সোমালিয়ায় খরা দেখা দিয়েছে৷ পর পর চারটি মৌসুমে বৃষ্টি হয়নি, জন্তুজানোয়ার না খেতে পেয়ে মারা যাচ্ছে, মানুষজন একটু পানির খোঁজে মাইলের পর মাইল পথ হাঁটছেন৷
বিজ্ঞাপন
সোমালিয়ায় এনজিও-র কর্মীদের বিদেশি বলেই মনে করা হয়৷ তবুও এই ত্রাণকর্মীরা সকলকে সাহায্য করার চেষ্টা করেন৷
হর্ন অফ আফ্রিকায় অবস্থিত দেশটি চরম খরার কোপে৷ ত্রাণকর্মীরা পরিস্থিতি যাচাই করার জন্য গ্রামাঞ্চলে যেতে চান৷ কিলোমিটারের পর কিলোমিটার পথ, বেতার সংযোগ ছাড়াই৷
দেওয়াল দিয়ে ঘেরা শিবির ছেড়ে পান্টল্যান্ড প্রদেশে সফরে বেরোতে সাথে সৈন্য নিতে হয়৷ সোমালিয়া একটি ‘ফেল্ড স্টেট’, ব্যর্থ রাষ্ট্র; দেশের বিভিন্ন অংশের মধ্যে যুদ্ধ চলেছে৷ কাজেই নিরাপত্তার জন্য সামনে-পিছনে দু’টি করে আর্মি জিপ৷ তাদের মাঝখানে ত্রাণকর্মীরা৷
খরার কবলে বিপর্যস্ত সোমালিয়া
05:32
এমন একটি এলাকা দিয়ে কনভয়টি যাচ্ছে, যা সাধারণত সবুজ হয়ে থাকার কথা৷ এখন আছে শুধু শুকনো, ধুলো ওঠা মাঠ-প্রান্তর৷ সোমালিয়ায় চরম খরা চলেছে, চার-চারটে বর্ষায় কোনো বৃষ্টি পড়েনি৷ পথের ধারে জীবজন্তু মরে পড়ে রয়েছে৷
খরা ও ক্ষুধা
যাযাবর সম্প্রদায়ের একজন শোনাচ্ছেন, জীবজন্তু মারা গেলে মানুষের কেমন লাগে৷ মরা গরুটির নাম ছিল নাকি নুরা৷ সোমালিয়ায় এমনকি ছাগলদেরও নাম থাকে৷ মরার আগে তাদের মেরে ফেলে মাংস খাবার উপায় ছিল না, কেননা ক্ষুধার্ত জীবগুলি রোগে ভোগে৷
পশুপালক আবশিদ হের্শি নুর বললেন, ‘‘অবশ্যই আমি ক্ষুধার্ত – আর শুধু আমিই নই, আমার পরিবার, আমার ছেলেমেয়ে, সবাই ক্ষুধার্ত৷ এখন এখানকার সকলেরই এই অবস্থা – কিন্তু বিশ্বাস করুন, আমি যখন আমার ছেলেমেয়েদের ক্ষুধার্ত দেখি, তখন যেন আমার নিজের খিদে বেড়ে যায়৷’’
বিশ্বে পানীয় জল কমে আসছে
প্রতিবছরের মতো এ বছরও স্টকহোমে ২৮শে আগস্ট থেকে দোসরা সেপ্টেম্বর অবধি বিশ্ব পানি সপ্তাহ উপলক্ষ্যে পানি বিশেষজ্ঞদের বৈঠক বসেছে৷ মানুষের বিশুদ্ধ পানির প্রয়োজন, বিশ্বের সব জায়গায় যেটা মেলে না৷
ছবি: picture alliance/WILDLIFE
পানি অনেক, তবে পান করার মতো নয়
পানি বা জলের অন্য নাম জীবন৷ জল ছাড়া মানুষ বাঁচতে পারে না৷ ভূ-পৃষ্ঠের ৭০ ভাগ পানিতে ঢাকা হলেও, সেই পানির মাত্র আড়াই শতাংশ পানের উপযোগী৷ আবার বিশ্বের মিষ্টজলের ভাণ্ডারের মাত্র ৩০০ ভাগের এক ভাগ পাওয়া যায় নদী-পুকুর-খালে-বিলে৷ বাকিটা অত সহজে পাবার উপায় নেই৷
ছবি: AFP/Getty Images
আরো বেশি মানুষের আরো বেশি পানির চাহিদা
১৯৫০ সালের পর থেকে বিশ্বব্যাপী পানির প্রয়োজন বেড়েছে প্রায় ৪০ শতাংশ৷ বিশ্বের জনসংখ্যা যত বাড়বে, পানির চাহিদা ততই বেড়ে যাবে৷ মিষ্টজলের মাত্রাধিক ব্যবহারের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে দূষণ, যার ফলে বিশেষ করে দক্ষিণ গোলার্ধে বিশুদ্ধ পানি পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ছে৷
ছবি: Reuters/P. Bulawayo
অ্যামাজনের মতো নদী থাকা সত্ত্বেও পানি নেই
বিশ্বে সবচেয়ে বেশি মিষ্টজল বয়ে নিয়ে যায় অ্যামাজন নদী৷ সেই নদী চলে গিয়েছে ব্রাজিলের মধ্য দিয়ে৷ তা সত্ত্বেও ব্রাজিলে জলাভাব৷ অ্যামাজন এলাকার বৃষ্টিপ্রধান অরণ্য কেটে ফেলার ফলে দক্ষিণ অ্যামেরিকার আবহাওয়ার পরিবর্তন ঘটছে; দেশের বাদবাকি অঞ্চলে বৃষ্টি কম হচ্ছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/M. Brandt
চরম খরা
২০১৫ সালে অনাবৃষ্টির ফলে ব্রাজিলে গত ৮০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে ভয়ানক খরা দেখা দেয়৷ সারা গ্রীষ্ম ধরে এক ফোঁটা বৃষ্টি পড়েনি৷ বড় বড় বাঁধে কোনো জল ছিল না৷ সাও পাওলোর মানুষদের জন্য পানির সরবরাহ মাঝেমধ্যে বেশ কয়েক দিনের জন্য বন্ধ রাখতে হয়েছে৷ ওদিকে বড় বড় খামার ও ফলের বাগানে যথারীতি জল সরবরাহ করা হচ্ছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/Aaron Cadena Ovalle
যে ফসল ফলাতে প্রচুর পানি লাগে
ইউরোপেও সে সমস্যা আছে, বিশেষ করে স্পেনে, যেখানে প্রায় ৩০ হাজার হেক্টার জমি জুড়ে ফল ও শাকসবজির চাষ করা হয়৷ এ কাজে প্রায়ই বেআইনিভাবে পানীয় জলের কুয়ো থেকে পানি তোলা হয়, যার ফলে কুয়োগুলি শুকিয়ে যায় অথবা লবণাক্ত হয়ে পড়ে৷ ভূগর্ভস্থ পানি পরিশোধনে প্রচুর টাকা লাগে, যা সরকারি ভরতুকি ছাড়া সম্ভব নয়৷
ছবি: picture-alliance/dpa/B.Marks
এক কিলোগ্রাম মাংসের জন্য ১৫,৪০০ লিটার পানি
মাংসের জন্য পশুপালনে বিপুল পরিমাণ পানি খরচ হয়৷ শেষমেশ এক কিলো মাংস পেতে মোট পানি খরচ হয় ১৫ হাজার ৪০০ লিটার, অঙ্ক করে দেখেছেন বিজ্ঞানীরা৷ বিশেষ করে ক্যাটল ফডার অর্থাৎ গরুর খাবারের চাষ করতে প্রচুর পানি লাগে৷ ওদিকে চীনের মতো দেশে সমৃদ্ধি যত হচ্ছে, ততই আমিষ খাওয়ার প্রবণতা বেড়ে চলেছে৷
অর্ধেক চীন জুড়ে খাল
বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশে ইতিমধ্যেই পানির সমস্যা দেখা দিয়েছে৷ উত্তর চীনের কিছু কিছু প্রদেশে নাকি বাসিন্দারা মাথা পিছু যে পরিমাণ পানীয় জল পেয়ে থাকেন, তা মধ্যপ্রাচ্যের মরুভূমি এলাকার চেয়েও কম৷ এ কারণে চীন দক্ষিণ থেকে উত্তরে মিষ্টজল নিয়ে যাওয়ার জন্য একাধিক বড় বড় খাল কাটাচ্ছে সরকার৷ ওদিকে চীনে ভূগর্ভস্থ পানির ৮০ শতাংশই নাকি দূষিত৷
ছবি: picture alliance/AP Images/Ma jian
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে পানি-সংকট আরো বাড়বে
আরো চল্লিশ শতাংশ বেশি মানুষের জলকষ্ট দেখা দেবে, বলছেন বিজ্ঞানীরা৷ বিশেষ করে দক্ষিণ চীন, যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণাঞ্চল, মধ্যপ্রাচ্য ও ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে জলাভাব দেখা দেবে৷
ছবি: picture alliance/WILDLIFE
8 ছবি1 | 8
হের্শি ১৫টি ছাগল বাঁচাতে পেরেছেন৷ তিনি তাদের গাড়িতে করে ৩০০ কিলোমিটার উত্তরে নিয়ে গেছেন, গাড়িভাড়ার টাকা ধার করে৷ ও অঞ্চলে এখনও ঘাসপাতা আছে৷ কাজেই খরা শেষ হলে হের্শিকে আবার শূন্য থেকে শুরু করতে হবে না৷
পানির রেশন
গাড়ির বহর যেখান দিয়েই যাক, দিগন্তে শুধু ভাঙাচোরা কুটির – খোলা মাঠের মাঝখানে৷ ইতিমধ্যে সোমালিয়ায় শত শত এ ধরনের শিবির আছে – প্রতিদিন আরো বেশি যাযাবর পরিবার এসে পৌঁছান৷ তারা চারণভূমি খুঁজে পাবার আশা পরিত্যাগ করেছেন, তাদের জন্তুজানোয়ার সব না খেতে পেয়ে মরেছে৷ এখানে অন্তত পানি আছে – ত্রাণ সংগঠনগুলি সপ্তাহে দু’বার করে পানি দিয়ে যায়৷
কড়া রেশন করে পানি দেওয়া হয়৷ পানি বণ্টন চলাকালীন কে একজন জোর করে লাইনে ঢুকে পড়ার ফলে ধস্তাধস্তি শুরু হয়েছে৷ এক ক্যানিস্টার পানিতে তিন দিন কাজ চালাতে হবে – তা সে পরিবারে যতজন মানুষই থাক না কেন৷
এক কিলোমিটার দূরের গ্রামেও প্রায় আর কিছুই নেই: কুয়োতে পানি আছে বটে, কিন্তু অতি নোংরা৷ শিবির থেকে উদ্বাস্তুরা প্রায়ই এখানে আসেন৷ কপাল ভালো থাকলে উদ্বাস্তুরা মাসে ১০০ ডলার পান: মোবাইল ফোনে ট্রান্সফার করা ডিজিটাল টাকা৷ গ্রামে সেই টাকা দিয়ে চাল আর তেল কেনা যায়, নিত্যপ্রয়োজনীয় বস্তু৷ অন্তত এ পর্যন্ত৷
ভয়াবহ খরায় কেনিয়ায় রোগ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা
গত ৫ বছরের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ খরা চলছে কেনিয়ায়৷ সরকার জানিয়েছে, ২৭ লাখ মানুষ খরার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত৷ অনুর্বর এলাকাগুলোতে ২০ শতাংশ পশু মারা গেছে৷ উত্তরাঞ্চলে গ্রামবাসীরা পশুর মৃতদেহ পোড়াচ্ছে যাতে রোগজীবাণু ছড়িয়ে না পড়ে৷
ছবি: Reuters/G.Tomasevic
তুর্কানা উপজাতিদের গ্রাম
কেনিয়ার লইয়ানগালানির কাছে তুর্কানা উপজাতিদের গ্রামটির দৃশ্য৷
ছবি: Reuters/G.Tomasevic
পোড়ানোর জন্য মৃতদেহ সংগ্রহ
তুর্কানা উপজাতির এক পুরুষ ছাগলের মৃতদেহ পোড়ানোর জন্য নিকটবর্তী গ্রামে নিয়ে যাচ্ছে৷
ছবি: Reuters/G.Tomasevic
আশ্রয়স্থল
লইয়ানগালানির কাছের একটি গ্রামে শিশু কোলে দাঁড়িয়ে আছেন তুর্কানা উপজাতির এক নারী৷
ছবি: Reuters/G.Tomasevic
পানি সংগ্রহ
লইয়ানগালানির কাছের একটি গ্রাম থেকে একটি টিনে করে পানি নিয়ে যাচ্ছেন এক নারী৷ কেনিয়া সরকার জানিয়েছে, সেদেশে ২৭ লাখ মানুষ খরার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে৷
ছবি: Reuters/G.Tomasevic
পশু পালন যাদের জীবিকার উৎস
তুর্কানা’র মানুষরা পশু পালন করেই জীবন ধারণ করেন৷ পশু মজুদ এবং পশু পালন তাদের সম্পদের মূল উৎস৷ এত পশুর মৃত্যু তাদের জন্য ভয়াবহ একটা ক্ষতি৷
ছবি: Reuters/G.Tomasevic
‘ডেস্টকিং’ কর্মসূচি
লেক তুর্কানার সৈকতে একটি নৌকা বাঁধা৷ সেদিকে হেঁটে যাচ্ছে কয়েকটি গাধা৷ সরকার ‘ডেস্টকিং’ কর্মসূচি শুরু করেছে৷ যেসব পশুপালক তাদের পশু বেচতে পারছে না, এই কর্মসূচিতে তাদের অর্থ দেয়া হয়৷ প্রতিটি ছাগল বা ভেড়ার জন্য দেয়া হয় কমপক্ষে ২০ ডলার, যা একটি স্বাস্থ্যবান পশুর দামের অর্ধেক৷
ছবি: Reuters/G.Tomasevic
এখানে সেখানে পশুর মৃতদেহ
একই এলাকায় পড়ে আছে একটি ছাগলের মৃতদেহ৷
ছবি: Reuters/G.Tomasevic
শিশুরাও নেমেছে পশুর মৃতদেহ সংগ্রহে
কেবল প্রাপ্তবয়স্করাই নন, শিশুরাও পশুদের মৃতদেহ সংগ্রহ করে তা পোড়াতে সাহায্য করছে৷
ছবি: Reuters/G.Tomasevic
ছাগলের মৃতদেহ নিয়ে যাচ্ছে এক শিশু
এখানে ছাগলের মৃতদেহ নিয়ে যাচ্ছে এক শিশু৷
ছবি: Reuters/G. Tomsevic
মানুষের জীবন বিপন্ন
খরার কবলে অনেক মানুষেরই জীবন বিপন্ন৷ একটি ঝোপের পাশে বসে আছে এক উপজাতি পুরুষ৷ বেশ অসুস্থ তিনি৷
ছবি: Reuters/G.Tomasevic
পশুর মৃতদেহ পোড়ানো
একই এলাকায় ছাগলের মৃতদেহ পোড়ানো হচ্ছে৷ আর সেখান দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে এক উপজাতি পুরুষ৷ কেনিয়ার উত্তরাঞ্চলে মারা যাওয়া সব পশুর দেহ স্তূপ করে পোড়ানো হচ্ছে, কেননা, এসব মৃতদেহ পঁচে রোগ জীবাণু ছড়াচ্ছে৷
ছবি: Reuters/G.Tomasevic
11 ছবি1 | 11
ভ্রাম্যমান ডাক্তার
উদ্বাস্তু শিবিরে ফেরার পর দেখা গেল ভ্রাম্যমাণ চিকিৎসা ভ্যানটি এখানে এসেছে৷ তাঁবুর নীচে ডাক্তার বসেছেন – সে খবর দূরদূরান্তে পৌঁছে গেছে৷ অনেকে এখানে এসেছেন রুগ্ন, আধমরা বাচ্চাদের কোলে নিয়ে৷ সবাই ধৈর্য্য ধরে অপেক্ষা করছেন৷ শুধু চিকিৎসা নয়, কচিকাঁচারা কিছু খেতে পাবে, সে আশাও আছে৷
ভ্রাম্যমান চিকিৎসা দলের ডাক্তার বাশির সুইয়ালে মুসে বললেন, ‘‘অধিকাংশ বাচ্চার বুক ভর্তি সর্দি, পেটে কৃমি৷ প্রায় সকলেই অপুষ্টিতে ভুগছে৷ খুব কম বাচ্চাই পরিষ্কার পানি পায় – আমরা খেয়াল না রাখলে যে কোনো সময় কলেরা শুরু হতে পারে৷’’
ত্রাণকর্মীরা বেশিক্ষণের জন্য থাকতে পারেন না৷ যেটুকু পারেন করেন, যেটুকু পারেন, দেখেন৷ তারপর আবার দিগন্ত পর্যন্ত ধুলো আর বালি৷
২০০ কিলোমিটার উত্তরে ধুবো গ্রামটি কিন্তু একটি মরুদ্যানের মতো, যদিও খুব কম মানুষই সেই পানির উৎস পর্যন্ত পৌঁছাতে পারেন৷ সাধারণত এখানে আরো দেড়-দু'হাত বেশি জল থাকে৷ এই পর্যন্ত যারা পৌঁছেছেন, তারা প্রথমে তাদের জন্তুজানোয়ারদের জল খেতে দেন৷ পারলে সকলেই এখানে থেকে যেতেন, কিন্তু তা হবার উপায় নেই৷
ধুবোতেও স্বল্পক্ষণের জন্য থামা৷ ত্রাণকর্মীর গাড়ির বহরকে সন্ধ্যে নামার আগেই গারোভেতে তাদের ক্যাম্পে ফিরে আসতে হবে – গারোভে হলো সোমালিয়ার উত্তরে পান্টল্যান্ড প্রদেশের রাজধানী৷