1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

সূর্য উৎসবের ২৫

১২ জানুয়ারি ২০২৫

কখনো ব্রক্ষ্মপুত্র নদীবেষ্টিত চিলমারীর শাখা হাতির দ্বীপ চর, কখনোবা রেমাক্রির মারমা পাড়া কিংবা চর কুকড়িমুকড়ি। এবার যেমন গাজীপুরের কালীগঞ্জ।

গাজীপুরে সূর্য উৎসব
মাথায় সূর্য মুকুট আর পরনে উৎসব টি-শার্টে যাত্রীদল। গাজীপুরের নাগরীর খোলা বিস্তীর্ণ প্রান্তরে কুয়াশার দাপট। দেখা নেই সূর্যের। না দেখা সূর্যকেই অভিযাত্রী দল বরণ করলো উল্লাসে৷ ছবি: Partho Sanjay

গেল পঁচিশ বছর ধরে পুরোনো বছরকে বিদায় আর নতুন বছরকে স্বাগত জানাতে ছোট্ট ব-দ্বীপের নানা প্রান্তে ছুটে গেছে । আয়োজনটির নাম দিয়েছে তারা ‘সূর্য উৎসব’৷

শুধু কি নতুন বছরকে বরণ, সাথে রয়েছে নতুন জায়গা দেখার আনন্দও। অনেকটা অ্যাডভেঞ্চারও বলা যায়। তবে এই উৎসবের যাত্রীদল পাঁচিশ বছর ধরে দেশের নানা প্রান্তে বিজ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দেবার কাজও করছে।

সাড়ে চার ইঞ্চি ডায়ামিটারের নিউটোনিয়ান টেলিস্কোপ থেকে শুরু করে আট ইঞ্চি ডায়ামিটারের ক্যাসিগ্রিন টেলিস্কোপ নিয়েও তারা ছুটে গেছেন পঞ্চগড়ের চা বাগান শ্রমিক সন্তানদের কাছে কিংবা নাইক্ষ্যংছড়ির দুর্গম পাহাড়ি জনপদে। টেলিস্কোপে চোখ রেখে সেখানকার স্কুল পড়ুয়া শিশুরা রাতের আকাশে অনন্ত নক্ষত্রবীথির মাঝে খুঁজেছে খোলা চোখে দেখা শুক্র, বৃহস্পতি কিংবা শনি গ্রহ। অবাকমানা চোখে আবিস্কার করেছে বইয়ের পাতা থেকে মুখস্ত করা সেইসব গ্রহ। কত বড় আর কত স্পষ্ট! অথচ ওই জনপদগুলোতে হয়তো কেউ এর আগে টেলিস্কোপই দেখেনি।

ক্লাস রুম প্ল্যানেটোরিয়ামও তাদের যাত্রার সঙ্গী হয়েছে। কাগজ কেটে রকেটের মডেল তৈরির শিক্ষাও হাতে কলমে পেয়েছে স্থানীয় শিক্ষার্থীরা সূর্য উৎসবের এমন আয়োজনে। উৎসবের আরেক অনুষঙ্গ বিজ্ঞান  কুইজ আর বিজ্ঞান বক্তৃতা।

যে জনপদেই সূর্য উৎসবের যাত্রীদল গেছে, সেখানেই নিশ্চিত করেছে স্থানীয় বিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ। বিজ্ঞানের আনন্দকে উৎসব সহচর করেছে আয়োজকরা।

পঁচিশের সূর্য উৎসব

২০২৪ সালের শেষ দিনে শুরু হয়েছিল পঁচিশের সূর্য উৎসবের যাত্রা। কুয়াশায় মোড়ানো সকালে প্রায় পঞ্চাশজনের যাত্রীদল ঢাকা ছাড়িয়ে পৌঁছে যায় গাজীপুরের কালীগঞ্জে পানজোড়া উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ে। সেখানেই ক্যাম্প করে থাকার ব্যবস্থা।

বলে রাখা ভালো, অঞ্চলটি খ্রিস্টান অধ্যুষিত। নাগরীর বিখ্যাত সাধু নিকোলাসের গির্জা ঘিরে এই জনপদ। গীর্জাটির প্রতিষ্ঠাকাল ১৬৬৩ সাল। পর্তুগিজ স্থাপত্যের অনন্য নিদর্শন হয়ে আছে পুরোনো গির্জা। এছাড়াও রয়েছে সাধু জোহানের গির্জা। এটিরও বয়স ১৮০ বছর।

২০০১ সালের প্রথম সূর্য উৎসব অনুষ্ঠিত হয় দেশের সর্ব দক্ষিণ পূর্ব প্রান্ত সেন্ট মার্টিনে। বাংলাদেশের ভূখন্ডে প্রথম সূর্যের আলো স্পর্শ করে যে ছেঁড়া দ্বীপে, সেখানে সূর্যোদয় লগ্নে ব্যানার হাতে আয়োজকদের কয়েকজনছবি: Alfred Khokon

বড়দিনের আনন্দ তখনও অটুট এই জনপদে। উৎসবের যাত্রীদল সঙ্গী হলো সে আনন্দের। ঘুরে বেড়িয়ে দেখলো গীর্জার স্থাপত্য শৈলী আর পাঠ নিলো ইতিহাসের।

মিশনারিজ বিদ্যালয় পানজোড়ায় দুপুরে ফিরে যাত্রীদল আহার সেরে লেগে গেল আয়োজনে। কিশোর যাত্রীদল ব্যস্ত হলো রকেটের মডেল তৈরিতে। আর বড়দের দল মঞ্চ তৈরি থেকে শুরু করে পুরো ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে।

বিকেল থেকেই স্কুলে আসতে শুরু করল স্থানীয় শিক্ষার্থীরা। জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জাদুঘরের টেলিস্কোপটি তৈরি হয়ে রইলো। সন্ধ্যা নামার আগেই শিক্ষার্থীদের সারিটা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়ে গেল। বিস্ময় চোখে তারা দেখলো সন্ধ্যার আকাশে ওঠা সন্ধ্যা তারা, কেউ দেখলো বৃহস্পতি।

সন্ধ্যা পেরিয়ে নাগরী ধর্মপল্লির কয়েকটি স্কুলের শিক্ষার্থীদের উপস্থিতিতে শুরু হলো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। তাদের নাচে, গানে মুখরিত আয়োজনে সঙ্গী হলো উৎসবের কিশোর যাত্রীদলও। আইনস্টাইন থেকে সত্যেন্দ্রনাথ বসু। ঈশ্বর কণা থেকে মহাকাশ। গল্পের ছলে জানলো উপস্থিত কয়েকশ' শিক্ষার্থী। উপস্থিত থাকলেন স্কুলের শিক্ষকরাও।

এর মাঝেই যাত্রীদলের বড়রা, যাদের কেউ চারুশিল্পী কিংবা নয়, সবাই মিলে লাল হলুদ কাগজ কেটে তৈরি করেছে সূর্য মুকুট। এই মুকুট পরেই যে নতুন বছরের প্রথম সূর্যকে স্বাগত জানানো হবে!

দেখতে দেখতে রাত বারোটা। স্কুল প্রাঙ্গণে জ্বলে উঠল মোমবাতির আলো। তাতে ‘সূর্য উৎসব ২০২৫’ লেখা। আলোকজ্জ্বল মাঠে নতুন বছরকে বরণের হর্ষধ্বনি!

নাগরীতে সূর্যবরণ

ভোরের আলো ফুটতেই অভিযাত্রীরা সবাই প্রস্তুত বছরের নতুন সূর্যকে বরণ করে নিতে। মাথায় সূর্য মুকুট আর পরনে উৎসব টি শার্ট। নাগরীর খোলা বিস্তীর্ণ প্রান্তরে কুয়াশার দাপট। দেখা নেই সূর্যের। না দেখা সূর্যকেই অভিযাত্রী দল বরণ করলো উল্লাসে।

এরপরই স্কুল প্রাঙ্গণে দিনের বাকি পর্ব গুলো চলতে থাকলো। অন্য বছরগুলোতে বছরের প্রথম দিনে স্কুল মুখর থাকতো বই উৎসবে। এবার হয়নি। তাতে কী! জাদু প্রদর্শনী, পাপেট শো, প্ল্যানটোরিয়ামে মহাকাশকে জানা, ভ্রাম্যমান বিজ্ঞান জাদুঘর দেখা-সব মিলিয়ে অন্যরকম আনন্দে ভাসলো শিক্ষার্থীরা।

দেয়া হলো সম্মাননাও। এবছর থেকেই প্রবত্রিত অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন পদক তুলে দেয়া হয় অর্থনীতিবিদ ও গবেষক ড. সাজেদা আমিনকে।

‘আশার চেয়ে বেশি প্রাপ্তি’

পানজোড়া উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সিস্টার মেরী দেবাশীষ এসএমআরএ'র কাছে এমন আয়োজন ‘আশার চেয়ে বেশি প্রাপ্তি'। তিনি বলছিলেন, ‘যখন আমাদের এ বিষয়ে বলা হয়েছে, তখনই আমি মেয়েদের আগ্রহ জাগাতে চেষ্টা করেছি। এই সময় আমাদের এলাকায় অনেক প্রোগ্রাম থাকে। আমি একটু চিন্তিত ছিলাম। আশাপ্রদ মেয়ে আসবে কি না। বা আমরা মেয়েদের মধ্যে এই বোধ জাগাতে পেরেছি কি না, যে একটা নতুন বিষয় শিখবে, জানবে। যখন বিকেল ৪.৩০, তখন আমার স্কুল মাঠ নীল হয়ে গেল আমাদের মেয়েদের দিয়ে। আর যখন রাতে তাদের মহাকাশের শুক্র গ্রহ, শনি গ্রহ দেখানো হচ্ছিল, ওরা এত মনোযোগী, এত সুন্দর করে দেখেছে, আমি তখন বুঝতে পেরেছি যে, ওদের জানার আগ্রহ আছে। এমনকি ছোট ভাই বোনদের সঙ্গে নিয়ে এসেছে। যেনো ওরাও আগ্রহ নিয়ে বিষয়টা জানতে পারে’।

এই প্রধান শিক্ষিকা তার শিক্ষকদের নিয়ে পুরো আয়োজনে শিক্ষার্থীদের সঙ্গী ছিলেন। প্ল্যানেটোরিয়ামে দল বেধে প্রথম বিশ জন শিক্ষার্থীর পর একুশতম হয়ে মহাকাশ দেখেছেন। আর বলেছেন, ‘আমাদের পানজোড়ার জন্য এটি সত্যিই সৌভাগ্যের যে, প্ল্যানেটোরিয়াম বিষয়টা আপনারা আমাদের স্কুলে নিয়ে এসেছেন। এটা আশার চেয়েও বেশি প্রাপ্তি’।

শুরুটা সেন্ট মার্টিনে

মিলেনিয়াম বা সহস্রাব্দ! বিশ্বজুড়ে কি উন্মাদনা। বাংলাদেশ অ্যাস্ট্রনমিক্যাল এসোসিয়েশন মনে করলো, গানিতিকভাবে সহস্রাব্দের শুরু ২০০১ সালের জানুয়ারির ১ তারিখ। এটি তারা উদযাপন করবে। সে ভাবনা থেকেই বছরের প্রথম সূর্যোদয়টা তারা দেখতে চায় দেশের সর্ব দক্ষিণ পূর্ব প্রান্ত সেন্ট মার্টিনের ছেঁড়া দ্বীপ থেকে। যেখানে বাংলাদেশের ভূখন্ডে প্রথম সূর্যের আলো স্পর্শ করে। আর এভাবেই শুরু হলো ‘সূর্য উৎসব' নামে একটি আয়োজন!

আশি জনের দল দুটো বাসে আঠারো ঘন্টার রোমাঞ্চকর যাত্রায় ঢাকার কলাবাগান থেকে টেকনাফ হয়ে পৌঁছায় সেন্ট মার্টিনে। সেখানেই সহস্রাব্দের শেষ সূর্যটাকে বালুকাবেলায় লাইন ধরে দাঁড়িয়ে বিদায় জানালো যাত্রীদল।

হৈ চৈ করে কাটানো সন্ধ্যায় তাদের সঙ্গী হলো বিজ্ঞান আলোচনা আর দলছুট ব্যান্ডের গায়ক প্রয়াত সঞ্জীব চৌধুরীর গান।

রাত বারোটায় করতালি আর উল্লাসের মাধ্যমে বরণ করা হলো নববর্ষকে। বৈচিত্রময় নববর্ষ উদযাপনের সাক্ষী হলো সেন্ট মার্টিন।

আর ভোরে ছোট ছোট ডিঙ্গি নৌকায় করে ছেঁড়া দ্বীপ। পূবের আকাশ একটু একটু করে লাল হয়ে উঠলো। অভিযাত্রীদের মধ্যে নতুন শতক ও প্রথম সূর্যোদয় দেখার উত্তেজনা। মুহূর্তটা অক্ষয় হয়ে থাকলো।

২০১৫ সালের সূর্য উৎসব অনুষ্ঠিতক হয় বান্দরবানের রেমাক্রির মারমা পাড়ায়। রাত বারোটায় নতুন বছরকে স্বাগত জানিয়ে প্রদীপের ২০১৫-কে ফুটিয়ে তোলে যাত্রীদলছবি: Bangladesh Astronomical Association (BAA)

সূর্য উৎসবের পরের তেইশ

সেন্ট মার্টিনের পর সুন্দরবন। ২০০২ সালের সূর্য উৎসব হয়েছেল ম্যানগ্রোভ ঘেরা অপরূপ সুন্দরবনে। তৃতীয় আসর কেওক্রাডং পাহাড় ছুঁড়ে। ২০০৪ সালে যাত্রী দল গেলো নিঝুম দ্বীপে। ২০০৫ এ পঞ্চগড়। ষষ্ঠ আসর বসলো নেত্রকোণার সুসঙ দুর্গাপুর। রাঙামাটির পাবলাখালিতে উৎসব হলো ২০০৭ এ। ২০০৮ এ টাঙ্গুয়ার হাওড়। ২০০৯ এ খাগড়া ছড়ি। সুন্দরবনে আবার গেলো যাত্রীদল ২০১০এ। ২০১১-তে জামালপুর। ২০১২ তে চর কুকড়ি মুকড়ি। ২০১৩ তে শ্রীমঙ্গল। ঢাকার রবীন্দ্র সরোবরে সূর্য উৎসব উদযাপিত হলো ২০১৪ তে। আর ২০১৫ তে হলো বান্দরবানের রেমাক্রিতে। ২০১৬ তে ভোলার চর ফ্যাশনে। ২০১৭ তে ময়মনসিংহের হালুয়াঘাটে। ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়াডাঙ্গিতে সূর্য উৎসব হলো ২০১৮ তে। ২০১৯ এ আবার ঢাকার হাতিরঝিলে। ২০২০ এ বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়িতে। ২০২১ এ গাজীপুরের কালিয়াকৈর। ২০২২ এ বিরিশিরিতে। কুড়িগ্রামে সূর্য উৎসব দল গেলো ২০২৩ এ। আর ২০২৪ এ উৎসব হলো মানিকগঞ্জের দৌলতপুরে।

‘আমরা করতে যাচ্ছি মহাকাশ জাদুঘর'

প্রতিষ্ঠার ৩৭ বছর পার করছে বাংলাদেশ অ্যাস্ট্রনমিক্যাল এসোসিয়েশন। সংগঠনের সভাপতি মশুহুরুল আমিন মিলন বলছিলেন, ‘‘আঠারো বা বিশ কোটি মানুষের দেশে একটা বিজ্ঞান ক্লাব দিয়ে সমস্ত মানুষের কাছে পৌঁছানো সম্ভব না। এর জন্য প্রয়োজন ব্যাপক আর্থিক সামর্থ্য ও জনবল। এই ৩৭ বছরের ভেতর দেখা যাবে যে, যারা ছাত্র ছিল, তারা এখন পরিণত বয়সে চলে এসেছে। তাদের সংসার, তাদের কাজ কর্ম। একটা বড় অংশ দেশের বাইরে। কেউ হয়তো বা এই পৃথিবীতেই নেই। এই কাজগুলো আমরা যারা করছি, তারা শৌখিন। ব্যক্তিগত আগ্রহ থেকেই করছি। এখানে অ্যাস্ট্রোনমির চর্চা করলে তার যে সামাজিক একটা পরিচিতি বাড়বে অথবা আর্থিক কিছু যোগ হবে, সে বিষয়গুলো নেই। তাই ব্যাপক মানুষকে আশা করাটাও ঠিক হবে না। কারণ একদম মৌলিক বিজ্ঞানের আগ্রহ থেকেই এই কাজগুলোতে আসা'।

আলাপেই মশহুরুল আমিন বলছিলেন, ‘‘আমরা করতে যাচ্ছি মহাকাশ জাদুঘর বা স্পেস সেন্টার। এ কাজটা যদি আমরা সফলভাবে করতে পারি, তাহলে হয়তো আগামী পঁচিশ বছর পরের সূর্য উৎসব একটা অন্য মাত্রায় উযাপিত হবে।’’

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য

আরো সংবাদ দেখান
স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ