স্কুলে চাকরিরত ৩৬ হাজারের নিয়োগ বাতিল আদালতে
১৪ মে ২০২৩নজিরবিহীন রায়
বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় অতীতে এই নিয়োগ দুর্নীতির শুনানিতে কঠোর পদক্ষেপের হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘আমি ঢাকি সমেত বিসর্জন দিয়ে দেব।‘ সেই অনুযায়ী শুক্রবার তার নজিরবিহীন নির্দেশ। এই প্রথমবার এতজনের চাকরি একলপ্তে বাতিল করল আদালত। ২০১৬ সালে নিযুক্ত সাড়ে ৪২ হাজার শিক্ষকের মধ্যে বাতিল হয়ে গেল প্রশিক্ষণহীন ৩৬ হাজারের চাকরি। পদে থাকলেন মাত্র সাড়ে ৬ হাজার শিক্ষক।
৩৬ হাজার নিয়োগপ্রাপ্তের চাকরি বাতিল করলেও এখনই তাদের স্কুলছাড়া হতে হচ্ছে না। আগামী চারমাস তারা স্কুলে যেতে পারবেন। কিন্তু পূর্ণ সময়ের শিক্ষক হিসাবে নয়, তারা পার্শ্বশিক্ষকের মতো বেতন পাবেন। রায় দিতে গিয়ে আদালতের পর্যবেক্ষণ, নিয়োগ বাবদ খরচ সাবেক পর্ষদ সভাপতি মানিক ভট্টাচার্যের কাছ থেকে তোলা হতে পারে!
মামলাকারীদের সওয়াল
নিয়োগ থেকে বঞ্চিত প্রশিক্ষণহীন চাকরিপ্রার্থীরা মামলা করেন হাইকোর্টে। তাদের বক্তব্য, তাদের থেকে কম নম্বর পেয়ে অনেক পরীক্ষার্থী নিয়োগ পেয়েছেন। এই পরীক্ষার্থীদেরও প্রশিক্ষণ নেই। তা হলে বেশি নম্বর পেয়েও তারা কেন বঞ্চিত হলেন?
মামলাকারীরা আদালতে নাম, নম্বর, র্যাঙ্ক ও অন্যান্য তথ্য-সহ অপ্রশিক্ষিত প্রার্থীদের তালিকা জমা দেন। পরে পর্ষদের তালিকায় দেখা যায়, মামলাকারীদের অভিযোগ যথার্থ। নিয়োগ করার সময় ওই প্রার্থীদের প্রশিক্ষণ ছিল না।
পর্ষদের চ্যালেঞ্জ
আদালতের রায়কে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছে প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদ। সভাপতি গৌতম পালের বক্তব্য, ‘হাইকোর্টের নির্দেশকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে আবেদন করা হবে। ইতিমধ্যে আইনি পরামর্শ নেয়া শুরু হয়েছে। চাকরিরত ৩৬ হাজার শিক্ষকরা আর অপ্রশিক্ষিত নেই। এনসিটিই-র নির্দেশিকা অনুযায়ী দূরশিক্ষার মাধ্যমে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে।‘
প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে অ্যাপটিটিউড টেস্ট নেয়া হয়নি বলে অভিযোগ উঠেছে। গৌতমের দাবি, ‘বিশেষজ্ঞরা অ্যাপটিটিউড টেস্ট নিয়েছেন। তারাই নম্বর দিয়েছেন।‘ নিয়োগের দুই বছরের মধ্যে প্রশিক্ষণের প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে বলে দাবি সভাপতির। এদের ফের যোগ্যতা নির্ণায়ক পরীক্ষায় বসতে হবে বলে নির্দেশ দিয়েছেন বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়। আগামী চার মাসের মধ্যে নিয়োগ প্রক্রিয়া সেরে ফেলার কথা বলেছেন তিনি।
পর্যবেক্ষক বিশ্বনাথ চক্রবর্তীর বক্তব্য, ‘'কর্মপ্রার্থী ও নিয়োগপ্রাপ্তরা বলছেন অ্যাপটিটিউড টেস্ট নেয়া হয়নি।চক-ডাস্টার ছাড়া কীভাবে এই পরীক্ষা হয়ে গেল? তা হলে কী করে পর্ষদ বলছে যে টেস্ট হয়েছে?''
বিরোধীদের বাণ
বিরোধীরা আদালতের রায়ের সূত্রে তৃণমূল সরকারকে বিঁধেছে। বিজেপি নেতা, আইনজীবী তরুণজ্যোতি তিওয়ারির মন্তব্য, ‘পর্ষদের আইনজীবী আদালতে বলছেন, অ্যাপটিটিউড টেস্টের বিষয়টি তার জানা নেই। অথচ পর্ষদ সভাপতি বলছেন যে টেস্ট নেয়া হয়েছে। আসলেনতুন সভাপতি মানিক ভট্টাচার্যেরই উত্তরসূরি।'' সাবেক পর্ষদ সভাপতি ও তৃণমূল বিধায়ক মানিক ভট্টাচার্য নিয়োগ দুর্নীতিতে এখন জেলে। কারাগারে রয়েছেন তার স্ত্রী ও পুত্রও।
সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সুজন চক্রবর্তীর প্রতিক্রিয়া, ‘এতজন চাকরি হারালেন, এটা দেখে খারাপ লাগছে। এ বার যারা টাকার বিনিময়ে চাকরি দিয়েছেন, তাদের কাছ থেকে টাকা আদায় করুন।‘ প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীর কটাক্ষ, ‘দুর্নীতিতে পশ্চিমবঙ্গ গিনেস বুকে নাম তুলবে! ‘ আদালত ও পর্ষদ আইনি লড়াইয়ে যুযুধান। তারই মধ্যে বিপুল সংখ্যক নিয়োগপ্রাপ্তের চাকরি বাতিল। এই পরিস্থিতিতে তৃণমূল কংগ্রেস মুখপাত্র কুণাল ঘোষের প্রতিক্রিয়া, ‘এটা জেদাজেদির বিষয় নয়। এর জন্য কাউকে যেন বলি হতে না হয়।‘
শিক্ষার কী হবে?
বিপুল সংখ্যক শিক্ষকের নিয়োগ বাতিল হওয়ায় বিদ্যালয় পরিচালনা নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। পঠনপাঠনের পাশাপাশি মিড ডে মিল-কে কেন্দ্র করে বড়সড় কর্মযজ্ঞ চলে প্রাথমিক স্কুলে। আদালতের নির্দেশে যে শিক্ষকরা এখন পার্শ্বশিক্ষক, অনেক কম বেতন পাবেন, তাদের দ্বারা স্কুল কীভাবে চলবে, এ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
বঙ্গীয় প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আনন্দ হান্ডা ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘পড়ুয়াদের যাতে ক্ষতি না হয়, সেটা মাথায় রাখতে হবে। যে ৩৬ হাজারের চাকরি বাতিল হয়েছে, তাদের নিয়োগের সময় যোগ্যতা না থাকলেও পরে তারা তা অর্জন করেছেন। একজনেরও যাতে চাকরি বাতিল না হয়, সেটা রাজ্যকে দেখতে হবে। যারা পাশ করেও চাকরি পাননি, তাদেরও স্বচ্ছভাবে এখনই নিয়োগ করা হোক।‘
পুর দুর্নীতিতেও ধাক্কা
স্কুলের মতো পুরসভার নিয়োগেও অনিয়মের অভিযোগ সংক্রান্ত মামলায় শুক্রবার হাইকোর্টে ধাক্কা খেয়েছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার। পুর নিয়োগের মামলায় সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দিয়েছিলেন বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়। এর বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করে রাজ্য। সিবিআই তদন্তের নির্দেশে সাময়িক স্থগিতাদেশ দেয় শীর্ষ আদালত। রিভিউ পিটিশন দাখিল করতে বলে হাইকোর্টে। ইতিমধ্যে এই মামলার দায়িত্ব পান হাইকোর্টের বিচারপতি অমৃতা সিনহা। তিনি সিবিআই তদন্তের নির্দেশই বহাল রেখেছেন।