সাংবাদিক জামাল খাশগজিকে নিয়ে সৌদি আরবের প্রাথমিক তদন্তে এটাই বেরিয়ে এসেছে যে ইস্তনবুলে দেশটির কনস্যুলেটে তাঁর মৃত্যু হয়েছে৷ এই ঘটনায় এক ঊধ্বর্তন গোয়েন্দা কর্মকর্তাকে চাকুরিচ্যুত এবং ১৮ সৌদি নাগরিককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে৷
বিজ্ঞাপন
অবশেষে নিখোঁজ সৌদি সাংবাদিক জামাল খাশগজির মৃত্যু হয়েছে বলে স্বীকার করেছে সৌদি আরব৷ তুরস্কে দেশটির কনস্যুলেটে তাঁর মৃত্যু হয়৷ সৌদি আরবের রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা এসপিএ শনিবার এই সংবাদ প্রকাশ করেছে৷
সৌদি পাবলিক প্রসিকিউটরের বরাতে সংবাদ সংস্থাটি লিখেছে, ‘‘জামাল খাশগজি এবং সৌদি কনস্যুলেটে তাঁর সঙ্গে যাদের আলোচনা হচ্ছিল, তাদের সঙ্গে কথোপকথন এক পর্যায়ে ‘মারামারিতে' রূপ নেয়, আর এতে তাঁর মৃত্যু হয়৷''
সৌদি ক্ষমতাকেন্দ্রে তারুণ্য
সৌদি আরবের ভবিষ্যৎ বাদশাহ মহম্মদ বিন সালমান ‘এমবিএস’ নামেও পরিচিত৷ গত কয়েক বছরে ক্ষমতাকেন্দ্রে তাঁর উত্থান সবার নজর কেড়েছে৷ এই তরুণ নেতা সম্পর্কে এই তথ্যগুলো কি জানা আছে?
ছবি: picture-alliance/dpa/R. Jensen
বাদশাহর আস্থাভাজন
অশীতিপর বাবা বাদশাহ সালমান কার্যত দেশের ক্ষমতা প্রিয় ছেলের হাতেই তুলে দিয়েছেন বলে অনেকে মনে করেন৷ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ছাড়াও তিনি পেট্রোলিয়াম কোম্পানি আরামকো ও দেশের অর্থনৈতিক সংস্কারের দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন৷ উপ প্রধানমন্ত্রী পদও তাঁর দখলে ছিল৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/Saudi Press Agency
ঝুঁকি নিতে ভয় পান না
প্রচণ্ড পরিশ্রমী বলে পরিচিত মহম্মদ বিন সালমান সৌদি শাসকগোষ্ঠীর এতকালের ধীরস্থির ভাবমূর্তি ভেঙে দিয়েছেন৷ অর্থনৈতিক সংস্কারসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে তিনি এতদিনের নানা প্রথা ভেঙে দ্রুত পদক্ষেপ নিয়ে সবাইকে চমকে দিয়েছেন৷ তাঁর সমর্থকরা মনে করেন, বর্তমান চ্যালেঞ্জগুলির মোকাবিলা করতে দেশে এমন নেতারই প্রয়োজন৷
ছবি: picture-alliance/abaca/Balkis Press
পররাষ্ট্র নীতির পরিবর্তন
এতকালের সংযম ভেঙে ফেলে সৌদি আরব গোটা অঞ্চলে নিজস্ব স্বার্থরক্ষায় বেশ কিছু বিতর্কিত পদক্ষেপ নিচ্ছে৷ ইরানের প্রতি বৈরি মনোভাব, ইয়েমেনে সেনা অভিযান থেকে শুরু করে কাতারকে একঘরে করে ফেলার সিদ্ধান্তের পেছনেও মহম্মদ বিন সুলতানের স্বাক্ষর স্পষ্ট৷ ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার স্থপতিও তিনি৷
ছবি: picture alliance / AP Photo
রাজপরিবারে উত্থান
সৌদি রাজপরিবারের জটিল ক্ষমতার কাঠামোর মধ্যে সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বীদের কোণঠাসা করে বাদশাহর ঠিক পরে শীর্ষ স্থানে পৌঁছানোর মতো অসাধ্যসাধন করেছেন ‘এমবিএস’৷ শুধু তাই নয়, এতকাল মনোনীত ‘ক্রাউন প্রিন্স’ মহম্মদ বিন নায়েফ (বামে) স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও উপাধি খুইয়েও তাঁর প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেছেন৷
ছবি: Reuters/Saudi Press Agency
ব্যতিক্রমী জীবন
সৌদি রাজপরিবারের সন্তানরা সাধারনত বিদেশে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেন, কমপক্ষে মাস্টার্স ডিগ্রি পর্যন্ত পৌঁছে যান৷ মহম্মদ বিন সালমান সেই পথে না গিয়ে দেশে থেকেই আইন নিয়ে পড়েছেন এবং বাবার কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত থেকেছেন৷ বাদশাহ সালমান যখন নিজে ক্রাউন প্রিন্স ছিলেন, তখনও তিনি বাবার রাজসভার দায়িত্বে ছিলেন৷
ছবি: Getty Images
পেট্রোলিয়ামের উপর নির্ভরতা
সৌদি অর্থনীতি এতকাল তার বিশাল পেট্রোলিয়াম ভাণ্ডারের উপর নির্ভর করে ছিল৷ মহম্মদ বিন সালমান অর্থনীতির খোলনলচে বদলে ২০৩০ সালের মধ্যে সেই পরিস্থিতি বদলানোর উদ্যোগ শুরু করেছেন৷ ভরতুকিসহ অনেক সুযোগসুবিধা বন্ধ করে তিনি বেশ কিছু অপ্রিয় সিদ্ধান্তও নিয়েছেন৷
ছবি: Reuters/Ali Jarekji
ধর্মীয় অনুশাসন
সৌদি আরবের প্রভাবশালী ধর্মীয় নেতাদের সঙ্গে এখনো কোনো বড় সংঘাতে যাননি মহম্মদ বিন সালমান৷ তবে দেশের বিশাল যুবসমাজের কথা ভেবে তিনি সংগীতের জলসা, অ্যামিউজমেন্ট পার্ক ইত্যাদির ব্যবস্থা করেছেন৷ সেইসঙ্গে ধর্মীয় অনুশাসনের তত্ত্বাবধায়ক পুলিশের দৌরাত্ম্য কিছুটা কমিয়েছেন৷
ছবি: Getty Images/AFP/A. Hilabi
7 ছবি1 | 7
প্রসঙ্গত, গত দুই অক্টোবর তুরস্কের ইস্তানবুলে অবস্থিত সৌদি কনস্যুলেটে প্রবেশের পর থেকে নিঁখোজ ছিলেন সৌদি ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানের সমালোচক হিসেবে পরিচিত খাশগজি৷ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাসিত জীবনযাপন করা এই সাংবাদিক সেদিন তাঁর তুর্কি বাগদত্তাকে বিয়ে করতে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সংগ্রহ করতে কনস্যুলেটে গিয়েছিলেন৷
তুরস্ক অবশ্য শুরু থেকেই দাবি করে আসছিল যে খাশগজিকে সৌদি কনস্যুলেটের মধ্যে হত্যা করা হয়েছে৷ দেশটির সরকারপন্থি গণমাধ্যম এমন খবরও প্রকাশ করেছে, সাংবাদিককে হত্যার জন্য সৌদি আরব থেকে একটি বিশেষ টিম তুরস্কে আসে এবং তাঁকে হত্যার পর দ্রুত ইস্তানবুল ত্যাগ করে৷ খাশগজিকে নির্যাতন করে হত্যার পর তাঁর মরদেহ কেটে টুকরো টুকরো করে লুকিয়ে ফেলা হয়েছে বলেও দাবি করেছে তুর্কি সংবাদমাধ্যম৷
খাশগজির মৃত্যুর খবর সৌদি আরব শুরুর দিকে স্বীকার করতে চায়নি৷ বরং বিষয়টিকে ভিত্তিহীন বলে ‘উড়িয়ে' দেয়ার সর্বাত্মক চেষ্টা করেছে দেশটি৷ কিন্তু, আন্তর্জাতিক চাপ বাড়তে থাকে৷ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মানি এবং ফ্রান্স বিষয়টি নিয়ে সৌদি সরকারের কাছে পরিষ্কার ব্যখ্যা চায়৷ গতসপ্তাহে একাধিক মার্কিন সংবাদমাধ্যম জানায় যে খাশগজির মৃত্যুর কথা স্বীকার করে নিতে প্রস্তুতি নিচ্ছে দেশটি৷
এদিকে, খাশগজির মৃত্যুর খবর প্রকাশের পর তাঁর পরিবার, বাগদত্তা আর বন্ধুদের প্রতি গভীর সমবেদনা প্রকাশ করেছেন হোয়াইট হাউসের মুখপাত্র সারাহ হুকাবি স্যান্ডার্স৷ তিনি বলেন, ‘‘আমরা এই বিয়োগান্তক ঘটনার আন্তর্জাতিক তদন্ত নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছি এবং সব প্রক্রিয়া অনুসরণ করে যাতে সময়মতো ন্যায় বিচার নিশ্চিত করা হয় তার জন্য চেষ্টা চালাচ্ছি৷''
উল্লেখ্য, খাশগজির মৃত্যুর খবর জানা গেলেও এখনো আরো অনেক কিছু জানা বাকি রয়ে গেছে৷ তিনি কোন পরিস্থিতিতে কিভাবে মারা গেছেন, সেটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড কিনা এবং কারা তাঁর মৃত্যুর জন্য দায়ী তা এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি৷ আন্তর্জাতিক সমাজ এই বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ তদন্তের দাবি জানিয়েছে৷ সৌদি আরবেরর রাজপরিবারের সঙ্গে খাশগজির মৃত্যুর কোন সম্পর্ক প্রমাণ হলে পশ্চিমা সমাজের সঙ্গে দেশটির সম্পর্কে টানাপোড়েন সৃষ্টির আশঙ্কাও করছেন বিশেষজ্ঞরা৷