জার্মানিতে আনুষ্ঠানিকভাবে স্কুল ছুটি হওয়ার আগে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে না জানিয়ে সন্তানকে ছুটি কাটাতে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগে ১০ শিক্ষার্থীর বাবা-মা-কে জরিমানা করেছে পুলিশ৷ বাভেরিয়া রাজ্যের এক বিমানবন্দরে এই ঘটনা ঘটেছে৷
বিজ্ঞাপন
জার্মানিতে স্কুল পালানোকে বড় অপরাধ হিসেবে দেখা হয় এবং ছয় থেকে ১৬ বছর বয়সি সন্তানদের মা-বাবাকে সন্তানকে স্কুলে না পাঠানোর জন্য দায়ী করা যেতে পারে৷
ডেয়ার স্পিগেল ম্যাগাজিন জানিয়েছে, আনুষ্ঠানিকভাবে স্কুল ছুটি শুরু হওয়ার আগের সপ্তাহে ছয় জন পুলিশ বাভেরিয়া রাজ্যের মেমিঙ্গেন বিমানবন্দরে উপস্থিত শিশুদের পরিবারকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে৷ কোনো পরিবারের সঙ্গে স্কুলে যেতে পারে এমন বয়সি শিশু থাকলে সেই পরিবারের কাছে প্রথমে ‘ভালোভাবে’ সন্তানের স্কুলের নাম জানতে চেয়েছে পুলিশ৷ তারপর ঐ স্কুলকে ফোন করে পুলিশ ঐ শিক্ষার্থীর ছুটির অনুমতি আছে কিনা, জানতে চেয়েছে৷ এভাবে পুলিশ ১০টি পরিবার পেয়েছে, যারা স্কুল থেকে অনুমতি নেয়নি৷ এই অভিযোগে পুলিশ তাঁদের জরিমানা করেছে৷ মিউনিখভিত্তিক প্রচারমাধ্যম ‘বায়ারিশার রুন্ডফুংক’ বলছে, স্কুল পালানোর জরিমানা এক হাজার ইউরো পর্যন্ত হতে পারে৷
স্কুলে প্রথম দিনে যা করা হয়
স্কুলের এক্কেবারে প্রথম দিনটায় কিছু শিশু রোমাঞ্চ অনুভব করে, কেউ কেউ আবার ভয় পায়৷ কিন্তু দিনটা এড়ানোর তো কোনো উপায় নেই৷ জার্মান স্কুলগুলোয় প্রথম দিনে অনেক কিছু করা হয়, যার কতগুলো শত বছর আগে থেকেই প্রচলিত৷
ছবি: picture alliance/dpa/P. Steffen
উপহারভর্তি ঠোঙা
জার্মান শিশুদের স্কুলের প্রথমদিন উপহারসামগ্রী ভর্তি একটি ‘শুলট্যুটে’ বা ঠোঙা নিয়ে যেতে হয়৷ বাচ্চাদের উৎসাহ দেয়ার জন্য এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ৷ স্কুলে শিশুটির ১২-১৩ বছর যাতে মধুর হয়, সে জন্যই সম্ভবত ঠোঙার মধ্যে বেশি করে মিষ্টি চকলেট ভরে দেওয়া হয়৷ সেই ঊনিশ শতক থেকেই এটা চালু রয়েছে৷
ছবি: imago/Kickner
নতুন অধ্যায়ের সূচনা
অধিকাংশ শিশুর বয়স ছ’বছর হলে রাজ্য ভেদে আগস্ট বা সেপ্টেম্বর মাসে স্কুল জীবন শুরু হয়৷ তবে এই শিশুদের অধিকাংশই এর আগের সময়টা কিন্ডারগার্টেন বা ডে-কেয়ার সেন্টারে কাটিয়ে আসে৷ এ সমস্ত সেন্টারে লেখাপড়া বা নিয়মকানুনের বিশেষ কোনো চাপ নেই৷
ছবি: Getty Images/AFP/S.Khan
সঠিক ব্যাগ বাছাই
প্রথমদিন শিশুকে স্কুলে পাঠানোর আগে তার জন্য সঠিক ব্যাকপ্যাকটি বাছাই করতে হয় অভিভাবকদের৷ এই ব্যাগের নাম ‘শলরানৎসেন’৷ এই ব্যাগ সাধারণ চৌকো হয়, যাতে সেটা বেঁকে না যায় এবং ভেতরে থাকা খাবার নষ্ট না হয়৷ শিশুরা স্কুল জীবনের শুরুর দিকে নিজেদের পোশাকের চেয়ে ব্যাগকেই গুরুত্ব দেয় বেশি৷ তাই বাচ্চাকে হালের ফ্যাশন অনুযায়ী ব্যাকপ্যাক কিনে দিলে তারা খুশি হয়৷
ছবি: picture-alliance/dpa
স্কুলে যা দেয়া গুরুত্বপূর্ণ
কেনার পর ব্যাগটি প্রথমদিনের জন্য প্রয়োজনীয় কলম, পেন্সিল, রুলার এবং ফোল্ডার দিয়ে ভরতে হয়৷ জার্মানির স্কুলগুলোতে প্রায়ই লাঞ্চের ব্যবস্থা থাকে না৷ তবে ক্লাসের ফাঁকে বাচ্চাদের একটা স্ন্যাক বিরতি দেয়া হয়৷ সেসময় খাওয়ার জন্য তাদের দিতে হয় ‘পাওসেব্রট’ বা ‘বিরতির রুটি’৷ তাই এ জন্য উপযোগী একটি টিফিনবক্সও স্কুলব্যাগের মধ্যে রাখা চাই৷
ছবি: picture-alliance/dpa/F. Gentsch
মনে রাখার মতো একটা দিন
অনেক অভিভাবকই সন্তানের প্রথম স্কুলে যাওয়ার দিনটির বা স্কুলের জন্য তৈরি হওয়া, সাজসজ্জার ছবি তুলে রাখেন৷ তাই কাঁধে ব্যাগ আর হাতে ‘শুলট্যুটে’ – প্রায় সব বাচ্চারই এমন ছবি দেখা যায়৷ ব্যাগটির আয়তন অবস্য বেশিরভাগক্ষেত্রেই শিশুর বড় হয়৷ ওপরে লেখা থাকে ‘স্কুলে আমার প্রথম দিন’৷ হ্যাঁ, ঠিক যেমনটা দেখতে পারছেন ছবিতে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/R. Hirschberger
আশীর্বাদ
জার্মানিতে স্কুলের প্রথমদিনটি পড়াশোনা দিয়ে শুরু হয় না৷ বরং এই দিন বিশেষ এক প্রার্থনাসভার মাধ্যমে শুরু হয় বাচ্চাদের স্কুল জীবন৷ শিশুদের অভিভাবক, আত্মীয়স্বজন আর ‘গড-প্যারেন্টসদের’ সেই সভায় আমন্ত্রণ জানানো হয়৷ সার্বজনীন গির্জায় অনুষ্ঠিত এই সভায় শিশুদের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য প্রার্থনা করা হয়৷
ছবি: picture-alliance/dpa
অভিজ্ঞদের নেতৃত্বদান
স্কুলের শুরুতে পুরনো শিক্ষার্থী এবং শিক্ষকরা স্কুল সম্পর্কে নবাগতদের একটি ধারণা দেয়ার চেষ্টা করেন৷ অনেক স্কুলে তৃতীয় বা চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের সঙ্গে নবাগতদের মধ্যে বন্ধুত্ব করিয়ে দেয়া হয়, যাতে তারা নতুনদের স্কুলটি চেনিয়ে দিতে সাহায্য করতে পারে৷
ছবি: picture alliance/dpa/P. Steffen
স্কুলের সঙ্গে মানিয়ে নেয়া
স্কুলে নবাগতদের প্রথম দিনই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে স্কুলটি দেখানো হয়, যাতে তারা সেখানে নিজেদের মানিয়ে নিতে পারে৷ স্কুলের আকার অনুযায়ী নবাগতদের ক্লাসরুমগুলো ‘ওয়ান এ’, ‘ওয়ান বি’, ‘ওয়ান সি’ ইত্যাদি লেবেলে সাজিয়ে দেয়া হয়৷ আর ক্লাসরুমের ভেতরে ব্ল্যাকবোর্ডে লেখা থাকে ‘‘স্বাগতম, ক্লাস ওয়ান এ’’ – এমন সব শুভেচ্ছাবার্তা৷
ছবি: picture alliance/dpa/G. Kirchner
পারিবারিক পুর্নমিলনী
প্রথমদিন স্কুল শেষে বাড়ি ফিরেই শিশুরা বাবা-মা, ভাই-বোন, এমনকি দূরের আত্মীয়স্বজনদেরও কাছে পায়৷ কেননা, অনেক পরিবারই সন্তানের স্কুলে যাওয়ার প্রথম এই দিনটিকে উদযাপন করার জন্য বাড়িতে ছোটখাট পার্টির আয়োজন করেন৷ সেখানে শিশুটিকে নতুন জগতে প্রবেশের জন্য অভিনন্দন জানানো হয়৷ বলাবাহুল্য, একদিনে এতসব আয়োজন অনেক শিশুকে কিছুটা শঙ্কিতও করে তোলে৷
ছবি: picture alliance/R. Goldmann
স্কুলে দ্বিতীয় দিন
প্রথমদিন উৎসবে শেষ হলেও ,দ্বিতীয় দিনে কিন্তু শিশুদের প্রথম কাজ হয় নিজের ক্লাসরুম খুঁজে বের করা৷ আর এভাবেই শুরু হয় তার শিক্ষা জীবন৷ প্রাথমিক স্কুলে চারবছর কাটানোর পর, মেধার ভিত্তিতে শিশুদের তিন ধরনের পৃথক স্কুলে পাঠানো হয় জার্মানিতে৷
ছবি: picture alliance/dpa/P. Steffen
10 ছবি1 | 10
পুলিশের এক মুখপাত্র ডেয়ার স্পিগেলকে জানিয়েছেন, ‘‘আমরা অনেকদিন ধরে বিষয়টি জানি এবং তাঁদের ধরা আমাদের অন্যতম কাজ৷’’ তিনি বলেন, ‘‘(ফোন করার পর) শিক্ষক যদি বলেন যে, তিনি শিক্ষার্থীর উপস্থিতি চান, তাহলে আমরা ঐ শিক্ষার্থীকে স্কুলে নিয়ে যাই৷’’ তবে সম্প্রতি ধরা পড়া অভিভাবকদের শুধু জরিমানা করা হয়েছে৷
নিয়ম অনুযায়ী, জার্মানিতে আনুষ্ঠানিকভাবে স্কুলে ছুটি শুরু হওয়ার আগে যদি ছুটির প্রয়োজন হয় তাহলে বাবা-মা-কে স্কুলের প্রধান শিক্ষক বরাবর আবেদন করতে হয়৷
জার্মানিতে স্কুল পালানোর বিষয়ে কঠোর নিয়ম-কানুন থাকলেও অনেক মা-বাবা ভিড় এবং চড়ামূল্যের বিমানভাড়া এড়াতে আগেই ছুটিতে যাওয়ার পরিকল্পনা করে থাকেন৷
আলিস্টেয়ার ওয়ালশ/জেডএইচ
গতবছরের ২১ জুলাইয়ের ছবিঘরটি দেখুন...
জার্মানির স্কুলে যত গোলাগুলি
জার্মানির স্কুলগুলোতে বেশ ক’বার বন্দুকধারীরা আক্রমণ করেছে৷ সর্বপ্রথম আঘাতটি এসেছিল ১৮৭১ সালে৷ এগুলোর মধ্যে বড় কয়েকটি ঘটনা তুলে ধরা হল৷
ছবি: picture-alliance/dpa/Kulturhaus Walle
সারব্রুকেন, ১৮৭১
১৮২০ থেকে ১৮৯১ পর্যন্ত পশ্চিম জার্মানির সারব্র্যুকেনের এই চার্চটিতে একটি স্কুল ছিল৷ একবার ইউলিয়স বেকার নামের মানসিক বিকারগ্রস্ত এক ছাত্র বাজে গ্রেড পায় এবং এর ফলে স্কুল থেকে তাঁর বাবার কাছে একটি নোট যায়৷ এতে ক্ষিপ্ত হয়ে ১৮৭১ সালের ২৫ মে সে দুই ছাত্রকে গুলি করে৷ ছেলে দু’টি গুরুতর আহত হলেও প্রাণে বেঁচে গিয়েছিল৷ বেকারকে কোর্ট কোনো সাজা দেয়নি৷ তবে তাঁর জীবন শেষ হয় একটি সংশোধন কেন্দ্রে৷
ছবি: Imago/W. Otto
ব্রেমেন, ১৯১৩
৩০ বছর বয়সি এক চাকুরিহীন শিক্ষক একবার এক স্কুলে গিয়ে এলোপাথাড়ি গুলি করে৷ তাতে সাত থেকে আট বছর বয়সি পাঁচটি মেয়ে শিশু মারা যায়৷ এই শেষকৃত্যটি সেই শিশুদের৷ ১৯১৩ সালের এই ঘটনায় আরো কয়েকজন শিশু ও কর্মচারী আহত হন৷ হাইনৎস শ্মিড্ট নামের সেই শিক্ষকের জীবনও শেষ হয় আশ্রমে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/Kulturhaus Walle
কোলন, ১৯৬৪
১৯৬৪ সালের ১১ জুন৷ কোলনের ফল্কহোফেন ডিস্ট্রিক্টে ৪২ বছরের যুবক ওয়াল্টার এস একটি ক্যাথলিক প্রাথমিক বিদ্যালয়ে হাতবোমা নিক্ষেপ করে৷ এতে আটজন শিশু এবং দু’জন শিক্ষিকা মারাত্মকভাবে আহত হন৷ আরো বিশজন শিশু এবং দুই শিক্ষকের বিভিন্ন অংশ পুড়ে যায়৷ এস পরে বিষপানে আত্মহত্যা করে৷ তবে মারা যাবার আগে তিনি দাবি করেন যে কেউ তাঁকে মেরে ফেলতে চেয়েছিল, তাই তিনি এ কাজ করেছেন৷
ছবি: picture-alliance/AP Images/H. Sanden Jr.
এপস্টাইন, ১৯৮৩
এই আগ্নেয়াস্ত্রটি ব্যবহার করেছিলেন ৩৪ বছরের চেক শরণার্থী কারেল সি৷ তৎকালীন পশ্চিম জার্মানির এপস্টাইনে ফ্রাইহের-ফম-স্টাইন স্কুলে তিনি ১১-১২ বছরের তিনজন শিক্ষার্থী এবং একজন পুলিশ অফিসারকে মেরে ফেলেন৷ আরো ১৪ জন আহত হন৷ এরপর নিজেও আত্মহত্যা করেন৷ ময়নাতদন্তের রিপোর্ট বলছে, তিনি মদ্যপ ছিলেন৷ কিন্তু কী কারণে ঘটনাটি ঘটিয়েছিলেন তা জানা যায়নি৷
ছবি: picture-alliance/dpa/J. Schmitt
অ্যারফুর্ট, ২০০২
জার্মানির ট্যুরিঙ্গিয়া রাজ্যের অ্যারফুর্টের ম্যাসাকারটি ঘটেছিল ২০০২ সালের ২৬ এপ্রিল৷ গুটেনবার্গ গিমনাসিয়ুমে ১৯ বছর বয়সি রবার্ট এস নামের এক স্কুল থেকে বহিষ্কৃত ছাত্র ১৩ কর্মচারী, দুই শিক্ষার্থী এবং একজন পুলিশ কর্মকর্তাকে গুলি করে মেরে ফেলেন৷ এক শিক্ষক তাকে কোনোরকমে শান্ত করতে সমর্থ হন এবং একটি ঘরে বন্ধ করে রাখেন৷ পরে ঐ ঘরে আত্মহত্যা করেন রবার্ট৷
ছবি: picture-alliance/dpa/M. Schutt
এমস্টেটেন, ২০০৬
এমস্টেটেনের গেশোয়েস্তার-শল স্কুলের এক প্রাক্তন ছাত্র সেবাস্টিয়ান বি৷ ১৮ বছর বয়সি এই তরুণ ২০০৬ সালের ২০ নভেম্বর হঠাৎ করেই বেশ কয়েকটি বন্দুক ও স্মোক বোমা নিয়ে স্কুলে আক্রমণ করেন৷ এতে ১২ থেকে ১৬ বছর বয়সি চার শিক্ষার্থী ও এক পরিচারক মারাত্মক আহত হন৷ এছাড়া আরো স্মোক বোমায়ও ক্ষতিগ্রস্ত হন এক শিক্ষক ও ১৬ জন পুলিশ সদস্য৷ পরে পুলিশ জানায় যে, তিনি প্রায়ই একটি হিংস্র ভিডিও গেম খেলতেন৷
ছবি: picture-alliance/ dpa
ভিনেন্দেন, ২০০৯
২০০৯ সালের ১১ মার্চ টিম কে নামের ভিনেন্দেন শহরের আলবার্টভিলে-রেয়ালশুলের এক সাবেক ছাত্র স্কুলে এসে মাতালের মতো গুলি ছুঁড়তে থাকেন৷ পিস্তলটি তিনি তার বাড়ি থেকে এনেছিলেন৷ তিনি ১৪ থেকে ১৬ বছর বয়সি নয় শিক্ষার্থী, যাদের আটজনই মেয়ে, এবং তিনজন নারী শিক্ষককে হত্যা করেন৷ পরে স্কুলের বাইরে গিয়েও তিনি এমন আচরণ শুরু করেন এবং আরো তিনজনকে হত্যা করেন৷ তারপর আত্মহত্যা করেন৷ কিন্তু তার এহেন মাতলামোর কারণ জানা যায়নি৷