মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চি'র ভাষণ হতাশাজনক বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশের বিশ্লেষকরা৷ আইন বিশ্লেষকরা বলছেন, বিভিন্ন দেশকে সঙ্গে নিয়ে আমাদের আন্তর্জাতিক আদালতে যাওয়ার সুযোগ আছে৷ তবে অবশ্যই কাজটা সহজ নয়৷
বিজ্ঞাপন
মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, মিয়ানমারের সরকারী বাহিনী যে গণহত্যা করেছে তার জন্য তাদের অবশ্যই বিচারের মুখোমুখি করতে হবে৷ রোহিঙ্গাদের মানবাধিকার এখন ভুলুণ্ঠিত৷
এদিকে রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চি'র ভাষণ প্রত্যাখ্যান করেছে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোট৷ জোটের মুখপাত্র ও আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মোহাম্মদ নাসিম বলেন, ‘‘রোহিঙ্গাদের নিয়ে সু চি'র কোনো বক্তব্য গ্রহণযোগ্য নয়৷ তাঁর বক্তব্য আমরা জোটের পক্ষ থকে প্রত্যাখ্যান করছি৷'' বুধবার দুপুরে ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগ সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়ে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিদের সঙ্গে ১৪ দলীয় জোটের নেতাদের মতবিনিময়কালে তিনি এ কথা বলেন৷
মানবাধিকার কর্মী নূর খান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘সু চি নানাবিধ আন্তর্জাতিক চাপের কারণে তাঁর কৌশল পরিবর্তন করেছেন৷ তারপরও বলব, তারা যে স্পেস আমাদের দিয়েছে সেটা কাজে লাগানো দরকার৷ তারা যে এখনই রোহিঙ্গাদের ফেরত নেবে সেই ধরনের কিছু তিনি বলেননি৷ তবে এই গণহত্যার সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে বিচারের ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার৷ তারা মানবাধিকার লংঘন করেছে, মৌলিক অধিকার হরণ করেছে৷ ফলে আন্তর্জাতিক মহলের দায়িত্ব তাদের বিচারের মুখোমুখি করা৷’’
সূ চি নানাবিধ আন্তর্জাতিক চাপের কারণে কৌশল পরিবর্তন করেছেন: নূর খান
নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) আব্দুর রশিদ বলেন, ‘‘সু চি বলেছেন, তিনি আন্তর্জাতিক চাপকে ভয় পান না৷’’ তিনি মনে করেন, সু চি একটি মিশ্র বক্তব্য দিয়েছেন৷ যার মাধ্যমে তিনি আন্তর্জাতিক অঙ্গন এবং সামরিক বাহিনীকে খুশি রাখার চেষ্টা করেছেন৷ মিয়ানমারের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ যা শুনতে পছন্দ করে সু চি তাই বলেছেন৷ সু চি তাঁর বক্তব্যে মানবাধিকার লঙ্ঘন, রোহিঙ্গাদের পালিয়ে যাওয়া ইত্যাদি বিষয়গুলো বলেছেন৷ যা দেখে মনে হয় তিনি কিছুটা সরে এসেছেন৷’’ তিনি বলেন, ‘‘আমি এটিকে সূচনা হিসেবে দেখছি, যার মাধ্যমে হয়তো কূটনৈতিক প্রয়াসের মাধ্যমে একটি জায়গায় উপনীত হওয়া যাবে৷’’
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘ওখানে যে গণহত্যা চলছে সেটার জন্য বার্মা সরকারের বিরুদ্ধে কিন্তু আন্তর্জাতিক আদালতে অভিযোগ উত্থাপন করা যায়৷ যদিও আমাদের দেশে এই হণহত্যা হয়নি, তবুও আমরা যেহেতু ক্ষতিগ্রস্থ, সে কারণে আমরা অভিযোগ উত্থাপন করতে পারি৷ এই রাস্তাটাই একমাত্র রাস্তা৷ অন্য যে পথগুলো আছে, সেখানে অনেকগুলো আন্তর্জাতিক সংস্থাকে একত্রিত হয়ে অভিযোগ উত্থাপন করতে হয়৷ সেখানে বাংলাদেশের এককভাবে কিছু করার সুযোগ নেই৷ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে তাদের চাপ অব্যহত রাখতে হবে৷ আমাদের জাতীয় আইনে এমন কিছু নেই যাতে তাদের বিরুদ্ধে আমরা কোনো অ্যাকশনে যেতে পারি৷ আমাদের আইন অনুযায়ী, মানবতাবিরোধী অপরাধ হলে সেটা দেশের নাগরিকদের বিরুদ্ধে হতে হবে৷ তাহলে ৭৩-এর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে যাওয়া যায়৷ এখানে আক্রান্তরা যেহেতু আমাদের দেশের নাগরিক না, সে কারণে এটা করা সম্ভব নয়৷’’
বার্মা সরকারের বিরুদ্ধে কিন্তু আন্তর্জাতিক আদালতে অভিযোগ উত্থাপন করা যায়: জ্যোতির্ময় বড়ুয়া
১৪ দলীয় জোটের মুখপাত্র মোহাম্মদ নাসিম বলেন, ‘‘মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী নিজ দেশের নিরীহ মানুষকে হত্যা করছে৷ আমরা ১৪ দলের পক্ষ থেকে এর তীব্র নিন্দা করছি৷ আমরা নিন্দা জানাই সু চি'র আজকের এই ভূমিকাকেও৷ তিনি শান্তিতে নোবেল পেয়ে কিভাবে এই নির্যাতনকে প্রশ্রয় দিচ্ছেন?’’
রোহিঙ্গা ইস্যুতে বিশ্বনেতাদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়ে মোহাম্মদ নাসিম বলেন, ‘‘আজকে আমরা আশা করবো বিশ্ববাসী জেগে উঠবে, চাপ সৃষ্টি করবে মিয়ানমারের ওপর৷ তারা যেন এই নিরীহ মানুষদের ফিরিয়ে নেয়, তাদের যেন নিজের দেশের আশ্রয় পাওয়ার ব্যবস্থা করে৷ যুক্তরাষ্ট্র, চীন, জাপান, ভারতসহ বিশ্বের শক্তিধর দেশগুলোকে অনুরোধ করব এই নিরীহ মানুষের দিকে তাকিয়ে মিয়ানমারকে চাপ সৃষ্টি করার জন্য তারা যেন এগিয়ে আসে৷’’
প্রিয় পাঠক, আপনি কিছু বলতে চাইলে লিখুন নীচে মন্তব্যের ঘরে...
রোহিঙ্গা সংকট: কার কী অবস্থান?
হিংসালীলা ও বৈরি মনোভাবের মুখে মিয়ানমার থেকে দলে দলে পালাতে হচ্ছে রোহিঙ্গাদের৷ তাদের পরিস্থিতি সম্পর্কে আন্তর্জাতিক সমাজে সহানুভূতি সত্ত্বেও মূলত কৌশলগত কারণে বিভিন্ন দেশ ভিন্ন ভিন্ন অবস্থান নিচ্ছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/B. Armangue/AP
বাংলাদেশ
মিয়ানমারের রাখাইন থেকে বাংলাদেশেই আশ্রয় নিচ্ছে বেশিরভাগ রোহিঙ্গা শরণার্থী৷ এত সংখ্যক মানুষকে আশ্রয় দেওয়া অবশ্যই বিশাল চ্যালেঞ্জ৷ আন্তর্জাতিক ত্রাণ সংগঠনের সঙ্গে সমন্বয়ের উদ্যোগ চলছে৷ শরণার্থীদের পরিচয় নিশ্চিত করতে তাদের আঙুলের ছাপ সংগ্রহ নিয়ে তথ্যভাণ্ডার গড়ার কথা চলছে৷
ছবি: picture-alliance/AA/Z. H. Chowdhury
ভারত
দেশের উত্তর পূর্বে বিদ্রোহীদের মোকাবিলা করতে এবং চীনের প্রভাব সীমিত রাখতে ভারতের একের পর এক সরকার মিয়ানমারের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখার চেষ্টা করে চলেছে৷ বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীও প্রথম মিয়ানমার সফরে গিয়ে সে দেশের সরকারের প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন৷ রাখাইনের অর্থনৈতিক উন্নতির লক্ষ্যেও প্রকল্পে অংশ নিচ্ছে ভারত৷
ছবি: Getty Images/AFP/M. Sharma
তুরস্ক
রোহিঙ্গাদের পরিস্থিতি নিয়ে সোচ্চার হয়ে উঠেছে তুরস্ক৷ শুধু কথায় নয়, বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য সাহায্য দিতেও তৎপর সে দেশ৷ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও ফার্স্ট লেডি শরণার্থী শিবির পরিদর্শন করে যাবতীয় সাহায্যের আশ্বাস দিয়েছেন৷ জাতিসংঘে রোহিঙ্গা ইস্যু তুলে ধরতেও তৎপর হতে চায় তুরস্ক৷
ছবি: picture-alliance/abaca/K. Ozer
মালয়েশিয়া
মালয়েশিয়া মানবিক কারণে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সাময়িক আশ্রয়ের আশ্বাস দিয়েছে৷ তবে অন্যান্য নথিপত্রহীন বহিরাগতদের মতো তাদেরও নির্দিষ্ট কেন্দ্রে আটক রাখা হবে বলে ধরে নেওয়া হচ্ছে৷ উল্লেখ্য, মালয়েশিয়া জাতিসংঘের শরণার্থী কনভেশনে স্বাক্ষর করেনি৷ তাই সেখানে শরণার্থীরা অবৈধ অনুপ্রবেশকারী হিসেবে বিবেচিত হয়৷
ছবি: Reuters/Stringer
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র
সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চি-র প্রতি অগাধ আস্থা দেখিয়েছিলেন৷ বর্তমান রোহিঙ্গা সংকটের বিষয়ে ট্রাম্প প্রশাসন এখনো উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নেয়নি৷ মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মিয়ানমারের পরিস্থিতি সম্পর্কে গভীর দুশ্চিন্তা প্রকাশ করলেও সরাসরি মিয়ানমারের বিরুদ্ধে কোনো কূটনৈতিক অবস্থান নেয় নি৷
ছবি: Getty Images/AFP/J. Watson
ইউরোপীয় ইউনিয়ন
ইউরোপীয় ইউনিয়ন রাখাইনে মানবিক সহায়তা পৌঁছানোর ক্ষেত্রে মিয়ানমারের সহযোগিতা দাবি করেছে৷ সেইসঙ্গে এই সংখ্যালঘু এই গোষ্ঠীর উপর নিপীড়ন বন্ধ করার ডাক দিয়েছে ইইউ৷ শরণার্থীদের সহায়তা করতে বাংলাদেশে ত্রাণ সাহায্য পাঠানোর অঙ্গীকার করেছে এই রাষ্ট্রজোট৷
ছবি: Reuters/M. P. Hossain
চীন
মিয়ানমারের সরকারের সঙ্গে চীনের দীর্ঘ ও গভীর সম্পর্ক রয়েছে৷ সে দেশে কৌশলগত স্বার্থের খাতিরেও রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারের সরকারের বিরোধিতা করছে না চীন৷ জাতিসংঘ সহ আন্তর্জাতিক মঞ্চে চীনের এই অবস্থান আন্তর্জাতিক চাপের মুখে মিয়ানমারের সরকারের জন্য জরুরি৷
ছবি: Reuters/R. Dela Pena
রাশিয়া
চীনের মতো রাশিয়াও মিয়ানমারের সরকারের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখার পক্ষে৷ জাতিসংঘে সে দেশের বিরুদ্ধে পদক্ষেপের বিরোধিতা করছে এই দুই ভেটো শক্তি৷ এদিকে রাশিয়ার মুসলিম-প্রধান চেচনিয়া অঞ্চলে রোহিঙ্গাদের প্রতি সমর্থন জানিয়ে প্রতিবাদ-বিক্ষোভে মস্কোর উপর চাপ সৃষ্টি করার চেষ্টা চলছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/Z.Bairakov
জাতিসংঘ
জাতিসংধের শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআর রোহিঙ্গা শরণার্থী পরিস্থিতির মোকাবিলার উদ্যোগ নিচ্ছে৷ জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস মিয়ানমারের উদ্দেশ্যে হিংসালীলা বন্ধ করার ডাক দিয়েছেন৷ প্রাক্তন মহাসচিব কোফি আন্নানের নেতৃত্বে এক কমিশন পরিস্থিতির উন্নতির লক্ষ্যে কিছু প্রস্তাব পেশ করেছে৷ তবে নিরাপত্তা পরিষদ এখনো প্রকাশ্যে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি৷