সিনেমায় প্রায় গোয়েন্দা সহ অনেক চরিত্রকে স্ট্রেস কমাতে কফি ও সিগারেট খেতে দেখা যায়৷ সিগারেটের ক্ষতিকারক প্রভাব স্পষ্ট হয়ে গেলেও কফির প্রভাব নিয়ে বিতর্ক এখনো চলছে৷ ক্যাফেইনকে বশে আনতে কাজ করছেন জার্মান বিজ্ঞানীরা৷
বিজ্ঞাপন
স্ট্রেস দূর করতে কফি কতটা উপযুক্ত?
03:53
স্ট্রেস বা মানসিক চাপ মানুষকে অসুস্থ করে তোলে৷ সহকর্মীদের সঙ্গে রোজকার বাকবিতণ্ডা, অথবা কম সময়ের মধ্যে একের পর এক কাজ শেষ করার চাপ থাকলে তো কথাই নেই৷ এর পরিণাম মোটেই ভালো হয় না৷ বন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ক্রিস্টা ম্যুলার বলেন, ‘‘ধারাবাহিক স্ট্রেস মানসিক বিষাদ ও ভয়ের জন্ম দেয়, সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা চলে যায়, ভাবনাচিন্তা অস্পষ্ট হয়ে পড়ে৷ এগুলিই ক্রনিক স্ট্রেস-এর সরাসরি প্রভাব৷ মানুষ ও জীবজন্তু – দুইয়ের ক্ষেত্রে এমনটা দেখা যায়৷''
স্ট্রেস দেখা দিলে অনেকে প্রচুর কফি খান৷ কফি মন চাঙ্গা করে এবং স্মৃতিশক্তি জোরদার করে৷ সেইসঙ্গে ক্যাফেইন সম্ভবত স্ট্রেস-এর প্রভাব কমিয়ে দেয়৷
অধ্যাপক ক্রিস্টা ম্যুলার এক আন্তর্জাতিক গবেষক দলের সঙ্গে মিলে পরীক্ষা চালিয়েছেন৷ তাঁদের সূত্র অনুযায়ী, ক্যাফেইন মস্তিষ্কে এমন এক ক্রিয়া বন্ধ করে দেয়, যা শরীরে বিভিন্ন রকম স্ট্রেসের লক্ষণ ছড়িয়ে দেয়৷ সেই ক্রিয়া বন্ধ হলে স্ট্রেসের লক্ষণও দূর হয়৷ ইঁদুরের ক্ষেত্রে হাতেনাতে ফল পাওয়া গেছে৷ অধ্যাপক ম্যুলার বলেন, ‘‘ইঁদুরগুলি আবার স্বাভাবিক হয়ে পড়ে৷ তাদের মধ্যে স্ট্রেসের কোনো লক্ষণ দেখা যায়নি৷ তারা আরও ভালো করে চিন্তা করতে পেরেছে, নাটকীয় উন্নতি ঘটেছে৷ ভয় ও বিষাদও দূর হয়েছে৷ আমাদের ধারণা, মানুষের ক্ষেত্রেও এর প্রয়োগ সম্ভব৷ ক্যাফেইন যে বিষাদ দূর করে ও চিন্তায় স্বচ্ছতা আনে, এমন ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে৷''
স্ট্রেস সংক্রান্ত গবেষণার ক্ষেত্রে অনেক অগ্রগতি ঘটেছে৷ ইতিমধ্যে বিজ্ঞানীরা শরীরের সেই প্রক্রিয়া শনাক্ত করতে পেরেছেন, যা স্ট্রেসের লক্ষণ ছড়িয়ে দেয়৷ তখন মস্তিষ্কের মধ্যে অত্যন্ত জটিল বায়ো-কেমিক্যাল প্রক্রিয়া ঘটে৷
প্রতিদিন কফি পান করুন, সুস্থ-চনমনে থাকুন
বাংলাদেশ চায়ের দেশ৷ চা ছাড়া যেন বাঙালির আড্ডা জমেই না৷ আজকাল কফির প্রতিও আগ্রহ বাড়ছে৷ কফির অভ্যাস থাকা কিন্তু ভালো৷ বিজ্ঞানীরা বলছেন, প্রতিদিন কফি পান করলে বেশ সুস্থ এবং চনমনে থাকা যায়৷
ছবি: ullstein bild - AISA
গন্ধেই ক্লান্তি দূর!
সৌল জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা এমন কিছু ইঁদুর নিয়ে গবেষণা করেছেন ঘুম কম হওয়ায় যাদের মস্তিষ্ক ছিল ক্লান্ত৷ ক্লান্ত সেই ইঁদুরগুলোর নাকের সামনে সুগন্ধি কফি ধরে রাখা হলো৷ দেখা গেল কিছুক্ষণের মধ্যেই ইঁদুরগুলো বেশ চনমনে হয়ে উঠেছে৷ ঘুম কম হওয়ায় যে ঝিমুনির ভাবটা ছিল তা মুহূর্তেই উধাও৷
ছবি: Fotolia/Africa Studio
পার্কিনসনের ঝুঁকি কমায়
পার্কিনসন হলে হাত-পা খুব বেশি কাঁপে৷ স্বাভাবিকভাবে চলাফেরাও মুশকিল হয়ে যায়৷ সায়েন্স ডেইলি-র এক প্রতিবেদন বলছে, নিয়মিত কফি পান করলে পার্কিনসন রোগীদের চলাফেরার অসুবিধা অনেকটা দূর হয়ে যায়৷ বিজ্ঞানীরা এ সম্পর্কে নিশ্চিত৷ সায়েন্স ডেইলিকে বিজ্ঞানী রোনাল্ড পোস্টুমা বলেছেন, ‘‘ক্যাফেইনযুক্ত কফি পান করলে পার্কিনসনের ঝুঁকি কমে৷’’
যকৃত সুস্থ রাখে
কফি পান করলে লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিও কমে৷ ২০০৬ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতিদিন অন্তত এক কাপ কফি পান করেন এমন লোকের লিভার সিরোসিস হওয়ার ঝুঁকি অন্যদের চেয়ে শতকরা অন্তত ২০ ভাগ কম৷ লিভার, অর্থাৎ যকৃতে সিরোসিস হওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ অতিরিক্ত মদ্যপান৷ এ রোগের সুচিকিৎসা না হলে যকৃতে ক্যানসারও হতে পারে৷
ছবি: Fotolia/ag visuel
বিষন্নতা দূর করে
কফিতে যে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট রয়েছে তা মনে এক ধরণের সুখানুভূতির জন্ম দেয়৷ বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, প্রতিদিন যাঁরা তিন-চার কাপ কফি পান করেন তাঁরা, কফি পান করেন না এমন ব্যক্তিদের চেয়ে অনেক কম অবসাদগ্রস্থ হন৷ কফি যদি মনে সুখানুভূতির জন্ম দেয় তাহলে মানুষ বেশি বিষন্ন হবে কী করে!
ছবি: Fotolia/ra2 studio
ত্বকের ক্যানসার থেকেও বাঁচাতে পারে কফি
১,১২,৮৯৭ জন নারী-পুরুষকে নিয়ে গবেষণা করেছিল যুক্তরাষ্ট্রের ব্রাইহাম অ্যান্ড হার্ভার্ড মেডিক্যাল স্কুল৷ গবেষণায় দেখা গেছে, কফি পান করলে মেয়েদের ত্বক ক্যানসারের ঝুঁকি কমে৷ দিনে ৩-৪ কাপ কফি পান করেন এমন নারীদের ত্বক ক্যানসারের ঝুঁকি, কফি যারা পান করেন না তাঁদের চেয়ে অনেক কম৷
ছবি: Fotolia/WavebreakmediaMicro
ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমায়
অ্যামেরিকান কেমিক্যাল সোসাইটির এক গবেষণা শেষে জানা গেছে, দিনে চার কাপ বা তার চেয়ে বেশি কফি পান করলে টাইপ-টু ডায়াবেটিসের ঝুঁকি শতকরা ৫০ ভাগ কমে৷ যত বেশি কফি পান করবেন টাইপ টু ডায়াবেটিস নাকি তত দূরে থাকবে!
ছবি: AP/J. Sarbach
আলৎসহাইমার এর শত্রু
যুক্তরাষ্ট্রের সাউথ ফ্লোরিডা অ্যান্ড মিয়ামি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা দারুণ একটি বিষয় উদ্ভাবন করেছেন৷ তাঁরা দেখেছেন, রক্তে ক্যাফেইনের মাত্রা বেশি এমন ব্যক্তির আলৎসহাইমার অন্যদের তুলনায় দেরিতে হয়৷ বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, ৬৫ বা তার বেশি বয়সি কফিপ্রেমির তুলনায় কফি পান করেন না এমন সমবয়সিদের অন্তত দুই থেকে চার বছর আগেই আলৎসহাইমার হয়৷
ছবি: Fotolia/fabioberti.it
কখনো কখনো কর্মক্ষমতাও বাড়ায়
সিএনএন-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কফি মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতা এবং দক্ষতাও বাড়ায়৷ টাইম ম্যাগাজিনের প্রতিবেদক মাইকেল লেমোরিক তো কফির প্রশংসায় পঞ্চমুখ৷ তিনি বলেন, ‘‘রাতে ঘুম কম হলে একটু কফিতে চুমুক দিয়ে দেখতে পারেন, দেখবেন আগের চেয়ে অনেক ভালো বোধ করছেন৷’’
ছবি: ullstein bild - AISA
8 ছবি1 | 8
অ্যাডেনোসিন নামের এই পদার্থ মস্তিষ্কের কোষের একটি অংশে জুড়ে যায়৷ ক্যাফেইন সেই পদার্থ চেপে দিলে স্ট্রেসের লক্ষণ দূর হয়৷ রিসেপ্টরের কাছে পৌঁছানোর দৌড়ে ক্যাফেইনের জয় হয়৷ বন বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. ডমিনিক টিম বলেন, ‘‘রিসেপ্টর অ্যাডেনোসিনের বদলে ক্যাফেইনের সঙ্গে যুক্ত হতে পারে বৈকি৷ প্রায় একই জায়গায় সেটা ঘটে৷ একবার ক্যাফেইন যুক্ত হলে অ্যাডেনোসিন আর যুক্ত হতে পারে না৷ অর্থাৎ স্ট্রেস সংকেত তখন কার্যত দূর হয়ে যায়৷''
তবে বেশি মাত্রায় ক্যাফেইন অপ্রিয় পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া ঘটাতে পারে৷ ঘুম কম হয়, বার বার টয়লেটে যাবার প্রয়োজন পড়ে, রক্তচাপ বেড়ে যেতে পারে৷ বিজ্ঞানীরা তাই এমন এজেন্ট খুঁজছেন, যা ক্যাফেইনের মতো স্ট্রেস থেকে সুরক্ষা দেয় বটে, কিন্তু যার এমন পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া নেই৷ অধ্যাপক ম্যুলার বলেন, ‘‘একদিকে রয়েছে ক্যাফেইন৷ পদার্থ হিসেবে ক্যাফেইনের প্রভাব আসলে বেশ দুর্বল৷ তাছাড়া এর এমন কিছু পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া রয়েছে, যেগুলি আমরা চাই না৷ তাই আমরা আরও অনেক শক্তিশালী এক পদার্থ তৈরির কথা ভাবি৷ সেটা আমরা করতে পেরেছি৷ এমন এক রেসিডিউ এখানে ঢুকিয়ে দিয়েছি, যা ফ্যাট পছন্দ করে৷ তখন তার অণু কয়েক হাজার গুণ শক্তিশালী হয়ে উঠেছে৷ এই রেসিডউ-এর মাপ রিসেপ্টরের সঙ্গে হুবহু মিলে যায়৷ তাই খুব সহজেই এবং ভালোভাবে তা যুক্ত হতে পারে৷''
নতুন এই পদার্থ মানুষের স্ট্রেস ও তার পরিণতির চিকিৎসার উপযুক্ত কিনা, রোগীদের উপর প্রাথমিক পরীক্ষা চালিয়ে তা দেখতে হবে৷ ততদিন পর্যন্ত স্ট্রেস কমাতে ক্যাফেইনের উপরই নির্ভর করতে হবে৷