সোলেইমানি হত্যা: ক্ষমতার খেলায় কি পিছিয়ে পড়বেন পুটিন
৭ জানুয়ারি ২০২০
মধ্যপ্রাচ্যে আধিপত্য রাখতে ইরান, সিরিয়া ও তুরস্কের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা রেখেছেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুটিন৷ ক্ষমতার এ খেলায় তার সবচেয়ে বড় অস্ত্র ইরান৷ কিন্তু দেশটির সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধাবস্থা তাকে বেকায়দায় ফেলেছে৷
বিজ্ঞাপন
যুক্তরাষ্ট্রের ড্রোন হামলায় ইরানের কুদস বাহিনীর প্রধান কাসিম সোলেইমানি নিহতের পর বিশ্ব রাজনীতিতে পুটিনের অবস্থান নিয়ে লিখেছেন রাশিয়ার সাংবাদিক ও রাজনীতি বিশ্লেষক কোনসটানটিন ইগের্ট৷
রাশিয়া জুড়ে অর্থরডক্স ক্রিসমাস উৎসব চলছে৷ কিন্তু উৎসব আমেজে দিন কাটাতে পারছেন না পুটিন৷ ক্রিসমাসের মাত্র তিনদিন আগে ইরানের দ্বিতীয় প্রভাবশালী ব্যক্তি সোলেইমানি হত্যা পুরো মধ্যপ্রাচ্যেকে ভয়ঙ্কর এক যুদ্ধ পরিস্থিতির সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে৷ সোলেইমানিকে খুব ভালো করেই চিনতেন পুটিন৷ রাশিয়া-ইরান বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরিতে যিনি মুখ্য ভূমিকায় ছিলেন৷ ইরানকে ব্যবহার করে আরেক মিত্র সিরিয়ার বাশার আল আসাদের ক্ষমতায় থাকা নিশ্চিত করেছেন পুটিন৷ কিন্তু সিরিয়ায় সফল হলেও খোদ ইরানকে নিয়ে এবার বিপাকে রাশিয়া৷
শুধু সোলেইমানিকে হত্যা করেই নয় বরং ইরানের সামরিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক স্থাপনাগুলো বোমা মেরে উড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়ে যুদ্ধের দামামা বাজিয়ে ফেলেছেন ডনাল্ড ট্রাম্প৷ মার্কিন প্রেসিডেন্টের ওই তালিকায় পবিত্র নগরী কোমের নামও নিশ্চয়ই আছে৷ ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতোল্লাহ আলী খামেনি কোমে বসবাস করেন৷
যুদ্ধ হলে কী হবে?
পুটিন ও খামেনি উভয়ের লক্ষ্য ক্ষমতায় টিকে থাকা৷ যদিও এখন পুটিনকে ক্ষমতা থেকে সরানো অ্যামেরিকার কম্ম না৷ কিন্তু সোলেইমানিকে হত্যা করে রাশিয়াকে কিছুটা চিন্তায় ফেলতে পেরেছেন ট্রাম্প৷
এ ঘটনায় রাশিয়ার অবস্থান দুইরকম হতে পারে৷ এক, অ্যামেরিকা-ইরান যুদ্ধ শুরু হলে বিশ্ববাজারে তেলের দাম বাড়বে৷ যার সুবিধা নিতে পারবে তেলসমৃদ্ধ দেশ রাশিয়া৷ এছাড়া তেহরান তখন বাধ্য হবে মস্কোর কাছ থেকে অস্ত্র কিনতে এবং নতুন নতুন চুক্তি করতে৷
কিন্তু সেক্ষেত্রে পুটিনকে হয়তো মিত্র ইরানের পাশে দাঁড়াতে হবে; ঝুঁকি বাড়বে অ্যামেরিকার সঙ্গে সামরিক লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়ার, বাড়বে মার্কিন নিষেধাজ্ঞার চাপ৷ সৌদি আবর ও ইসরায়েলের সঙ্গে কষ্টে গড়া সম্পর্কের অবনতিও হবে৷ তবে সব কিছু ছাপিয়ে অ্যামেরিকার সঙ্গে ইরানের যুদ্ধ জয়ের কোনো সুযোগ আসলে নেই৷
অথবা, পুটিন নিবরে ইরানকে সামরিক ও অর্থনৈতিকভাবে অ্যামেরিকার যাঁতাকলে পিষ্ট হতে দেখতে পারেন৷ তা তেহরানে ক্ষমতায় নিশ্চিত পরিবর্ত আসবে৷ কারণ যুদ্ধে হেরে যাওয়া সরকার জনগণের আস্থা হারাবে৷ নতুন সরকার স্বাভাবিকভাবে অ্যামেরিকার সঙ্গে সম্পর্ক ভালো করতে চাইবে৷ মস্কোর সঙ্গে দেশটির বর্তমান মাখামাখি আর থাকবে না৷ মস্কো তখন শুধু গুরুত্বপূর্ণ মিত্রই হারাবে না বরং ইসরায়েল ও সৌদি আরব আর পুটিনকে পাত্তা দেবে না৷ মোদ্দা কথা ক্ষমতার খেলায় মধ্যপ্রাচ্যে প্রভাব হারাবে রাশিয়া৷
এ পরিস্থিতিতে পুটিনের জন্য সবচেয়ে নিরাপদ ইরানকে যুদ্ধ থেকে সরিয়ে আনা৷ একাজে তিনি জার্মানির চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল ও তুরস্কের রেচেপ তাইয়্যিপ এর্দোয়ানকে পাশে পেতে পারেন৷ ম্যার্কেল ও এর্দোয়ান উভয়ই মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ আটকাতে চান এবং শিগগিরই দুই নেতা বৈঠক করবেন৷ যদি তাদের এই উদ্যোগ শেষ পর্যন্ত ভেস্তে যায় তবে পুটিন তার নিজের রচনা করা নাটকে দর্শকে আসনে চলে যাবেন৷
ইরান-যুক্তরাষ্ট্র: বন্ধু থেকে শত্রু
একটা সময়ে মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বিশ্বস্ত বন্ধু ছিল ইরান৷ সেখান থেকে চিরশত্রুতায় রূপ নিয়েছে তাদের সম্পর্ক৷ কীভাবে এই মেরুকরণ ঘটল দেখুন ছবিঘরে৷
ছবি: gemeinfrei
ইরানের সরকার উৎখাত
১৯৫১ সালে ইরানের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন মোহাম্মদ মোসাদ্দেক৷ তিনি ব্রিটিশদের কাছ থেকে দেশটির তেল সম্পদ জাতীয়করণ করেন৷ ১৯৫৩ সালে ব্রিটিশ গোয়েন্দা সংস্থা এমআই সিক্স এবং এবং মার্কিন সিআইএ ক্যু ঘটিয়ে মোসাদ্দেককে উৎখাত করে৷
ছবি: picture-alliance/CPA Media Co. Ltd
শাহের ক্ষমতা আরোহন
মোসাদ্দেকের পতনের পর ক্ষমতায় ফেরেন ইরানের নির্বাসিত শেষ সম্রাট রেজা শাহ পাহলভি৷ পরবর্তী দুই দশক ইরানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের গড়ে ওঠে নিবিড় বন্ধুত্ব৷ এক পর্যায়ে মার্কিন অস্ত্রের সবচেয়ে বড় ক্রেতায় পরিণত হয় পারস্য উপসাগরের দেশটি৷ যুক্তরাষ্ট্রের কোন অনুরোধই এসময় ফেলেননি শাহ, এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার৷
ছবি: gemeinfrei
ইসলামী বিপ্লব
শাহের আমলে ইরানের তেল ব্যবসায় প্রায় একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ ছিল ব্রিটিশ ও অ্যামেরিকান কোম্পানিগুলোর৷ ইরানি জনগণের মধ্যে রাজতন্ত্রবিরোধী ক্ষোভ দানা বাঁধতে শুরু করে৷ ১৯৭৯ সালের ১৬ জানুয়ারি দেশ ছাড়তে বাধ্য হন রেজা শাহ পাহলভি৷
ছবি: Getty Images/Afp
খোমেনির ফেরা
দুই সপ্তাহ পর দেশে ফেরেন নির্বাসিত নেতা আয়াতোল্লাহ খোমেনি৷ তিনি ইরানের ‘ইসলামি বিপ্লবের’ নেতৃত্ব দেন৷ কিছুদিনের মধ্যেই দেশটির ছাত্ররা তেহরানে মার্কিন দূতাবাস দখল করে৷ ৪৪৪ দিনের জন্য বন্দী হয় ৫২ অ্যামেরিকান৷
ছবি: picture-alliance/dpa/AFP/G. Duval
প্রথম অবরোধ
বন্দী সঙ্কটের সমাধান না হওয়ায় ইরানের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদের ঘোষণা দেন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার৷ দেশটিতে মার্কিন পণ্য রপ্তানি ও তেল আমদানির উপর নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়৷ জব্দ করা হয় ইরানের ১২ বিলিয়ন ডলারের সম্পদ৷ বের করে দেয়া কূটনীতিকদের৷
ছবি: Imago/ZumaPress
ইরাক-ইরান যুদ্ধ
এক বছরেরও কম সময়ের মধ্যে ইরান আক্রমণ করে সাদ্দাম হুসেন৷ যুদ্ধ চলাকালে ইরাককে গোয়েন্দা প্রতিবেদন, অর্থ, সামরিক প্রযুক্তি এমনকি রাসায়নিক অস্ত্রও সরবরাহ করে যুক্তরাষ্ট্র৷ এই যুদ্ধ চলে আট বছর৷ এসময় লেবাননে ইরানের সমর্থিত হেজবুল্লাহ গোষ্ঠীর হামলায় বৈরুতের একটি ব্যারাকে ২৪৪ অ্যামেরিকান নিহত হয়৷
ছবি: picture-alliance/Bildarchiv
ইরানের বিমানে হামলা
১৯৮৮ সালে পারস্য উপসাগরে ইরানের একটি যাত্রিবাহী বিমানে হামলা চালায় যুক্তরাষ্ট্র৷ নিহত হয় ইরানের ২৯০ জন যাত্রী৷ একে দুর্ঘটনা হিসেবে অভিহিত করেন তৎকালীন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রেগান৷ এই ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্র-ইরান সম্পর্ক আরও তিক্ততায় রূপ নেয়৷
ছবি: picture alliance/dpa/A. Taherkenareh
নতুন অবরোধ
ইরান সন্ত্রাসীদের মদত দেয়ার পাশাপাশি পরমাণু অস্ত্র তৈরির চেষ্টা করছে, এমন অভিযোগে দেশটিকে একঘরে করার জন্য প্রচার চালায় ক্লিনটন প্রশাসন৷ ১৯৯৬ সালে বিদেশি কোম্পানিগুলোর ইরানে বিনিয়োগের উপর নিষেধাজ্ঞা দেয় ওয়াশিংটন৷
ছবি: AP
সম্পর্ক সহজীকরণ
১৯৯৮ থেকে পরবর্তী দুই বছর মোহাম্মদ খাতামি সরকারের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার আগ্রহ প্রকাশ করে ক্লিনটন প্রশাসন৷ এজন্য রোডম্যাপও ঘোষণা করা হয়৷ খাতামি দুই দেশের মধ্যে সাংস্কৃতিক বিনিময়ের প্রস্তাব দেন৷ ২০০০ সালে যুক্তরাষ্ট্র ইরানের পণ্য আমদানির উপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়৷
ছবি: AP
পরমাণু আকাঙ্ক্ষা
২০০৫ সালে আহমদিনেজাদের শাসনামলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইরানের সম্পর্কের আবারও অবনতি ঘটে৷ ইরান এসময় পরমাণু কার্যক্রম শুরু করে৷ বুশ ইরানকে সন্ত্রাসের রপ্তানিকারক হিসেবে অ্যাখ্যায়িত করেন৷ তবে ২০১৫ সালে ওবামা যুক্তরাষ্ট্র ও জোট রাষ্ট্রগুলোর সাথে ইরানের পরমাণু কার্যক্রম স্থগিতকরণ চুক্তিতে বৈরিতার সেই বরফ কিছুটা গলে৷
ছবি: AP
যুদ্ধের দামামা
২০১৮ সালে ইরানের সঙ্গে পরমানু চুক্তি বাতিল করে ডনাল্ড ট্রাম্প৷ ইরানের উপর চাপ প্রয়োগ করতে নতুন করে অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করে ওয়াশিংটন৷ দুই দেশের প্রক্সি ওয়ার অনেকটাই যুদ্ধাবস্থায় রূপ নিয়েছে চলতি বছরের তিন জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্র ইরানের জেনারেল কাসিম সোলেইমানিকে হত্যার পর৷