কয়েকদিন আগেই আশঙ্কা করেছিলাম, খুনিরা সম্ভবত প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে৷ ব্লগারদের উপর আক্রমণ আসন্ন৷ সেই শঙ্কা সত্যি হলো, অথচ তাদের রক্ষায় কেউ এগিয়ে আসলো না৷
বিজ্ঞাপন
জাগৃতি প্রকাশনীর ফয়সাল আরেফিনকে শাহবাগে তাঁর কার্যালয়ে কুপিয়ে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা৷ ‘সেক্যুলার' প্রকাশক হিসেবে পরিচিত ছিলেন তিনি৷ ওদিকে পৃথক একটি হামলায় ব্লগার অভিজিৎ রায়ের বইয়ের প্রকাশক আহমেদুর রশীদ টুটুল গুরুতর আহত৷ আহত ব্লগার রণদীপম বসু এবং তারেক রহিম৷ শনিবার দুপুরে টুটুলের কার্যালয়ে তাঁদের কোপানো হয়েছে৷ সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে এই খবর ছড়িয়েছে দ্রুত৷ তবে এভাবে আর কতদিন চলবে?
ঢাকায় খুন হওয়া অভিজিতের বইয়ের প্রকাশক টুটুল৷ তাঁর উপর হামলা হতে পারে, এমন আশঙ্কা ব্লগাররা প্রকাশ করেছেন আগেই৷ খুনিদের তালিকায় তাঁর নাম ছিল, এই দাবি তাঁদের তাসত্ত্বেও নিরাপত্তা দেয়া হয়নি তাঁকে৷ কয়েকদিন আগে লিখেছিলাম ব্লগারদের উপর হামলার প্রস্তুতি বুঝি আবার শুরু হয়েছে৷ গণমাধ্যমে নিষিদ্ধ জঙ্গি গোষ্ঠী ‘আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের' ই-মেল দেখে সেই শঙ্কা জেগেছিল৷ গণমাধ্যমে সেই সংবাদ প্রকাশের পরও পুলিশ প্রশাসন যে সতর্ক হয়নি, সেটা বোঝা গেল আজকের ঘটনার পর৷
বাংলাদেশে জঙ্গি হামলার শিকার যারা
চলতি বছর ইসলামপন্থিরা একের পর এক হামলা চালিয়ে বাংলাদেশকে কাঁপিয়ে দিয়েছে৷ এতে প্রাণ হারিয়েছেন বেশ কয়েকজন৷ চলুন জানা যাক ২০১৫ সালের কবে, কারা হামলার শিকার হয়েছেন...৷
ছবি: Getty Images/AFP/Uz Zaman
বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ব্লগার খুন
একুশে বইমেলা থেকে ফেরার পথে ২৭ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে খুন হন ব্লগার এবং লেখক অভিজিৎ রায়৷ কমপক্ষে দুই দুর্বৃত্ত তাঁকে কুপিয়ে হত্যা করে৷ এসময় তাঁর স্ত্রী বন্যা আহমেদও গুরুতর আহত হন৷ বাংলাদেশি মার্কিন এই দুই নাগরিককে হত্যার দায় স্বীকার করেছে নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি গোষ্ঠী ‘আনসারুল্লাহ বাংলা টিম’৷ পুলিশ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত সন্দেহে একাধিক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করেছে৷
ছবি: Getty Images/AFP/M. Uz Zaman
বাড়ির সামনে খুন
ব্লগার ওয়াশিকুর রহমান বাবুকে হত্যা করা হয় ঢাকায়, গত ৩০ মার্চ৷ তিন দুর্বৃত্ত মাংস কাটার চাপাতি দিতে তাঁকে কোপায়৷ সেসেময় কয়েকজন হিজরে সন্দেহভাজন দুই খুনিকে ধরে ফেলে, তৃতীয়জন পালিয়ে যায়৷ আটকরা জানায়, তারা মাদ্রাসার ছাত্র ছিল এবং বাবুকে হত্যার নির্দেশ পেয়েছিল৷ কে বা কারা এই হত্যার নির্দেশ দিয়েছে জানা যায়নি৷ বাবু ফেসবুকে ধর্মীয় উগ্রপন্থিদের বিরুদ্ধে লিখতেন৷
ছবি: Munir Uz Zaman/AFP/Getty Images
সিলেটে আক্রান্ত মুক্তমনা ব্লগার
শুধু ঢাকায় নয়, ঢাকার বাইরে ব্লগার হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে৷ গত ১২ মে সিলেটে নিজের বাসার কাছে খুন হন নাস্তিক অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট এবং ব্লগার অনন্ত বিজয় দাস৷ ভারত উপমহাদেশের আল-কায়েদা, যাদের সঙ্গে ‘আনসারুল্লাহ বাংলা টিম’-এর সম্পর্ক আছে ধারণা করা হয়, এই হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করেছে৷ দাস ডয়চে ভেলের দ্য বব্স জয়ী মুক্তমনা ব্লগের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন৷
ছবি: picture-alliance/EPA/Str
বাড়ির মধ্যে জবাই
ব্লগার নিলয় চট্টোপাধ্যায়কে, যিনি নিলয় নীল নামেই বেশি পরিচিত ছিলেন, হত্যা করা হয় ঢাকায় তাঁর বাড়ির মধ্যে৷ একদল যুবক বাড়ি ভাড়ার আগ্রহ প্রকাশ করে ৮ আগস্ট তাঁর বাড়িতে প্রবেশ করে এবং তাঁকে কুপিয়ে হত্যা করে৷ নিজের উপর হামলা হতে পারে, এমন আশঙ্কায় পুলিশের সহায়তা চেয়েছিলেন নিলয়৷ কিন্তু পুলিশ তাঁকে সহায়তা করেনি৷ ‘আনসারুল্লাহ বাংলা টিম’ এই হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করেছে, তবে তার সত্যতা যাচাই করা যায়নি৷
ছবি: Getty Images/AFP/Uz Zaman
জগিংয়ের সময় গুলিতে খুন বিদেশি
গত ২৮ সেপ্টেম্বর রাতে জগিং করার সময় ঢাকার কূটনৈতিক এলাকায় খুন হন ইটালীয় এনজিও কর্মী সিজার তাবেলা৷ তাঁকে পেছন থেকে পরপর তিনবার গুলি করে দুর্বৃত্তরা৷ জঙ্গি গোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট বা আইএস এই হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করেছে বলে দাবি করেছে জিহাদিদের অনলাইন কর্মকাণ্ডের দিকে নজর রাখা একটি সংস্থা৷ তবে বাংলাদেশে সরকার এই দাবি অস্বীকার করে বলেছে ‘এক বড় ভাইয়ের’ তাঁকে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/ A.M. Ahad)
রংপুরে নিহত এক জাপানি
গত ৩ অক্টোবর রংপুরে খুন হন জাপানি নাগরিক হোশি কুনিও৷ মুখোশধারী খুনিরা তাঁকে গুলি করার পর মোটরসাইকেলে করে পালিয়ে যায়৷ ইসলামিক স্টেট এই হত্যাকাণ্ডেরও দায় স্বীকার করেছে, তবে সরকার তা অস্বীকার করেছে৷ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্বাস করেন না যে তাঁর দেশে আন্তর্জাতিক জঙ্গি গোষ্ঠীটির উপস্থিতি রয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo
হোসনি দালানে বিস্ফোরণ, নিহত ১
গত ২৪ অক্টোবর ঢাকার ঐতিহ্যবাহী হোসনি দালানে শিয়া মুসলমানদের আশুরার প্রস্তুতির সময় বিস্ফোরণে এক কিশোর নিহত এবং শতাধিক ব্যক্তি আহত হন৷ বাংলাদেশে এর আগে কখনো শিয়াদের উপর এরকম হামলায় হয়নি৷ এই হামলারও দায় স্বীকার করেছে ইসলামিক স্টেট, তবে সরকার সে দাবি নাকোচ করে দিয়ে হামলাকারীরা সম্ভবত নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি গোষ্ঠী জেএমবি-র সদস্য৷ সন্দেহভাজনদের একজন ইতোমধ্যে ক্রসফায়ারে মারা গেছে৷
ছবি: Getty Images/AFP/M. Zaman
ঢাকায় প্রকাশক খুন
গত ৩১ অক্টোবর ঢাকায় দু’টি স্থানে কাছাকাছি সময়ে দুর্বৃত্তরা হামলা চালায়৷ এতে খুন হন এক ‘সেক্যুলার’ প্রকাশক এবং গুরুতর আহত হন আরেক প্রকাশক ও দুই ব্লগার৷ নিহত প্রকাশক ফয়সাল আরেফিন দীপনের সঙ্গে ঢাকায় খুন হওয়া ব্লগার অভিজিৎ রায়ের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল৷ জঙ্গি গোষ্ঠী ‘আনসার-আল-ইসলাম’ হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করেছে৷
ছবি: Getty Images/AFP/M. Uz Zaman
প্রার্থনারত শিয়াদের গুলি, নিহত ১
গত ২৭ নভেম্বর বাংলাদেশের বগুড়ায় অবস্থিত একটি শিয়া মসজিদের ভেতরে ঢুকে প্রার্থনারতদের উপর গুলি চালায় কমপক্ষে পাঁচ দুর্বৃত্ত৷ এতে মসজিদের মুয়াজ্জিন নিহত হন এবং অপর তিন ব্যক্তি আহত হন৷ তথকথিত ইসলামিক স্টেট-এর সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ততা দাবি করা স্থানীয় একটি গোষ্ঠী হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করেছে৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo
9 ছবি1 | 9
গত জুনে ঢাকায় পুলিশের এক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা হয়েছিল৷ তিনি তখন বলেছিলেন, সব ব্লগারের নিরাপত্তা দেয়া সম্ভব নয়৷ কিন্তু কেউ কি সব ব্লগারের নিরাপত্তা চাইছে? খুনিরা তালিকা ধরে খুন করছে৷ এখন পর্যন্ত যে ব্লগাররা খুন হয়েছেন, তাঁদের নিরাপত্তা নিয়ে ঝুঁকি আগেই বোঝা গিয়েছিল৷ টুটুলরা আক্রান্ত হতে পারেন, সেই শঙ্কা ছিল৷ ফলে সব ব্লগার নয়, বরং নির্দিষ্ট কিছু ব্লগারের জীবন ঝুঁকির মুখে৷ সেই ঝুঁকিতে থাকাদের নিরাপত্তা দিতে এত অনীহা কেন পুলিশের?
দু'দিন আগে আরো এক ব্লগারের বাড়িতে হানা দেয়ার চেষ্টা করেছিল সন্দেহভাজন দুর্বৃত্তরা৷ সেই চেষ্টা সফল হয়নি৷ ফলে সেই ব্লগার বেঁচে গেছেন৷ আলোচিত সেই ব্লগারও আছেন ২০১৩ সালে প্রকাশিত ‘হিট লিস্টে৷' এই লিস্ট এমন এক সময় প্রকাশ হয়েছিল, যখন ঢাকার রাজপথে ‘নাস্তিক ব্লগারদের' হত্যার দাবিতে মিছিল করছিল উগ্র ইসলামপন্থি গোষ্ঠী ‘হেফাজতে ইসলাম৷' এখন পর্যন্ত ব্লগার খুনের পরপর যে দু'জন আটক হয়েছেন, তারা স্বীকার করেছেন যে তারা মাদ্রাসার ছাত্র৷ যদিও পুলিশ এই তথ্যটুকু সযতনে এড়িয়ে যাচ্ছে৷ আর ব্লগারদের ফাঁসি চাওয়া হেফাজতের সঙ্গে বর্তমান সরকারের সম্পর্কটাও পাকাপোক্ত হচ্ছে৷ যেটা বোঝা যায় তখন, যখন রেলের জমি তাদের নামে বরাদ্দ হয়৷
অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, বাংলাদেশের পরিস্থিতি ক্রমশ খারাপের দিকেই যাচ্ছে৷ গণমাধ্যম হারাচ্ছে স্বাধীনতা, আর ব্লগার, প্রকাশকরা প্রাণ৷ অন্যদিকে, নিরব প্রশাসন, সরকার৷