মিনায় হাজিদের মৃত্যু নিয়ে সৌদি সরকারের দায়িত্বশীলতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে ফেসবুকে ‘স্ট্যাটাস' দেয়ায়, এক উন্নয়নকর্মীসহ দু'জন আটক হয়েছেন৷ তাঁদের স্থানীয় এক আওয়ামী লীগ নেতার তথ্য-প্রযুক্তি আইনে দায়ের করা মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়৷
বিজ্ঞাপন
[No title]
পুলিশের দাবি, ‘‘ঐ স্ট্যাটাসে হজ নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্য করা হয়েছে৷'' অথচ সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ‘লিডার্স'-এর নির্বাহী পরিচালক, উন্নয়কর্মী মোহন কুমার মন্ডল তাঁর ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছিলেন, ‘‘শয়তানকে পাথর মারার জন্য এত মানুষের লাশ, লাশের স্তূপ করা দেখে মনে হচ্ছিল লতিফ সিদ্দিকী ভাই সঠিক বলেছিলেন৷ তবে সৌদি কর্তৃপক্ষ কাস্টমারদের সাথে ভালো ব্যবহার করেনি৷ দু'টি দরজা বন্ধ করে দিলে সেটি সাথে সাথে হাজিদের জানালো হলো না কেন? কিন্তু একটা কথা মাথায় ঢোকে না৷ শয়তানকে পাথর মারার জন্য লক্ষ লক্ষ খরচ করে মিনায় যেতে হবে কেন? আপনার আমার বাড়ির পাশের শয়তানকে একটা পাথর মারুন না!'''
বাংলাদেশসহ বেশ কিছু দেশে পবিত্র ঈদ-উল-আজহা পালিত হচ্ছে শুক্রবার৷ তবে বৃহস্পতিবার ঈদ উদযাপন করছিল সৌদি আরবের মানুষ৷ ঈদের দিনে হজের আনুষ্ঠানিকতাও ঠিকভাবেই চলছিল৷ একেবারে শেষ দিকে হুড়োহুড়ি শুরু হওয়ার কারণেই শুরু হয় বিপর্যয়৷
অথচ একটু আগেই সবই ছিল শান্ত
হজের একেবারে শেষ দিকের একটি আনুষ্ঠানিকতা ‘বড় জামারা’, অর্থাৎ ‘বড় শয়তান’-কে লক্ষ্য করে নুড়ি ছুড়ে মারা৷ নির্বিঘ্নেই শুরু হয়েছিল এই আনুষ্ঠানিকতা৷ প্রতীকী অর্থে শয়তানকে ঢিল ছোড়ার জন্য পাথর সংগ্রহ করার সময়ও বিশ্বের নানা দেশ থেকে আসা ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের মাঝে কোনো উত্তেজনা বা আতঙ্ক লক্ষ্য করা যায়নি৷
ছবি: Reuters/Ahmad Masood
একদিকে নিশ্চিন্ত মানুষ, অন্যদিকে....
হাজিদের নির্বিঘ্নে শয়তানকে লক্ষ্য করে নুড়ি বা পাথর ছোড়ার এই ছবি দেখে কে বলবে এই আনুষ্ঠানিকতা সারতে গিয়েই জীবনাবসান হতে পারে অনেকের! অথচ তা-ই হয়েছে৷ পায়ের নীচে চাপা পড়ে সাতশ’রও বেশি মানুষ মারা গেছে, আহতের সংখ্যাও অনেক৷
ছবি: Reuters/Ahmad Masood
উদ্ধার তৎপরতা
ভিড়ের চাপ এবং হুড়োহুড়িতে হতাহতের খবর ছড়িয়ে পড়ার পরই নিরাপত্তাকর্মীরা ঘটনাস্থলে উদ্ধার তৎপরতা শুরু করে৷ ততক্ষণে অবশ্য মৃত্যুর মিছিলটা অনেক দীর্ঘ গয়ে গেছে!
ছবি: Reuters/Saudi Civil Defense agency
নির্দেশনা না মানায়
সৌদি স্বাস্থ্যমন্ত্রী খালিদ আল-ফালিহ-র ধারণা, হজযাত্রীরা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা ঠিকভাবে না মানায় এই দুর্ঘটনা ঘটে থাকতে পারে৷
ছবি: Reuters/Stringer
সৌদির সমালোচনায় খামেনেই
ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি-খামেনেই দুর্ঘটনার জন্য সৌদি কর্তৃপক্ষের ‘অব্যবস্থাপনা’-কে দায়ী করেছেন৷ দুর্ঘটনায় ইরানের প্রায় একশ’র বেশি হজযাত্রী নিহত হয়েছেন৷ তাই দেশটিতে তিন দিনের শোক ঘোষণা করা হয়েছে৷
ছবি: picture alliance/AP Photo
পরিকল্পনা পর্যালোচনা
দুর্ঘটনার পর সৌদি বাদশা সালমান হজ পরিকল্পনা নতুন করে পর্যালোচনার নির্দেশ দিয়েছেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa/O. Douliery
পোপের শোক প্রকাশ
পোপ ফ্রান্সিস বৃহস্পতিবার নিউ ইয়র্কে তাঁর সান্ধ্য প্রার্থনাসভার সূচনায় মিনায় নিহতদের জন্য সহানুভূতি প্রকাশ করেছেন৷ পোপ সেন্ট প্যাট্রিকস ক্যাথিড্রালে তাঁর প্রাথমিক প্রার্থনায় বলেন, ‘‘এই প্রার্থনার মুহূর্তে আমি তোমাদের সকলের সঙ্গে ঈশ্বরের প্রতি প্রার্থনায় মিলিত হচ্ছি৷’’
ছবি: Reuters
জার্মানির পক্ষ থেকে শোক
জার্মান প্রেসিডেন্ট ইওয়াখিম গাউক, জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল এবং জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী ফ্রাংক-ভাল্টার স্টাইনমায়ার মিনার ঘটনায় শোক প্রকাশ করেছেন৷
ছবি: Getty Images/AFP/O. Andersen
ফুটবল, রাগবি ইভেন্টের ব্যবস্থাপনা আরও ভালো!
এ বছর ২০ লক্ষ হজযাত্রীর নিরাপত্তার জন্য প্রায় এক লক্ষ নিরাপত্তা বাহিনীর ব্যবস্থা করেছিল সৌদি আরব৷ কিন্তু তারা এত বড় জনসমাবেশের নিরাপত্তা দেয়ার মতো প্রশিক্ষিত নন এবং নিরাপত্তা কর্মীদের ভাষাজ্ঞানের অভাব রয়েছে বলে মন্তব্য করেন ইরফান আল-আলাউই৷ মক্কায় যে উন্নয়ন কাজ চলছে তার কঠোর সমালোচক আলাউই৷ তিনি মনে করেন সর্বোচ্চ পর্যায়ে ফুটবল ও রাগবি প্রতিযোগিতা আরও ভালভাবে আয়োজন করা হয়৷
ছবি: Reuters/Saudi Red Crescent
২৫ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বড়
১৯৯০ সালে হজের সময় মক্কায় এক দুর্ঘটনায় পদদলিত হয়ে ১,৪২৬ জন নিহত হয়েছিল৷ ওটাই এখন পর্যন্ত হজ সম্পর্কিত দুর্ঘটনায় নিহতের সবচেয়ে বড় সংখ্যা৷ বৃহস্পতিবারের দুর্ঘটনার অবস্থান তার পরেই৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo
দু’সপ্তাহের মধ্যে সৌদিতে আবার শোকের ছায়া
গত ১১ সেপ্টেম্বরও দুর্ঘটনার কারণেই খবরের শিরোনামে এসেছিল সৌদি আরব৷ সেদিন মক্কার মসজিদুল হারামে ক্রেন ভেঙে পড়ায় মারা যান ১০৯ জন৷ ৯ বছর আগে আরেকটি বড় দুর্ঘটনা ঘটেছিল সৌদি আরবে৷ সেবার শয়তানকে লক্ষ্য করে নুড়ি ছুড়ে মারার সময়ই নিহত হয়েছিলেন ৩৬৪ জন হাজি৷
ছবি: picture-alliance/dpa/AA/O. Bilgin
12 ছবি1 | 12
শনিবার দেয়া এই স্ট্যাটাসটি তিনি ২৪ মিনিট পর প্রত্যাহারও করে নেন৷ কিন্তু তারপরও তাঁকে রেহাই দেয়নি পুলিশ৷ অবশ্য শুধু তাঁকে নয়, তাঁর স্ট্যাটাসকে সমর্থন (লাইক) দেয়ার অভিযোগে শওকত গাজী নামে আরো একজনকে আটক করা হয়৷
তাঁদের বিরুদ্ধে তথ্য-প্রযুক্তি আইন বা আইসিটি অ্যাক্টের ৫৭ (২) ধারায় মামলা করেন শ্যামনগর সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আকবর কবীর৷ স্থানীয় সূত্র দাবি করছে, ‘‘পূর্ব শত্রুতার জের ধরে তিনি মামলাটি করেন৷'
এই গ্রেপ্তারের ঘটনায় সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ব্যাপক সমালোচনা হচ্ছে৷ তাঁদের মুক্তি দাবি করে অনেকেই ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছেন৷ সৌদি আরবের সমালোচনা করে লিখেছেন তাসলিমা নাসরিনও৷
বাংলাদেশের বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল এটিএন নিউজ-এর ডেপুটি বার্তা প্রধান প্রভাষ আমিন ডয়চে ভেলেকে বলেন,‘‘আমি মোহন কুমার মন্ডলসহ আটক দু'জনের মুক্তি চাই৷ তথ্য-প্রযুক্তি আইনের অপব্যবহার করে তাঁদের আটক করা হয়ছে৷ মোহন ধর্মের অবমাননা করেননি, সৌদি সরকারের অব্যবস্থাপনায় হাজিদের মৃত্যুর সমালোচনা করেছেম৷ তাঁর স্ট্যাটাস পড়ে আমার কাছে মনে হয়েছে যে, হজকে হেয় বা খাট করা তাঁর উদ্দেশ্য নয়৷ সৌদি সরকারের সমালোচনা করা কোনো বেআইনি কাজ হতে পারে না৷''
তিনি বলেন, ‘‘আমিও মনে করি সৌদি সরকার হাজিদের জীবনের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে৷ তাদের অবশ্যই জবাবদিহি করতে হবে৷''
[No title]
প্রভাষ আমিন এও মনে করেন, ‘‘আইসিটি আইনের ৫৭ ধারা বাতিল করা প্রয়োজন৷ কারণ এই আইনটি দিয়ে যে কাউকে গ্রেপ্তার করা যায়৷ সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে কোনো মন্তব্য বা পোস্ট কারুর বিরুদ্ধে গেলে বা অনুভূতিতে আঘাত করলে তিনি মামলা করে দিতে পারেন৷ অনুভূতি এভাবে ঢালাও হতে পারে না৷''
শ্যামনগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ইনামুল হকের কাছে অভিযোগের ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি ডয়চে ভেলেকে ফেসবুক স্ট্যাটাসটি পড়ে শোনান এবং বলেন, ‘‘হজ নিয়ে খারাপ মন্তব্য করা হয়েছে৷'' স্ট্যাটাসে সৌদি সরকারে যে সমালোচনা রয়েছে, সেটা বেআইনি কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘বেআইনি কিনা আমার জানা নেই৷''