1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

চ্যালেঞ্জের মুখে পুজো সাহিত্য

পায়েল সামন্ত কলকাতা
১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৭

পুজো এসে যাওয়া মানেই খবরের কাগজের হকার বন্ধুর কাছে একটা বাড়তি আবদার জমা হওয়া — বাড়ির সক্কলের চোখ এড়িয়ে পূজাবার্ষিকীটা যেন আমার হাতেই এসে পড়ে৷ কাকাবাবু, মিতিনমাসি, অর্জুন, পাণ্ডব গোয়েন্দারা সব অপেক্ষায় আছে যে!

ছবি: DW/P.Samanta

যুগটা এমনই ছিল৷ কিন্তু হঠাৎ যেন পাল্টে গেছে অনেক কিছু৷ সেইসব খুদেদের হাতে এখন পূজাবার্ষিকীর বদলে উঠে এসেছে অনলাইন গেম, কার্টুন আর সোশ্যাল নেটওয়ার্কিংয়ের ভার্চুয়াল জগৎ৷ তারা নতুন জামার মতো আর অপেক্ষা করে না শারদীয়া সংখ্যার জন্য৷ এই পরিবর্তনটা শুধু শিশুদের নয়, এসেছে বড়দের মধ্যেও৷ মুঠোয় ধরে থাকা স্মার্টফোনে বিশ্বজগতের সব অচেনাকে চেনা আর দুর্লভকে সুলভ করার বৃত্ত থেকে রেহাই নেই যে কারও! অথচ এই ই-যুগেও পুজোর চার-পাঁচ মাস আগে থেকে বড় বড় পত্রিকা গোষ্ঠী পুজোসংখ্যার বিজ্ঞাপন দিতে শুরু করে৷ কিন্তু, সেই বিজ্ঞাপন দেখে ক'জন আর শারদীয় সাহিত্য কেনেন?  

বাংলার পুজো সাহিত্যের এতদিনের ঐতিহ্যের এহেন অবস্থা কেন? ডয়চে ভেলে খোঁজ নিতে পৌঁছে গিয়েছিল লেখক, সম্পাদক থেকে প্রকাশক, পাঠকের কাছেও৷ কী বলছেন তাঁরা?

‘বাবা-মায়েরাই ছেলেমেয়েদের বই কেনায় উৎসাহ দিচ্ছেন না’

This browser does not support the audio element.

দীর্ঘদিন ধরেই বাংলা ছোটগল্পের চর্চা করেন সাহিত্যিক গৌর বৈরাগী৷ চন্দননগরে ‘গল্পমেলা’ নামের একটি সংগঠনে তিনি নিয়মিত ছোট ও বড়দের গল্প লেখানোর কর্মশালা করে আসছেন৷ বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে তিনি শঙ্কিত৷ ব্লু হোয়েলের মারণ থাবায় ছোটরা যে আক্রান্ত হচ্ছে, তার জন্য তিনি বইকে নির্বাসন দেওয়ার হাল আমলের প্রবণতাকে দায়ী করছেন৷ ছোটদের খেলার মাঠ বা গল্পের বই আর টানে না৷ তবে গৌর বৈরাগী এ জন্য শুধু বিনোদনের পসরা বা তার আকর্ষণকে দায়ী করতে রাজি নন৷ তিনি দূষছেন অভিভাবকদেরও৷ গৌর বৈরাগীর মন্তব্য, ‘‘বাবা-মায়েরাই ছেলেমেয়েদের বই কেনায় উৎসাহ দিচ্ছেন না৷ ছোটরা একটি বই পছন্দ করলে, তার দাম যদি হয় ২৫০ টাকা, তখন অভিভাবকেরা আঁতকে ওঠেন৷ অথচ তার আগেই হয়তো ওই বাবা-মা শিশুটিকে আড়াই হাজার টাকার পোশাক কিনে দিয়েছেন৷’’

শিশুদের মধ্যে বিনোদনের যে সংক্রমণ, তার ছোঁয়াচ বড়দেরও লাগবে, এটাই স্বাভাবিক৷ তবে এ সময়ের সাহিত্যিক সঙ্গীতা বন্দ্যোপাধ্যায় একইভাবে সোশ্যাল মিডিয়ার ঘাড়ে সব দোষটা চাপাতে চাইছেন না৷ তাঁর কন্ঠে বরং আত্মসমালোচনার সুর৷ তিনি বলেন, ‘‘সাধারণ মানুষ বই কিনে কেন পড়বে? ভালো লেখা নেই বলেই পড়ার অভ্যেস কমে যাচ্ছে৷ এখন যাঁরা লেখেন, তাঁদের মধ্যে দু -তিনজনকে বাদ দিলে বাকীরা নেহাতই ছাপোষা লেখক৷ তাঁরা নিজেদের লেখার বস্তু সেই মধ্যবিত্ত জীবনের গণ্ডীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখেন৷ একুশ শতকের গ্লোবাল বাঙালি সেই একঘেয়ে লেখা পড়বে কেন? যাঁরা লিখছেন, তাঁরা নতুন বিষয় নিয়ে ভাবছেন না৷ তাঁদের লেখায় এই সময়ের উপযোগী ভাবনা চিন্তা ধরা পড়ছে না৷ তাই পাঠকরা উৎসাহ হারাচ্ছেন৷ এ কথা বলে লাভ নেই৷’’

‘‘সাধারণ মানুষ বই কিনে কেন পড়বে?’’

This browser does not support the audio element.

সভ্যতার অগ্রগমন পাঠকের সঙ্গে লেখকের দূরত্ব তৈরি করেছে, এমনটাই মনে করেন  সঙ্গীতা৷ এরই ফল ভোগ করছে বাঙালির পুজোসাহিত্য৷ এখন অবসর বা একাকীত্ব বলে কিছু নেই৷ সোশ্যাল মিডিয়ার দাক্ষিণ্যে পাঠকদের আত্মপ্রকাশের জায়গা অনেক৷ তাঁর ভাষায়, ‘‘আগে আত্মপ্রকাশের জায়গাটা ছিল সাহিত্য৷ এখন মাংস রান্না করে সেটাও প্রকাশের জায়গা রয়েছে৷ সেই অর্থে ফাঁকা সময় বলে কিছু নেই৷ ইনভলভ হওয়ার মতো অনেক কিছু আছে৷ তবুও আমি বলব এসব সোশ্যাল মিডিয়া থাকা সত্ত্বেও ভালো লেখা থাকলে মানুষ পড়বেই৷’’

সঙ্গীতা বন্দ্যোপাধ্যায় লেখার গুণমান নিয়ে যে প্রশ্ন তুলেছেন, তাঁর সঙ্গে একমত সাহিত্যিক ও পশ্চিমবঙ্গের বহুল প্রচারিত ‘সাপ্তাহিক বর্তমান’ পত্রিকার সম্পাদক জয়ন্ত দে৷ পত্রিকার দপ্তরে আসা নামি-অনামি লেখকদের গল্প পড়ে তাঁকে পত্রিকার জন্য বাছাই করতে হয়৷ তিনি বলেন, ‘‘গুণমান কমেছে একথা অস্বীকার করার উপায় নেই৷ অতীতের দিকপাল সাহিত্যিকরাও আজ নেই৷ পাঠকের আগ্রহ কমার সেটা একটা কারণ তো বটেই৷ তবে বিনোদনের বিকল্প উপায় আমাদের এতই গ্রাস করছে যে, বই পড়ার আর সময় থাকছে না৷ এই সত্যিটাও অস্বীকার করার উপায় নেই৷ এখন একজন লেখকের প্রতিদ্বন্দ্বী আরেকজন লেখক নন৷ তাঁকে লড়তে হয় ইনস্টাগ্রাম, ফেসবুকের সঙ্গে৷’’

‘‘এখন একজন লেখকের প্রতিদ্বন্দ্বী আরেকজন লেখক নন৷ তাঁকে লড়তে হয় ইনস্টাগ্রাম, ফেসবুকের সঙ্গে’’

This browser does not support the audio element.

কলকাতা থেকে প্রকাশিত একগুচ্ছ পূজাবার্ষিকীর মধ্যে জয়ন্ত দে সম্পাদিত পত্রিকাটির বিক্রি বিপুল৷ তা সত্ত্বেও সমকালীন সাহিত্য নিয়ে তাঁর গলায় এমন হতাশা কেন? কার্যত আত্মসমালোচনা করেই তিনি বলেন, ‘‘আগে সংবাদপত্র বা পত্রিকাগোষ্ঠী লেখককে দাঁড়ানোর সুযোগ করে দিত৷ মালিকপক্ষ নবীণ লেখকদের উৎসাহ দিতো৷ এখন পত্রিকাগোষ্ঠীগুলি এই প্রজন্মের লেখকদের সেভাবে আর পৃষ্ঠপোষকতা করেন না৷ তাহলে কীভাবে সমকালীন সাহিত্য সমৃদ্ধ হবে?’’

বাংলা সাহিত্যে পূজোবার্ষিকীর প্রসঙ্গ উঠলেই, যে প্রকাশনা সংস্থাটির নাম অনিবার্যভাবে উঠে আসে, তার নাম দেব সাহিত্য কুটির৷ ‘শুকতারা' ও ‘নবকল্লোল' ছাড়াও এই সংস্থা আলাদা পূজাবার্ষিকী বের করতো৷ এখন আর নতুন পূজাবার্ষিকী প্রকাশিত হয় না৷ সেই পুরনো সংখ্যাগুলিই পুনর্মুদ্রণ করা হয়৷ রায় পরিবারের মানসসন্তান ‘সন্দেশ' পত্রিকা সন্দীপ রায়ের হাত ধরে আজও প্রকাশিত হয়, এ কথাটা অনেকের জানাই নেই! এককালের সাড়া জাগানো এই শিশু-কিশোর পত্রিকা থেকে চলচ্চিত্র জগতের মুখোরোচক খবর তুলে ধরা পত্রিকা ‘প্রসাদ’ সব স্টলে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর৷ ‘মৌচাক’, ‘উল্টোরথ’, ‘পরিবর্তন’ সেই কবেই হারিয়ে গেছে!  

‘‘বই-পত্রিকার পাঠক চিরকালই থাকবে’’

This browser does not support the audio element.

কলকাতার নামী প্রকাশনা সংস্থা ‘পত্রভারতী' প্রকাশিত ‘কিশোর ভারতী' পত্রিকা পাঁচ দশক পার করেছে৷ ৫০ বছর আগে শারদীয় সংখ্যার হাত ধরে এই পত্রিকার আত্মপ্রকাশ৷ এই পত্রিকার সম্পাদক ও কলকাতার ‘পাবলিশার্স অ্যান্ড বুকসেলার্স গিল্ড’-এর কর্তা ত্রিদিব চট্টোপাধ্যায় কিন্তু পুজো সাহিত্য নিয়ে যথেষ্ট আশাবাদী৷

পত্রিকার সংখ্যা অনেক বেড়ে যাওয়ায় বিক্রি কমেছে, এটা মানলেও তিনি বলেন, ‘‘বিনোদনে যে উপকরণই আসুক না কেন, বই পড়া বন্ধ হবে না৷ তাই ই-বুক সাফল্য পায়নি৷ অ্যামাজনকে ব্যবসা গুটিয়ে নিতে হয়েছে এই দেশ থেকে৷’’ ত্রিদিব চট্টোপাধ্যায়ের যুক্তি, ‘‘যখন আমাদের দেশে টেলিভিশন এসেছিল, তখনও ‘গেল, গেল’ রব উঠেছিল, কই বই পড়া কি বন্ধ হয়েছে?এখন আবার সোশ্যাল মিডিয়া নিয়ে হইচই হচ্ছে৷ আমি বলছি, বই-পত্রিকার পাঠক চিরকালই থাকবে৷’’

প্রিয় পাঠক, আপনি কিছু বলতে চাইলে লিখুন নীচে মন্তব্যের ঘরে...

৩০ জানুয়ারির এই ছবিঘরটি দেখুন...

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ

ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ