বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর এক কর্মকর্তার বাড়িতে তীব্র নিপীড়নের শিকার হয়েছে এক শিশু গৃহকর্মী৷ সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপক হৈ চৈ হলেও অভিযুক্তরা প্রভাবশালী হওয়ায় এর বিচার শেষ পর্যন্ত হবে কিনা, তা নিয়ে অনেকই সন্দেহ প্রকাশ করেছেন৷
বিজ্ঞাপন
শিশুটি বর্তমানে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওয়ানস্টপ ক্রাইসিস সেন্টার নেয়া হলেও পরে সামরিক হাসপাতাল সিএমএইচে নিয়ে আসা হয়৷
এ ঘটনায় শিশুটি গৃহকর্তীর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে বলে ঢাকায় ডয়চে ভেলের কন্টেন্ট পার্টনার বিডি নিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম জানিয়েছে৷
এই ঘটনায় একাধিক পোস্ট ফেসবুকে ভাইরাল হয়ে গেছে৷ বিচারের দাবিতে কী বোর্ড ধরেছেন অসংখ্য মানুষ৷
এক সাংবাদিককে উদ্বৃত করে শামীম আরা নীপা নামে এক ব্যক্তি রবিবার ফেসবুকে জানিয়েছেন, সাবিনা নামের ওই শিশুটির শিশুটির পরিচয় এবং ঘটনার বিবরণও তিনি পূর্ণভাবে জানেন না৷
তবে পোস্টের সঙ্গে তিনি তিনটা ছবি দেন যার প্রত্যেকটিতেই নির্যাতনের চিহ্ন ছিল স্পষ্ট৷
ছবিতে দেখা যায় মেয়েটির দুই চোখ, চোখের পাতা এবং চোখের নীচের অংশে বেশ খানিকটা জায়গাজুড়ে ফুলে গেছে৷ ফোলা অংশগুলো কালো হয়ে গেছে এবং ফোলার কারণে ভেতরে ঢুকে গেছে চোখ৷ এছাড়া হাতে রয়েছে পুড়ে যাওয়ার দাগ৷ যার এক অংশ থেকে চামড়াও উঠে গেছে৷
ডিমপোচ ঠিকমতো করতে না পারায় বেলুন দিয়ে বেধড়ক পেটানোয় এই হাল হয়েছে বলেও ঢাকার একটি দৈনিকের খবরে বলা হয়েছে৷
ছবি দেখেই শামীম আরা মন্তব্য করেন, ‘‘যারা এমন পাশবিক কাজ করে তাদের আদৌ কোনো বিচার হবে কিনা জানি না....খুব ক্রোধ হচ্ছে, ঘেন্না হচ্ছে এই সমাজের সেইসব পশুদের উপর যারা প্রতিদিন শিশুদের উপর এমন নির্যাতন করে এবং বিনা বিচারে টাকা কিংবা ক্ষমতার বিনিময়ে শাস্তি থেকে রক্ষা পেয়ে যায়...৷ আমার শুধু শিশুটির চেহারার জায়গায় নিজের সন্তানদের মুখ ভেসে উঠছে....খুব বীভৎস লাগছে...৷''
বাংলাদেশে গৃহকর্মীদের দুর্দশার কথা
পশ্চিমা বিশ্ব যখন ঘরের কাজে রোবট ব্যবহারের দিকে ঝুঁকছে, বাংলাদেশে তখনও ঘরের কাজ করছেন গৃহকর্মীরা৷ মাসে তাঁদের গড় বেতন ৫১০ টাকা, কাজ করতে হয় কমপক্ষে দশ ঘণ্টা৷ আর ঘুমাতে হয় রান্না ঘরের মেঝেতে৷ এই বিষয়ে আমাদের ছবিঘর৷
ছবি: picture-alliance/Godong
মাসিক বেতন ৫১০ টাকা
পশ্চিমা বিশ্ব এখন ঘরের কাজে রোবট ব্যবহারের দিকে ঝুঁকছে৷ এই নিয়ে চলছে বিস্তর গবেষণা৷ তবে বাংলাদেশের পরিস্থিতি ভিন্ন৷ সেদেশে ঘরের কাজের জন্য অধিকাংশ বাড়িতে রয়েছেন গৃহকর্মী৷ যাঁদের মাসিক গড় বেতন ৫১০ টাকা৷ আর দিনে কাজ করতে হয় কমপক্ষে দশ ঘণ্টা৷
ছবি: imago/Michael Westermann
৮৩ শতাংশ নারী
ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড ইউনিয়ন কনফেডারেশন বা আইটিইউসি ২০১২ সালে বাংলাদেশের গৃহকর্মীদের নিয়ে বিভিন্ন তথ্য প্রকাশ করেছে৷ এতে দেখা যাচ্ছে, শুধুমাত্র ঢাকা এবং চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনে গৃহকর্মীর সংখ্যা বিশ লাখের মতো৷ এঁদের মধ্যে ৮৩ শতাংশ নারী, যাঁদের অনেকে বয়সে শিশু কিংবা তরুণী৷
ছবি: imago/imagebroker
মেঝেতে ঘুমানো
আইটিইউসি-র ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, গৃহকর্মীদের মধ্যে ৩৩ শতাংশ রাতে রান্নাঘরে ঘুমান৷ এছাড়া বসার এবং শোয়ার ঘরের মেঝেতে ঘুমান গড়ে ২০ শতাংশ করে গৃহকর্মী৷ কারো কারো আবার ঘুমাতে হয় স্টোর রুমে৷ (প্রতীকী ছবি)
ছবি: DW/Mustafiz Mamun
অন্যায়, নির্যাতন
অধিকাংশ গৃহকর্মী বা কাজের মেয়ে পড়ালেখার সুযোগ পান না৷ বিনোদনেরও অভাব রয়েছে৷ কমপক্ষে ৫৩ শতাংশ গৃহকর্মীর সঙ্গে বাজে ভাষায় কথা বলা হয়৷ কাজ হারানোর আতঙ্কও কাজ করে তাঁদের মধ্যে৷ যৌন নির্যাতনের শিকার গৃহকর্মীর সংখ্যা ১৬ দশমিক ৬৭ শতাংশ৷ (প্রতীকী ছবি)
ছবি: Fotolia/Miriam Dörr
প্রাণহানি
২০০১ থেকে ২০১০ সাল সময়কালের মধ্যে বাংলাদেশে নির্যাতনের শিকার হয়ে কমপক্ষে ৩৯৮ গৃহকর্মী প্রাণ হারিয়েছে বলে দাবি করেছে বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অফ লেবার স্টাডিজ বা বিলস৷ এছাড়া নির্যাতনে আহত গৃহকর্মীর সংখ্যা ২৯৯৷ আইটিইউসি-র ওয়েবসাইটে প্রকাশিত বাংলাদেশ বিষয়ক বিভিন্ন তথ্যের উৎস বিলস এবং ‘গৃহশ্রমিক অধিকার প্রতিষ্ঠা নেটওয়ার্ক’৷ (প্রতীকী ছবি)
ছবি: Fotolia/GrafiStart
জনসচেতনতা সৃষ্টি
গৃহকর্মীদের অধিকারের বিষয়ে জনগণকে সচেতন করতে বিভিন্ন উদ্যোগও রয়েছে বাংলাদেশে৷ ‘গৃহশ্রমিক অধিকার প্রতিষ্ঠা নেটওয়ার্ক’ এক্ষেত্রে সক্রিয়৷ এই নেটওয়ার্ক ১৪ বছরের কম বয়সিদের গৃহকর্মী হিসেবে নিয়োগ দেয়া থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়েছে৷
ছবি: imago/epd
ঘরে আটকে রাখা নয়
বাংলাদেশের বিভাগীয় শহরগুলো অনেক সময় গৃহকর্মীদের ঘরের মধ্যে রেখে বাইরে থেকে বাড়িতে তালা দিয়ে রাখা হয়৷ ‘গৃহশ্রমিক অধিকার প্রতিষ্ঠা নেটওয়ার্ক’ এই কাজের তীব্র বিরোধীতা করেছে৷ গৃহকর্মীদের সুরক্ষা নীতির আওতায় এ ধরনের কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধের দাবি জানিয়েছে নেটওয়ার্কটি৷ (প্রতীকী ছবি)
ছবি: TAUSEEF MUSTAFA/AFP/Getty Images
শ্রমিক হিসেবে স্বীকৃতি
গৃহকর্মী বা গৃহশ্রমিকদের ‘শ্রমিক হিসেবে’ স্বীকৃতি ও শ্রম আইনে তাঁদের অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করারও দাবি জানিয়েছে ‘গৃহশ্রমিক অধিকার প্রতিষ্ঠা নেটওয়ার্ক’৷ ‘বাংলাদেশ লেবার অ্যাক্ট-২০০৬’-এ গৃহকর্মীদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি৷
ছবি: picture-alliance/Godong
8 ছবি1 | 8
এই অপরাধের বিচারের পথটা যে সহজ হবে না – সেদিকে ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, এ সবের সুবিচার আদায় করে নেয়া লাগে, কিন্তু কে করবে সেই আন্দোলন...?
ফেসবুকে পোস্ট দেয়ার প্রথম ১৬ ঘণ্টায় প্রায় ১৫শত বার শেয়ার হয়েছে এই পোস্টটি৷ এছাড়া নিজ নিজ স্ট্যাটাসে আরও শত শত মানুষ এটাকে উদ্বৃত করেছেন৷
বকুল রায় বলেন, সৃষ্টির সেরা জীব মানুষ হয়ে আমরা আর কত মানুষের জীবন বিপন্ন করব? পৃথিবীর কোনো প্রাণী সমগোত্রীয় ছোটদের এভাবে আঘাতে আঘাতে জর্জরিত করে না৷ বরং বিপদে সবাই একত্রে প্রতিরোধ গড়ে৷ সমাজের উচুঁ স্তরের মানুষেরা আর কত অমানুষ হবি তোরা?
প্রকাশক রবিন আহসান তার ফেইসবুকে বলেন, বাংলাদেশে গরিব নারী শিশুরা সব চেয়ে অসহায়! যখন স্কুলে যাওয়ার কথা তখন তারা অন্যের শিশুদের বড়দের মতো আগলে রাখে! অন্যরা যখন খেলে তখন তার হাতে বড় সাহেব বিবিদের পুরো সংসার!
‘‘বড় সাহেব-বিবিদের মন মেজাজ খারাপ থাকলে সকল ধাক্কা এই নারী শিশুর উপর দিয়ে যায়! আর ও ছোট্ট মানুষ হিসেবে একটু আধটু ভুল করলে বিবিদের গরম খুনতি নারী শিশুর শরীরে অনিবার্য হয়ে পরে!''
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পল্লবী থানার এসআই আসিফ ইকবালকে উদ্বৃত করে ডয়চে ভেলের কন্টেন্ট পার্টনার বিডি নিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সোমবার দেয়া এক খবরে বলা হয়, সাবিনা আক্তার নামে মেয়েটির বয়স ১১ বছর, বাড়ি টাঙ্গাইল জেলায়৷ গত ছয় মাস ধরে মিরপুর ডিওএইচএস-এ লেফটেন্যান্ট কর্নেল তসলিম আহসানের বাসায় কাজ করছিল সে৷
মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, ‘সাবিনাকে প্রায়ই মারধর করতেন গৃহকর্ত্রী আয়েশা লতিফ৷ রবিবার মারধরের এক পর্যায়ে তাকে বাসা থেকে বের করে দেওয়া হয়৷'
অভিযোগের বিষয়ে লেফটেন্যান্ট কর্নেল তসলিম আহসান বা তাঁর স্ত্রী আয়েশা লতিফের বক্তব্য বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম জানতে পারেনি৷
আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর ) পরিচালক রাশেদুল হাসানকে উদ্বৃত করে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম বলেছে, কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে ওয়াকিবহাল রয়েছে৷ ভুক্তভোগীকে চিকিৎসাসহ সার্বিক সহযোগিতা দেওয়া হবে৷ কেউ দোষী সাব্যস্ত হলে তার বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে৷
কেমন আছে অন্য দেশের গৃহকর্মীরা?
বাংলাদেশে গৃহকর্মীদের অবস্থা কখনই ভালো ছিল না, এখনও নেই৷ তাঁদের রক্ষায় নেই কোনো আইন৷ কিন্তু বিশ্বের আর অন্যান্য দেশে তাঁদের কী অবস্থা? সেই তথ্যই থাকছে ছবিঘরে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/empics/L. Hurley
পাঁচ কোটি ৩০ লক্ষ
২০১৩ সালে প্রকাশিত আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা, আইএলও-র এক প্রতিবেদন বলছে, সারা বিশ্বে গৃহকর্মীর সংখ্যা প্রায় ৫৩ মিলিয়ন৷ এর মধ্যে ৮৩ শতাংশই নারী৷ তবে প্রকৃত সংখ্যাটি যে আরও কয়েক মিলিয়ন বেশি হতে পারে, সে কথাও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে৷ এদিকে ১৫ বছরের কমবয়সি শিশু গৃহকর্মীদের সংখ্যা আইএলও-র প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়নি – ২০০৮ সালে এই সংখ্যাটি ছিল ৭৪ লক্ষ৷
ছবি: AP
আইনের বাইরে
আইএলও-র প্রতিবেদন বলছে, বিশ্বের গৃহকর্মীদের প্রায় ৩০ শতাংশই শ্রম আইনের সুবিধাবঞ্চিত৷
ছবি: DW
সাপ্তাহিক ছুটি
বিশ্বের প্রায় অর্ধেক (৪৫ শতাংশ) গৃহকর্মী সাপ্তাহিক ছুটি পান না৷ তাছাড়া তাঁদের এমন কোনো বার্ষিক ছুটি নেই, যার জন্য তাঁদের অর্থ প্রাপ্য (পেইড লিভ)৷
ছবি: DW/M. Krishnan
প্রসূতি সুরক্ষা
প্রতি তিনজনের একজন গৃহকর্মী এই সুবিধা পায় না বলে জানিয়েছে আইএলও৷
ছবি: Sam Panthaky/AFP/Getty Images
বছরে ৮ বিলিয়ন ডলার!
গৃহকর্মী মানেই যেন কম টাকা দিয়ে বেশি ঘণ্টা কাজ করানো৷ এভাবে গৃহকর্মীদের প্রতারিত করে তাঁদের নিয়োগদাতারা অবৈধভাবে বছরে প্রায় ৮ বিলিয়ন ডলার আর্থিক সুবিধা পাচ্ছে বলে জানিয়েছে ‘ইন্টারন্যাশনাল ডমেস্টিক ওয়ার্কার্স ফেডারেশন’৷
ছবি: imago/imagebroker
‘কাফালা’ যেন দাসপ্রথার অন্য রূপ
গাল্ফ দেশগুলোতে এই ব্যবস্থা থাকার কারণে গরিব দেশ থেকে সেখানে যাওয়া গৃহকর্মীরা নির্যাতনের শিকার হলেও তাঁদের নিয়োগদাতাদের বিরুদ্ধে কিছু বলতে পারে না৷ কারণ কাফালা ব্যবস্থার কারণে নির্যাতিতরা চাইলেও নিয়োগদাতার ছাড়পত্র ছাড়া দেশ ত্যাগ করতে পারেন না৷ ‘ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড ইউনিয়ন কনফেডারেশন’ এই অবস্থাকে দাসত্বের সঙ্গে তুলনা করেছে৷ আইএলও-র হিসেবে মধ্যপ্রাচ্যে গৃহকর্মীর সংখ্যা প্রায় ২১ লক্ষ৷
ছবি: AP
হংকংয়ে গৃহকর্মীদের অবস্থা
তিন হাজার গৃহকর্মীর উপর চালানো এক জরিপে উত্তরদাতাদের প্রায় ৫৮ শতাংশ বলেছে, তাঁদের মৌখিকভাবে নির্যাতন করা হয়েছে৷ ১৮ শতাংশ তাঁদের উপর শারীরিক নির্যাতনের কথা বলেছে৷ আর যৌন হয়রানির কথা জানিয়েছে ৬ শতাংশ৷
ছবি: Miguel Candela/TRANSTERRA
বাড়ি তো নয়, যেন কারাগার!
উন্নত দেশ অস্ট্রেলিয়াতেও ভালো নেই গৃহকর্মীরা৷ ২০১৪ সালের এক প্রতিবেদনে সেখানে গৃহকর্মীদের সর্বোচ্চ ১৬ ঘণ্টা কাজ করানো, বেতন না দেয়া ও শারীরিক নির্যাতনের কথা বলা হয়েছে৷ প্রতিবেদনে অস্ট্রেলিয়ার ব্যক্তিমালিকানাধীন বাড়িগুলোকে ‘কারাগার’-এর সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে৷
ছবি: Fotolia/apops
একা বাড়ির বাইরে নয়
না, ছোট্ট শিশুদের কথা বলা হচ্ছে না৷ ইংল্যান্ডের মতো দেশে প্রায় ৬০ শতাংশ গৃহকর্মীদের একা বাড়ির বাইরে যেতে দেয়া হয় না বলে জানিয়েছে বেসরকারি সংস্থা ‘কালায়ন’৷