ইরানের পথিকৃৎ ব্লগার হোসেইন দেরাখশান৷ ব্লগিং-এর জন্য তাঁকে ছ'বছর জেলে কাটাতে হয়েছিল৷ জেল থেকে বেরিয়েই তিনি লক্ষ্য করেন কী পরিমাণ অকিঞ্চিতকর হয়ে উঠেছে ইন্টারনেট৷ ডয়চে ভেলেকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে সে কথাই বলেছেন তিনি৷
বিজ্ঞাপন
হোসেইন দেরাখশানের জন্ম ইরানে, ১৯৭৫ সালে৷ ২০০১ সালে তিনি উচ্চশিক্ষার জন্য যান ক্যানাডার টরন্টোয়৷ সেখান থেকে তিনি হোদার ছদ্মনামে ব্লগ করতে শুরু করেন এবং ফার্সিতে ব্লগ করা সম্বন্ধে একটি গাইডের অনুবাদ করেন – যা থেকে ফার্সি ভাষায় ব্লগিং-এর ধুম শুরু হয়৷ ২০০৪ সালে ব্লগারদের সংখ্যার হিসেবে বিশ্বে ইরানের অবস্থান ছিল পঞ্চম৷
কিন্তু অচিরেই বিপদে পড়তে থাকেন মুক্তমনা ব্লগাররা৷ ২০০৮ সালে দেরাখশানকেও কারারুদ্ধ করে ইরান সরকার৷ দীর্ঘ ছ'বছর পরে তাঁকে অপ্রত্যাশিতভাবে মুক্তি দেওয়া হয়, এবং সেটা নাকি সম্ভব হয় স্বয়ং আয়াতোল্লাহ খামেনেই-এর হস্তক্ষেপে৷ সরকারের সঙ্গে এই যোগাযোগ দেরাখশানকে বিপাকে ফেলে; ইরানের অনলাইন কমিউনিটি তাঁর রাজক্ষমাকে সন্দেহের চোখে দেখে৷
২০১৫ সাল থেকে দেরাখশান তেহরানে বাস করছেন, প্রবন্ধ লিখছেন এবং সোশ্যাল মিডিয়ার প্রভাব ও অনলাইনে রাজনৈতিক বাকবিতণ্ডা, যুক্তিতর্ক, আলাপ-আলোচনা কমে যাওয়া সম্পর্কে বক্তৃতা দিয়ে বেড়াচ্ছেন৷
ডয়চে ভেলে: মিস্টার দেরাখশান, আপনি জেলে থাকাকালীন ছ'বছর অফলাইন ছিলেন৷ সেই সময়ে ইন্টারনেট বিপুলভাবে বদলে গেছে৷ জেল থেকে বেরনোর পর আপনি কী দেখলেন?
ইরানে পুলিশের নজর এড়াতে অ্যাপ
ইরানের নৈতিকতা বিষয়ক পুলিশের নজর এড়াতে ‘গেরশাদ’ নামে অভিনব একটি অ্যাপ তৈরি করা হয়েছে৷ চলতি বছর ডয়চে ভেলের দ্য বব্স প্রতিযোগিতার একটি বিভাগে ‘জুরি অ্যাওয়ার্ড’ জিতেছে প্রকল্পটি৷
ছবি: DW/Röhl
অ্যাপ তৈরির উদ্দেশ্য
‘গেরশাদ’ নামক অ্যাপটি তৈরির উদ্দেশ্য পুলিশকে এড়িয়ে চলা৷ ইরানের ‘গাশত-ই-এরশাদ’ বা নৈতিকতা পুলিশের কাজ রাস্তায় নারী ও পুরুষরা ‘ঠিক’ পোশাক ও সাজসজ্জা অনুযায়ী বের হয়েছে কি না তা দেখা৷ ব্যতিক্রম হলে ‘অপরাধী’ ধরে শাস্তি দেয়া৷
ছবি: gershad.com
অপরাধের ধরণ
নারীরা যদি স্কার্ফ দিয়ে মাথা না ঢাকেন, তাঁদের চুলের স্টাইল যদি রীতি অনুযায়ী না হয় এবং তাঁরা যদি অতিরিক্ত মেক-আপ নেন তাহলে তাঁদের নৈতিকতা পুলিশের মুখোমুখি হতে হয়৷ ছেলেদের ক্ষেত্রে তাঁরা যদি পশ্চিমা ধাঁচের পোশাক পরেন তাহলেই বিপত্তি ঘটতে পারে৷
ছবি: gershad.com
শাস্তি
‘অপরাধ’ অনুযায়ী শাস্তি দিয়ে থাকে পুলিশ৷ জরিমানা আদায় থেকে শুরু করে সংশোধন কেন্দ্রে নিয়ে গিয়ে জীবনযাপনের উপর শিক্ষা দেয়া, কারাগারে পাঠানো এমন সব শাস্তি দেয়া হয়ে থাকে৷ গেরশাদ এর পেছনের কারিগররা জানান, ২০১৩ সালে প্রায় ত্রিশ লক্ষ নারীকে জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ৷ এর মধ্যে দুই লক্ষের বেশি জনকে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চেয়ে পত্র লিখতে হয়েছে৷ আর জেলে যেতে হয়েছে ১৮ হাজারেরও বেশি নারীকে৷
ছবি: DW
অ্যাপটি যেভাবে কাজ করে
অ্যান্ডরয়েড ফোন যাঁরা ব্যবহার করেন তাঁরা এই অ্যাপটি ব্যবহার করেন৷ অ্যাপের মাধ্যমে শহরের কোন স্থানে নৈতিকতা পুলিশ চেকপোস্ট বসিয়েছে তা জানা যায়৷ ফলে পথচারীরা সহজেই ঐ পথ এড়িয়ে চলতে পারেন৷
ছবি: https://www.gershad.com
ব্যবহারকারীরাই তথ্য দেন
অ্যাপের ব্যবহারকারীরাই তথ্য দিয়ে জানিয়ে দেন, কোথায় চেকপোস্ট আছে আর কোথা থেকে চেকপোস্ট উঠিয়ে নেয়া হয়েছে৷ অ্যাপের মাধ্যমে পুলিশকে এড়িয়ে বিকল্প পথে যাওয়ার পথও বাতলে দেয়া হয়৷
ছবি: gershad.com
সরকারের নিষেধাজ্ঞা
অ্যাপের কার্যক্রম শুরু হওয়ার পরপরই ব্যবহারকারীরা এটি তাদের স্মার্টফোনে ডাউনলোড করা শুরু করলে সরকার এটি ব্যবহারের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে৷
ছবি: gershad.com
আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি
চলতি বছর ডয়চে ভেলের দ্য বব্স প্রতিযোগিতার ‘প্রগতির জন্য প্রযুক্তি’ বিভাগে ‘জুরি অ্যাওয়ার্ড’ জিতেছে প্রকল্পটি৷ তবে অ্যাপটির নির্মাতারা নিজেদের পরিচয় গোপন রাখতে চান৷ দ্য বব্সের ইরানি ভাষার বিচারক গোলনাজ এসফানডিয়ারিকে তাঁরা জানান, ‘‘এই পুরস্কার অ্যাপটির ব্যবহারকারীদের প্রাপ্য৷ এটা নিঃসন্দেহে যারা নৈতিকতা বিষয়ক পুলিশ বাহিনীকে এড়িয়ে চলতে চান, তাদের উপর ইতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করবে৷’’
ছবি: DW/Röhl
7 ছবি1 | 7
হোসেইন দেরাখশান: আমি ইন্টারনেটে একটা পরিবর্তন লক্ষ্য করি; একটি বিকেন্দ্রিক, বৈচিত্র্যপূর্ণ, লিংক-ভিত্তিক, সংযোগমূলক, কৌতূহলী, বহির্মুখী এবং রচনাকেন্দ্রিক স্পেস থেকে সেটি একটি ইমেজ-কেন্দ্রিক স্পেস হয়ে উঠেছে, যার মূল উপজীব্য আলোচনা, বিতর্ক বা চিন্তাধারা না হয়ে মনোরঞ্জন হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ ইন্টারনেট এখন বেশ কেন্দ্রীভূত ও সোশ্যাল নেটওয়ার্কগুলির দ্বারা প্রভাবিত৷ আগের চেয়ে অনেক কম বৈচিত্র্যপূর্ণ৷ মনোরঞ্জনই এখন বেশি গুরুত্বপূর্ণ৷ রাজনীতি সহ সিরিয়াস কন্টেন্ট কম৷
আপনি যে ব্লগারদের সাথে কাজ করতেন, তাদের কী খবর?
অনেক সাবেক ব্লগার আর অ্যাক্টিভিস্ট এই নতুন ‘স্পেসে' যোগ দিয়েছেন৷ তাঁরা যেন ভুলে গেছেন যে, রাজনীতি তাঁদের জীবনে এককালে একটা বড় ভূমিকা নিয়েছিল৷ এখন তাঁরা সোশ্যাল নেটওয়ার্কে ছোটখাটো যা কিছু দেখেন, তাই নিয়েই খুশি৷ ক্রমেই আরো কম লোক সিরিয়াস নিউজ বা সিরিয়াস ডিসকাশনে আগ্রহী, বলে আমার ধারণা৷
নব্বই-এর দশকে ইন্টারনেট যখন বেরোয়, তখন তা সিরিয়াস আলাপ-আলোচনা, তর্ক-বিতর্কের জন্য একটা সুযোগ সৃষ্টি করেছিল৷ ২০ বছর পরে এখন সেই সুযোগ অন্তর্হিত হচ্ছে, ইন্টারনেট টেলিভিশনের মতো হয়ে যাচ্ছে৷
সোশ্যাল নেটওয়ার্কগুলি কি কোনো কাজের নয়, বলে আপনি মনে করেন?
কোনো বিশেষ খবর বা ঘটনার প্রতি আবেগ-অনুভূতিগত প্রতিক্রিয়া হিসেবে সোশ্যাল নেটওয়ার্কগুলির উপযোগিতা থাকতে পারে – হয়ত কোনো কোনো ক্ষেত্রে মানুষজনকে পথে বার করে আনতে৷ কিন্তু একজন মিশরী আন্দোলনকারী যেমন বলেছেন: তার ফলে মিশরী বিপ্লবের কোনো সুবিধা হয়নি৷ সোশ্যাল নেটওয়ার্কগুলি জনতাকে ঘর থেকে বার করে এনে তাদের চলতি পরিস্থিতি সম্পর্কে প্রতিবাদের কণ্ঠ দিয়েছে, কিন্তু সেটা একটি নেতিবাচক কণ্ঠ; তা থেকে ইতিবাচক কিছু আসেনি৷ সকলে পরস্পরের সঙ্গে মারামারি শুরু করেছে..
কাজেই (সোশ্যাল নেটওয়ার্কগুলি) জনতাকে কোনো কিছুর বিরুদ্ধে সংগঠিত করতে পারে, কিন্তু কোনো ইতিবাচক কাজে তাদের ঐক্যবদ্ধ করতে পারে না, কেননা সোশ্যাল নেটওয়ার্ক নেতৃত্বের বিকল্প হতে পারে না৷
বাকস্বাধীনতা যেখানে যেমন
আপনার দেশে বাকস্বাধীনতা পরিস্থিতি কেমন? ডয়চে ভেলের দুই সাংবাদিক এই প্রশ্ন করেছিলেন সদ্য সমাপ্ত গ্লোবাল মিডিয়া ফোরামে আগত বিভিন্ন দেশের ব্লগার, সাংবাদিক, অ্যাক্টিভিস্টদের৷
ছবি: DW/A. S. Brändlin
শাম্মী হক, অ্যাক্টিভিস্ট, বাংলাদেশ
‘‘বাংলাদেশের মানুষ তাদের মনের কথা বলতে পারেন না৷ সেখানে কোনো বাকস্বাধীনতা নেই এবং প্রতিদিন পরিস্থিতি খারাপের দিকেই যাচ্ছে৷ একজন সামাজিক অ্যাক্টিভিস্ট এবং ব্লগার হিসেবে আমি ধর্ম নিয়ে লেখালেখি করি, যা ইসলামিস্টরা পছন্দ করেনা৷ তারা ইতোমধ্যে ছয় ব্লগারকে হত্যা করেছে৷ ফলে আমি দেশ ছাড়তে বাধ্য হই৷’’
ছবি: DW/A. S. Brändlin
নিরাপত্তার কারণে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক, ভেনেজুয়েলা
‘‘বাকস্বাধীনতা হচ্ছে এমন এক ধারণা যার অস্তিত্ব আমার দেশে নেই৷ সাংবাদিকরা জরিমানা আর নিজের জীবনের উপর ঝুঁকি এড়াতে সরকারের সমালোচনা করতে চায়না৷ সরকারের সমালোচনা করলে সাংবাদিকদের বিচারের মুখোমুখি হতে হয়৷ এরকম পরিস্থিতির কারণে অনেক সাংবাদিক দেশ ছেড়ে চলে গেছেন৷ দেশটির আশি শতাংশ গণমাধ্যমের মালিক সরকার, তাই সাধারণ মানুষের মত প্রকাশের একমাত্র মাধ্যম হচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়া৷’’
ছবি: DW/A. S. Brändlin
রোমান দবরোখটভ এবং একাতেরিনা কুজনেটসোভা, সাংবাদিক, রাশিয়া
রোমান: ‘‘রাশিয়ায় সরকার আপনাকে সেন্সর করবে৷ আমাদের ওয়েবসাইটটি ছোট এবং লাটভিয়ায় নিবন্ধিত৷ ফলে আমি সেন্সরশিপ এড়াতে পারছি৷ তা সত্ত্বেও সরকার মাঝে মাঝে আমাদের সার্ভারে হামলা চালায়৷’’ একাতেরিনা: ‘‘রাশিয়ায় বাকস্বাধীনতার কোনো অস্তিত্ব নেই৷ ইউরোপের মানুষ রাজনীতিবিদদের সমালোচনা করার ক্ষেত্রে স্বাধীন৷ আমি আশা করছি, রাশিয়ার পরিস্থিতিও বদলে যাবে৷’’
ছবি: DW/A. S. Brändlin
নিরাপত্তার কারণে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক, সিরিয়া
‘‘বেশ কয়েক বছর ধরেই সিরিয়ায় বাকস্বাধীনতার কোনো অস্তিত্ব নেই৷ এমনকি আসাদের শাসনামল সম্পর্কে অনুমতি ছাড়া মতামতও প্রকাশ করা যায়না৷ এটা নিষিদ্ধ৷ কেউ যদি সেই নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে তাহলে খুন হতে পারে৷ আমি যদি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সমালোচনামূলক কিছু লিখি, তাহলে বেশিদিন বাঁচতে পারবো না৷’’
ছবি: DW/A. S. Brändlin
আয়েশা হাসান, সাংবাদিক, পাকিস্তান
‘‘পাকিস্তানে ‘গণমাধ্যমের স্বাধীনতা’ শব্দ দু’টি খুবই বিপজ্জনক৷ এগুলোর ব্যবহার আপনার ক্যারিয়ার বা জীবন শেষ করে দিতে পারে৷’’
ছবি: DW/A. S. Brändlin
রাবা বেন দউখান, রেডিও সাংবাদিক, টিউনিশিয়া
‘‘আমাদের অভ্যুত্থানের একমাত্র ফল হচ্ছে বাকস্বাধীনতা৷ আমরা এখন আমাদের সরকারের সমালোচনা করার ব্যাপারে স্বাধীন৷ এবং আমি যখন আমাদের অঞ্চলের অন্য দেশের বাসিন্দাদের বাকস্বাধীনতার কথা জিজ্ঞাসা করি, তখন একটা বড় ব্যবধান দেখতে পাই৷ আমাদের দেশে দুর্নীতিসহ নানা সমস্যা আছে সত্যি, তবে বাকস্বাধীনতা কোনো সমস্যা নয়৷’’
ছবি: DW/A. S. Brändlin
খুসাল আসেফি, রেডিও ম্যানেজার, আফগানিস্তান
‘‘বাকস্বাধীনতা আফগানিস্তানে একটি ‘সফট গান৷’ এটা হচ্ছে মানুষের মতামত, যা সম্পর্কে সরকার ভীত৷ এটা চ্যালেঞ্জিং হলেও আমাদের প্রতিবেশীদের তুলনায় আমাদের অবস্থা ভালো৷’’
ছবি: DW/A. S. Brändlin
সেলিম সেলিম, সাংবাদিক, ফিলিস্তিন
‘‘ফিলিস্তিনে সাংবাদিকদের খুব বেশি স্বাধীনতা নেই৷ একটা বড় সমস্যা হচ্ছে, সাংবাদিকরা মুক্তভাবে ঘোরাফেরা করতে পারে না৷ ইসরায়েল এবং ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ সাংবাদিকদের গ্রেপ্তার করছে৷ তারা যদি ফেসবুকে তাদের মতামত জানায়, তাহলেও সরকার গ্রেপ্তার করে৷ তবে সিরিয়া বা ইরাকের চেয়ে অবস্থা ভালো৷’’
ছবি: DW/A. S. Brändlin
অনন্য আজাদ, লেখক, বাংলাদেশ
‘‘আমাদের দেশে কোনো বাকস্বাধীনতা নেই৷ আপনি ইসলাম বা সরকারের সমালোচনা করে কিছু বলতে পারবেন না৷ ইসলামী মৌলবাদীরা ঘোষণা দিয়েছে, কেউ যদি ইসলামের সমালোচনা করে, তাহলে তাকে হত্যা করা হবে৷ আমি একজন সাংবাদিক এবং গত বছর আমাকে ইসলামিস্ট জঙ্গিরা হত্যার হুমকি দিয়েছে৷ ফলে আমাকে দেশ থেকে পালাতে হয়েছে৷’’