শিক্ষার্থীরা সুষ্ঠু রাজনীতি শিখুক৷ শিখুক সুষ্ঠু গণতন্ত্র চর্চা৷ স্কুল কেবিনেট তার জন্য একটা চমৎকার প্লাটফর্ম৷ এই রাজনৈতিক প্লাটফর্মটিকে মূল ধারার রাজনীতি থেকে দূরে রাখতে হবে৷
বিজ্ঞাপন
ছাত্র রাজনীতিকে বরাবরই আমি ইতিবাচকভাবে দেখি৷ অনেকেই ছাত্র রাজনীতির প্রয়োজন আছে কী নেই, তা নিয়ে চায়ের কাপে ঝড় তোলেন৷ বলেন, শিক্ষার্থীদের কাজ শুধু পড়াশোনো করা৷ কিন্তু আমি বলি, শিক্ষার্থী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষণীয় সব কিছুই করতে পারে৷ যা তার ভালো লাগে সবই সে করবে৷ তাতেই সে অনেক কিছু শিখে যাবে, যা তার জীবনে কাজে লাগবে৷ খেলাধুলা বা সংস্কৃতি বা রাজনীতি চর্চা সবকিছু থেকেই শেখার আছে৷
এবার মূল প্রসঙ্গে আসি৷ তা হলো, স্কুল-মাদ্রাসার কেবিনেট নির্বাচন৷ এই আইডিয়াটি আমার কাছে অনেক চমৎকার লেগেছে৷ ২০১৫ সাল থেকে এটি চলছে৷ মার্চ মাসে ১৬ হাজার ২শ' ৪৫টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ও ৬ হাজার ৭শ' ১৬টি দাখিল মাদ্রাসায় এ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়৷ মাধ্যমিক পর্যায়ে ১ লাখ ২৯ হাজার ৯শ' ৬০টি পদের জন্য ২ লাখ ৩১ হাজার ১শ' ২৬ জন ও মাদরাসা পর্যায়ে ৫৩ হাজার ৭শ' ২৮টি পদের জন্য ৯৩ হাজার ৭শ' ১০ জন শিক্ষার্থী নির্বাচনে অংশ নেয়৷
শিক্ষার্থীরা প্রত্যক্ষ ভোটে প্রত্যেক স্কুলে ৮ সদস্যের স্টুডেন্টস কেবিনেট নির্বাচন করে৷ ষষ্ঠ-দশম শ্রেণির যে-কোনো শিক্ষার্থী নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারে৷ বিষয়টি অনেক সুন্দর৷ উৎসবমুখর পরিবেশে তারা ভোট দিচ্ছে, নির্বাচনে প্রার্থী হচ্ছে এবং মন্ত্রিসভা নির্বাচিত হচ্ছে৷
ছোটবেলায় যখন বিতর্ক করতাম, তখন কয়েকটি ফরম্যাট খুব আকর্ষণীয় লাগত৷ সংসদীয় বিতর্ক, আদালত বিতর্ক ইত্যাদি৷ আমার সংসদীয় বিতর্ক খুব ভালো লাগত৷ সেখানে প্রধানমন্ত্রী থাকতেন, বিরোধী দলের নেতা থাকতেন, সংসদীয় নেতা থাকতেন৷ আমরা এক্সিবিশন শোগুলোতে বিষয়টিকে জনগণের কাছে আকর্ষণীয় করার জন্য সংসদে ওয়াক আউট করতাম৷ ঝগড়া করতাম৷ এক পক্ষ আরেক পক্ষকে টিজ করতাম৷ বিষয়টি দর্শকরা খুব মজা পেতেন৷ কিন্তু যে বিষয়টি তখন কখনো চিন্তাতেও আসেনি তা হলো, আমরা জনগণের কাছে আকর্ষণীয় করবার জন্যসারাবিশ্বের সংসদগুলোতে যেসব ঘটনা ঘটে তেমন ঘটনা ঘটাবার চেষ্টা করতাম৷ যেমন, ফাইল ছোড়া, ঝগড়া করা, টিজ করা ইত্যাদি৷ কিন্তু একটি আদর্শ সংসদ কেমন হওয়া উচিত, তা কখনো তুলে ধরার চেষ্টা করতাম না, পাবলিক মজা পাবে না বলে৷
বাংলাদেশসহ পৃথিবীর অনেক দেশের জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচনের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য আছে৷ সেগুলো হলো, সহিংসতা, ভোট কারচুপি, ভীতি ও পেশিশক্তি প্রদর্শনসহ আরো বেশ কিছু বিষয়৷ শিক্ষার্থীদের কেবিনেট নির্বাচনে এগুলোর মাত্রা তেমন না হলেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে হবার শঙ্কা রয়েছে এবং আগে ঘটেছে৷ কিন্তু সুখের বিষয় হলো, ২০১৯ সালের নির্বাচনে তেমন কিছু ঘটেনি৷ এজন্য স্কুল-মাদ্রাসাগুলোর প্রশাসন সাধুবাদ পেতে পারে৷ কিন্তু আমাদের খেয়াল রাখতে হবে যে, এই নির্বাচনগুলোতে যেন জাতীয় বা স্থানীয় রাজনীতির ছায়া না পড়ে৷ তাহলে আদর্শ নির্বাচন কী হওয়া উচিত, আদর্শ গণতন্ত্র কী হওয়া উচিত, তা হাতে কলমে শেখার যে বিরাট সুযোগ তৈরি হয়েছে, তা থেকে বঞ্চিত হবে শিক্ষার্থীরা৷ এই খেয়াল রাখার দায়িত্বটা সরকার বা শিক্ষা প্রশাসন, শিক্ষক, অভিভাবক ও স্থানীয় জনগণের৷ এরা ভবিষ্যতে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে রাজনীতিতে যে ভূমিকা রাখবে, তাতে আজকের এই শিক্ষার অনেক প্রভাব থাকবে, যেটা আজ হয়তো বুঝবে না এই শিক্ষার্থীরা, যেটা আমরাও ছোটবেলায় বুঝিনি৷
স্কুল শিক্ষার্থীদের নির্বাচন কোন দেশে কেমন?
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে স্কুল পর্যায় থেকেই শিশুদের নেতৃত্ব চর্চায় উৎসাহ দেয়া হয়৷ কোথাও কাউন্সিল, কোথাও গভর্নমেন্ট, কোথাওবা কেবিনেট গঠনের মাধ্যমে এই সুযোগ করে দেয়া হচ্ছে৷ কোনো কোনো দেশে এই চর্চা চলছে প্রায় শত বছর ধরে৷
ছবি: Bdnews24.com
কেন গুরুত্বপূর্ণ
নিজেদের জীবনে প্রভাব ফেলবে এমন সব বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় শিশুদেরও অন্তর্ভুক্ত করা উচিত৷ জাতিসংঘের ‘কনভেনশন অন দি রাইটস অব দি চাইল্ড’ বা ইউএনসিআরসি এর ১২ ধারায় এ বিষয়টি নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে৷ স্কুলে শিক্ষার্থী প্রতিনিধি নির্বাচন তেমনই একটি ধারণা যার মাধ্যমে শিশুরা মত প্রকাশ করতে ও নিজেদের সিদ্ধান্ত নিজেরাই নিতে শিখে৷
ছবি: Getty Images/AFP/I. Mukherjee
যুক্তরাষ্ট্রে ৯০ বছরের চর্চা
যক্তরাষ্ট্রে উচ্চমাধ্যমিক ও কলেজ পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধি নির্বাচন হয়৷ কোথাও স্টুডেন্ট কাউন্সিল, কোথাও স্টুডেন্ট গভর্নমেন্ট নামে তা পরিচিত৷ নির্বাচিতদের কেন্দ্রীয় সংগঠনও রয়েছে৷ তেমনই একটি ন্যাশনাল স্টুডেন্ট কাউন্সিল৷ ১৯৩১ সাল থেকে এটি স্টুডেন্ট কাউন্সিলগুলোকে সক্রিয় রাখতে ভূমিকা পালন করছে৷ কাউন্সিল বা গভর্নমেন্টের সদস্যদের দায়িত্ব, নির্বাচন পদ্ধতিতে অবশ্য প্রতিষ্ঠানভেদে পার্থক্য রয়েছে৷
ছবি: picture alliance/ZUMAPRESS.com/R. Majewski
যুক্তরাজ্যে সরকারি সহযোগিতা
স্কুলগুলোতে স্টুডেন্ট কাউন্সিল গঠনে উৎসাহ দিয়ে থাকে যুক্তরাজ্যের সরকার৷ এ নিয়ে দেশটির শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আলাদা একটি প্রকল্প আছে, যার নাম ‘ডেমোক্রা স্কুল’৷ বিদ্যালয়গুলোতে স্কুল কাউন্সিল গঠনে এর মাধ্যমে সহযোগিতা দেয়া হয়৷ অন্যদিকে ওয়েলসের প্রতিটি স্কুলে স্টুডেন্ট কাউন্সিল থাকা আইনত বাধ্যতামূলক৷ কীভাবে নির্বাচন হবে, কাউন্সিলের কার্যক্রম কী হবে তা নিয়ে ২০০৫ সালে বিধিমালাও জারি করেছে সেখানকার সরকার৷
ছবি: S.Ponsford
ইউরোপে শিক্ষার্থীদের গণতন্ত্র চর্চা
ইউরোপের ব্যক্তিমালিকানাধীন স্কুলগুলোর নেটওয়ার্ক ‘ইউরোপিয়ান স্কুলস’৷ তাদের গঠনতন্ত্রে ক্লাস প্রতিনিধি থেকে শুরু করে বিভিন্ন কমিটির জন্য ছাত্র প্রতিনিধি নির্বাচনের কথা বলা হয়েছে৷ পাশাপাশি প্রতি বছর ৯ মে’র মধ্যে স্কুলে আলাদা একটি ছাত্র কমিটিও গঠন করতে হয়৷ যেখানে সভাপতি, সহসভাপতি, কোষাধ্যক্ষসহ কমপক্ষে ছয়টি পদে নির্বাচনের কথা বলা হয়েছে৷
ছবি: Reuters/A. Gea
ভারতে সহযোগিতা দেয় ইসি
ভারতে অনেকদিন ধরেই স্কুল শিক্ষার্থীদের নেতৃত্ব নির্বাচনের প্রচলন রয়েছে৷ শিক্ষার্থীরা একজন প্রেসিডেন্টসহ বিভিন্ন পদের প্রার্থীদের নির্বাচন করে৷ প্রতিযোগিতামূলক ও জাতীয় নির্বাচনের আবহ তৈরি করতে অনেক সময় এমনকি রাজ্যের নির্বাচন কমিশন ভোটিং মেশিনসহ তাদের অন্যান্য সহযোগিতাও দিয়ে থাকে৷
ছবি: Imago/Hindustan Times
পাকিস্তানে জাতীয় নির্বাচনের আদলে
নির্বাচন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে ছাত্রদের প্রতিনিধি বেছে নেয়া হয় পাকিস্তানের বিভিন্ন স্কুলে৷ কোনো কোনো স্কুলে জাতীয় নির্বাচনের আদলেই হয় এই আয়োজন৷ মনোনয়ন, প্রচার, ভোটগ্রহণ সবই চলে গুরুত্বের সাথে৷
ছবি: DW/I. Jabeen
বাংলাদেশে স্কুল শিক্ষার্থীদের মন্ত্রিসভা
বাংলাদেশে গত চার বছর ধরে স্কুল ও মাদ্রাসাগুলোতে আয়োজিত হচ্ছে ছাত্রদের মন্ত্রিসভা বা স্টুডেন্টস কেবিনেট নির্বাচন৷ প্রতিটি স্কুল থেকে মোট আটজন প্রতিনিধি নির্বাচন করে শিক্ষার্থীরা৷ এর মধ্যে প্রতিটি শ্রেণি থেকে এক জন এবং সর্বোচ্চ ভোট প্রাপ্তদের মধ্য থেকে তিনজনকে বাছাই করা হয়৷ নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মধ্য থেকে কেবিনেটে একজন প্রধানমন্ত্রী এবং বাকিরা বিদ্যালয়ে মন্ত্রী হিসেবে পরিচিত পায়৷