1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

সেনাপ্রধানের যে কথার যেমন তাৎপর্য

২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

তৎকালীন বিডিআর (বর্তমান বিজিবি) সদর দপ্তর পিলখানায় সংঘটিত নির্মম হত্যাকাণ্ডে শাহাদতবরণকারী সেনা কর্মকর্তাদের স্মরণে মঙ্গলবার আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান বক্তব্য দেন।

বাংলাদেশের সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান
বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব, রাজনৈতিক পরিস্থিতি, নির্বাচন ইত্যাদি প্রসঙ্গে সেনাপ্রধানের সাম্প্রতিক বক্তব্য নিয়ে নানা আলোচনা চলছে রাজনৈতিক অঙ্গনেছবি: DW

সেখানে তিনি সবাইকে যেমন সতর্ক করেছেন, তেমনি আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি নিয়ে কথা বলেছেন। তিনি নির্বাচনের কথা যেমন বলেছেন, তেমনি ‘নিজের উচ্চাকাঙ্খা নেই' বলেও জানিয়েছেন। তার এই বক্তব্য নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে শুরু করে চায়ের দোকানেও চলছে আলোচনা। কেউ তার বক্তব্যকে ‘হুমকি' বলছেন, আবার কেউবা ‘সময়োচিত বক্তব্য' বলে করছেন প্রশংসা।

সেনাপ্রধানের এই বক্তব্যের বিভিন্ন দিক নিয়ে ডয়চে ভেলের সঙ্গে সাবেক সেনা কর্মকর্তা, সাবেক পুলিশ প্রধান, রাজনীতিক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সাংবাদিক কথা বলেছেন।

পুলিশ, র‌্যাব, ডিজিএফআই, এনএসআইকে ‘আন্ডারমাইন করা' বলতে সেনাপ্রধান কী বোঝাতে চেয়েছেন জানতে চাইলে মেজর জেনারেল (অব.) জামিল ডি আহসান বীরপ্রতীক ডয়চে ভেলেকে বলেন, "এগুলো তো রাষ্ট্রের ইনস্ট্রুমেন্ট। যে কোনো রাষ্ট্র সুষ্ঠুভাবে চালাতে গেলে এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে লাগবে। এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে আগে তো নানাভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। একটা বিষয় প্রতিষ্ঠিত যে, এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে সুষ্ঠুভাবে ব্যবহার করা হয়নি। এগুলো তো রাষ্ট্র কাঠামোর বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান। ফলে, এরা সুষ্ঠুভাবে কাজ না করলে এর প্রভাব তো বিভিন্ন জায়গায় পড়বেই। এই প্রতিষ্ঠানগুলোর দুর্বলতা তো আমরা দেখছি। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নেই। উনি বলেছেন, এই প্রতিষ্ঠানগুলো তো আগে ভালো কাজও করেছে। আবার এদের দ্বারা তো অনেক নেতিবাচক কাজ হয়েছে। সেগুলো কাদের নির্দেশে হয়েছে? কাজগুলো তো জনগণের পক্ষে ছিল না। উনি এই কথাটাই বলতে চেয়েছেন, এদের অবমূল্যায়ন করা হলে কাদের দিয়ে রাষ্ট্র চলবে? কেউ অপরাধ করলে বিচার হবে- সেটাও উনি বলেছেন। এগুলো তো বন্ধ করে দেওয়া যাবে না। র‌্যাব বন্ধ করা যেতে পারে, কারণ, সেটা একটা সাপোর্টিং ফোর্স।”

দেশের জন্য, ভালোর জন্য উনার কথা তো আমরা শুনতে চাই: মেজর জেনারেল (অব.) জামিল ডি আহসান

This browser does not support the audio element.

‘স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব বিপন্ন হবে'- বলতে তিনি কী বোঝাতে চেয়েছেন? এ প্রসঙ্গে জবাবে জনাব আহসানের বিশ্লেষণ, "স্বাধীন দেশ হিসেবে আমাদের তো একটা সত্ত্বা থাকার কথা। ভেতর ও বাইরে থেকে যদি এর বিরুদ্ধে কাজ করা হয়, তাহলে তো সেটা ব্যাহত হবে। আমি নিজেও একজন মুক্তিযোদ্ধা। ৫৪ বছর ধরে তো অনেক ঘটনা ঘটেছে। এখনো যদি আমরা অন্যের সেবাদাস হওয়ার জন্য কাজ করতে থাকি, তাহলে তো হবে না। আমি নিজেও গতকাল ওখানে উপস্থিত ছিলাম, কথাও বলেছি। সতর্ক করার বিষয়টি হলো, তিনি যেখানে আছেন, সেখান থেকে তিনি অনেক কিছুই বুঝতে পারেন। আমরা তো বাইরে থেকে একভাবে দেখি। উনি যেহেতু সিদ্ধান্ত গ্রহণের জায়গায় আছেন, সেখান থেকে উনি সতর্ক করা বলতে সাবধান করে দেওয়া বা বলে দেওয়া যে, এটার ফলশ্রুতিতে ওটা হতে পারে। দেশের জন্য, ভালোর জন্য উনার কথা তো আমরা শুনতে চাই।”   

সেনাপ্রধানের বক্তব্য সম্পর্কে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. জাহেদ উর রহমান ডয়চে ভেলেকে বলেন, "আমি মনে করি, উনার বক্তব্য শোনা শুধু নয়, দেখাও দরকার। কারণ, উনার বডি ল্যাংগুয়েজটা দেখতে হবে। উনার মধ্যে বেশ কিছু স্ট্রেস বা বিরক্তি আছে। শেষে কিন্তু উনি বলেছেন, আজ অনেক কথা বলে ফেললাম। বলা হয়ে উঠছিল না। কোনোভাবে উনি বলে ফেলেছেন। বেশ কিছুদিন ধরে উনার মধ্যে কথাগুলো আছে। দ্বিতীয় ব্যাপারটা হচ্ছে, অনেকে মনে করছেন উনি কমান্ডিং টোনে কথা বলেছেন। কেউ বলছেন, উনি হুমকি দিয়েছেন। উনি যে বলেছেন, আপনাদেরকে, অর্থাৎ, উনার জায়গা থেকে উনি যখন বলেন, আপনাদেরকে, অর্থাৎ, উনি আপনাদের বাইরের কেউ। অনেকেই এটাকে নির্দেশ বা ধমক বা হুমকি মনে করেছেন। তিনি সেনাপ্রধান হিসেবে আমি মনে করি, প্রয়োজনের চেয়ে অনেক বেশি তথ্য জানেন।''

সেনাপ্রধানের বক্তব্য শুনে ড. জাহেদ উর রহমানের মনে হয়েছে, ‘‘সংকটটা আমাদের জন্য কতটা ঝুঁকি তৈরি করছে সেটার জন্য তিনি অ্যালার্ম দিয়েছেন। তার মধ্যেও ক্ষোভ আছে। সেনাবাহিনীকে নিয়ে কথা হচ্ছে। তাকে নিয়ে কথা হচ্ছে। তাকে অপসারণের জন্য চাপ সৃষ্টি করা হয়েছে। এটা নিয়েও উনি বিরক্ত আছেন। এছাড়া অভ্যন্তরীণ চাপেও তিনি আছেন। তিনি ডিজিএফআই-এর নামও করেছেন। জাতিসংঘের রিপোর্টের পর যখন এটা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তখন বিচারের এক ধরনের চাপ আছে। সেটা নিয়েও উনি চাপে আছেন। আমাদের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো নির্বাচন। নির্বাচন পেছানোর আলাপ উনি শেষ করে দিয়েছেন। উনি ইনক্লুসিভ নির্বাচনের কথা বলেছেন। তাতে বোঝা যাচ্ছে তার অগ্রাধিকারের মধ্যে আওয়ামী লীগও আছে। উনি আসলে ল্যাংগুয়েজের দিক থেকে একটু টাফ ছিলেন।”

আমরা গণতন্ত্রের বাইরে কোনো শক্তির ছায়া দেখতে চাই না: রুহিন হোসেন প্রিন্স

This browser does not support the audio element.

সেনাপ্রধানের বক্তব্যের রাজনৈতিক গুরুত্বের বিষয়ে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি)-র সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স ডয়চে ভেলেকে বলেন, "আমার ব্যক্তিগত মত হলো, অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে নতুন একটা সরকার এসেছে। আমরা এখন পূর্ণ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে আছি। সেক্ষেত্রে আমরা সেনাবাহিনীসহ অন্যদের ইতিবাচক ভূমিকা দেখতে চাই। আন্দোলনের শেষ দিকে সেনাবাহিনীর বল প্রয়োগ না করা এবং সর্বশেষ যে ভূমিকা রাখছে তাতে হয়ত অনেকেই তাদের নিরীহ ভূমিকার জন্য প্রশ্নবিদ্ধ করছেন। তবে তাদের এই ভূমিকা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় উত্তরণের জন্য নেগেটিভ না। সেনাপ্রধানের বক্তব্যে আমার মনে হয়েছে, তিনি যে প্রত্যাশা করেছিলেন, দ্রুত রাজনৈতিক দল ও শ্রেনি, পেশার মানুষ আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে দ্রুত সংকট উত্তরণের পথে যাবে- সেটা হয়ত তিনি দেখতে পাননি বলে গতকাল কতগুলো কঠোর মন্তব্য করেছেন। আমার বক্তব্য হলো, আমরা যে গণতান্ত্রিক অভিযাত্রা শুরু করেছি, সেই কাজটা আমরাই করবো। এখানে অন্য কোনো হস্তক্ষেপ প্রত্যাশা করি না। উনি যে ভালো নির্বাচনের প্রত্যাশা করেছেন, আমরা সেই পথেই এগুবো। আমরা গণতন্ত্রের বাইরে কোনো ওয়ান ইলেভেন জাতীয় শক্তি বা অন্য কোনো শক্তির ছায়া দেখতে চাই না।” 

সেনাপ্রধানের বডি ল্যাংগুজে দেখে গত ৬ মাসে যা হয়েছে, তাতে যথেষ্ট ক্ষুব্ধ এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে রাগান্বিত বলে মনে হয়েছে সাংবাদিক মাসুদ কামালের। ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, "উনি বলেছেনও, যা আশা করেছিলেন, সেদিকে দেশটা যাচ্ছে না। এজন্য উনি বলেছেন, হানাহানি, মারামারি করলে বা বিভেদ বাড়তে থাকলে দেশ সংকটে পড়বে। এজন্য উনি উল্লেখ করেছেন, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির যে উন্নতি হচ্ছে না- সেই কারণও বলেছেন। এখন প্রশ্নটা হলো, ‘নিজেরা' বলতে উনি কাদের বুঝিয়েছেন? এই নিজেরা কারা? নিজেরা বলতে আমি যেটা বুঝি, জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে যারা স্বৈরাচারবিরোধী অবস্থানে ছিলেন, তারাই হলো ‘নিজেরা'। এটা আমরা দেখতেও পাচ্ছি যে, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এক ধরনের বিভেদ, আন্দোলন কে করেছে- তা নিয়ে বিতর্ক। এই সময়ে উনি কিছু সতর্ক করেছেন। উনি কাকে সতর্ক করলেন? মনে হচ্ছে, এই সরকার নিরব দর্শকের মতো দেখছে। পুরো জিনিসটায় আমার মনে হয়েছে, বর্তমান সরকারের ব্যর্থতা... উনার যে ক্ষোভ, উনার যে বিরক্তি, সেটা এই সমস্ত মারামারি ও হানাহানির জন্য। মূলত সরকারের ব্যাপারে উনি বিরক্ত। দেশের এই পরিস্থিতিতে সেনাপ্রধান হিসেবে উনার এই বক্তব্য অনেকের কাছে ভালো লেগেছে। আমার কাছেও মনে হয়েছে, একটু রিলিফের মতো। সরকার এটা শোনার পর যদি ভালোভাবে দেশটা পরিচালনা করে, তাহলেই আমরা একটা ভালো জায়গায় পৌঁছাতে পারবো।”

বোঝা যাচ্ছে তার অগ্রাধিকারের মধ্যে আওয়ামী লীগও আছে: ড. জাহেদ উর রহমান

This browser does not support the audio element.

‘ইনক্লুসিভ নির্বাচন' বলতে সেনাপ্রধান কী বোঝাতে চেয়েছেন? এ প্রসঙ্গে মাসুদ কামাল বলেন, "উনি কী বুঝিয়েছেন সেটা আমি জানি না। কিন্তু আমি উনার এই শব্দটার সঙ্গে একমত। আসলেই ইনক্লুসিভ নির্বাচন হতে যাচ্ছে কিনা সেটা আমার কাছে মনে হচ্ছে না। সেটার নমুনা আমি দেখছি না। আপনি যখন কোনো নির্বাচন করবেন, তখন বৈধ সকল রাজনৈতিক দলের সমান সুযোগ থাকবে। সেটাই হওয়া উচিত। কিন্তু সেই পরিবেশ আছে বলে আমার কাছে মনে হচ্ছে না। যখন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সেক্রেটারি বলেন, ‘‘আওয়ামী লীগের লিফলেট বিতরণ করা হলে গ্রেপ্তার করা হবে, তখন সেখানে লেভেল -প্লেয়িং ফিল্ড আছে বলে আমি মনে করি না। আওয়ামী লীগের লোকজনকে লিফলেট বিতরণ করতে দিবেন না কেন? আপনি কি আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করেছেন? যে দল নিষিদ্ধ নয়, তাহলে সেই দল তার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করবে। লিফলেট বিতরণের মতো কর্মকাণ্ডের জন্য যদি আপনি হুমকি দেন, তাহলে সেটা কোন আইনে দেন? তাহলে নির্বাচনটা কেমন হবে সেটাও কিন্তু আমরা বুঝতে পারি।”   

পুলিশকে কেন সক্রিয় করা যাচ্ছে না? সেনাপ্রধান যে আন্ডারমাইন করার কথা বলেছেন- তার সঙ্গে এর সম্পর্ক আছে কিনা জানতে চাইলে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক আব্দুল কাইয়ুম ডয়চে ভেলেকে বলেন, "সেনাপ্রধান কয়েকটি বিষয় সঠিকভাবে উল্লেখ করেছেন। আসলেই আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ঠিক করতে হলে পুলিশকে আন্ডারমাইন করা যাবে না। দিনশেষে তাদের দিয়েই আপনাকে কাজটা করতে হবে। তারা যদি ঠিকভাবে কাজ না করেন. তাহলে এই কাজ করার বিকল্প কেউ নেই। ফলে তাদের দিয়েই কাজটা করাতে হবে। তাদের আস্থায় নিতে হবে। তবে হ্যাঁ, যারা অপরাধের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে, অবশ্যই তাদের বিচারের আওতায় আনতে হবে। গত ১৫-১৬ বছরে তো পুলিশকে রাজনৈতিক দলের হাতিয়ার করা হয়েছিল। নানাভাবে ব্যবহার করা হয়েছে এই বাহিনীকে। এখন এই বাহিনীতে যারা আছেন, তাদের মধ্যে স্বচ্ছ ও ক্লিন ইমেজ যাদের, তাদের নিয়ে কাজটা শুরু করতে হবে। নতুন নিয়োগ দিলেও তো তাদের এক বছরের ট্রেনিং করতে হয়। ফলে চাইলেই কালকে নতুন পুলিশ মাঠে নামানো যাবে না। তাই ভালো লোকদের দিয়ে কাজটা চালিয়ে নিতে হবে।”