মানুষের তৈরি প্রথম মহাকাশযান, যা দীর্ঘদিন ধরে মহাকাশে ঘুরছিল, সেই ভয়েজার গত বছর তারকামণ্ডলের বাইরে চলে গেছে৷ নতুন গবেষণায় জানা গেছে এটি সৌরজগত ছেড়ে পুরোপুরি চলে গেছে৷
বিজ্ঞাপন
ভয়েজার মহাকাশযানটি কখন সৌরজগতের চৌম্বক ক্ষেত্রের ঠিক ভিন্ন দিক দিয়ে একটি চৌম্বক ক্ষেত্র নির্ধারণ করে তা দেখার অপেক্ষায় ছিলেন বিজ্ঞানীরা৷ কিন্তু দেখতে পেলেন এর ভিন্ন চিত্র৷
বৃহস্পতিবার মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ মার্ক সুইসড্যাক রয়টার্সকে জানান, তাঁরা ভেবেছিলেন, সৌরজগত এবং তারকামণ্ডলের চৌম্বকক্ষেত্র প্রায় একই রকম৷ তাই কোনো মহাকাশযানের ক্ষেত্র পরিবর্তন হওয়ার সময় তার নিজের কোনো পরিবর্তন হওয়ার কথা নয়৷
ইউরোপীয় মঙ্গলগ্রহ অভিযানের ১০ বছর
চার বছর আগে ইউরোপের ‘মার্স এক্সপ্রেস’ মঙ্গলগ্রহের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেছিল৷ তারপর প্রায় ১২,০০০ বার মঙ্গল প্রদক্ষিণ করেছে যানটি৷ ফলে গোটা গ্রহের থ্রি়ডি বা ত্রিমাত্রিক মডেল তৈরির কাজ প্রায় শেষ৷
ছবি: picture-alliance/dpa
দীর্ঘ অভিযান
২০০৩ সালের ২রা জুন ‘মার্স এক্সপ্রেস’ মঙ্গলগ্রহের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে৷ ইউরোপীয় মহাকাশ সংস্থা এসা-র এই অভিযানের মেয়াদ স্থির করা হয়েছিল ৬৮৭ দিন, যা মঙ্গলগ্রহের হিসাবে ঠিক এক বছর৷ কিন্তু ‘মার্স এক্সপ্রেস’ গত প্রায় ১০ বছর ধরে ছবি ও মূল্যবান তথ্য পাঠিয়ে চলেছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
বিশাল দায়িত্ব
‘মার্স এক্সপ্রেস’ ইউরোপের প্রথম মঙ্গলগ্রহ অভিযান৷ এর মূল উদ্দেশ্য ছিল সম্পূর্ণ ও বিস্তারিত মানচিত্র তৈরি করা৷ তাছাড়া মঙ্গলের বায়ুমণ্ডল, ভূ-পৃষ্ঠ ও তার গঠন সম্পর্কেও তথ্য সংগ্রহ করারও ছিল অন্যতম কাজ৷
ছবি: AP
ধীরে ধীরে রহস্য উন্মোচন
প্রায় ১২,০০০ বার মঙ্গলগ্রহ প্রদক্ষিণ করেছে ‘মার্স এক্সপ্রেস’৷ এরই মধ্যে বিশেষ স্টিরিও ক্যামেরা প্রায় তিন-চতুর্থাংশের ছবি তুলে ফেলেছে৷ ফলে গোটা গ্রহের থ্রিডি মডেল তৈরির কাজ প্রায় শেষ হতে চলেছে৷
ছবি: AP
ধাঁধার উত্তর খোঁজার কঠিন কাজ
জার্মান এয়ারোস্পেস সেন্টার ডিএলআর এই অভিযানে ক্যামেরা সরবরাহ করেছে৷ সম্ভবত এটাই জার্মানির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান৷ এতে আছে বিভিন্ন কোণ থেকে ছবি তোলার জন্য উন্নত মানের ৯টি ডিটেক্টর৷ সেই ছবি সত্যি চমকপ্রদ৷
ছবি: ESA/DLR/FU Berlin (G. Neukum)
গোটা বিশ্বে আগ্রহ
শুধু ইউরোপ নয় গোটা বিশ্বের বিজ্ঞান জগতই মঙ্গলগ্রহ সম্পর্কে অত্যন্ত আগ্রহী৷ আমাদের সৌরজগতে মঙ্গলগ্রহের সঙ্গেই পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি মিল রয়েছে৷ মহাকাশ বিশেষজ্ঞদের মতে, পৃথিবী ও মানবজাতির ভবিষ্যৎ সম্পর্কে জানতে মঙ্গলগ্রহ সম্পর্কে আরও তথ্য সংগ্রহ করতে হবে৷
ছবি: cc by sa NASA/JPL/MSSS & User:DrLee
মঙ্গলগ্রহের টান
মঙ্গলগ্রহ সম্পর্কে অ্যামেরিকার আগ্রহও কম নয়৷ ২০১২ সালের ৬ই অগাস্ট থেকে ‘মার্স রোভার কিউরিয়সিটি’ মঙ্গলগ্রহে ঘুরে বেড়াচ্ছে৷ এটাই এখনো পর্যন্ত সেই গ্রহে সবচেয়ে বড় রোবোট৷ অভিযানের ব্যয় প্রায় ২৫০ কোটি ডলার, যা একটা রেকর্ড৷
ছবি: NASA/JPL-Caltech/Malin Space Science Systems
ভিন্ন গ্রহে প্রাণের সন্ধান
কিউরিয়সিটি মঙ্গলগ্রহের মাটিতে প্রাণের চিহ্নের খোঁজ চালাচ্ছে৷ বিশেষ কিছু খনিজের অস্তিত্ব ও পরিমাণ এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ৷ সে সব বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা মঙ্গলগ্রহের বায়ুমণ্ডলের গত প্রায় ৪০০ কোটি বছরের বিবর্তনের হদিস পেতে চান৷
ছবি: picture alliance/AP Photo/NASA
মহাকাশযানের ভিড়
১৯৬০ সাল থেকে প্রায় ৪০টি যান মঙ্গলগ্রহে পাঠানো হয়েছে৷ তবে সবকটি সফল হয় নি৷ কয়েকটি যান তো মঙ্গলগ্রহের কক্ষপথ পর্যন্তও পৌঁছতে পারে নি৷ মূলত অ্যামেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়ন তথা রাশিয়াই এক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে৷ ইউরোপ শুধু ‘মার্স এক্সপ্রেস’ পাঠিয়েছে৷
ছবি: ESA
গ্রহদের মধ্যে আত্মীয়তা
মঙ্গলগ্রহ (ডানে) পৃথিবীর বেশ কাছেই রয়েছে৷ সূর্য থেকে তার দূরত্ব ২২ কোটি ৮০ লক্ষ কিলোমিটার (পৃথিবী: ১৫ কোটি, শুক্রগ্রহ: ১০ কোটি, ৮০ লক্ষ, বুধগ্রহ: ৫ কোটি ৮০ লক্ষ)৷ মঙ্গলগ্রহের বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইড ও নাইট্রোজেনের আধিক্যই বেশি৷ আয়তনের বিচারে পৃথিবীর সঙ্গে শুক্রগ্রহের মিলই বেশি৷ তারও বায়ুমণ্ডল রয়েছে৷ সূর্যের সবচেয়ে কাছে রয়েছে বুধগ্রহ৷ তার অবশ্য বায়ুমণ্ডল নেই৷
ছবি: NASA/Lunar and Planetary Institute
যা জানা গেছে
মার্স রোভার-এর তোলা অসংখ্য ছবি ও পরিমাপের ভিত্তিতে অনেক নতুন তথ্য জানা গেছে৷ যেমন পাওয়া গেছে বিশাল আগ্নেয়গিরি৷ কিছু গহ্বর প্রায় ৪,০০০ কিলোমিটার দীর্ঘ ও ৭ কিলোমিটার গভীর৷ মঙ্গলের লাল রঙের কারণ ফেরিক অক্সাইড-এর ধুলো৷ ভূ-প্রৃষ্ঠ ও বায়ুমণ্ডলেও তা ছড়িয়ে রয়েছে৷
ছবি: AP
পানির খোঁজ
মঙ্গলগ্রহের দুই মেরুতে জমাট কার্বন ডাই-অক্সাইড ও বরফ রয়েছে৷ উত্তর মেরুর বরফের স্তর প্রায় ১,০০০ কিলোমিটার দীর্ঘ ও প্রায় পাঁচ কিলোমিটার গভীর৷ দক্ষিণ মেরুর বরফ ৩৫০ কিলোমিটার দীর্ঘ ও দেড় কিলোমিটার গভীর৷ পানির অস্তিত্বের সম্ভাবনাও রয়েছে৷ ফিনিক্স নামের এক যান পানির বিন্দু আবিষ্কার করেছে৷
ছবি: picture-alliance/ dpa ESA
সবচেয়ে বড় প্রশ্ন
কখনো কি মঙ্গলগ্রহে প্রাণের অস্তিত্ব ছিল? হয়ত ছিল৷ বা ছিল না৷ উত্তর যাই হোক না কেন, পৃথিবীর মানুষের আগ্রহ কমার কোনো লক্ষণ নেই৷
ছবি: AP
12 ছবি1 | 12
কিন্তু গত বছর গ্রীষ্মে হঠাৎ করেই সূর্য থেকে বেশি কিছু কণা এবং তারকামণ্ডল থেকে মহাজাগতিক রশ্মি নিঃসরণের পরিমাণ বেড়ে গিয়েছিল৷ অর্থাৎ সে সময় ভয়েজার তারকামণ্ডল অতিক্রম করছিল৷
তবে, মার্কের এ মতের সাথে অনেকের অমিলও রয়েছে৷
নাসার সাবেক কর্মকর্তা এবং ভয়েজার প্রকল্পের প্রধান বিজ্ঞানী এডওয়ার্ড স্টোন বলছেন, সুইসড্যাকের গবেষণাটা অদ্ভূত৷ কেননা ভয়েজারের তথ্যের বিষয়ে বিভিন্ন কম্পিউটার নানা তথ্য দিতে পারে৷
স্টোনের মত অনেক বিজ্ঞানীদের বিশ্বাস, ভয়েজার তার আগের অজানা অবস্থানেই আছে, সেটা কোন ম্যাগনেটিক হাইওয়ে হতে পারে, যা হেলিওস্ফেয়ার এবং তারকামণ্ডলের মধ্যকার কোনো স্থান৷
সৌরজগতের গ্রহগুলোর চারপাশের অবস্থান জানার জন্য ১৯৭৭ সালে ভয়েজার ১ ও এর সহযোগী যান ভয়েজার ২ মহাকাশে পাঠানো হয়েছিল৷ বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি থেকে ভয়েজার ১ যে শক্তি সংগ্রহ করে, তা শেষ হবে ২০২০ সালের মধ্যে৷ আর ২০২৫ সালের মধ্যে এটির শক্তি পুরোপুরি শেষ হয়ে যাওয়ার কথা৷ তবে বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, ভয়েজার ২ যদি সৌরজগতের বাইরে চলে যায়, তখন আরো নির্ভুল তথ্য পাওয়া যেতে পারে৷ ভয়েজার ১ এখন সূর্য ও পৃথিবীর মধ্যকার দূরত্বের ১২০ গুন দূরে অবস্থান করছে৷