশিয়া
মালয়েশিয়া মানবিক কারণে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সাময়িক আশ্রয়ের আশ্বাস দিয়েছে৷ তবে অন্যান্য নথিপত্রহীন বহিরাগতদের মতো তাদেরও নির্দিষ্ট কেন্দ্রে আটক রাখা হবে বলে ধরে নেওয়া হচ্ছে৷ উল্লেখ্য, মালয়েশিয়া জাতিসংঘের শরণার্থী কনভেশনে স্বাক্ষর করেনি৷ তাই সেখানে শরণার্থীরা অবৈধ অনুপ্রবেশকারী হিসেবে বিবেচিত হয়৷
ছবি: Reuters/Stringer
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র
সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চি-র প্রতি অগাধ আস্থা দেখিয়েছিলেন৷ বর্তমান রোহিঙ্গা সংকটের বিষয়ে ট্রাম্প প্রশাসন এখনো উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নেয়নি৷ মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মিয়ানমারের পরিস্থিতি সম্পর্কে গভীর দুশ্চিন্তা প্রকাশ করলেও সরাসরি মিয়ানমারের বিরুদ্ধে কোনো কূটনৈতিক অবস্থান নেয় নি৷
ছবি: Getty Images/AFP/J. Watson
ইউরোপীয় ইউনিয়ন
ইউরোপীয় ইউনিয়ন রাখাইনে মানবিক সহায়তা পৌঁছানোর ক্ষেত্রে মিয়ানমারের সহযোগিতা দাবি করেছে৷ সেইসঙ্গে এই সংখ্যালঘু এই গোষ্ঠীর উপর নিপীড়ন বন্ধ করার ডাক দিয়েছে ইইউ৷ শরণার্থীদের সহায়তা করতে বাংলাদেশে ত্রাণ সাহায্য পাঠানোর অঙ্গীকার করেছে এই রাষ্ট্রজোট৷
ছবি: Reuters/M. P. Hossain
চীন
মিয়ানমারের সরকারের সঙ্গে চীনের দীর্ঘ ও গভীর সম্পর্ক রয়েছে৷ সে দেশে কৌশলগত স্বার্থের খাতিরেও রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারের সরকারের বিরোধিতা করছে না চীন৷ জাতিসংঘ সহ আন্তর্জাতিক মঞ্চে চীনের এই অবস্থান আন্তর্জাতিক চাপের মুখে মিয়ানমারের সরকারের জন্য জরুরি৷
ছবি: Reuters/R. Dela Pena
রাশিয়া
চীনের মতো রাশিয়াও মিয়ানমারের সরকারের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখার পক্ষে৷ জাতিসংঘে সে দেশের বিরুদ্ধে পদক্ষেপের বিরোধিতা করছে এই দুই ভেটো শক্তি৷ এদিকে রাশিয়ার মুসলিম-প্রধান চেচনিয়া অঞ্চলে রোহিঙ্গাদের প্রতি সমর্থন জানিয়ে প্রতিবাদ-বিক্ষোভে মস্কোর উপর চাপ সৃষ্টি করার চেষ্টা চলছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/Z.Bairakov
জাতিসংঘ
জাতিসংধের শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআর রোহিঙ্গা শরণার্থী পরিস্থিতির মোকাবিলার উদ্যোগ নিচ্ছে৷ জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস মিয়ানমারের উদ্দেশ্যে হিংসালীলা বন্ধ করার ডাক দিয়েছেন৷ প্রাক্তন মহাসচিব কোফি আন্নানের নেতৃত্বে এক কমিশন পরিস্থিতির উন্নতির লক্ষ্যে কিছু প্রস্তাব পেশ করেছে৷ তবে নিরাপত্তা পরিষদ এখনো প্রকাশ্যে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি৷
ছবি: Reuters
9 ছবি1 | 9
অস্ট্রেলিয়া-আসিয়ান শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিতে সু চি'র অস্ট্রেলিয়া সফরকে ঘিরে এই উদ্যোগ নিয়েছেন ঐ আইনজীবীরা৷ শনি ও রবিবার ঐ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে৷ সেই সময় সু চি রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে আসিয়ান ও অস্ট্রেলিয়ার নেতৃবৃন্দের সহায়তা চান বলে জানিয়েছেন অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী ম্যালকম টার্নবুল৷
‘মিয়ানমার সবচেয়ে খারাপ'
গত ছয় মাসে ত্রাণ বিতরণ পরিস্থিতি খারাপ হয়েছে এমন দেশের তালিকায় সবার উপরে আছে মিয়ানমার৷ জেনেভাভিত্তিক গবেষণা সংস্থা এসিএপিএস ৩৭টি দেশের উপর গবেষণা করে এই তথ্য জানিয়েছে৷ ত্রাণকর্মীদের উপর হামলা, ত্রাণ নিতে আসা মানুষকে বাধা দেয়াসহ নয়টি বিষয় বিবেচনায় নিয়ে এই তালিকা প্রকাশ করেছে এসিএপিএস৷ এক বিবৃতিতে সংস্থাটি জানায়, ‘‘মিয়ানমারে ত্রাণ প্রবেশের পরিস্থিতি সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় পৌঁছেছে৷ রোহিঙ্গাদের কাছে ত্রাণ পৌঁছানোর বিষয়টি খুবই কঠিন হয়ে পড়েছে৷''
অং সান সু চির কিছু তথ্য
ছবিঘরে তাই তাঁর ঘটনাবহুল জীবনের গুরুত্বপূর্ণ কিছু মুহূর্ত৷
ছবি: picture-alliance/dpa
শৈশবেই বাবার মৃত্যু
১৯৪৫ সালের ১৯ জুন তখনকার ব্রিটিশ উপনিবেশের অংশ বার্মার রেঙ্গুনে জন্ম অং সান সু চি-র৷ বাবা জেনারেল অং সান-কে যখন হত্যা করা হয় সু চি-র বয়স তখন মাত্র ৩ বছর৷ ওপরের ছবিটি তোলা হয়েছিল জেনারেল অং সান-এর মৃত্যুর অল্প কিছুদিন আগে৷
ছবি: gemeinfrei
রাজনীতিতে পদার্পণ
সু চি-র শৈশব কেটেছে ভারতে৷ উচ্চ শিক্ষার্থে ইংল্যান্ডে যাওয়ার পর সেখানে মাইকেল অ্যারিসের সঙ্গে পরিচয় হয়৷ পরবর্তীতে অ্যারিসকেই বিয়ে করেছিলেন সু চি৷ দুটি ছেলে আছে এই দম্পতির৷ ১৯৮৮ সালে নিজের দেশ মিয়ানমারে ফেরেন সু চি৷ দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ঘোষণাও দেন প্রথম জনসভাতেই৷
ছবি: AFP/Getty Images
নির্বাচিত হয়েও বঞ্চিত
১৯৯০ সালে নির্বাচন হয়৷ নির্বাচনে শতকরা ৮০ ভাগ ভোট পায় সু চি-র দল এনএলডি৷ কিন্তু তখনকার সামরিক শাসক নির্বাচনের ফলাফলের ভিত্তিতে ক্ষমতায় পরিবর্তনের গণতান্ত্রিক দাবিকে পাত্তাই দেয়নি৷
ছবি: picture alliance/AP Images/M. Sato
গৃহবন্দি
নির্বাচনের কিছুদিন আগেই সু চি-কে গৃহবন্দি করা হয়৷ ২০১০ সালে পুরোপুরি মুক্তি প্রাপ্তির আগে বার কয়েক বাইরে আসার সুযোপ পেয়েছিলেন ‘মিয়ানমারের গণতন্ত্রের মানসকন্যা’ হিসেবে পরিচিত এই রাজনীতিবিদ৷
ছবি: picture-alliance/epa/N. Chan Naing
নোবেল পেলেন সু চি
গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য অহিংস আন্দোলন করায় ১৯৯১ সালে সু চি-কে শান্তি পুরস্কার বিজয়ীর স্বীকৃতি দেয় নোবেল কমিটি৷ গৃহবন্দি ছিলেন বলে সু চি নিজে যেতে পারেননি৷ তাঁর পক্ষ থেকে পুরস্কার গ্রহণ করেছিলেন তাঁর ব্রিটেনে নির্বাসিত পুত্র কিম৷
ছবি: AP
মুক্তির দাবি
সু চি-কে মুক্তি দেয়ার দাবি উঠছিল বিশ্বের প্রায় সব প্রান্ত থেকে৷ কিন্তু তখনকার সামরিক বাহিনী তাতে কর্ণপাত করেনি৷
ছবি: picture-alliance/ dpa
অবশেষে মুক্তি
অবশেষে ২০১০ সালের ১৩ নভেম্বর মুক্তি পান অং সান সু চি৷
ছবি: picture alliance/epa/N. C. Naing
সংসদ সদস্য সু চি
২০১২ সালে আবার নির্বাচন হয় মিয়ানমারে৷ ১৯৯০ সালে সু চি-কে গৃহবন্দি করার পর থেকে কোনো নির্বাচনে অংশ নেয়নি সু চি-র দল এনএলডি৷ ২২ বছর পর আবার নির্বাচনে অংশ নিয়ে ঠিকই নির্বাচিত হন সু চি৷ সেই সুবাদে এখন তিনি বিরোধী দলের নেত্রী৷
ছবি: AP
২০ বছর পর
২০১২ সালে মুক্ত সু চি-র হাতেই তাঁর পুরস্কারটা তুলে দেয় নোবেল কমিটি৷ সু চি জানান, এই পুরস্কার তাঁকে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে অনেক প্রেরণা জুগিয়েছে৷
ছবি: Reuters
জার্মানিতে সু চি
২০১৪ সালে সু চি জার্মানির রাজধানী বার্লিনেও এসেছিলেন৷ তখন মানবাধিকার রক্ষা এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দাবিতে দীর্ঘদিন লড়াই করার স্বীকৃতি হিসেবে তাঁর হাতে ভিলি ব্রান্ড পুরস্কার তুলে দেন জার্মান প্রেসিডেন্ট গাউক৷
ছবি: picture-alliance/dpa
রোহিঙ্গা প্রসঙ্গে সমালোচিত
মিয়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর ব্যাপক নির্যাতন সত্ত্বেও এর প্রতিবাদ করেননি অং সান সু চি৷ অনেক রোহিঙ্গা দেশছাড়া হয়ে সাগরে ডুবে মরলেও সু চি নীরব ভূমিকাই পালন করছেন৷ শান্তিতে নোবেল জয়ী হয়েও একটি সম্প্রদায়ের ওপর অত্যাচার নির্যাতনের বিষয়ে তাঁর নিষ্ক্রিয়তার সমালোচনা করেছেন অনেকেই৷