গত জানুয়ারিতে সৌদি আরবের ফুটবল ম্যাচে উপস্থিত সমর্থকেরা শিয়া মুসলিমদের কাছে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব ইমাম হোসেনের জন্ম উদযাপন উপলক্ষ্যে একটি ধর্মীয় গান গেয়েছিলেন৷ এই ঘটনায় ১২ জন শিয়া মুসলিমকে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে৷
বিজ্ঞাপন
তাদের ছয় মাস থেকে একবছর পর্যন্ত কারাদণ্ড দেওয়া হয়৷
সৌদি আরবের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যের দুটি দল আল সাফা ও আল বুকিরিয়ার মধ্যে ম্যাচটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল৷ সুন্নিপ্রধান সৌদি আরবে বাস করা শিয়ারা মূলত ঐ রাজ্যে থাকেন৷
দুল দুটি সৌদি আরবের প্রথম বিভাগে খেলে৷ দেশটির লিগ সিস্টেমে এটি দ্বিতীয় সারির প্রতিযোগিতা ধরা হয়৷ শীর্ষসারির লিগের নাম সৌদি প্রো লিগ, যেখানে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো খেলেন৷
সাইবার অপরাধ আইনে ফুটবল সমর্থকদের শাস্তি দেওয়া হয়েছে৷ নামের সঙ্গে সাইবার থাকলেও প্রায়ই অফলাইন সংঘটিত অপরাধের জন্যও এই আইন ব্যবহার করে সৌদি আরব৷ বিরোধী মত দমনে এই আইন ব্যবহার করা হয় বলে সমালোচকেরা অভিযোগ করেন৷
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের সৌদি আরব বিষয়ক গবেষকজোয়ে শেয়া ডিডাব্লিউকে বলেন, ‘‘রাষ্ট্রকে অস্থিতিশীল করা বা দেশের নেতাদের অপমান করা হিসাবে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে, এমন যে-কোনো কিছুর জন্য এই আইনে বড় শাস্তির ব্যবস্থা আছে৷ এবং কাকে কোন কথার জন্য ধরা হবে সেটা শেষ পর্যন্ত একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত হতে পারে- যা সত্যিই এক ভয়ংকর পরিস্থিতি৷''
সাম্প্রতিক সময়ে এই আইন ব্যবহার করে দেশটির শাসকদের সমালোচনা করে টুইট করার জন্য ১০ বছরের জেল, এমনকি মৃত্যুদণ্ডও দেওয়া হয়েছে৷
মোহামেদ বিন সালমান সৌদি আরবের অন্যতম প্রভাবশালী নেতা হয়ে ওঠার পর দেশটির শিয়ারা তাদের পরিস্থিতি উন্নতির আশা করেছিলেন৷ তাদের একজন তাহা আলহাজ্জি৷ তিনি দেশ থেকে পালিয়ে এখন জার্মানিতে আইনজীবী হিসেবে কাজ করছেন৷ ডিডাব্লিউকে তিনি বলেন, ‘‘শিয়া সম্প্রদায়ের মধ্যে একটা আশা ছিল তাদের অবস্থা ভালো হবে, তারা তাদের ধর্মীয় রীতি ঠিকমতো পালন করতে পারবেন৷'' কিন্তু বাস্তবে শিয়াদের উপর আরও কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে বলে জানান তিনি৷
ইউরোপিয়ান সৌদি অর্গানাইজেশন ফর হিউম্যান রাইটসকে আইনি পরামর্শ দেওয়া আলহাজ্জি বলেন, সমর্থকেরা গান গেয়ে কোনো অপরাধ করেনি৷ ‘‘তারা কাউকে উসকানি দেননি, কাউকে গালি দেন বা কারও সঙ্গে আগ্রাসী আচরণ করেননি,'' বলেন তিনি৷
কিন্তু সৌদি কর্তৃপক্ষ তার সঙ্গে একমত নয়৷ একটি বিবৃতিতে দেশটির ক্রীড়া মন্ত্রণালয় বলেছে, আল সাফা ক্লাব আইনের ৩৬/৩ অনুচ্ছেদ ভঙ্গ করেছে এবং ‘পাবলিক অর্ডার, পাবলিক নৈতিকতা ও নিয়মের সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ' কাজ করেছে৷
২০৩৪ সালের ফুটবল বিশ্বকাপ আয়োজন করবে সৌদি আরব৷ হিউম্যান রাইটস ওয়াচ কর্মকর্তা শেয়া মনে করছেন, সৌদি আরবে ফুটবল ম্যাচ দেখতে গিয়ে মোহামেদ বিন সালমানের সমালোচনামূলক মন্তব্য করা নিরাপদ নয়৷
আলহাজ্জিও এই বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন৷
মধ্যপ্রাচ্য কি ধর্ম থেকে দূরে সরছে?
কয়েকটি সমীক্ষা জানাচ্ছে, মধ্যপ্রাচ্যের মানুষের মনে ধর্মের বিষয়ে চিন্তায় পরিবর্তন আসছে৷ বিস্তারিত দেখুন ছবিঘরে...
ছবি: Reuters/Saudi Ministry of Media
মধ্যপ্রাচ্যে ধর্ম
মধ্যপ্রাচ্যের দেশে ধর্মভিত্তিক নানা প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যা স্থানীয়দের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ৷ কয়েকটি রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রেও এসব প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে৷ তবে বেশ কয়েকটি সমীক্ষার তথ্য বলছে, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলিতে কিছু ক্ষেত্রে আগের চেয়ে কমছে ধর্মের গুরুত্ব৷
ছবি: picture-alliance/imagebroker/W. G. Allgöwer
লেবানন
২৫ হাজারেরও বেশি মানুষের সাক্ষাৎকার থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ‘দ্য আরব ব্যারোমিটার’ জানাচ্ছে যে, লেবাননে গত দশ বছরে ব্যক্তিগত স্তরে ধর্মীয় আচার মানার হার কমেছে ৪৩ শতাংশ৷ আরো জানাচ্ছে যে, সেদেশের জনসংখ্যার মাত্র এক-চতুর্থাংশ নিজেদের ‘ধার্মিক’ বলে দাবি করে৷ যদিও লেবাননে সরকারিভাবে কোনো নাগরিক ধর্মহীন হতে পারেন না, তবে ব্যক্তিগত পরিসরে ধর্মচর্চা কমছে- এমন ধারণা দিচ্ছে আরব ব্যারোমিটারের সমীক্ষা৷
ছবি: picture-alliance/dpa/N. Mounzer
ইরান যা বলছে
গ্রুপ ফর অ্যানালাইজিং অ্যান্ড মেসারিং অ্যাটিটিউডস ইন ইরান, গামান-এর একটি সমীক্ষায় ৪০ হাজার মানুষের সঙ্গে কথা বলে তথ্য সংগ্রহ করা হয়৷ ফলাফল বলছে, অংশগ্রহণকারীদের ৪৭% জানান যে তারা এক সময় ধার্মিক ছিলেন, তবে বর্তমানে নন-রিলিজিয়াস, যার অর্থ এখন আর ধর্মীয় আচার পালন করেন না৷ অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ৭৮% শতাংশ অবশ্য ঈশ্বরে বিশ্বাসী, ২২ শতাংশ কোনো নির্দিষ্ট ধর্মের সাথে একাত্মবোধ করেন না এবং ৯ শতাংশ নাস্তিক৷
ছবি: picture-alliance/abaca/SalamPix
কেন এই বদল
রিলিজিয়াস স্টাডিজের অধ্যাপক পুয়ান তামিমি আরাব মনে করেন, এই পরিবর্তনের পেছনে বড় ভূমিকা পালন করছে শিক্ষা ও নগরায়ন৷ পাশাপাশি, গোটা বিশ্বের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ধারা প্রথাগত পরিবারের ধারণাকেও বদলেছে, ফলে পারিবারিক স্তরে যা যা আগে করা হতো, এখন তা বদলেছে৷ এক্ষেত্রে ইন্টারনেটও একটি বড় ‘ফ্যাক্টর’ বলে মনে করেন তামিমি আরাব৷
ছবি: Fotolia/Gina Sanders
সরকারি তথ্য ও বাস্তবতা...
সরকারি তথ্য অনুযায়ী, ইরানে ৯৯ দশমিক ৫ শতাংশ মানুষই শিয়াপন্থি৷ অথচ সমীক্ষা বলছে অন্য কথা৷ গামানের সমীক্ষা অনুযায়ী, অংশগ্রহণকারীদের ৭৮ শতাংশ ঈশ্বরবিশ্বাসী হিসাবে নিজেদের পরিচয় দিলেও, মাত্র ৩২ শতাংশ নিজেদের শিয়া পরিচয় দেন৷ ৫ শতাংশ জানান যে, তারা সুন্নি মুসলিম৷ ৭ শতাংশ আধ্যাত্মিক ও ৬ শতাংশ অ্যাগনস্টিক বা অজ্ঞেয়বাদী৷
১০০টি দেশে ধর্মচর্চা বিষয়ে নানা সমীক্ষার ভিত্তিতে সমাজতাত্ত্বিক রনাল্ড ইংলেহার্টের মত, দ্রুত গতিতে সেকুলারিজমের দিকে হাঁটা কোনো একটি মধ্যপ্রাচ্যের দেশের বাস্তবতা নয়৷ একই সুরে তামিমি আরাবের মত, ‘‘এই যারা কিছুতেই নেই, মানে কোনো নির্দিষ্ট বিশ্বাসের সাথে একাত্মবোধ করেন না, তাদের সংখ্যা মরক্কো, ইরাক ও তিউনিশিয়ার মতো দেশে বাড়ছে৷’’
ছবি: Changiz M. Varzi
ধর্ম রাষ্ট্রে ও বিশ্বাসে
মানুষ কতটা ধার্মিক, তার সাথে যুক্ত ধর্মের প্রতি রাষ্ট্রের মনোভাবও৷ অধ্যাপক জেমস ডরসের মতে, এই চারিত্রিক ভিন্নতা বোঝা যাবে সংযুক্ত আরব আমিরাতের সাথে সৌদি আরবের তুলনা করলে৷ একদিকে, আমিরাতে মদ্যপান নিষিদ্ধ নয়৷ অবিবাহিত নারী-পুরুষ একসাথে থাকতে পারেন সেখানে৷ অন্যদিকে, সৌদি আরবে নাস্তিকতা যেন এক ধরনের সন্ত্রাসী আচরণ হিসাবে পরিচিত৷ তাঁর মত, কোন দেশের নাগরিক কতটা ধার্মিক, তা নির্ধারণ করে রাষ্ট্রের মনোভাব৷