সৌর বিদ্যুতে শুধু বাতি, ফ্যান বা মোবাইল ফোনে চার্জ দেয়া নয়, চলছে সেচ পাম্পও৷ এতে করে প্রতিদিন ১৫ লাখ গ্যালন পানি উঠছে৷ কুষ্টিয়া, রংপুর ও দিনাজপুরে চলছে এই ‘ইরিগেশন পাম্প'৷
বিজ্ঞাপন
শান্তিতে নোবেল জয়ী প্রতিষ্ঠান গ্রামীণ ব্যাংকের সহ-উদ্যোক্তা এবং ‘বাংলাদেশ সোলার অ্যান্ড রিনিউয়েবল এনার্জি অ্যাসোসিয়েশন' বিএসআরইএ-এর সভাপতি ও ব্রাইট গ্রিন এনার্জি ফাউন্ডেশন বিজিইএফ-এর প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান দীপাল বড়ুয়া ডয়চে ভেলের সঙ্গে এক একান্ত সাক্ষৎকারে জানিয়েছেন বাংলাদেশে সৌর বিদ্যুতের আদ্যপান্ত৷
‘সোলার হোম সিস্টেম'-এর এই জনক জানান, প্রাথমিকভাবে এই প্রকল্প সফল হয়েছে৷ অর্থাৎ আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে বাংলাদেশের সকল সেচ পাম্প চলবে সৌরবিদ্যুতে৷
সৌরশক্তিকে মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়ার জন্য ড. বড়ুয়া ইতিমধ্যে নানান আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছেন৷ তিনি বলেন, ‘‘কৃষি প্রধান দেশ বাংলাদেশে কয়েক লাখ ‘ইরিগেশন পাম্প' চলে৷ এগুলোর অধিকাংশই ডিজেল চালিত৷ তবে কিছু কিছু বিদ্যুতেও চলে৷ বলা বাহুল্য, এগুলো ডিজেলে চললে কালো ধোয়া বের হয়, ব্যয় হয় প্রচুর অর্থের৷ আর ইরিগেশন মৌসুমে দেশের বিভিন্ন এলাকায় লোডশেডিং করে বিদ্যুৎ দেয়া হয় সেচ পাম্পে৷ ফলে দেশে তখন বিদ্যুতের ঘাটতি দেখা দেয়ষ৷ কিন্তু এই পাম্পগুলো সোলারে চললে অর্থের অপচয় যেমন রোধ করা যাবে, পরিবেশও রক্ষা পাবে৷ তাই আমরা সেচ পাম্পগুলো সব সোলারে নিয়ে যেতে কাজ করছি৷ এর জন্য অবশ্য একটু সময় লাগবে৷''
বাংলাদেশে সৌরশক্তির ব্যবহার দ্রুত বাড়ছে
বাংলাদেশে গ্রামীণ শক্তি কার্যত নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে বিপ্লব এনেছে৷ ইতোমধ্যে দশ লাখ সোলার সিস্টেম স্থাপনের রেকর্ড গড়েছে প্রতিষ্ঠানটি৷ ৬৪ জেলাতেই চলছে তাদের কার্যক্রম৷ এই বিষয়ে আমাদের ছবিঘর৷
ছবি: MUNIR UZ ZAMAN/AFP/Getty Images
সৌরবিপ্লব
বাংলাদেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে কার্যত বিপ্লব এনেছে গ্রামীণ শক্তি৷ গত বছরের শুরুতে দশ লাখ সোলার সিস্টেম স্থাপনের রেকর্ড গড়ে তারা৷ ২০১৫ সাল নাগাদ আরো দশ লাখ সোলার সিস্টেম স্থাপনের রেকর্ড গড়তে চায় তারা৷
ছবি: picture-alliance/dpa
শুরুর কথা
বাংলাদেশে গ্রামীণ শক্তির যাত্রা শুরু হয় ১৯৯৬ সালে৷ নবায়নযোগ্য জ্বালানির সুবিধা সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে কাজ করছে প্রতিষ্ঠানটি৷ শান্তিতে নোবেলজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান৷
ছবি: picture-alliance/dpa
৬৪ জেলায় কার্যক্রম
বাংলাদেশে ৬৪ জেলাতেই কাজ করছে গ্রামীণ শক্তি৷ ২০১৩ সালে প্রকাশিত হিসেব অনুযায়ী, ইতোমধ্যে ৫০ হাজার গ্রামে সেবা পৌঁছে দিয়েছে সংস্থাটি৷ গ্রামীণ শক্তির মাধ্যমে পাওয়া সৌর প্যানেল ব্যবহার করে লাভবানের সংখ্যা আট মিলিয়নের বেশি৷
ছবি: MUNIR UZ ZAMAN/AFP/Getty Images
শুধু গ্রামীণ শক্তি নয়
গ্রামীণ শক্তি ছাড়াও আরো কয়েকটি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে সৌরশক্তি সেবা প্রদান করছে৷ রয়েছে সরকারি উদ্যোগও৷ সরকারি বিভিন্ন ভবনে সৌরশক্তি ব্যবহারের উদ্যোগও শুরু হয়েছে৷ ঢাকায় পরিসংখ্যান ব্যুরো ভবনের ছাদে সোলার প্যানেল বসানো হয়েছে গত বছর৷ (ফাইল ফটো)
ছবি: MUNIR UZ ZAMAN/AFP/Getty Images
জাতীয় গ্রিডের জন্য সৌরশক্তি
সৌরশক্তি থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে বেসরকারি সংস্থা ‘রহিমআফরোজ রিনিউবেল এনার্জি’৷ প্রতিষ্ঠানটি ইতোমধ্যে ঢাকার সচিবালয়ের ছাদে সোলার প্যানেল বসিয়েছে৷ তাদের উৎপাদিত বিদ্যুৎ মেগাওয়াট প্রতি নির্দিষ্ট দামে কিনে নেবে ঢাকা বিদ্যুৎ বিতরণ কর্তৃপক্ষ৷ (ফাইল ফটো)
ছবি: ROBYN BECK/AFP/Getty Images
সহায়তায় জার্মানি
বাংলাদেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানি বিশেষ করে সৌরশক্তির ব্যবহার বাড়াতে সহায়তা করছে জার্মান আন্তর্জাতিক সহযোগী সংস্থা জিআইজেড৷ সোলার প্যানেলে মূল্য বেশি হওয়ায় শুরুতে ভর্তুকিও দিয়েছে জিআইজেড৷ তবে কিস্তিতে সোলার প্যানেল কেনার সুবিধা থাকায় প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষ সহজেই সেগুলো ব্যবহার করতে পারছে৷ (ফাইল ফটো)
ছবি: Centro de Energía Chile
লক্ষ্য অর্ধেক জনশক্তি
২০২১ সাল নাগাদ বাংলাদেশের অর্ধেক জনগোষ্ঠীর কাছে সৌরশক্তির সুবিধা পৌঁছে দিতে চান এই খাতের সংশ্লিষ্টরা৷ ডয়চে ভেলেকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে একথা জানান বাংলাদেশে সৌরশক্তি জনপ্রিয় করার অন্যতম কারিগর দীপাল চন্দ্র বড়ুয়া৷
ছবি: MUNIR UZ ZAMAN/AFP/Getty Images
7 ছবি1 | 7
গ্রামীণ শক্তির প্রতিষ্ঠাতা দীপাল বড়ুয়া বলেন, বর্তমানে বাংলাদেশে ১৫ শতাংশ বা সোয়া ২ কোটি মানুষ ‘সোলার সিস্টেম' ব্যবহার করেন৷ আগামী দুই বছরের মধ্যে এই সংখ্যা ২৫ শতাংশে বা ৪ কোটি মানুষের মধ্যে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা চলছে৷ তিনি সরকারকে ধন্যবাদ দিয়ে বলেন, ‘‘এতদিন এই উদ্যোগ ছিল বেসরকারি পর্যায়ে৷ এখন এটা জাতীয় উদ্যোগ৷ কারণ সরকার সংসদ সদস্য ও স্থানীয় সরকার পর্যায়ে যে টেস্ট রিলিফ (টিআর) বা কাজের বিনিময়ে খাদ্যের (কাবিখা) জন্য যে বরাদ্দ দিচ্ছে, তাতে সোলার প্যানেল স্থাপন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে৷ এর বাইরেও সরকার এক বা দুই মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য বড় আকারের প্যানেল স্থানের উদ্যোগ নিয়েছে৷ এর অর্থ হলো, সরকার এই দিকে এখন বেশ ভালোই মনোযোগ দিয়েছে বলে মনে হচ্ছে৷''
সৌর শক্তি ব্যবহারে বাংলাদেশ বিশ্বে প্রথম হবে এমনটাই প্রত্যাশা দীপাল বড়ুয়ার কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘‘বাংলাদেশে সূর্যের প্রখরতা অনেক বেশি৷ তাছাড়া অনেক বেশি সময় সূর্যের আলো যাওয়া যায়৷ ১৯৯৬ সালে এটি চালুর পর গত ২০ বছরে এর প্রসার অনেক বেড়েছে৷'' বর্তমানে বাংলাদেশে ৫০টি বড় প্রতিষ্ঠানসহ ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় ৩০০ বেসরকারি প্রতিষ্ঠান কাজ করছে৷ প্রত্যন্ত অঞ্চলে পৌঁছে গেছে এই বিদ্যুতের ব্যবস্থা৷
দেশেই তৈরি হচ্ছে সোলার প্যানেল
বাংলাদেশের ছয়টি প্রতিষ্ঠান এখন সোলার প্যানেল উৎপাদন করছে৷ এছাড়া সৌরশক্তি বিষয়ে অনেক গবেষণা হচ্ছে৷ ফলে সৌরবিদ্যুতের দাম দিন দিন কমছে বলে জানান বাংলাদেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানি জনপ্রিয় করার অন্যতম ব্যক্তি দীপাল বড়ুয়া৷
ছবি: Fotolia/Marco2811
দাম কমছে
বাংলাদেশের ছয়টি প্রতিষ্ঠান এখন সোলার প্যানেল উৎপাদন করছে৷ এছাড়া সৌরশক্তি বিষয়ে অনেক গবেষণা হচ্ছে৷ ফলে সৌরবিদ্যুতের দাম দিন দিন কমছে বলে জানান ‘বাংলাদেশ সোলার অ্যান্ড রিনিউয়েবল এনার্জি এসোসিয়েশন’ বা বিএসআরইএ-র সভাপতি দীপাল চন্দ্র বড়ুয়া৷
ছবি: MUNIR UZ ZAMAN/AFP/Getty Images
দেশেই তৈরি হচ্ছে
বড়ুয়া বলেন, সোলার প্যানেল সাধারণত চীন থেকে আমদানি করা হয়৷ তবে এখন দেশেও এটা তৈরি হচ্ছে৷ এছাড়া এলইডি অ্যাসেম্বলিং, চার্জ কন্ট্রোলার তৈরির মতো কাজ করতে সমর্থ হওয়ায় বাংলাদেশের মানুষ এখন কম খরচে সৌরশক্তি ব্যবহার করতে পারছে৷
ছবি: MUNIR UZ ZAMAN/AFP/Getty Images
মাসে ৮০ হাজার
বর্তমানে বাংলাদেশে প্রতিমাসে ৮০ হাজার সোলার হোম সিস্টেম বিক্রি হচ্ছে বলে জানান বড়ুয়া৷ ২০১২ সালে এই সংখ্যাটা ছিল অর্ধেক অর্থাৎ ৪০ হাজার৷
ছবি: BGEF
সবার জন্য বিদ্যুৎ
বড়ুয়ার আশা আগামী ৫-৭ বছরের মধ্যে প্রতিটি গ্রামে, প্রতিটি বাড়িতে সৌরশক্তি পৌঁছে যাবে৷ যারা এখনো বিদ্যুৎ বঞ্চিত তাদের ঘরেও বিদ্যুৎ পৌঁছে যাবে৷ কারণ সরকারি প্রতিষ্ঠান ইডকলের আর্থিক সহায়তায় ছোট-বড় প্রায় ৫০টি প্রতিষ্ঠান এ খাতে কাজ করছে৷
ছবি: BGEF
সোলার হোম সিস্টেম
পাঁচজনের একটা পরিবারের জন্য ৪০-৫০ ওয়াটের সোলার হোম সিস্টেম হলেই চলে বলে জানান বড়ুয়া৷ এই সিস্টেম দিয়ে ঘরে লাইটের ব্যবস্থা করা, টিভি দেখা ও মোবাইল চার্জ করা যায়৷ তবে ফ্যান চালাতে হলে ৮৫ বা ১০০ ওয়াটে যেতে হবে৷
ছবি: MUNIR UZ ZAMAN/AFP/Getty Images
খরচ কেমন?
দীপাল বড়ুয়া বলেন, বিশ বছরের জন্য ২০ ওয়াটের একটি প্যানেল নিলে, সঙ্গে পাঁচ বছর মেয়াদী ব্যাটারি, তিন বছরের জন্য চার্জ কন্ট্রোলার আর এলইডি লাইট ৩ থেকে ৫ বছরের জন্য, এমন হলে ১২ হাজার টাকা খরচ হবে৷ তবে ক্রেতাকে টাকাটা একসঙ্গে দিতে হয় না৷ ১০ বা ১৫ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে বাকি টাকাটা কিস্তিতে দেয়ার সুযোগ রয়েছে৷ এ ক্ষেত্রে তিন বছর পর আর কোনো টাকা লাগবে না৷
ছবি: BGEF
বুদ্ধি করে ব্যবহারে লাভ
ব্যাটারির ক্ষেত্রে পাঁচ বছরের গ্যারান্টি থাকলেও বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে ব্যবহার করলে ৬-৭ বছরও চলে যায় বলে জানান বড়ুয়া৷ এরপর ব্যাটারিটা বদলে নতুন ব্যাটারি নেয়ার ক্ষেত্রে ক্রেতাকে আগের ব্যাটারির খরচের এক-তৃতীয়াংশ টাকা ফেরত দেয়া হয়৷ ছবিতে নারীদের সৌরশক্তি ব্যবহারের প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে৷
ছবি: BGEF
গ্রিডে সরবরাহের সুযোগ
জার্মানিতে নিজের ছাদে বসানো সৌর প্যানেল থেকে জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ সরবরাহের সুযোগ রয়েছে৷ এর ফলে বাড়ির মালিক নিজে বিদ্যুৎ ব্যবহারের পাশাপাশি বাড়িত বিদ্যুৎ সরকারের কাছে বেচে অর্থ উপার্জন করতে পারে৷ বাংলাদেশেও এ ধরনের ব্যবস্থা চালুর জন্য সরকারের কাছে প্রস্তাব দিয়েছে বিএসআরইএ, জানান দীপাল বড়ুয়া৷
ছবি: Fotolia/Marco2811
8 ছবি1 | 8
শুধু অর্থ সাশ্রয় বা পরিবেশবান্ধবই নয়, নারীর ক্ষমতায়নেও কাজ করছে এই সৌর বিদ্যুৎ৷ কিভাবে নারীর ক্ষমতায়ন হচ্ছে? এমন প্রশ্নের জবাবে দীপাল বড়ুয়া বলেন, ‘‘প্রতিটি সোলার প্যানেলে চার্জ কন্ট্রোলার লাগে৷ এগুলো তৈরি করছে নারীরা৷ পাশাপাশি সোলার প্যানেল চালানোর জন্য নারীদের প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে৷ কারণ বাড়ির পুরুষরা নানা কাজে বাইরে থাকেন৷ বাড়িতে থাকেন নারীরা৷ ফলে এই প্যানেলটি তারাই দেখভাল করেন৷ আর ট্রেনিং প্রাপ্ত নারীরা শুধু নিজের বাড়ির সৌর প্যানেলই নয়, আশেপাশের বাড়ির প্যানেলগুলো সংস্কার করে অর্থ উপার্জন করছে৷ এই কাজে বিপুল সংখ্যক নারীর সম্পৃক্ততা রয়েছে৷''
জার্মান ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান জিআইজেড প্রত্যন্ত অঞ্চলে সৌরশক্তি পৌঁছে দিতে দারুণভাবে কাজ করেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘‘প্রত্যন্ত গ্রামে যে ছোট আকারের ‘সোলার সিস্টেম' স্থাপন করা যায়, সেটা তারাই প্রথম দেখিয়েছে৷ পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বড় আকারের সোলার প্যানেল স্থাপনের জন্য তারা কাজ করছে বলে উল্লেখ করেন তিনি৷