বিধানসভা নির্বাচন উপলক্ষে প্রতিশ্রুতির বন্যায় ভাসছে মানুষ৷ সেই সঙ্গে উঠে আসছে নানা অভাব আর অভিযোগ৷ সোনাগাছির যৌনকর্মীদের রয়েছে না পাওয়ার এমন অভিযোগ৷
বিজ্ঞাপন
উত্তর কলকাতার সোনাগাছিতে যৌনকর্মীদের সংখ্যা আর আগের মতো নেই৷ পনেরো হাজার থেকে কমে দাঁড়িয়েছে সাত হাজারে৷ সমস্যাবহুল সোনাগাছির সহযোগীতায় কিছু স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ও অরাজনৈতিক দলের সাক্ষাৎ মেলে৷ কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলো কি তাদের দায়িত্ব পালন করে? অভিযোগ আছে, রাজনৈতিক দিক থেকে সমর্থন পায় না বলেই যৌনকর্মীরা আইনের স্বীকৃতি পাননি৷
সমস্যার সমাধান মেলে?
ফি বছর চাঁদার নাম করে জুলুম সহ্য করতে হয় নিষিদ্ধপল্লীর কর্মীদের৷ ইমমরাল ট্রাফিকিং প্রিভেনশন অ্যাক্টের (ITPA) দরুণ এখনও পুলিশি হেনস্তার স্বীকার হতে হয় তাদের৷ অধিকার ও সম্মানের লড়াইয়ে সামিল যৌনকর্মীদের সংগঠন ‘দুর্বার মহিলা সমন্বয় সমিতি'র সেক্রেটারি কাজল বসু বলেন, "এই ধারাগুলো বদলাতে কেউ একটা বাক্যও বলেন না৷ আমরা অ্যান্টি ট্রাফিকিং নিয়ে কাজ করি৷ বোর্ডের স্বীকৃতি পেলে কাজটা আরও ভাল করতে পারি৷ শ্রমদপ্তরে নামটুকু তুলতেও কেউ এগিয়ে আসেন না৷”
সংগঠনের প্রেসিডেন্ট বিশাখা লস্কর বলেন, ‘‘প্রত্যেক দল যা প্রতিশ্রুতি দেয়, সবই মিথ্যা৷ আমরা কোনো সমস্যা নিয়ে গেলে সেটা নেতারা গুরুত্ব দিয়ে দেখেন না৷ বরং তাদের দলের লোকেরা দোষ করলেও ছাড়া পায়৷”
‘পেশার স্বীকৃতি দিতে কোনো রাজনৈতিক দলই এগিয়ে আসে না’
ভোটের আগে সব দলের কাছেই যৌনকর্মীদের সংগঠন তাঁদের দাবিদাওয়া নিয়ে যান৷ মূলত পেশার স্বীকৃতি পাওয়াই বড় দাবি তাদের৷ যৌনকর্মীর সন্তানদের সংগঠন ‘আমরা পদাতিক'-এর সভাপতি রতন দোলুইয়ের মতে, ‘‘বর্তমান সরকারের কাছ থেকে টাকা-পয়সা পেলেও নৈতিক সাপোর্ট কিছু পাইনি৷ শ্রমের মর্যাদা বা পেশার স্বীকৃতি দিতে কোনো রাজনৈতিক দলই এগিয়ে আসে না৷’’
বিশাখা বলেন, "একটা সময় ভিড় বাড়ানোর জন্য আমাদের মিছিলে নিয়ে যাওয়া হত৷ রাজনৈতিক দলগুলো ভোটের কাজে ব্যবহার করে৷ তারপর ভোট মিটে গেলে ছুঁড়ে ফেলে দেয়৷’’
ভোটার কার্ডে সমস্যা
অনেক যৌনকর্মীরই নেই ভোটার কার্ড৷ রাজনৈতিক কর্তারা সে নিয়ে উদাসীন থাকতেই পছন্দ করেন৷ কিন্তু এই ভোটের দিকে নেতাদের নজর নেই কেন? রতন দোলুই বলেন, ‘‘স্বার্থসিদ্ধির জন্য রাজনৈতিক দলগুলোই কাজ করতে ব্যস্ত৷ আর যৌনকর্মীদের কোনো নির্দিষ্ট এলাকা নেই৷ আজ এখানে, কাল ওখানে৷ তাই তাদের ভোট নিয়ে নেতারা মাথা ঘামান না৷’’
নারী অধিকার আন্দোলনের কর্মী অধ্যাপিকা শাশ্বতী ঘোষ বলেন, ‘‘এখানে ভোটার কার্ড অনেকেরই নেই৷ এটা ভাবার কোনো কারণ নেই যে ওঁরা শুধু যৌনকর্মী বলেই প্রশাসন বঞ্চনা করছে৷”
তবে নির্বাচন কমিশনের উদ্যোগে ভোটার কার্ড পেয়েছেন এলাকার অনেকেই৷ গতকালই ১৫০-২০০ জনের মতো ভোটার কার্ড হাতে পেয়েছেন বলে জানান এক বাসিন্দা৷ রেশন কার্ড করানোর জন্যও কোনো রাজনৈতিক সাহায্য পাননি তাঁরা৷
‘ভিড় বাড়ানোর জন্য আমাদের মিছিলে নিয়ে যাওয়া হত’
বিধায়কের কাজে খুশি?
শ্যামপুকুর থানার জোড়াবাগান, রামবাগান, রবীন্দ্রসরণী, শেঠবাগান সব এলাকারই বিধায়ক ডঃ শশী পাঁজা বর্তমানে নারী ও শিশুকল্যাণ দপ্তরের মন্ত্রী৷ কিন্তু সোনাগাছির বাসিন্দাদের অভিযোগ, যৌনকর্মীদের সন্তানদের জীবনযাপনের মানোন্নয়নের জন্য যে সাহায্য দরকার সেটাও পাওয়া যায় না৷ তবে মাঝে মাঝে বিধায়ক তহবিল থেকে স্পোর্টস বা এ ধরনের কিছু অনুদান পাওয়া যায়৷ কিন্তু সোনাগাছির পরিবেশে ছোট ছোট মেয়েদের ভবিষৎ গড়তে যে আন্তরিক সাহায্য দরকার, তা এখনও অধরা৷ কাজল বসু বলেন, ‘‘শশী পাঁজা বা কাউন্সিলর কেউই কিছুই করেন না৷ পুজোর সময় শুধু বিধায়ক একবার এসে একটা শাড়ি আর একটু চাল দিয়েছিলেন৷ লকডাউনেও তিনি কিছুই করেননি৷” তাই ভোটবাক্সে গণতান্ত্রিক অধিকারে ‘নোটা'ই ভরসা? বিশাখা বলেন, "যে আমাদের স্বার্থ দেখবে, তাকেই ভোট দেব৷ তেমন না হলে নোটাই বেছে নেব৷’’
শঙ্কা ও ভয়
সকলেই ভোট দিতে চাইলেও ভোট দেওয়ার পরিবেশ নেই বলেই জানালেন একাধিক যৌনকর্মী৷ ভোটের আগে রাতের অন্ধকারে হুমকি বা ঘরবাড়ি ভেঙে দেওয়া হয়৷ এমন ভয়ের পরিবেশে অনেকেই নতি স্বীকার করে ভোট দিতে যান না৷ আবার তারা ভোট দিতে যাওয়ার আগে তাদের ভোট পড়ে যায় বাক্সে, এমন নজিরও মেলে৷
ভোট মিটলেও কি শান্তি আছে? নাগরিকত্ব আইন নিয়ে এখন অনেকেই শঙ্কিত৷ শিলচরে প্রায় দু'শ যৌনকর্মী নথি দেখাতে পারেননি৷ তাদের ঠাঁই হয়েছে আটক শিবিরে৷ তাই বিপদের আশঙ্কা, ভোট মিটলে নাগরিকত্ব আইন চালু হবে না তো?
যেসব দেশে পতিতাবৃত্তি বৈধ
পতিতাবৃত্তি নাকি পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন পেশা৷ কিন্তু কোনো যুগে, কোনো দেশেই মানুষ বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেনি, আজও করে না৷ তবে বিশ্বের বহু দেশেই পতিতাবৃত্তি বৈধ এবং সেখানে যৌনকর্মীরা নিয়মিত আয়করও দেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa/R. Vennenbernd
হল্যান্ডের ‘পতিতাপল্লী’ পর্যটকদের মূল আকর্ষণ
নেদারল্যান্ডসে পতিতাবৃত্তি শুধু বৈধ নয়, ইউরোপের এই দ্বীপদেশটির পতিতাপল্লী সত্যিকার অর্থেই বিশ্ববিখ্যাত৷ ঐ ‘রেডলাইট জোন’ দেখতে প্রতি বছর বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে হাজার হাজার পর্যটক আসে আমস্টারডামে৷ নেদারল্যান্ডসের মতো ইউরোপের আরেক দেশ বেলজিয়ামেও দেহব্যবসা সম্পূর্ণ বৈধ৷
ছবি: picture-alliance/AP
জার্মানি এবং ফ্রান্সে কঠোর আইন
জার্মানি এবং ফ্রান্সেও দেহব্যবসা বৈধ৷ তবে এ দু’দেশেই যৌনকর্মীদের এই ব্যবসা করতে হয় কঠোর আইন মেনে৷ জার্মানির কিছু শহরে এখনো যৌনকর্মীরা রাস্তায় নেমে খদ্দের ডাকতে পারেন না, এভাবে খদ্দের সংগ্রহ করা সেসব জায়গায় আইনত দণ্ডনীয়৷ ফ্রান্সেও ২০১৪ সালে এমন একটা আইন হয়েছে, যা মেনে যথেচ্ছ দেহব্যবসা করা খুব কঠিন৷
ছবি: picture-alliance/dpa
সুইডেন আর নরওয়েতেও নিয়ন্ত্রিত পতিতাবৃত্তি
ফ্রান্স ২০১৪ সালে যে আইন প্রবর্তন করে, সেটা প্রথম চালু হয়েছিল সুইডেনে, ১৯৯৯ সালে৷ এ কারণে আইনটি ‘সুইডিশ মডেল’ হিসেবে পরিচিত৷ এ আইনে যৌনকর্মীদের অধিকার রক্ষা করে দালালদের নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করা হয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
সুইজারল্যান্ড ও অস্ট্রিয়ায় স্বাস্থ্যপরীক্ষা বাধ্যতামূলক
সুইজারল্যান্ড ও অস্ট্রিয়াতেও দেহব্যবসা বৈধ৷ তবে এ দু’টি দেশে ১৯ বচর বয়স না হলে কেউ দেহব্যবসায় আসতে পারেন না৷ যৌনকর্মীদের যাতে কোনো যৌনরোগ না হয়, কিংবা তাঁদের মাধ্যমে খদ্দেরদের মাধ্যে যাতে এইডস, সিফিলিস বা অন্য কোনো রোগ ছড়াতে না পারে, তা নিশ্চিত করতে যৌনকর্মীদের নিয়মিত স্বাস্থ্যপরীক্ষা করাতে হয়৷ অবশ্য শুধু সুইজারল্যান্ড ও অস্ট্রিয়াতে নয়, জার্মানিতেও ঐ একই নিয়ম৷
ছবি: AFP/Getty Images
গ্রিস এবং তুরস্কে পতিতাবৃত্তি নিয়ন্ত্রিত
গ্রিস এবং তুরস্কেও পতিতাবৃত্তি পুরোপুরি বৈধ, তবে দেহ ব্যবসার আইন খুব কঠিন৷ জার্মানির মতো এই দু’টি দেশেও যৌনকর্মীদের স্বাস্থ্যবীমা করা বাধ্যতামূলক৷ এছাড়া যৌনকর্মীরা নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করান কিনা, তা সবসময় তদারক করা হয়৷ স্বাস্থ্যকার্ডেই লেখা থাকে স্বাস্থপরীক্ষার সব তথ্য৷
ছবি: picture-alliance/dpa/R. Vennenbernd
যে দুই দেশের পতিতাপল্লীতে ধীরে চলা মানা
ব্রিটেন আর আয়ারল্যান্ডের পতিতাপল্লী বা ‘রেড লাইট জোন’-এর প্রায় সব আইনই জার্মানির মতো ছিল৷ তবে সম্প্রতি ব্রিটেনে কিছু বেসরকারি সংস্থার দাবিতে এতে নতুন কিছু বিষয় যোগ করা হয়েছে৷ ব্রিটেনের রেড লাইট জোন-এ এখন যেমন ধীরে গাড়ি চালানো নিষেধ৷
ছবি: picture-alliance/dpa
কাউকে জোর করে পতিতা বানানো যায় না
ইউরোপের সব দেশেই পতিতাবৃত্তি আইনত বৈধ৷ তবে আইন বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেশভেদে একটু হলেও অন্যরকম৷ যেমন স্পেন এবং পর্তুগালেও দেহব্যবসা বৈধ৷ কিন্তু স্পেনে কাউকে জোর করে বা ইচ্ছার বিরুদ্ধে যৌনকর্মী বানানো শাস্তিযোগ্য অপরাধ৷
ছবি: picture-alliance/dpa/A. Dedert
দক্ষিণ অ্যামেরিকায় অন্যরূপ
দক্ষিণ অ্যামেরিকার অধিকাংশ দেশেই যৌনব্যবসা বৈধ৷ তবে কিছু দেশে মাফিয়া এবং মানবপাচার বড় সমস্যা হয়ে ওঠায়, এই ব্যবসার ওপর কড়াকড়ি এবং তদারকি বেড়েছে৷ দেহব্যবসাকে মাফিয়া চক্রের নিয়ন্ত্রণের বাইরে রাখতে ব্রাজিল এবং মেক্সিকোতে রয়েছে কঠোর আইন৷ তারপরও দেশ দু’টিতে মাফিয়া চক্রের আধিপত্য রয়ে গেছে৷
ছবি: Yasuyoshi Chiba/AFP/Getty Images
প্রতিবেশী হয়েও নিউজিল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়া আলাদা
নিউজিল্যান্ডে যৌনব্যবসা একেবারেই বৈধ৷ তবে প্রতিবেশী দেশ অস্ট্রেলিয়ার অনেক রাজ্যে এই ব্যবসা এখনো অবৈধ৷ ২০০৩ সালে আইন করে সব প্রাপ্তবয়স্কের জন্য যৌনব্যবসাকে বৈধ করে দেয় নিউজিল্যান্ড৷
ছবি: picture-alliance / rolf kremming
এশিয়ায় লুকোনো পতিতাবৃত্তি
ভারতের পতিতাবৃত্তি বৈধ৷ তারপরও পতিতাবৃত্তি চলে আড়ালে-আবডালে৷ রাস্তায় নেমে পতিতারা খদ্দের সংগ্রহ করতে পারেন না৷ খদ্দেররা অর্থের বিনিময়ে যৌনক্ষুধা মেটাতে যায় রাতের আঁধারে৷ বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে পতিতালয় কমলেও মাসাজ পার্লার এবং আবাসিক হোটেলে প্রায়ই চলে পুলিশি অভিযান৷ খদ্দেরসহ পতিতা আটকের খবর আসে তখন৷ থাইল্যান্ড ও ফিলিপিন্সে পতিতাবৃত্তি চলে অবাধে৷ তবে দেশ দুটিতে এই ব্যবসা আইনের চোখে অবৈধ৷