তাবলিগ জামাতকে নিষিদ্ধ করেছে সৌদি আরব। তাদের 'সন্ত্রাসের দরজা' বলে চিহ্নিত করেছে সৌদি সরকার।
বিজ্ঞাপন
রোববার রাতে সৌদি আরবের ইসলামিক অ্যাফেয়ার্স মন্ত্রী বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছেন, তাবলিগ জামাতের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করতে হবে। শুক্রবার নামাজের জামাতে এ বিষয়ে সমস্ত মানুষকে সচেতন করতে হবে। প্রতিটি মসজিদকে এই নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। মন্ত্রী জানিয়েছেন, ইসলামের পাঠ দেওয়ার নামে বিশ্ব জুড়ে সন্ত্রাসের আবহ তৈরি করছে তাবলিগ। সে কারণেই তাদের সঙ্গে কোনোরকম সম্পর্ক রাখা যাবে না। দাওয়া গোষ্ঠীর বিরুদ্ধেও একই ফতোয়া জারি করা হয়েছে।
একশ বছর আগে ভারতে প্রথম তৈরি হয়েছিল তাবলিগ জামাত। করোনাকালে দিল্লিতে করোনাবিধি উপেক্ষা করে সভার আয়োজন করে তারা বিপুল বিতর্কের জন্ম দিয়েছিল। একশ বছর আগে মহম্মদ ইলিয়াস কান্দলাবি যখন তাবলিগ তৈরি করেছিলেন, তখনো গোষ্ঠীটিকে নিয়ে বিতর্ক হয়েছিল। ইলিয়াসের বক্তব্য ছিল, বিশুদ্ধ ইসলাম প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যেই কাজ করবে সংগঠনটি। বস্তুত, এখনো গ্রামে গ্রামে ঘুরে সে কাজই করে তাবলিগ। কীভাবে আদর্শ মুসলিম হয়ে উঠতে হবে, তার পাঠ দেওয়া হয়।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় তাবলিগের প্রভাব যথেষ্ট। ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, মালয়েশিয়া এবং ইন্দোনেশিয়ায় তাবলিগের শক্তিশালী সংগঠন আছে। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, তাবলিগের মূল টাকা আসে আরব থেকে। ফলে সৌদিতে তাবলিগ নিষিদ্ধ হলে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় তাদের টাকায় টান পড়বে এবং সংগঠনটির স্বাভাবিক মৃত্যু হবে।
বিশ্ব ইজতেমা: দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম সমাবেশ
গাজীপুরের টঙ্গীর তুরাগতীরে অনুষ্ঠিত হয় তাবলিগ জামাতের ৫৩তম বিশ্ব ইজতেমা৷ বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় এবং বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্মীয় এ সমাবেশের নানান দিক নিয়ে এই ছবিঘর৷
ছবি: DW/M. M. Rahman
তাবলিগ জামাতের বার্ষিক সমাবেশ
বিশ্ব ইজতেমা তাবলিগ জামাতের বার্ষিক সমাবেশ৷ বাংলাদেশের গাজীপুর জেলার টঙ্গী এলাকায় তুরাগ নদীর তীরে প্রতিবছর অনুষ্ঠিত হয় মুসলমানদের বিশাল এই সমাবেশ৷ পৃথিবীর নানান দেশ থেকে ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা এতে যোগ দেন৷
ছবি: Munir Uz Zaman/AFP/Getty Images
অর্ধশত বছরের পুরনো
এ বছরেরটি বিশ্ব ইজতেমার ৫৩তম আসর৷ ১৯৬৭ সাল থেকে প্রতি বছর এই সমাবেশ নিয়মিত হয়ে আসছে বাংলাদেশে৷
ছবি: DW/M. M. Rahman
গোড়ার কথা
১৯৪৬ সালে ঢাকার কাকরাইল মসজিদে তাবলিগ জামাতের বার্ষিক সম্মেলন বা ইজতেমা প্রথম অনুষ্ঠিত হয়৷ এর পরে ১৯৪৮ সালে চট্টগ্রামে হাজি ক্যাম্পে এবং ১৯৫৮ সালে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে অনুষ্ঠিত হয় ইজতেমা৷ তখন এই সমাবেশ কেবল ইজতেমা নামেই পরিচিত ছিল৷
ছবি: Reuters
যখন থেকে তুরাগ তীরে
ইজতেমায় অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা দিনে দিনে বাড়তে থাকায় ১৯৬৬ সালে টঙ্গীর পাগার গ্রামের খোলা মাঠে ইজতেমার আয়োজন করা হয়৷ ওই বছর থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা অংশ নিতে শুরু করে৷ তখন থেকে এটি পরিচিতি পায় ‘বিশ্ব ইজতেমা’ নামে৷ পরের বছর থেকে তুরাগ নদীর উত্তর-পূর্ব তীরের বিশাল খোলা জায়গায় অনুষ্ঠিত হচ্ছে এই সমাবেশ৷
ছবি: Reuters
দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম সমাবেশ
সৌদি আরবের হ্জের পর বিশ্ব ইজতেমা মুসলমান সম্প্রদায়ের দ্বিতীয় বৃহত্তম সমাবেশ৷ প্রতি বছর বিশ্ব ইজতেমায় অংশ নেনে প্রায় ত্রিশ লাখ মুসলমান৷
ছবি: REUTERS
বিদেশি অংশগ্রহণকারী
২০১৭ সালে বিশ্ব ইজতেমায় অংশ নিয়েছিলেন প্রায় ছয় হাজার মুসল্লী৷ এসেছিলেন বিশ্বের ৯৬ টি দেশ থেকে তাঁরা৷
ছবি: Munir Uz Zaman/AFP/Getty Images
দুই পর্বে ইজতেমা
পুণ্যার্থীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার কারণে স্থান সংকুলান না হওয়ায় ২০১১ সাল থেকে বিশ্ব ইজতেমা অনুষ্ঠিত হচ্ছে দুই পর্বে৷ এবছর প্রথম পর্ব ১২ থেকে ১৪ জানুয়ারি এবং দ্বিতীয় পর্ব অনুষ্ঠিত হবে ১৯ থেকে ২১ জানুয়ারি৷
ছবি: REUTERS
শুরু শুক্রবার
বিশ্ব ইজতেমার দুই পর্বই শুরু হয় শুক্রবার৷ ফজরের নামাজের পর থেকে শুরু হয় বয়ান (ধর্মীয় আলোচনা)৷ এদিন জুম্মার নামাজে অংশ নিতেও অনেকে ঢাকা ও এর আশপাশ থেকে বিশ্ব ইজতেমা প্রাঙ্গণে আসেন৷
ছবি: DW/M. M. Rahman
আখেরি মোনাজাত
বিশ্ব ইজতেমার শেষ দিন দুপুরে অনুষ্ঠিত হয় বিশেষ প্রার্থনা৷ এ বছর বিশ্ব ইজতেমার দুই পর্বের আখেরি মোনাজাত অনুষ্ঠিত হবে যথাক্রমে ১৪ ও ২১ জানুয়ারি৷ রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীও অংশ নেন আখেরি মোনাজাতে৷
ছবি: REUTERS
নিরাপত্তা
বিশ্ব ইজতেমা উপলক্ষে বিশেষ নিরপত্তা ব্যবস্থা গড়ে তোলে সরকার৷ প্রায় সাত হাজার পুলিশ সদস্য ছাড়াও বেশ কিছু ব়্যাব সদস্যও থাকবে ইজতেমা প্রাঙ্গণের নিরাপত্তায়৷ এছাড়া বেশ কিছু ওয়াচ টাওয়ার আর সিসি ক্যামেরার মাধ্যমেও পর্যবেক্ষণ করা হবে মেলা প্রাঙ্গণ৷
ছবি: Getty Images/AFP
অন অ্যারাইভাল ভিসা
বাংলাদেশে যেসব দেশের দূতাবাস নেই, সেসব দেশের নাগরিকরা ইজতেমায় অংশ নিতে চাইলে বাংলাদেশে ৩০ দিনের অন অ্যারাইভাল ভিসা পান৷
ছবি: REUTERS
শেষ দিনে
আখেরি মোনাজাতের দিন লোকে লোকারণ্য হয়ে যায় টঙ্গী এলাকা৷ তখন আশপাশের এলাকার সড়ক, বাড়ির ছাদে বসেও মোনাজাতে অংশ নেন হাজার হাজার মানুষ৷
ছবি: Getty Images/AFP/M. U. Zaman
বিশেষ ট্রেন
বিশ্ব ইজতেমা উপলক্ষে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে বিশেষ ট্রেন সার্ভিস চালু করে বাংলাদেশ রেলওয়ে৷
ছবি: DW/M. M. Rahman
সড়ক বন্ধ
দুই পর্বেই আখেরি মোনাজাতের দিনে ভোর রাত থেকে বিকেল পর্যন্ত ঢাকা ও গাজীপুরের কিছু সড়কে যান চলাচল প্রায় বন্ধ থাকে৷ এদিন ঢাকার নিকুঞ্জ থেকে উত্তরামূখী এবং গাজীপুরের চৌরাস্তা থেকে টঙ্গীমূখী সড়ক আর আশুলিয়া থেকে উত্তরামূখী সড়কে যান চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা হয়৷
ছবি: Munir Uz Zaman/AFP/Getty Images
14 ছবি1 | 14
সাংবাদিক এবং ইসলাম বিষয়ক গবেষক জাভেদ আখতারের বক্তব্য, সৌদি আরবে তাবলিগ নিষিদ্ধ হওয়ার বিষয়টি অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য। তাবলিগ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই ভারতের প্রশাসন খোঁজখবর রাখছে। করোনার সময় দিল্লিতে তাদের অনুষ্ঠানের পর প্রশাসন এবং কেন্দ্রীয় সরকার তাবলিগের বিরুদ্ধে একাধিক ব্যবস্থা নিয়েছিল। ভারত এবার সৌদি আরবকে মডেল হিসেবে ব্যবহার করতে পারে। তাবলিগের বিরুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে পারে।
জাভেদের মতে, ''ওয়াহাবিদের সঙ্গে তাবলিগের বরাবরই বিরোধ ছিল। সৌদিতে ওয়াহাবিদের গুরুত্ব বেশি। তাদেরই চাপে সরকার তাবলিগকে নিষিদ্ধ করেছে।'' কিন্তু ভারতে তাবলিগ নিয়ে যখন বিতর্ক হয়েছিল তখন ওয়াহাবিরা তাবলিগের পাশে দাঁড়িয়েছিল। এবার সৌদির কথা মেনে তারাও তাবলিগের বিরোধিতা করে কি না, সেটাই দেখার।
বস্তুত, এখনই এ বিষয়ে মত প্রকাশ করতে চাইছেন না ভারতের ইসলামিক পণ্ডিতরা। সৌদি কেন এ কাজ করল, তার প্রতিফলন কী হবে, এই বিষয়গুলির দিকে তারা নজর রাখতে চাইছেন। ডিডাব্লিউকে অল ইন্ডিয়া মুসলিম মজলিস মোশাওয়ারাতের প্রধান নাভেদ হামিদ বলেছেন, ''সৌদির বিবৃতিটি এখনো খুব স্পষ্ট নয়। তারা তাবলিগের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করছে, নাকি স্থানীয় স্তরে কিছু ব্যবস্থা নিচ্ছে, এ বিষয়টি স্পষ্ট হচ্ছে না। যার থেকে বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে।'' নাভেদের বক্তব্য, ওয়াহাবিদের সঙ্গে তাবলিগের ইসলামিক ভাবনার তফাত আছে। কিন্তু তাই বলে একটি সংগঠনকে নিষিদ্ধ করা হবে কেন, তা বোঝা যাচ্ছে না। তবে এর প্রভাব ভারতে পড়বে বলে তিনি মনে করেন না। তাবলিগকে নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ বই লিখেছেন জিয়া উস সালাম। ডিডাব্লিউকে তিনি বলেছেন, ''নিষিদ্ধ ঘোষণা করার মতো কোনো কাজ তাবলিগ করে না। তাদের সঙ্গে সন্ত্রাসের যোগ তৈরি করা অনুচিত। সৌদির মতো রাষ্ট্র এ কাজ করলে অবাক লাগে।''
ডিডাব্লিউ ভারতের তাবলিগ নেতৃত্বের সঙ্গেও যোগাযোগ করেছিল, কিন্তু তারা এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাননি। তবে ইসলামিক স্কলারদের একাংশের বক্তব্য, সৌদির টাকা বন্ধ হয়ে গেলে তাবলিগের মতো এত বড় সংগঠনকে সচল রাখা কঠিন। সৌদি নিষিদ্ধ করার ফলে অন্য দেশের বিভিন্ন মুসলিম সংগঠনও তাবলিগের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করবে বলে তারা মনে করছেন।