জার্মানির স্কুলগুলোতে ইহুদিবিদ্বেষের ঘটনা বাড়ছে৷ নর্থরাইন ওয়েস্টফালিয়া রাজ্যের এক শিক্ষক এর প্রসার রুখতে কাজ করে যাচ্ছেন৷ শিক্ষার্থীদের তিনি কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প পরিদর্শনে নিয়ে যান৷
বিজ্ঞাপন
৪০ বছর বয়সি ফ্লোরিয়ান বিয়ার একটি সান্ধ্যকালীন স্কুলের শিক্ষক৷ তবে ইদানীং বিভিন্ন স্কুলে ইহুদিবিদ্বেষ নিয়ে ক্লাস নিতে গিয়ে তাঁর ব্যস্ত সময় কাটছে৷ তাঁর স্ত্রী ইহুদি৷
বার্লিনের টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটির এক গবেষণা বলছে, গত ১০ বছরে অনলাইনে ইহুদিবিদ্বেষ সংক্রান্ত মন্তব্য প্রায় তিনগুন বেড়েছে৷
এছাড়া ২০১৭ সালে জার্মানিতে ইহুদিবিদ্বেষ সম্পর্কিত ৩২৪টি অপরাধের ঘটনা ঘটেছে, যা আগের বছরের তুলনায় নয় শতাংশ বেশি৷ রাজ্যের শিক্ষা বিভাগের কাছে সংখ্যাটি অনেক বেশি৷
ইহুদিবিদ্বেষের ঘটনা ঘটার সঙ্গে সঙ্গে তা জানাতে স্কুলগুলোকে নির্দেশ দিয়েছে শিক্ষা বিভাগ৷
‘ইহুদিবিদ্বেষ প্রতিহত করা জার্মানির অন্তহীন দায়িত্ব’
00:49
তবে ফ্লোরিয়ান বিয়ার এমন পদক্ষেপ নিয়ে খুব বেশি সন্তুষ্ট নন৷ ‘‘একদিক দিয়ে চিন্তা করলে এই উদ্যোগ একেবারে ঠিক আছে৷ তবে তারপরও আমার কাছে সেটি সমস্যার মনে হয়েছে, কারণ, যে মুহূর্তে আমি একজন শিক্ষার্থী সম্পর্কে রিপোর্ট করব, তখনই শিক্ষার্থী-শিক্ষক সম্পর্কে ছেদ পড়বে,'' ডয়চে ভেলেকে বলেন তিনি৷
বিয়ার বরং এক্ষেত্রে প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপের পক্ষে৷ তাই তিনি তাঁর শিক্ষার্থীদের বুখেনভাল্ড, সাখসেনহাউসেন কিংবা আউশভিৎসের কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে নিয়ে যান৷ এসব সফরে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে শক্ত প্রতিক্রিয়া পান তিনি৷ ‘‘বেশিরভাগই নীরব থাকে৷ আবার অনেকে একেবারেই কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে যেতে চায় না,'' বলেন বিয়ার৷
তাই শিক্ষাসফরে যাওয়ার জন্য শিক্ষার্থীদের বাধ্য করেন না তিনি৷ কারণ, ক্যাম্প পরিদর্শনে নিয়ে গিয়ে শিক্ষার্থীদের ট্রমায় ফেলতে চান না বিয়ার৷
কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প পরিদর্শন ছাড়াও ইহুদিদের সাধারণ জীবনযাপন সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের ধারণা দেয়ার চেষ্টা করেন বিয়ার৷ সেজন্য তিনি পোল্যান্ডের ক্রাকো শহরে বসবাসরত ইহুদি সম্প্রদায়ের জীবন দেখাতে শিক্ষার্থীদের সেখানে নিয়ে যান৷
জার্মানিতেস্কুলে নবম গ্রেড থেকে হলোকস্ট সম্পর্কে পড়ানো হয়৷ ইতিহাস, জার্মান ভাষা ও ধর্ম ক্লাসে এটি পড়ানো হয়৷ তবে বিয়ার মনে করেন, বর্ণবাদী আচরণ ও ইহুদিবিদ্বেষ সম্পর্কে আরো বেশি পড়া বাধ্যতামূলক করা উচিত৷ কাউকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেয়ার আগে বিজ্ঞান, গণিতের মতো ইহুদিবিদ্বেষ বিষয়েও জানা বাধ্যতামূলক করা উচিত বলে মনে করেন বিয়ার৷
হলোকস্টের স্মরণে জার্মানি যা করেছে, করছে
১৯৪৫ সালের ৮ মে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয় ইউরোপে৷ এরপর থেকে হলোকস্টের শিকার হয়েছিলেন যাঁরা, তাঁদের স্মরণে রাখতে এই গণহত্যার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন স্থাপনা সংরক্ষণ করে আসছে জার্মানি৷
ছবি: picture-alliance/dpa/Sven Hoppe
ডাখাউ
মিউনিখের কাছে ডাখাউ-এ প্রথম কনসেনট্রেশন ক্যাম্পটি স্থাপন করেছিল নাৎসিরা৷ আডল্ফ হিটলারের ক্ষমতা গ্রহণের কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই তাঁর গড়ে তোলা কুখ্যাত আধা-সামরিক বাহিনী বা এসএস-এর সদস্যরা রাজনৈতিক ভিন্নমতাবলম্বীদের সেই ইহুদি নিধন শিবিরে ধরে নিয়ে গিয়ে প্রথমে বন্দি করতো৷ তারপর অমানুষিক নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করতো তাঁদের৷ পরবর্তীতে নাৎসিদের স্থাপন করা অন্যান্য ক্যাম্পগুলো ঐ ডাখাউ-এর আদলেই তৈরি করা হয়েছিল৷
ছবি: picture-alliance/dpa
নাৎসিদের ব়্যালি গ্রাউন্ড
ন্যুরেমব্যার্গে নাৎসি আমলের সবচেয়ে বড় প্রচারণা ব়্যালিটি অনুষ্ঠিত হতো৷ প্রায় ১১ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে থাকা একটি ‘গ্রাউন্ডে’ নাৎসিদের বার্ষিক কংগ্রেস এবং এই ব়্যালি অনুষ্ঠিত হতো, যাতে প্রায় দুই লক্ষ মানুষ অংশগ্রহণ করতেন৷ ছবিতে অসমাপ্ত কংগ্রেস হলটি দেখতে পাচ্ছেন৷ এটি বর্তমানে একটি জাদুঘর এবং ডকুমেন্টেশন সেন্টার৷
ছবি: picture-alliance/Daniel Karmann
হলোকস্টের মূল পরিকল্পনা
বার্লিনের ভানজে লেক এলাকার এই ‘ভানজে হাউস’-টিতে ইহুদি নিধনযজ্ঞের মূল পরিকল্পনা হয়েছিল৷ নাৎসি সরকার ও এসএস বাহিনীর মোট ১৫ জন সদস্য ১৯৪২ সালের ২০ জানুয়ারি এই ভবনে মিলিত হয়ে ‘ফাইনাল সলিউশন’ নামের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন৷ অর্থাৎ জার্মান নিয়ন্ত্রিত অঞ্চল থেকে সব ইহুদিদের তাড়ানো ও তাঁদের শেষ করার পরিকল্পনা নেওয়া হয় এখানেই৷ ১৯৯২ সাল থেকে ভবনটি একটি জাদুঘরে পরিণত হয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
আনে ফ্রাঙ্কের স্মৃতি বিজড়িত
আনে ফ্রাঙ্ককে এখন অনেকেই চেনেন৷ তাঁর ডাইরিও পড়েছেন অনেকে৷ আনে ফ্রাঙ্ক সহ প্রায় ৫০ হাজার ইহুদিকে ব্যার্গেন-বেলজেনের এই কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে হত্যা করা হয়েছিল৷
ছবি: picture alliance/Klaus Nowottnick
হিটলারকে মারার ব্যর্থ পরিকল্পনা
জার্মানিতে হিটলারের নাৎসি অপশাসন প্রতিরোধে ১৯৪৪ সালের ২০ জুলাই সামরিক কর্মকর্তা কর্নেল ক্লাউস ফন স্টাউফেনব্যার্গ-এর নেতৃত্বে একটি দল হিটলারের ওপর বোমা হামলা চালায়৷ কিন্তু হত্যা পরিকল্পনাটি ব্যর্থ হলে, সেই রাতেই বার্লিনের এই ‘বেন্ডলারব্লক’ ভবনে স্টাউফেনব্যার্গ ও তাঁর সঙ্গীদের গুলি করে হত্যা করা হয়৷ এই ভবনটি এখন ‘জার্মান রেসিস্টেন্স মেমোরিয়াল সেন্টার’ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধী হত্যা স্মরণ
হেসে রাজ্যের হাডামারে একটি হাসপাতালের প্রায় ১৫ হাজার শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধীকে হত্যা করা হয়৷ এরকম ‘অক্ষমদের’ নাৎসি সরকার ‘অবাঞ্চিত’ ঘোষণা করেছিল৷ তাই তাঁদের দেহে ইনজেকশনের মাধ্যমে বিষাক্ত ওষুধ প্রবেশ করানোসহ বিভিন্ন উপায়ে হত্যা করা হয়৷ পুরো জার্মানিতে এভাবে প্রায় ৭০ হাজার প্রতিবন্ধীকে মেরে ফেলে নাৎসি বাহিনী৷ পরবর্তীতে নিহতদের স্মরণে হাডামারে একটি স্মৃতিস্তম্ভ গড়ে তোলা হয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
বার্লিনে স্মৃতিস্তম্ভ
হলোকস্টের স্মরণে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষের ৬০ বছর পর, বার্লিনের ঐতিহাসিক ব্রান্ডেনবুর্গ তোরণের কাছে ‘মেমোরিয়াল টু দ্য মার্ডার্ড জিউস অফ ইউরোপ’ নামের এই স্মৃতিস্তম্ভটি স্থাপন করা হয়৷ নিহতদের স্মরণে সেখানে কংক্রিটের ২,৭১১টি স্ল্যাব বসানো হয়েছে৷ ইহুদি নিধনযজ্ঞের শিকার, এমন বহু মানুষের নামও লেখা আছে একটি জায়গায়৷
ছবি: picture-alliance/dpa
সমকামী হত্যা স্মরণ
বার্লিনের ঐ স্মৃতিস্তম্ভ থেকে সামান্য দূরে অবস্থিত ‘টিয়ারগার্টেন’ নামক একটি উদ্যানে স্থাপন করা হয়েছে চার মিটার উঁচু এই স্মৃতিফলক৷ ১৯৩৩ থেকে ১৯৪৫ সালের মধ্যে নাৎসিদের হাতে নিহত সমকামীদের স্মরণে এটি স্থাপন করা হয়৷ এই স্তম্ভের মধ্যে থাকা একটি পর্দায় চোখ রাখলে দুটি ছবি দেখা যায়৷ একটিতে চুমু খাচ্ছেন দু’জন পুরুষ, অন্যটিতে দুই নারী৷
ছবি: picture alliance/Markus C. Hurek
সিন্টি ও রোমা হত্যা স্মরণ
বার্লিনের সংসদ ভবনের ঠিক উল্টো দিকে ২০১২ সালে একটি পার্ক উদ্বোধন করা হয়৷ নাৎসি আমলে নিহত প্রায় পাঁচ লক্ষ সিন্টি ও রোমার স্মরণে এটি স্থাপন করা হয়েছিল৷
ছবি: picture-alliance/dpa
স্মতিস্মারক হিসেবে ‘শ্টলপারশ্টাইন’
নব্বইয়ের দশকে শিল্পী গুন্টার ডেমনিগ নাৎসি নির্যাতনের শিকাররা যে সব বাড়িতে বাস করতেন, সেগুলোর সামনে রাস্তার ওপর সোনালি পাতের ছবির মতো এই স্মৃতিস্মারক বসানো শুরু করেন৷ এতে যিনি নির্যাতিত হয়েছিলেন, তাঁর নাম, তাঁকে ধরে নিয়ে যাওয়া ও মেরে ফেলার তারিখ লেখা আছে৷ ইউরোপের ১৮টি দেশে এরকম ৪৫ হাজারেরও বেশি ‘শ্টলপারশ্টাইন’ রয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
মিউনিখের ব্রাউন হাউস
নাৎসি আমল শেষের এত বছর পরও সে সময়ের স্মৃতি ধরে রাখতে তৎপর জার্মানি৷ তাই তো ৩০ এপ্রিল, ২০১৫-তে আরও একটি ডকুমেন্টেশন সেন্টার উদ্বোধন করতে যাচ্ছে জার্মানি৷ মিউনিখ শহরে হিটলারের অফিসের অদূরে যেখানে নাৎসিদের প্রধান কার্যালয় ছিল, সেই ব্রাউন হাউসে ‘ডকুমেন্টেশন সেন্টার ফর দ্য হিস্টরি অফ ন্যাশনাল সোশ্যালিজম’ নামের এই সেন্টারটির উদ্বোধন করা হবে৷