করোনা ভাইরাসের সময়ে বিশ্ববাজারে কমেছে অপরিশোধিত তেলের চাহিদা৷ আর তা ভাবনায় ফেলেছে তেল-অর্থনীতির উপর টিকে থাকা মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোকে৷
বিজ্ঞাপন
তেল রপ্তানিকারক দেশগুলোর ভাবনায় এ বিষয়টি নাড়া দিয়েছে যে, তেলের বিশ্ববাজার জীবাশ্ম জ্বালানির দিকে ঝুঁকে পড়ছে৷ আর তাই কমে যেতে পারে খনিজ তেলের চাহিদা৷
অপরিশোধিত তেলের বাজার একেবারে ফুরিয়ে যাওয়ার আগে নিজেদের আখের গোছাতে ব্যস্ত সৌদি আরব৷দেশটির রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত তেল উৎপাদনকারী সংস্থা আরামকো অপরিশোধিত তেল উৎপাদন বাড়িয়ে দিয়েছে৷ জানা গেছে, তেলের দৈনিক উৎপাদন ১২ মিলিয়ন ব্যারেল থেকে ১৩ মিলিয়নে উন্নীত করার পরিকল্পনা করছে দেশটি৷ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশ্ববাজারে পরিবেশবান্ধব তেলের চাহিদা বাড়ার আগেই নিজেদের তেল রপ্তানি বাড়িয়ে মুনাফা হাতিয়ে নিতে চাইছে তারা৷
এদিকে পশ্চিমা দেশগুলোতে অপরিশোধিত তেলের চাহিদা কমলে নতুন বাজারে নিজেদের অবস্থান ধরে রাখার পরিকল্পনাও করছে দেশটি৷ এজন্য ভারত ও চীনের মতো দেশগুলোতে নিজেদের অবস্থান শক্ত করতে চাইছে তারা৷
তবে এখনো খনিজ তেলের বিশ্ব বাজার নিয়ে আশাবাদী আরামকো৷ ‘‘জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে বিশ্ব বাজারে তেলের চাহিদা বাড়বে৷ খুব দ্রুতই এ বাজারের পতন ঘটার আশঙ্কা নেই,'' বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে দেওয়া এক বিবৃতিতে এমন মন্তব্য করেন আরামকোর এক কর্মকর্তা৷
সৌদি আরবের ক্রাউন প্রিন্স মোহামেদ বিন সালমানের নতুন অর্থনৈতিক পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য অর্থ প্রয়োজন৷ প্রিন্স সালমান ২০৩০ সালের মধ্যে তেল রপ্তানির উপর দেশটির নির্ভরতা কমিয়ে আনতে চান৷ আর এ জন্য তার প্রয়োজন অর্থ৷ সে অর্থের অন্যতম উৎস তেল রপ্তানি৷
আর তাই অধিক পরিমানে তেল রপ্তানি করে উপার্জিত টাকা অন্য খাতে বিনিয়োগের কথা ভাবছেন সালমান, বিশেষজ্ঞদের বরাত দিয়ে জানিয়েছে রয়টার্স৷
এদিকে বাজারে পরিবেশবান্ধব তেলের চাহিদা বাড়ার কারণে, আরামকোকেও সে বিষয়ে ভাবতে হচ্ছে৷ আরামকোর তেল তার প্রতিযোগী প্রতিষ্ঠানগুলোর চেয়ে বেশি পরিবেশবান্ধব৷ আরামকোর প্রতি ব্যারেল তেলে কার্বন ডাই অক্সাইডের তীব্রতা দশ দশমিক এক কেজি যা তার প্রতিযোগীদের চেয়ে অনেক কম৷
প্রতিষ্ঠানটির একজন কর্মকর্তা রয়টার্সকে বলেন, ‘‘আমাদের লক্ষ্য হলো পরিবেশবান্ধব তেল উৎপাদনে মনোযোগী হওয়া আর উৎপাদন খরচ কমিয়ে আনা৷ পাশাপাশি তেল উৎপাদন বাড়ানোর দিকেও আমাদের নজর রয়েছে যেন প্রতিযোগীদের সাথে পাল্লা দিয়ে আমরা টিকে থাকতে পারি৷''
তেল গবেষণা প্রতিষ্ঠান এনার্জি অ্যাসপেক্টস-এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা অমৃতা সেন মনে করেন, যে দেশগুলো পরিবেশবান্ধব উপায়ে তেল উৎপাদন করতে পারবে তারা বাজারে টিকে থাকবে৷ আর এক্ষেত্রে সৌদি প্রতিষ্ঠান আরামকো ভালো অবস্থানে থাকবে৷
তেলের দাম কমায় বিপদে যারা
চাহিদার চেয়ে উৎপাদন বেশি আর বিশ্ব অর্থনীতিতে অস্বস্তির কারণে অশোধিত তেলের দাম প্রতিনিয়ত কমছে৷ এতে অনেকে লাভবান হলেও বিপদে পড়ছে কেউ কেউ৷
ছবি: picture-alliance/dpa/W. Hong
দাম শুধু কমছেই
তেলের দাম কমতে থাকায় নরওয়েও রক্ষা পাচ্ছে না৷ স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশটি গত কয়েকবছরে তার অর্থনীতির দ্রুত উন্নয়ন ঘটিয়েছে নর্থ সি থেকে তেল তুলে৷ কিন্তু তেলের দাম কমতে থাকায় দেশটির নীতিনির্ধারকরা ভাবনায় পড়ে গেছেন৷ এখন তারা চিন্তা করছেন তেল তোলার চেয়ে মৎস খাতকে সমৃদ্ধ করা লাভজনক কিনা৷
ছবি: picture-alliance/dpa/O. Hagen
দ্বিগুণ বিপদ
পশ্চিমাদের নানাবিধ নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়ে এমনিতেই বিপদে আছে রাশিয়া৷ তার সঙ্গে এখন যোগ হয়েছে তেলের মূল্যহ্রাসের জটিলতা৷ নিষেধাজ্ঞার কারণে গতবছর রাশিয়ার মুদ্রা রুবেলে ডলারের বিপরীতে ব্যাপক গুরুত্ব হারিয়েছে৷ দেশটিতে বেতনও কমানো হয়েছে৷ ধারণা করা হচ্ছে, চলতি বছর আর্থিকভাবে আরো অনেক দুর্বল হয়ে পড়বে রাশিয়া৷
ছবি: Getty Images/AFP/A. Druzhinin
অনিশ্চিত ভবিষ্যত
নাইজেরিয়া হচ্ছে আফ্রিকার সবচেয়ে বড় তেল উৎপাদনকারী দেশ৷ ক্ষমতায় আসার আগেই দেশটির প্রেসিডেন্ট মোহাম্মাদু বুহারি ঘোষণা দিয়েছিলেন সরকারের খরচ আরো বাড়াবেন তিনি৷ কিন্তু তেলের দাম কমায় সেই ঘোষণা বাস্তবায়ন সম্ভব হবে কিনা তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
নতুন বাস্তবতা
নাইজেরিয়া একমাত্র দেশ নয় যেটি তেলের মূল্য যখন বেশি ছিল তখনকার ভিত্তিতে চলতি বছরের বাজেট নির্ধারণ করেছিল৷ এখন তেলের দাম কমায় বাজেটে তাই বিস্তর ফারাক সৃষ্টি হচ্ছে৷ ২০১৪ সালের মধ্যভাগের তুলনায় বর্তমানে অশোধিত তেলের দাম ব্যারেল প্রতি কমেছে প্রায় ৭৫ শতাংশ৷ বিশেষজ্ঞরা এখন যৌক্তিকভাবেই ধরে নিচ্ছেন, তেলের দাম শীঘ্রই আবার বাড়ার কোনো সম্ভাবনা নেই৷
নিষেধাজ্ঞা লাঘবের পর
পশ্চিমাদের নিষেধাজ্ঞা থেকে মুক্তি পাওয়ার পর ইরান এখন তেলের উৎপাদন আরো অনেক বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে৷ এর ফলে তেলের দাম ভবিষ্যতে আরো কমার শঙ্কা তৈরি হয়েছে৷ তবে দেশটি তেলের ব্যাপক মূল্যহ্রাসের জন্য সৌদি আরবকে দায়ী করছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/A. Taherkenareh
কম দেয়া, বেশি নেয়া
মার্কিন ফ্র্যাকিং ইন্ডাস্ট্রি এবং ইরানের মতো প্রতিদ্বন্দ্বীদের কাছ থেকে নিজেকে নিরাপদ রাখতে আন্তর্জাতিক বাজারে তেল রপ্তানির পরিমাণ কমানোর আহ্বান নাকচ করে দিয়েছে সৌদি আরব৷ তবে তেলের দাম ব্যাপক হারে কমায় বিশ্বের সবচেয়ে বড় তেল রপ্তানিকারক দেশটিও এখন বিপাকে পড়ছে৷ দেশটি ব্যাপক বাজেট ঘাটতির শিকার হতে পারে বলে মনে করছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)৷
ছবি: picture-alliance/dpa/P. Grimm
ভেনিজুয়েলায় পরিবর্তনের হাওয়া
বিশ্বের সবচেয়ে বড় তেলের মজুদ রয়েছে ভেনেজুয়েলার কাছে৷ দেশটির সমাজতান্ত্রিক সরকার তেল বিক্রি থেকে অর্জিত মুনাফা দিয়ে এতকাল জনগণের জন্য প্রয়োজনের চেয়ে বেশি অর্থ খরচ করে বিভিন্ন সামাজিক কর্মসূচি পরিচালনা করেছে৷ কিন্তু এখন দেশটিতে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়েছে তেলের দাম কমে যাওয়ায়৷
ছবি: Reuters
এখন কী হবে?
বর্তমান সময়ে বিশ্বের সবচেয়ে বড় জ্বালানি উৎপাদনকারী দেশ হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র৷ তবে তেলের দাম কমায় সেদেশের ফ্র্যাকিং ইন্ডাস্ট্রি ক্রমশ লোকসানের দিকে আগাচ্ছে৷ গাড়ি চালকদের জন্য অবশ্য তেলের কম দাম আনন্দের৷ এই আনন্দে বড় বড় গাড়ি বিক্রি বাড়ছে, যা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর৷